কী অদ্ভুত। এই একটানা বিশ্রী গোলাগুলির গুড়ুম গুড়ুম। চারদিকে বিকট চিৎকার। আর ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়া সৈন্যদের বুটের বুকভার করা মসমস শব্দ। এই সব ছাপিয়ে কী ভাবে যেন একটা বেহালার সুর মাথাচাড়া দিয়েছিল। অদ্ভুতই বটে।
বহুক্ষণ কোনো জ্ঞান ছিলনা য়মনতের। যখন জ্ঞান ফিরল তখন মুখে কড়া রোদ্দুর, গোটা পিঠ রক্তে ভেজা। দু’টো বুলেট; একটা পিঠে আর অন্যটা ডান পায়ে। যন্ত্রণার ভার কিছুটা লাঘব হচ্ছিল অপার ক্লান্তিতে; যন্ত্রণা অনুভবের শক্তিটুকুও হারিয়েছিলেন য়মনত। একটা স্বস্তির কথা; শত্রু সৈন্যের হাতে বন্দী হতে হয়নি, নয়ত যে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হত তার কাছে মৃত্যুও নস্যি।
মাথা তোলার একটা মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন য়মনত, লাভ হয়নি। তীব্র পিপাসার জ্বালা শরীরের অন্যান্য যন্ত্রণা আর ক্লান্তিকে ম্লান করে দিচ্ছিল। আর কী কাণ্ড; এই এতকিছুর মধ্যে বেহালার সুরটা কানে বুকে দিব্যি নেচে বেড়াচ্ছিল।
য়মনত ঠিক সঙ্গীতের সমঝদার নয়। তবে বেহালাটা বড় মিঠে ঠেকছিল কানে; সে মিঠে স্বাদের সুরে সামান্য মনখারাপ মেশানো। বাড়ির সুবাস মেশানো, মায়াময়, তুলতুলে। গোলাগুলির শব্দ আর হাহাকারের মধ্যিখানে বড্ড বেমানান।
সুরটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কী ভীষণ ভালোবাসা মেশানো সুর, যে সুরের আবডালে প্রেমিকার আঙুলের ডগা ছুঁয়ে বসে থাকা যায়। সে সুরে গোপন ডায়েরির পাতায় শুকনো পাতার পেজমার্ক এসে মেশে। তৃষ্ণা, যন্ত্রণা সে সুরের স্পর্শে মোমের মত গলে পড়ে যেন। প্রবল ভালোলাগার আবেশে যখন চোখ বুজলেন য়মনত; তখন রোদের তাপ কমে এসেছে, বাতাস থেকে বারুদের গন্ধ হাওয়া হয়ে অল্প শিউলি শিউলি মেজাজ। ব্যথা যন্ত্রণা হাপিশ।
য়মনতের দৃষ্টির অন্ধকার ভেদ করে এক বিন্দু আলো ফুটে উঠলো। সেই আলোর দানা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল একটা রোদ্দুর মাখানো ঝুলবারান্দায়। সে’খানে মাদুর পাতা। বৌয়ের বৌ-বৌ বকরবকর, মায়ের মা-মা গন্ধ, নয়নতারার মাথা দোলানো; খোকার খিলখিল হাসি; সমস্ত মিলে পরিপূর্ণ। সে বেহালার সুরের মত।
***
- ক্যাপ্টেন। সময় হয়ে গেছে।
- আমার বাজানোও শেষ। আই অ্যাম রেডি।
- বাজানো? মানে?
- সে কী! এতক্ষণ ধরে বাজালাম! শুনলেন না? বেহালার সুর? আপনার কানটা গেছে।
- আপনি শত্রুপক্ষের লোক হলেও সৈনিক। আপনাকে অপমানসূচক কথা বলতে আমি চাইনা ক্যাপ্টেন। কিন্তু তবু বলে বাধ্য হচ্ছি। আমার কান নয়। আপনার মাথাটা গেছে। গত আধঘণ্টা ধরে এই যে বেহালা বাজানোর ভানটা করলেন, সে’টা আর যাই হোক সুস্থতা নয়। অবশ্য ফায়ারিং স্কোয়াডের নাম শুনলে মাথার পোকাগুলো নড়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। যা হোক। স্কোয়াড রেডি। আপনার কাউকে কিছু জানানোর আছে? শেষ বার্তা?
- ও মা! জানিয়ে গেলাম যে।
- এক্সকিউজ মি?
- ওই যে! বেহালার সুরে। আরে সঙ্গীতের জন্য সবসময় যন্ত্রের প্রয়োজন হয়না স্যার। মিউজিক ইস নট ফায়ারিং স্কোয়াড।
- আপনি বেহালা বাজালেন? এতক্ষণ?
- রীতিমত। আমার মধ্যে যতটুকু ভালোবাসা জমেছিল, বিলিয়ে দিলাম। আহা, আপনি যদি শুনতে পারতেন মশাই, ভেসে যেতেন, বর্তে যেতেন।
- যত্ত পাগলামি। বেহালাই নেই, অথচ হাত পা নেড়ে দুলে দুলে নেচে বলে বেহালা বাজিয়েছি।
- বাজিয়েছি স্যার। আমার এই সেল থেকে অপার্থিব সুর ছড়িয়ে দিয়েছি এ শহর জুড়ে। যার শোনার হৃদয় আছে সে শুনেছে, সব সুরে কানের ফাঁদে ধরা দেয় না স্যার। জানেন, আমার বিশ্বাস অন্তত একজন শুনেছে সে সুর। সমস্ত গোলাগুলির শব্দ আর হাহাকার সরিয়ে রেখে একজন অন্তত সে সুর শুনেছে। আমি নিশ্চিত। বাজাতে বাজাতে একসময় আমি স্পষ্ট দেখলাম এক ভদ্রলোক ছেলে বৌ মা নিয়ে ব্যালকনিতে গা এলিয়ে বসে; পাশে নয়নতারার টাব। ভদ্রলোকের নামটাম জানি না; কিন্তু আহা। তাঁর মুখের তৃপ্ত হাসিটা লাখটাকার। সে শুনেছে, আমার বেহালার সুর। কোথায়, কী ভাবে তা জানি না। বিশ্বাস করুন!
- স্কোয়াড রেডি। শ্যাল উই গো?
- জো হুকুম!
No comments:
Post a Comment