Sunday, November 18, 2018

সঠিক দিকে

- এই যে, অ্যাস্ট্রনট দত্ত! কন্ট্রোলরুম থেকে বলছি৷ কদ্দূর পৌঁছলেন?

- আর ভায়া কন্ট্রোলরুম, মহাকাশে সেঁধিয়ে তারপর টের পেলাম তালমিছরির ডিবেটা নিয়ে আসতে ভুলে গেছি। কী কাণ্ড বলুন দেখি...।

- আরে ধ্যার, যত অকাজের কথা। বলি যন্ত্রপাতি সব স্টেবল?

- দিব্যি। কোনো অসুবিধে নেই৷ এই বেলা একটু গা এলিয়ে নেব ভাবছি।

- সে কী! কাজ শুরু হয়নি?

- কাজ?

- উফফ! দত্তদা! ছবি তোলেননি? ফ্রম স্পেস? যে কাজের জন্য প্রাইমারি ভাবে আপনার যাওয়া!

- আলবাত! আর এ'বারে যা পাওয়ারফুল ক্যামেরা দিয়েছেন৷ তা দিয়ে এখান থেকেই সব যা ছবি তুলছি না; আইফোনও হার মেনে যাবে।

- আসল ছবিগুলো চটপট দিন। "মহাকাশ থেকে দেখা গেল ভারতের এই মেগা-আশ্চর্য"  গোছের হেডলাইন তৈয়ার। এ'বার আপনি ছবি দিলেই..।

- তা অনেক ছবিই তো তুললাম, কোনটা দেব...।

- আরে যে কোনো...দিন না মশাই...ক্যুইক।

- এইটে দিই? সরকারি হাসপাতালের উঠোনে রুগীরা দলে দলে বেওয়ারিশ শুয়ে আছে? অনেকের হাতে স্যালাইনের বোতল? এই প্রথম মহাকাশ থেকে তোলা ছবিতে তাদের দেখা যাচ্ছে! ইন্ট্রিগিং।

- সে কী! সে'সব কে চায়! এই আপনার মাথাটা গেছে...আসল ছবি কই?

- আসল ছবি! ওহ হো! ভাঙা ব্রিজট্রিজের ছবি দেব? তাও তুলেছি৷ স্পষ্ট৷ দারুণ রেজোলিউশনে। ফর দ্য ফার্স্ট টাইম ফ্রম স্পেস!

- আরে ধুর্ছাই কাঁচকলা! সব মাটি করলেন দেখছি। আরে এত খরচ করে আপনাকে স্পেসে পাঠালো হল কেন? স্পেস থেকে আমাদের দেশের এই মেগা-সাইজের মূর্তির ছবি তুলতে। আর আপনি রুগী আর ভাঙা ব্রীজের ছবি তুলে সমস্ত গুবলেট পাকাচ্ছেন?

- ওহ হো! তাই তো, তাই তো! এই তালমিছরির শর্টেজ হলেই না; আমার মাথাটা যায় গুলিয়ে। ক্যামেরা ঘুরিয়ে এখুনি সঠিক দিকে তাক করছি। এখুনি।

Tuesday, November 13, 2018

সুইসাইড পয়েন্ট


- সুইসাইডটা কি ঠিকঠাক হয়নি?

- আজ্ঞে?

- না মানে, স্পষ্ট ঝাঁপ দিলাম। ওভার ব্রীজ থেকে ডায়রেক্ট লাইনের ওপর। ট্রেন দেখেই ঝাঁপিয়েছি। টাইমিংয়েও ভুলচুক করিনি বলেই মনে হয়। অথচ...।

- কচুকাটা হয়ে পড়ে থাকার বদলে এই অদ্ভুত এলাকায় কী করে এসে পড়লেন...সে'টাই ভাবছেন তো?

- আজ্ঞে। ঠিক তাই। মানে, এতটা ভেবড়ে গেছি না..। আপনাকে দেখতে পেয়ে ভাবলাম জিজ্ঞেস করেই ফেলি।

- মরেও মরেননি। 

- সর্বনাশ! মরেছি? কিন্তু মরিনি?

- বাহ্। বেশ চট করে বুঝে গেলেন দেখছি।

- ও মা! না! এ কী! কিস্যু বুঝিনি। আর এই জায়গাটাই বা কোথায়..মাটি নীল, আকাশ নীল...এক্কেবারে বিতিকিচ্ছিরি।

- প্রাহ্যাজামস্ক্বহ।

- প্রাহ্যা...?

- জামস্ক্বহ।

- নরকটরক নাকি?

- ধুর। সে'সব থ্রিলিং কিস্যু নয়। পাতি একটা গ্রহ। তাও পৃথিবীর চেয়ে বহু দূরের একটা গ্যালাক্সিতে। ভীষণ মোনোটনাস ব্যাপার।

- এ'খানে কারা থাকে?

- যারা থাকে তারা নিজেদের ভারি গালভরা নামে ডাকে।  বশ্রুজ্বক্বজ।

- বশ্রু?

- জ্বক্বজ। তবে নাম শুনে ঘাবড়াবেন না। ব্যাটারা আদতে বেঢপ বিটকেল সব বেড়াল। এক্কেবারে গায়েপড়ার দল।

- বেড়াল! যাহশ্লা! বেড়াল?

- বেড়াল। ল্যাজ গোঁফ মিউ সব আছে। অথচ বিটকেল। ভোট দেয়, সফটওয়্যার প্রগ্র‍্যামিং করে, রান্নায় নুন বেশি দেয়, কেউ না দেখলে রাস্তায় থুতু ফেলে, কথায় কথায় বানান ভুল করে। অখাদ্য, প্রায় মানুষের মতই।

- কী কাণ্ড। কী কাণ্ড। আচ্ছা, মরেও মরিনি কেসটা কী?

- পৃথিবীর ওই সুইসাইড পয়েন্ট, যে'খান থেকে আপনি টুক করে ঝাঁপ দিলেন। ও'টা একটা এই-আছে-এই-নেই-ওয়ার্মহোল। ঠিকঠাক মোমেন্টামে ঝাঁপ দিলে রেললাইনের ওপরে না পড়ে সোজা এই...।

- প্রাহ্যাজামস্ক্বহে?

- প্রাহ্যাজামস্ক্বহে। কাজেই পৃথিবীর লোকে আপনাকে গায়েব ভাবলেও, এ'খানে আপনি বহাল তবিয়তেই থাকবেন। 

- থাকব? খাবো কী?বেঁচে থাকব কী করে? 

- সে চিন্তা এ'খানকার মাতব্বর বেড়ালদের। এই কেউ একটা এলো বলে। আপনাকে রাস্তায় ফেউফেউ করে ঘুরে বেড়াতে দেখলেই তুলে নিয়ে যাবে। তারপর আপনার থাকা খাওয়া মৌরুসিপাট্টা সমস্ত কিছুর দায় সে বেড়ালের।

- যত্নআত্তি করবে তা'হলে? 

- আদরযত্নের চোটে প্রাণ আইঢাই করবে মশাই। খতরনাক আদেখলামো। গায়ে গা ঘষবে, কাতুকুতু দেবে আর গাণ্ডেপিণ্ডে গেলাবে। সে'সব তাও ঠিক আছে; মাঝেমধ্যেই রকমারি ছবি তুলবে। দিনে বারো হাজার বাইশটা ছবি গড়ে। গা জ্বলে ছারখার হয়ে যায় মাইরি। আমি তো ব্যাটাগুলোকে তেড়ে খিস্তি করি।

- খিস্তি করেন? সর্বনাশ!

- আরে ওরা বোঝেটোঝে না। ভাবে খুব মিষ্টি কোনো শব্দ করেছি বোধ হয়। আদর আরো এক ডিগ্রি বেড়ে যায়। তবে কী জানেন মশায়, পৃথিবীর চেয়ে এই প্রাহ্যাজামস্ক্বহই ভালো। বেড়ালরা দিব্যি জামাই আদরে রেখেছে। ওরা ভাবে ওরা আমাদের চালাচ্ছে এ'দিকে জানেনা যে তলেতলে ওদের আমরা চালাচ্ছি। কবি তো বলেই গেছেন; শখের প্রাণ, গড়ের মাঠ।

- তা'হলে ভালোই থাকব, তাই তো?

- আলবাত্। আরে মশাই আপনার ইয়ে পেলেও বেড়ালেরা আপনাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে 'বসতে আজ্ঞা হোক, করতে আজ্ঞা হোক' বলে কাকুতিমিনতি করবে। 

- টেরিফিক।

- তা নতুন এসেছেন যখন, আমার সঙ্গেই যাবেন নাকি? আমি যে বশ্রুজ্বক্বজদের সঙ্গে আছি তারা আরো খান কয়েক মানুষ পেলে মিউমিউ করে আত্মহারা হয়ে যাবে।

- তাই চলন। তবে দাদা, একটা প্রশ্ন মাথায় এলো। এই গ্রহেও কি বেড়ালদের জন্য কোনো গোলমেলে সুইসাইড পয়েন্ট আছে? 


Monday, November 12, 2018

গব্বরের কাঁপুনি



- ওহে গব্বর, একবার এ'দিকে এসো ভাইটি।


- আ...আমি?


- নাদুসনুদুস ভুঁড়ি। নোংরা চুলদাড়ি। কালচে দাঁত।  বিটকেল হাসি। তোমায় তো আর প্রসেনজিত বলে ভুল করা চলে না ভাই। এ'দিকে একটু এসো দেখি।


- ইয়, স্যার। আমি কিছু..ভ...ভুল করে ফেলেছি নাকি? 


- সর্দার মানুষ, তুমি কি আর ভুলচুক করতে পারো। তা শুনলাম নাকি তুমি কালিয়া আর আরো দু'জনকে উড়িয়ে দিয়েছ?


- না মানে...কাজটা বোধ হয় ঠিক হয়নি। না? আসলে মাত্র দু'জন কচি ছোকরার হাতে ওরা এমন হেনস্থা হল...।


- তা'তে তোমার ইজ্জতে চোট লাগল। বুঝি বুঝি। সর্দার মানুষ, অমন রাগধাপ তোমায় দিব্যি মানায়।


- আপনি রেগে থাকবেন না স্যার। এই নাকে খত দিচ্ছি। আগামী সাতদিন আমি রামগড়ের রাস্তা থেকে পানের পিক আর ঘোড়ার ইয়ে সাফ করে প্রায়শ্চিত্ত করব। রেগে থাকবেন না প্লীজ।


- তুমি কালিয়াকে মারো, সাম্ভার কানে সুড়সুড়ি দাও, ঠাকুরকে গীতাঞ্জলি পাঠাও; যা খুশি করো! আমার বয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে আমার নামের ডায়লগ নিজের নামে চালাবে?


- আজ্ঞে? স্যার?


- ন্যাকা! সো জা নহি তো গব্বর আ জায়েগা! এ'সব বলে ইয়ার্কি হচ্ছে? 


- কান মলছি স্যার। ভুলে বলে ফেলেছি। আর হবে না। ও ডায়লগ দিয়ে আমার মা আমায় ঘুম পাড়াত। আমি মুহূর্তের ভুলে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছি।


- বটে?


- তখন খোকা বয়স। স্বভাবে অত্যন্ত দুরন্ত ও বদখত। কিন্তু যতই লাফঝাঁপ করি, যেই মা বলত "খোকা, এ'বার ঘুমো! নয়ত এখুনি সোমবার চলে আসবে"; অমনি আমি চোখ বুঝে ঢিপ করে খাটের উপর টানটান। সোমদা গো! এ'বারের মত ছোটভাইটিকে ক্ষমা করে দাও। পায়ে পড়ি! 


- একবার ভয় পেয়েছ কী মরেছ। জেনে রেখো গবুচন্দ্র; যার যত ভয়, সোমবারে তার কপালে তত বেশি ট্র‍্যাফিক জ্যাম, বসের মেজাজ ততোধিক তিরিক্ষি আর ফাইলের স্তুপ ততটাই উঁচু। আমার ডায়লগ নিজের নামে ঝাড়ার বেয়াদবী?  ইসকি সজা মিলেগি ভায়া গব্বর, বরাবর মিলেগি।

লাইসেন্স


- কী নাম?


- আজ্ঞে হরিসাধন দত্ত। 


- বয়স? 


- চুয়ান্ন।


- পেশা?


- বিজনেস। স্ক্র‍্যাপ কেনাবেচা, বুঝলেন..ওই শিপইয়ার্ড থেকে এজেন্সি নিয়ে...।


- আহ, রামকাহিনী  ফাঁদতে বলিনি। ব্যবসা বললেই হবে।


- বেশ। ব্যবসা।


- ঠিকানা?


- সত্তরের এ, কালীকৃষ্ণ লাহিড়ী স্ট্রীট। কলকাতা সাতাশ।


- এ'বার বলুন। কী চাই..।


- আজ্ঞে ওই, বাজিপোড়ানোর লাইসেন্স।


- বাজিপোড়ানোর লাইসেন্স করানোর অফিসে কি আপনি জলভরা কিনতে আসবেন? বলি কী কী বাজি পোড়ানোর লাইসেন্স চাই? চটপট বলুন।


- আজ্ঞে, এক বাক্স লারেলাপ্পা চকোলেট বোমা, হাফ ডজন জুবানকেশরি তুবড়ি, বাইশটা চুটকি চরকি আর সতেরোটা পিসেমশাই মার্কা মাল্টিকালার রংমশাল।


- এই যুগে দাঁড়িয়ে এক বাক্স চকোলেট, ছটা তুবড়ি, বাইশটা চরকি, সতেরোটা রংমশাল। স্ক্র‍্যাপের ব্যবসা তো ভালোই দাঁড়িয়েছে মশাই।


- হে হে। ওই, খেটে খাচ্ছি কোনোক্রমে। এ'বার ওই লাইসেন্সটা স্যার। 


- এক বাক্স চকোলেট, ছটা তুবড়ি, বাইশটা চড়কি সতেরোটা রংমশাল। তিন মানুষ বাতাস। মানুষ এনেছেন?


- তিন মানুষ? বলেন কী! 


- এতগুলো বাজি! কতটা বাতাস খেয়ে নেবে, বাপ রে বাপ! কম্পিউটারের হিসেবে তিন মানুষ ফিজ আর এমন কী। 


- আজ্ঞে আমি ভেবেছিলাম দু'মানুষ। তেমনই ব্যবস্থা করে এনেছিলাম। এখন তিন নম্বর মানুষ পাই কোথায়...।


- তুবড়িগুলো বাদ দিন, দু'মানুষে হয়ে যাবে।


- না না, খোকাকে আমি কথা দিয়েছিলাম যে। তুবড়ি বাদ দেওয়া যাবে না স্যার। আপনি বিল কেটে দিন, আমি তিন নম্বর মানুষ জোগাড় করব। আমার একটা অকাজের চাকর আছে; অকালকুষ্মাণ্ড। তিরিশ বছরের বন্ডে কেনা তাই ওগড়াতেও পারছিলাম না। ভাবছি বাকি দু'জনের সঙ্গে ওকে জুড়ে দেব। ও ব্যাটা বাজির বস্তা নিয়ে বাইরেই অপেক্ষা করছে। লাইসেন্স কেটেই দিন। 


- বাকি দু'জন কোথায়?


- তারাও বাইরেই আছে৷ আপনি বললেই নিয়ে আসব।


- রিলেশন?


- আমার বাবা মা। এমনিতেও বয়স হয়েছে। অক্সিজেন কন্সাম্পশনের দিক দিয়ে রীতিমত সোশ্যাল লায়াবিলিটি। ও'রা ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসলে এ বছর একটু বাড়তি ট্যাক্স রিবেটও পেতে পারি। হেহ্...। 


- বেশ। নিয়ে আসুন তিনজনকে। ইলেক্ট্রিক চেয়ারে পনেরো মিনিট লাগবে। তারপর লাইসেন্সের পেপারওয়ার্কে আরো দশ মিনিট। কেমন?


- এক বাক্স চকোলেট, ছটা তুবড়ি, বাইশটা চরকি সতেরোটা রংমশাল; সব কটাই থাকছে তো স্যার লাইসেন্সে? ছেলেটার বড্ড শখ!

হ্যাপা

- দারোগাবাবু, রসগোল্লা খাবেন?

- স্পঞ্জ?

- না না, অর্থোডক্স টেক্সচারের। মাঝারি মিষ্টি।

- উঁ, খান চারেক আনাও তা'হলে। টেস্ট করে দেখি। যা বুঝছি, হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে।

- তা আছে। গোডাউনের চাবি রাখা থাকে আমার বাড়ির দেরাজে। দিবাকর সাইকেল নিয়ে গেছে বটে, তবে তার হাঁটুতে যা ব্যথা। দু'মাইল যেতে অন্তত কুড়ি-পঁচিশ মিনিট। তারপর গিন্নীর থেকে চাবি নিতে পাঁচ দশ মিনিট। সব মিলে প্রায় ধরুন গিয়ে এক ঘণ্টা। বরং এক কাজ করি। সঙ্গে দু'টো নিমকি বলে দিই। বেশ খাস্তা করে। এই পাশেই দোকান।

- আনাবে?

- চট করে। আপনি আর আপনার দুই হাবিলদার,  সক্কলের চোখ মুখ বসে গেছে এক্কেবারে। বড্ড কাজের চাপ, তাই না দারোগাবাবু?

- কী আর বলব মিত্তির। সর্ষের তেলের ব্যবসা নিয়ে থাকো, পুলিশের ঝামেলা আর কী বুঝবে। গোটা সকাল কাটলো জোড়াচোর বিধু নিধুকে ধাওয়া করে। জান কয়লা করে দিলো ছোকরা দু'টো। তারপর থানায় ফিরে কাতলার ঝোল, পোস্তর বড়া আর জলপাইয়ের চাটনি দিয়ে দু'মুঠো ভাত খেয়েছি কি খাইনি; সদর থেকে ইন্সট্রাকশন এলো তোমার গোডাউন রেড করার। এ'খানে তুমি নাকি গোলমেলে কিছু শুরু করেছে।

- আমি? গোলমেলে? আমি? হরিহর মিত্র? প্রতি বছর কালীপুজোয় কত টাকা চাঁদা দিই জানেন? আর দুর্গামণ্ডপের চাতালটা গত বছর কত টাকা খরচ করে বাঁধিয়ে দিয়েছি সে খবর জানেন?

- আরে আমি তো বড়সাহেবকে তাই বললাম। মিত্তির অতি সজ্জন মানুষ। একটু জুয়ার নেশা ছিল এক কালে। তা অনেকটা এখন কমে গিয়েছে। আর গোপন তেজারতির কারবার নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। তাছাড়া আজ গা'টাও একটু ম্যাজম্যাজ করছিল। গোডাউন রেডে বড় ঝক্কি।  কিন্তু কী আর করি বলো। তুমি বরং এক কাজ করো। রসগোল্লা নিমকির সঙ্গে দু'টো পানতো জুড়ে দিও। গরম দিলে ভালো হয়। গা ম্যাজম্যাজে গরম পানতো খুব হেল্প করে।

- বেশ বেশ। তা'হলে চারটে করে রসগোল্লা, দু'টো পান্তুয়া, দু'টো নিমকি আর একটা জলভরা। পার প্লেট। আনতে বলি?

- মিষ্টির প্রপোরশন বড্ড বেশি হে মিত্তির।

- শিঙাড়া জুড়ে দিই তা'হলে। বাজারে ফুলকপিও এসে গেছে।

- তাই বলে দাও। বেশি বাড়াবাড়ির দরকার নেই। দিবাকর চাবি নিয়ে আসার আগে একটু জিরিয়ে নেওয়া আর কী।

- আর চা?

- সামান্য কফি হলে দিও বরং। বাতাসে অল্প শীত শীত ভাব।

- বেশ বেশ। হারাধন, শুনে নিয়েছিস। এ'বার চট করে সব নিয়ে আয় দেখি। আর শোন, এক কিলো রাবড়ি আলাদা করে নিয়ে এসে দারোগাবাবুর জীপে রাখিয়ে দিস্। যা যা, চট করে।

- আবার রাবড়ি কেন।

- ওই আমার এক রোগ দারোগাবাবু। মাঝেমধ্যে গুণী মানুষজনকে ভালো রাবড়ি না খাওয়ালে আমার ভালো লাগে না। অ্যাই হারু, দাঁড়িয়ে আছিস কেন। জলদি জলদি।

- তা হ্যাঁ হে মিত্তির, বলি গোডাউনে কিছু গোলমাল করেছ নাকি?

- গোডাউনে গোলমাল? আমার গোডাউনে? জানেন বছরে অন্তত তিনবার তীর্থে যাই আমি? তাও সপরিবারে। তারপর ধরুন হপ্তায় তিন দিন নিরামিষ। আর শনিবার হাফবেলা উপোস, একদম নির্জলা। আমার তেলের গোডাউনে গোলমাল?  এ'টা যে দত্তদের কারবার তা কি আমি জানি না? ওদের চোখ টাটায়। চোরাকারবার ওরা করে। এ'দিকে আমার গোডাউনে স্রেফ ঝাঁজালো খাঁটি সর্ষের তেল। আঙুলের ডগায় নিয়ে নাকের কাছে নিয়ে যান, অমনি চোখের জলে নাকের জলে একাকার হয়ে যাবে।

- খাঁটি তেলে বুঝলে মিত্তির, মাছ ভাজার স্বাদই আলাদা হয় যায়।

- বটেই তো। বটেই তো। আমি বরং প্রতি মাসে আপনাকে দু'টিন করে তেল পাঠিয়ে দেব।

- ও মা! না না, তা আমি নিই কী করে।

- এ'তো স্যাম্পেল টেস্টিংয়ের জন্য দারোগাবাবু। নিয়মিত আমার তেলে মাছ ভাজলেই বুঝবেন পিউরিটি কাকে বলে। স্যাম্পেল টেস্টিং মাত্র।

- তা বটে। পাঠিও মাসে তিন টিন করে তেল। তবে গোপনে পাঠিও হে। ঢাকঢোল পিটিয়ে স্যাম্পেল টেস্ট করা যায়না।

- আলবাত। তিন টিন মাসে। হিংসেয় কত লোকে কত কিছু রটায়। মাঝখান থেকে আপনাদের যত ছোটাছুটি আর হেনস্থা।

- আর বলো কেন। যাকগে, তোমার গোডাউনে তেমন কিছু গোলমেলে নেই বলছ?

- ওই দেওয়ালে যে মাকালীর ক্যালেন্ডার ঝুলছে, সে'টা ছুঁয়ে বলব? আমার গোডাউনে যদি এক ফোঁটাও ভেজাল তেল পাওয়া যায় তা'হলে আমার জিভে এমন ঘা হবে যা সতেরো বছরেও সারবে না।

- আহ্, আমি সন্দেহ করিনি। তবে ডিউটির ব্যাপার তো। বুঝতেই পারছ।

- কর্মই ধর্ম দারোগাবাবু। আপনাকে দেখলে কি সাধে ভক্তি ভাব জাগে।

- তা ইয়ে, তোমার নামে কে যেন বদনাম ছড়াচ্ছে বললে?

- আজ্ঞে ওই দত্তর ব্যাটা। মাছের পাইকারি ব্যবসা।

- ওই বিনোদ মল্লিক লেনে যাদের অফিস? সরোজ দত্ত?

- মহাধুরন্ধর। তার পেটে পেটে যে কত। আমি নিজের মুখে বলতে চাই না। তবে তার গুদামে যে স্রেফ বরফচাপা মাছই নেই, সে'টা সবাই জানে।

- কী সর্বনাশ!

- রীতিমত। তবে আমি আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চাইনা। আমি সাদামাটা মানুষ দারোগাবাবু। সামান্য তেল বেচে দু'পয়সা আয়। ওই, হারু মিষ্টি নিয়ে এসে গেছে।

- আর দিবাকর? সে এলো চাবি নিয়ে?

- তার আসতে যে দেরী আছে...।

- তবে আজ তোমার গোডাউন রেডটা থাক। সে'সব পরে হবে'খন। তুমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছ না। মিষ্টি খেয়ে আমি বরং বিনোদ মল্লিক লেন থেকে একটু ঘুরে আসব।

- আজ্ঞে? যাবেন?

দারোগাবাবু বিষন্ন ভাবে হেসে মাথা নাড়লেন। জীবনে হ্যাপা কি কম? মাসে মাসে তিন'টিন খাঁটি সর্ষের তেল আসবে বাড়িতে। কড়াই ভর্তি তেলে নিয়ম করে ছাড়ার মত মাছের ব্যবস্থাও তো করতে হবে। ব্যস্ত হয়ে মিষ্টি শিঙাড়ার প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিলেন দারোগাবাবু।

Saturday, November 3, 2018

অপচয়

- হোয়াই শুড উই হায়্যার ইউ?

- কারণ...কারণ আমি জানপ্রাণ লাগিয়ে কাজ করব স্যার৷ দেখবেন! যে কোনো কাজ! প্রয়োজনে দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে না খেয়ে...অনবরত কাজ করে যাব। ফ্যাক্টরি থেকে কোথাও বেরোব না....।

- মিস্টার সেন। ফ্যাক্টরি ফ্লোরে প্রাণপাত করার জন্য ক্যান্ডিডেট কম পড়েনি। আপনার মত অন্তত হাজারখানেক মানুষের আবেদনপত্র জমা পড়েছে। চাকরীটা তাদেরও জন্যেও ততটাই দরকারী মিস্টার সেন। যাকগে, অন্য প্রশ্নে আসি। আগের চাকরীটা গেল কী করে?

- বিশ্বাস করুন, দোষ আমার ছিল না৷ যন্ত্রটা আপনা থেকেই স্লো ডাউন করেছিল; আমার অপারেট করার ভুলে নয়। তা'তে প্রডাকশন গ্রোথ পয়েন্ট ফাইভ পার্সেন্ট কমে গেছিল চার মিনিটের জন্য। তবে জবাবদিহি করার কথা ছিল মেন্টেনেন্স টীমের, অপারেটর হিসেবে আমার কিছুই করার ছিল না।

- আপনার এই ঘ্যানঘ্যান করার স্বভাবটা কি পুরনো?

- স্যর, বিশ্বাস করুন...।

- আজকের ইন্টারভিউতে যদি কিছু একটা করে না উঠতে পারেন মিস্টার সেন...।

- আমার বেকারির তিরিশ দিন পূর্ণ হবে। আর তা'হলে কাল ভোরে ফায়্যারিং স্কোয়্যাড। সরকারী  মেমো এসে গেছে।

- ভাবতে অবাক লাগে, একশো দশ কি বারো বছর আগেও আপনারই মত বেকার মানুষগুলোকে দিনের পর দিন বাঁচিয়ে রাখা হত। এমন কী অবসরপ্রাপ্ত প্রতিটা মানুষকেও বাঁচতে দেওয়া হত। সেই দিনগুলো সম্বন্ধে আপনার কী মতামত মিস্টার সেন?

- অপচয়।  রিসোর্সের তীব্র অপচয়। যার ফলে মানুষকেই ভুগতে হয়েছে। আর সেই সময় শুধু বেকার বা বৃদ্ধরাই নন, অনেক মানুষ এমন সব খেলো জীবিকায় নিজেদের গা ভাসিয়ে রেখেছিলেন যে'খানে তাদের সমাজে নেট প্রডাকশন-ওয়াইজ কন্ট্রিবিউশন ছিল জিরো, অনেক ক্ষেত্রে নেগেটিভ। 

- তেমন কিছু প্রফেশনের উদাহরণ দিতে পারেন?

- কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, অভিনেতা...এ'রকম আরো দু'শো বত্রিশ রকমের জীবিকায় থাকা যত মানুষ; যাদের ইভল নিউক্লিয়াস বলা হত। দ্য গ্রেট পার্জিং অফ টু থাউজ্যান্ড অ্যান্ড সেভেন্টিটুতে এ'দের সবাইকে...। এ'দের সবাইকে ফায়্যারিং স্কোয়্যাডের সামনে রেখে...।

- আপনার গলা কাঁপছে মিস্টার সেন, আপনিও কি আন্ডারগ্রাউন্ড কবিতা অ্যাক্টিভিস্টদের মত এদের প্রতি সিম্প্যাথেটিক?

- না! না! বিশ্বাস করুন স্যার ও'দের আমি ঘেন্না করি। যারা এক দানা সম্পদও নষ্ট করে তাদের আমি সহ্য করতে পারিনা। আমি আমাদের কন্সটিটিউশনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, আর পাঁচটা সৎ নাগরিকের মতই। 

- আই মাস্ট সে মিস্টার সেন, আপনাকে আমার তেমন অপছন্দ হয়নি।

- রিয়েলি স্যর?

- রিয়েলি! এই ফ্যাক্টরিতে আপনি একদম বেমানান হবেন না। হিউম্যান রিসোর্সকে বলে দিচ্ছি আপনার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে। ওই ম্যান্ডেটরি বেসিক ব্যাপার। আপনার দুই জেনারেশনের মধ্যে যদি কোনো ইভল স্কোয়্যাডের মানুষ ছিল কিনা; ফর্ম্যালিটি মাত্র। আর তারপর আপনার একটা শপ ফ্লোর প্রডাক্টিভিটি টেস্ট হবে। আজকেই। কঙ্গ্র‍্যাচুলেশনস মিস্টার সেন। 

- থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। থ্যাঙ্কিউ। 

ভবদুলালের ভোর

নভেম্বরের ভোরগুলোয় অমন একটু শীতশীত ভাব থাকেই। আর ছুটির ভোরগুলোতে ট্রেনও খালিখালি থাকবেই। ভোরের শীতশীত আমেজ আর ট্রেনের ফাঁকাফাঁকা ভাব; ভবদুলালের মনে হচ্ছিল যেন তার বুকের মধ্যে কেউ দু'ঘটি আনন্দ-শরবত ঢেলে দিয়েছে।

আর মনের মধ্যে আনন্দ চাগাড় দিয়ে উঠলেই একটু গড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করে তাঁর। এমনিতেই চোখ ঢুলঢুল করছিল; সেই অন্ধকার থাকতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশনমুখো ছুটতে হয়েছে। কামরাটা দিব্যি ফাঁকা; কাজেই সীটের ওপরেই লম্বা হতে দ্বিধা করেনি ভবদুলাল। হাওয়ায় শিরশিরানি ভালোই আছে, তবু জানালার কাচ সামান্য তুলে রেখেছিল সে। ট্রেনের ঝুকুরঝুকুর শব্দ আর দুলুনিতে আমেজ জমাট বাঁধে বেশ। বিভিন্ন ঝকঝকে স্মৃতির টুকরো আপনা থেকেই বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। জানালা বেয়ে গড়িয়ে আসা হাওয়ার কনকনে যখন দু'চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো; তখন সেই সে'দিনের কথা মনে ভাসতে লাগল; অফিসের বড়সাহেব বলছেন "কঙ্গ্রাচুলেশন ভবদুলাল, ইউ হ্যাভ বিন প্রমোটেড"।

তড়াক করে ঘুমটা গেল কেটে। ঝুকুরঝুকুর শব্দ আর ট্রেনের দুলুনি সব গায়েব, সামনে একটা বিকট টেবিল। টেবিলের ও'পাশে বড়সাবেব; তার চোখজোড়া কটমটে;

"তোমায় আমি প্রমোশনের খবর দিচ্ছি ভবদুলাল, আর তুমি ঝিমোচ্ছ"? 

" সরি স্যর, সরি। না না, ঝিমিয়ে পড়িনি। খুব মন দিয়ে শুনছিলাম আপনার কথা, তাই চোখটা বুজে এসেছিল"। 

"ইউ হ্যাভ বিন প্রমোটেড। এক্সেকিউটিভ টু সিনিয়র এক্সেকিউটিভ। উইথ ইমিডিয়েট এফেক্ট। এবং তার সঙ্গে তোমায় দু'টো বাড়তি দায়িত্বও দেব"।

" দু'টো কেন বড়বাবু? চারটে দেবেন", জোর করে ঝিমুনিভাব ঝেড়ে ফেলতে চাইল ভবদুলাল। আমতাআমতা করে আরো কিছু বলতে যাবে, এমন সময় চনমনে খাস্তা কচুরির সুবাস নাকে বুকে টের পেল সে। আহা, বাতাসে সে গন্ধ যেন নেচে নেচে বেড়াচ্ছে; তার অপূর্ব আবেশে নিজের অজান্তেই ফিক করে হেসে ফেলল আর পরক্ষণেই নিল সামলে। কী না কী ভেবে বসবেন বড়বাবু। 

"থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ সো মাচ স্যার"। বড়সাহেবের দিকে কৃতজ্ঞতা ভরা আপ্লুত দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করল ভবদুলাল। ও মা! বড়সাহেবের কাঁধে ওই ঢাউস ঝুড়িটা এলো কেন? আর সেই ঝুড়ি বোঝাই বর্ধমান লাইন-খ্যাত খাস্তা কচুরি যে! ঝুড়ির এক কোণে শালপাতা আর জোলো কাসুন্দির ডিবে।

"ঘুমের মধ্যেই কচুরি বলে হাঁক দিলেন দেখছি দাদা! আসুন, জোড়া দশটাকা" দু'টো কচুরি মোড়া শালপাতাটা তখন ভবদুলালের নাকের কাছে প্রায়।

"দু'টো কেন বড়বাবু? চারটে দেবেন"।

Friday, November 2, 2018

নো পার্কিং

হাইওয়ে ঘেঁষা ছোট্ট বসতি। এত রুক্ষ যে আর পাঁচটা বাংলার গাঁয়ের সঙ্গে তুলনা চলে না, আবার শহর যে নয় তা এ অঞ্চলের নিরিবিলিতেই মালুম হয়। খানকয়েক বাড়ি বেয়াড়া ভাবে দাঁড়িয়ে; মানুষজন কে আছে না আছে তা বাইরে থেকে দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়না। দু'চারজন লোক যাও বা দেখা যায়, তা ওই জরাজীর্ণ 'জনতা ধাবা'তেই। পথচলতি কিছু ট্রাক বা অন্যান্য গাড়ি চা জলখাবারের জন্য দাঁড়ায়। 

মানুষজনের দেখা পাওয়াই দুস্কর, কাজেই ঝগড়াঝাটির শব্দ সচরাচর কানে ভেসে আসে না। কিন্তু আজ একটা ভালো রকমের তালগোল পাকিয়েছিল, যা শুনে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন অমর মিত্র। তাঁর বাড়ি থেকে দু'পা এগিয়েই একটা পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে নীল টিশার্ট পরা এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক রীতিমত হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়েছেন। আর ভদ্রলোক আঙুল নাচিয়ে যাকে ফালাফালা করতে ফেলতে চাইছেন, সে একজন বিকট জোব্বা পরিহিত ছোকরা; সে ভয়ে প্রায় কাঁদোকাঁদো, ঠকঠক করে কাঁপছে। তম্বি করা ভদ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছে সামনের ছেলেটিকে যে কোনো মুহূর্তে চড়থাপ্পড়ে কষিয়ে দিতে পারেন।

দ্রুত পায়ে নীল টিশার্টের ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলেন অমর মিত্র। 

- কিছু গোলমাল হয়েছে নাকি?

- গোলমাল? রাহাজানি! ডাকাতি! 

- ব্যাপারটা কী?

- আপনি এই এলাকায় থাকেন?

- হ্যাঁ। আমার নাম অমর। কিন্তু আপনি বোধ হয়...।

- আমি নিমাই দত্ত! নিজে ড্রাইভ করে ইলামবাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। ওই ধাবার চা খাবো বলে দাঁড়িয়েছি..। গাড়িটা এ'খানে পার্ক করে ও'দিকে গেছিলাম...।

- ও'মা! ধাবা তো কিছুটা দূরে৷ আপনি এ'খানে পার্ক করেছিলেন কেন?

- গাছের ছায়া দেখে অফকোর্স। যা রোদ্দুর। মিনিট দশেক পর ফিরে দেখি আমার গাড়ি হাওয়া! হাওয়া! মাত্র দু'বছরের গাড়ি। মারুতি ওয়্যাগনআর, সাদা রঙের। নাইন টু সেভেন ফাইভ। এই দশ মিনিট আগেও ছিল৷ এখন নেই! উবে গেছে জাস্ট। আর এই ব্যাটাচ্ছেলে আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল...।

- আর তাই আপনি ওর ওপর হামলে পড়লেন?

- না মানে, ওর হাবভাব সুবিধের ঠেকছে না! দেখুন না কেমন চুপসে আছে!

- চুপসে আছে আপনার গলাবাজির ভয়ে!

- এই শুনুন, আপনি চেনেন একে?

- না! এ অঞ্চলে একে আগে দেখিনি। তবে আমি নিশ্চিত এ নির্দোষ।  গাড়ি চোর তো আর গাড়ি চুরি করে নিজের পকেটে লুকিয়ে রাখতে পারবে না৷ আর চুরির পর গাড়ির মালিকের মুখঝামটা শোনার জন্য পড়েও থাকবে না।

- থামুন মশাই! দেখুন না কেমন মিউমিউ করছে। আর কী বিটকেল এর জামা! হারামজাদা! বল আমার গাড়ি গেল কোথায়! আমি নিশ্চিত এ ব্যাটা গোলমেলে!

- আপনিও তো কম গোলমেলে নন মশাই। দেওয়ালে স্পষ্ট নো পার্কিং লেখা আছে। তবু এ'খানে পার্ক করতে গেলেন কেন?

- কোথাকার আমার ট্রাফিক পুলিশ এলেন গো! চাদ্দিকে একটা সাইকেল পর্যন্ত নেই সেখানে আমায় দেওয়ালে নো পার্কিং লেখা দেখাচ্ছেন? বেশ করেছি এখানে পার্ক করেছি।

- তা'হলে বেশ হয়েছে আপনার গাড়ি গায়েব হয়ে গেছে।

- তবে রে! এত বড় সাহস? তুইও কি গাড়িচোরদের দলে আছিস নাকি?

- দেখুন, ভদ্রভাবে কথা বলুন। এ'খান থেকে দু'মাইলের মধ্যে একটা পুলিশচৌকি আছে। ওই ও'দিকে; সোজা গেলে রাস্তার বাঁ হাতে পড়বে। সে'খানে গিয়ে রিপোর্ট লিখিয়ে আসুন।

- তাই করব! কাউকে ছাড়ব না! নিমাই দত্তের গাড়ি গায়েব করা? দেখাচ্ছি মজা! 

দুদ্দাড় করে এগোলেন নিমাই দত্ত। ঘুরে তাকিয়েছিলেন কয়েকবার; বোধ হয় চাউনিয়ে ঝলসে দিতে চাইছিলেন অমরবাবু আর বিদঘুটে জোব্বা পরা ছেলেটাকে। ছেলেটা থরথর করে কাঁপছিল। অমরবাবু ওর দিকে এগিয়ে যেতেই ছেলেটা বলে উঠল;

- আমি কিছু করিনি...বিশ্বাস করুন।

- জানি। আমি চিনি তোমায়। 

- চেনেন? 

- তোমাকেই নিতে এসেছি ভায়া। বদমানুষের খপ্পর থেকে তোমার মত নিষ্পাপ বন্দীদের মুক্তি দিতেই তো এই নো পার্কিং দেওয়াল। চলো আমার সঙ্গে। অনেক বন্ধুবান্ধব অপেক্ষা করে আছে। তোমার নামটা কী যেন ভাই?

- আজ্ঞে, নদুসাপাঁ।

- নয় দুই সাত পাঁচ। অফ কোর্স। এসো আমার সঙ্গে। আমার গ্যারেজ এখান থেকে খুব দূরে নয়।

কুটুম্ব

- চা খাবেন?

- না।

- কফি?

- উঁ...না থাক।

- কোল্ডড্রিঙ্কস?

- শুনুন না মলয়দা। চা-ঠা থাক বরং।

- ও মা! সে কী বিধুদা! আপনি আমার শ্বশুরবাড়ির পাড়ার লোক। অদ্দূর থেকে আমার অফিসে এসেছেন৷ কিছু একটা না খেলে চলবে কী করে। আই ইনসিস্ট। আচ্ছা, লস্যি আনিয়ে দেব? আমাদের অফিসের নীচেই..।

- ওই চা হলেই হবে।

- গ্রীন টী দিতে বলি?

- গ্রীন? না ওই নর্মাল চা হলেই হবে।

- দুধ চা?

- হ্যাঁ।

- গুড। আমাদের নির্মল প্যান্ট্রি সামলায়। এ-ক্লাস চা বানায়। এ-ক্লাস। দাঁড়ান, হাঁক দিই। ওহে নির্মল, দু'টো চা দিয়ে যাও। একটা দুধচা। একটা লিকার। চিনি আলাদা করে। বিধুদা, সঙ্গে থিন অ্যারারুট না ক্রীমক্র‍্যাকার?

- বিস্কুটের দরকার নেই।

- না না, তা কী করে হয়। নির্মল! শুনতে পারছ তো? চায়ের সঙ্গে বরং একটু কাজু নিয়ে এসো। সল্টেড। 

- মলয়দা, ব্যস্ত হবেন না প্লীজ..।

- কী বলছেন। আপনি আমার শ্বশুরমশাইয়ের ছোটবেলার বন্ধুর ছেলের আপন শালা। এ'টুকু অফার করব না? ওহে নির্মল, কাজুর সঙ্গে একটু নিমকি দিও তো। 

- বলছিলাম যে, দাদা! বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।

- বিপদটিপদের কথা শুনব। তবে তার আগে আমাদের অফিসের এই স্পেশাল কুচো নিমকি খেয়ে দেখুন। মিনিমাম তেল, ম্যাক্সিমাম মুচমুচ। বম্বে থেকে আমাদের ডিরেক্টর সাহেব এলে আড়াই কিলো প্যাক করিয়ে নিয়ে যান। এভরিটাইম। শোনো নির্মল, নিমকিটা একটু বেশি করে এনো ভাই।

- আমার বড় বিপদ মলয়দা।

- বিপদ? 

- আপনাদের কোম্পানির এক ভদ্রলোক, ট্রেনে আলাপ। সে না, আমায় কেমন করে যেন হাত করে নিলে।

- হাত করে নিলে?

- মানে ওই, আমায় বললে সে হিউম্যান রিসোর্সে আছে। আর বললে; সে একটা চাকরীর ব্যবস্থা করতে পারে। কোম্পানির কাগজপত্রটত্রও দেখালে।

- বলেন কী? অ্যালেন স্টীল অ্যান্ড প্রজেক্টেসের এইচ-আর সামলানো লোকের সঙ্গে আপনার ট্রেনে আলাপ? 

- সদাশিব সান্যাল। কাটোয়া লাইনে বাড়ি। মানে, তাই তো বললে।

- এখানকার হিউম্যান রিসোর্স আমি সামলাই বিধুদা! ও নামের কেউ এখানে চাকরী করে না। আর আপনি আমার সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলেন না?

- আসলে, আমার ঠিক খেয়াল ছিল না। তাছাড়া, ব্যাপারটা একটু ইয়ে, আন্ডার দ্য টেবিল ছিল কিনা। সে বোঝালে যে দু'লাখ টাকা দিলেই..।

- ও মাই গড! আপনি ওকে টাকা দিয়েছিলেন?

- হার্ড ক্যাশে। আমার মাথাখারাপ হয়ে গেছিল। লোভে পাপ, পাপে সর্বনাশ। 

- শুনেই খুব খারাপ লাগছে বিধুদা। আপনি যদি একবার অন্তত আমার সঙ্গে কথা বলতেন। তা'হলে এমন বিশ্রি ভাবে ঠকতে হত না।

- আসলে, ঘুষটুষের ব্যাপার কি আর জামাইমানুষের সঙ্গে আলোচনা করা যায়?

- দু'লাখ টাকার ধাক্কা। আপনাকে কী ধাপ্পাটাই না দিয়েছে। যাকগে। এমন দুঃখের খবর নিয়ে এসেছেন; সামান্য চা নিমকি খাইয়ে আপনাকে ছাড়ি কী করে বিধুদা। আপনার পাড়ার জামাই বলে কথা। ওহে নির্মল! চা নিমকি ক্যানসেল। আমরা নীচের রেস্টুরেন্ট থেকে বরং কাটলেট খেয়ে আসব।

- আহা! আবার কাটলেট কেন।

- নীচের দোকানে যা মাটন কাটলেট সার্ভ করে না বিধুদা, কোটি টাকা হারানোর দুঃখ হাপিস হয়ে যায়। দু'লাখ তো নস্যি। নস্যির কথায় মনে পড়লো, কাটলেটের পর কিন্তু আপনাকে লস্যি খেতেই হবে। রিফিউজ করলে শুনব না।

- কিন্তু...।

- আরে চলুন চলুন। কিছুতেই না শুনছি না। 

- আহা, আসলে আমি...।

- ওহে নির্মল। আমরা বেরোলাম বাবা। রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিও। কেমন? চলুন। আর সময় নষ্ট নয়।

বিধুবাবুকে কাটলেট লস্যি খাইয়ে, বাসে তুলে দিয়ে যখন মলয়বাবু বাড়িমুখো হলেন তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কাল সকালে এসেই নির্মল ছোকরাকে জোর ধমক দিতে হবে। পইপই করে বলা সত্ত্বেও ব্যাটা তার শ্বশুরবাড়ির লাইনের লোককে পাকড়াও করে। চা নিমকি নিয়ে সদাশিব সান্যাল ঘরে এসে ঢুকলেই যে কী বিশ্রী কাণ্ড হত, তা ভাবতেই বার বার শিউরে উঠছিলেন মলয়বাবু।

রসম-এ-মহব্বত

যে যাই বলুক, ভালোমানুষ চারদিকে দিব্যি ছড়িয়ে আছে৷ কেউ আলপটকা উপকার করে বেড়াচ্ছে, তো কেউ ট্যাক্স ফাঁকির কথা শুনলেই আঁতকে উঠছে। কেউ কেউ আবার অন্যায় দেখলেই তেলেবেগুন মোডে চলে যাচ্ছে। কাজেই ভালোমানুষের খোঁজ পাওয়া তেমন বড় ব্যাপার নয়। তার চেয়ে বরং ভালো ডিম তড়কার সন্ধান পাওয়া ঢের কঠিন। ফোড়ন মশলা ঠিকঠাক পড়তে হবে, ঝালনুন খাপে খাপ হতে হবে, ডিমের পরিমাণ বেশি কম হবে না; হাজার রকম নক্সা মেনে চলার কথা।

নেদু আলাভোলা মেজাজে তড়কা বানানো চলেনা। হাইওয়ের ওপর ট্রাক আসা যাওয়ার শোঁ শাঁ আর ঢাউস উনুনের ওপর চাটুতে পেঁয়াজ টমেটো লঙ্কাকুচি ছাড়ার চ্যাড়চ্যাড় শব্দ মিলে প্রিলিমিনারি সিম্ফনি তৈরি হবে। ধাবার ক্যাশিয়ারের থ্রুতে উনুনের ও'পাশে ইনস্ট্রাকশন যাবে "এক্সট্রা ঝাল হবে, ডাবল ডিম"।  নাকে আসবে রুটি সেঁকার গন্ধ আর পাশের টেবিল বা খাটিয়া থেকে ভেসে আসা চিকেন কষার সুবাস। স্টিলের গেলাসে ডিম ফ্যাটানোর ফটরফটর শব্দ কানে আসলেই জিভ তৈরি হবে; ওই এলো বুঝি। 

স্টিলের থালার পাশে একবাটি তড়কা আর ধবধবে হাফফুলকো খানকয় রুটি। সঙ্গে ফালি করা কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা আর সামান্য আচার। অবশ্যই সে তড়কা প্যাকেট করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার মানে হয়না। বাড়ির ডাইনিং টেবিলে বসে জি-টিভিতে সারেগামাপা দেখতে দেখতে তড়কা খাওয়া আর লুঙ্গি, স্যান্ডোগেঞ্জি পরে ব্রিসেবেনে ব্যাট করতে নামা; একই ব্যাপার। 

মুখভর্তি তড়কা-রুটির আবেশকে ইন্টেন্সিফাই করবে ধাবার ধারে দাঁড় করানো ট্রাকের স্ট্রিরিও থেকে ভেসে আসা কুমারশানুর আশ্বাস; " দিল হ্যায় কি মানতা নহি, মুশকিল বড়ি হ্যায় রসম-এ-মোহব্বত, ইয়ে জানতা হি নহি"..।

বনমালী কন্ডাক্টরের বাস

১।

স্ট্রীট ল্যাম্পের ঘোলাটে হলুদ আলো ভেদ করে ডাবলডেকার বাসটা টুপ করে উদয় হল। প্রায় নিঃশব্দে। প্রথমে বিভূবাবু বিলকুল টের পাননি, তারপর হঠাৎ যেন বাসটা রাস্তা বেয়ে ভেসে উঠলো। তা'তে ঘাবড়ে যাননি বিভূবাবু; এ বাস এমনভাবেই আসে। 

যাক, এ'বার অন্তত রাতভর বাসস্টপের বেঞ্চিতে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে না। অবশ্য বাসের অপেক্ষায় রাতভর বাসস্টপে পায়চারী করার অভিজ্ঞতা নতুন নয়;  অন্তত হাজার দেড়েক রাত এইভাবে কেটেছে। 

সে হাজার দেড়েক রাতের মধ্যে বড় জোর বার চারেক এসেছে এই বাস। কাজেই রাতভর অপেক্ষা করার অভ্যেস তার নতুন নয়।

২।

ফিস শব্দে সে বাস এসে দাঁড়ালো বিভূবাবুর সামনে। যথারীতি ড্রাইভারের সীট খালি; স্টিয়ারিংটা ট্যাওটুই করে এ'দিক সে'দিক পাক খাচ্ছে। এ'বাসে এমনটাই হয় বটে। আগেরবারগুলোর অভিজ্ঞতায় এ'সব হালচাল দিব্যি বুঝে গেছেন তিনি। তাও ভালো, হাজারখানেক রাতের চেষ্টায় অন্তত বারচারেক এ বাসে চড়ে হাওয়া খেয়ে বেরিয়েছেন তিনি। 

বিভূবাবুর চেনাজানা প্রায় কেউই এ বাসের খোঁজ পাননি। এমন কী গিন্নীকেও এ বাসের খবর দিতে গিয়ে রীতিমত 'ছিটগ্রস্ত' বলে চোপা শুনতে হয়েছে।

এদ্দিনে তিনি দিব্যি বুঝেছেন যে এ খবর নিয়ে বেশি আলোচনা না করাই ভালো। বাসেই অবশ্য একবার অফিসের দিলু প্রামাণিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল; সেই থেকে মাঝেমধ্যে লাঞ্চের সময় চাপা গলায় বাসযাত্রা নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা তাঁদের মধ্যে।

বিভূবাবুর ধারণা, কলকাতা শহরে আরো অন্তত জনা কুড়ি লোক আছেন যারা এ বাসের খবর জানেন। রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় আশেপাশের মানুষজনকে মন দিয়ে জরীপ করেন তিনি, যদি সেই অদ্ভুত ডাবলডেকার বাসের কোনো সহযাত্রীর দেখা পাওয়া যায়। যদি।

৩।

কন্ডাক্টর বনমালীর একগাল হাসি দেখলেই বুকের ভার লাঘব হয়ে আসে। ঢলা পাজামা আর গোলাপি ফতুয়া পরা বনমালী খৈনি ডলতে ডলতে শুধোয়;

- আরে বিভূতি যে!

- এ বাসের খোঁজে হন্যে হয়ে রাত কাটে গো বনমালীদা, দেখা পাই কোথায় রোজ।

- খোলামকুচি যে নয় ভায়া। খোলামকুচি নয়। 

- তা তো বটেই। 

- তা এ জয়রাইডে তো তুমি নতুন নয় হে। দেরী না করে সোজা দোতলায় উঠে জানালার পাশে বসে পড়ো। আমি ড্রাইভারদাদাকে বলি বাস ছাড়তে...।

- ড্রাইভারদাদাকে দেখা যায় না যে বনমালীদা। এ বাস আপনি চলে না?

- তুমি দেখতে পাওনা বলে কি তোমার পিঠের আঁচিলটা  নেই ব্রাদার?

- ও। ঠিক। ঠিক।

সুড়সুড় করে বাসের ওপরের তলায় উঠে এলেন বিভূবাবু। এ বাসের এ'টাই মজা, সবার জন্য দোতলার জানালা। 

৪।

এ যাত্রায় বাসে আরো জনা দশেক লোক দেখতে পেলেন তিনি। সবার চোখে ঢুলুঢুলু আলসেমি, ঠোঁটে মাখাসন্দেশের মত নরম হাসি। কেউ মাথা নেড়ে নিজের মনে বেজে চলা সুরে তাল দিচ্ছেন, কেউ কেউ স্থির হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে; মিঠে বাতাসে সবার চুলে ফুরফুর। পছন্দমত জানালা বেছে বসে পড়লেন বিভূবাবু।

আহ্, বসামাত্রই হাওয়ার ঝাপটায় বড় গান পেল ভদ্রলোকের। তুলতুলে নরম সীটে গা এলিয়ে দিলেন তিনি; নাকে এলো বিকেলের জিলিপি শিঙাড়ার সুবাস।

জানালার বাইরে অন্ধকার, তা'তে টুপটাপ জোনাকির দানা ভেসে বেড়াচ্ছে। 

৫।

বিমলের কথা তরতরিয়ে বিভূবাবুর মনের মধ্যে এসে পড়লো। কী সুন্দর বেহালা বাজাতো ছেলেটা, বাজারের মাছ চেনার জুড়ি ছিল না ওর, আর ক্যারমটা বড় ভালো খেলত। সবচেয়ে বড় কথা বিভূবাবুর প্রাণের বন্ধু ছিল বিমল। সেই ক্লাস সেভেন থেকে। 

ছিল। ছিল। এখন নেই।

বিকম পাশ করে দু'জনে মিলে একটা ব্যবসা শুরু করেছিলেন; লোহার স্ক্র‍্যাপ কেনাবেচা৷ টু পাইস পকেটে আসতে শুরু করেছিল। দিব্যি চলছিল সবকিছু। তারপর কীভাবে যেন বিমল পালটে গেল; ঠকিয়ে হাতিয়ে নিলো ব্যবসাটা। অনটনের সংসারে ভার ছিল বটে ওর কাঁধে, কিন্তু তাই বলে নিজের বন্ধুকে এমন ভাবে ঠকাবে? গা গনগনে রাগ আর বিশ্রী ঘেন্না নিয়ে সরে এসেছিলেন বিভূবাবু। বছর তিনেক পর একবার বিমল ফিরেছিল; অপরাধীর মত। একমিনিটের জন্যেও তাকে বরদাস্ত করতে পারেননি বিভূবাবু।

কদ্দিন আগেকার কথা, অন্তত বছর কুড়ি কেটে গেছে তারপর। বিমলের সঙ্গে আর কখনও কোনো যোগাযোগ হয়নি।

৬।

বাস থেকে নেমে প্রতিবারের মত এ'বারেও তিনি সোজা এসে পড়েছেন বিছানায়। পাশে গিন্নী তখনও ঘুমে কাদা। জানলা দিয়ে ভোরের নরম আলো গায়ে এসে পড়ছে।

ভালোলাগায় বড্ড আলুথালু বোধ করছিলেন বিভূবাবু।ততক্ষণে তিনি মনেমনে ঠিক করেই ফেলেছেন যে আজ অফিসে না গিয়ে তিনি সোজা যাবেন বেলঘরিয়া; বিমলের বাড়ি। নিশ্চয়ই তাঁর খোঁজ পাওয়া যাবে সে'খানে। আর এ'বার দেখা হলে আর কোনো ছাড়াছাড়ি নয়, এমন কী বিমল নিজে ফসকে বেরিয়ে যেতে চাইলেও তাকে ছাড়া হবে না। জাপটে জড়িয়ে রাখবেন বিভূবাবু। ঠিক আছে, বিমল না হয় একবার একটা বড় ভুল করেই ফেলেছে, কিন্তু তা বলে ছোটবেলার অমন বন্ধুত্ব গোটা জীবনের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে? বিভূবাবুর বন্ধুত্ব কি অতই খেলো? রাগধাপ গজরগজর অনেক হয়েছে; বিমলকে কম কথা শোনাননি বিভূবাবু। এ'বার সব ফেলে ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। আজ বিমলের বেহালা বাজানো শুনেই ছাড়বেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, কথা জমানো আড্ডা সাতপুরনো রাগের পাল্লায় পড়ে নষ্ট হচ্ছে; এর একটা হিল্লে করা দরকার।

তবে অফিসের বদলে বেলঘরিয়া যাওয়ার প্ল্যান  গিন্নীকে এখনই বলা যাবেনা, বিমলের নাম শুনলেই সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে। জ্বলে উঠবেই। তার জন্য অবশ্য  গিন্নীকে দোষ দেওয়া যায়না। আর যাই হোক, সে বেচারি তো আর বনমালী কন্ডাক্টরের বাসের খোঁজ পায়নি।

মা ও সাকরেদ

মামাবাড়ির লক্ষ্মীপুজোয় ইলিশ রান্না হয়। আমাদের বাড়িতে নেতিপেতি ফর্ম্যাটে নিরামিষ। তবে সে নিরামিষে থাকে মায়ের রান্না ভুনোখিচুড়ি। নারকোল কুচি, ভাজা বাদাম আর ফুলকপি দেওয়া; তার কোয়ালিটিতে ইলিশের অভাব তেমনটা বোধ হয়না।

মা নিজে গোটাদিন উপোসী থাকে, তা'তে রান্নার ফোকাস বাড়ে কিনা কে জানে; কিন্তু লক্ষ্মীপুজোর দিন রাঁধা খিচুড়ির টেস্টের সঙ্গে অন্যদিনগুলোর তুলনা চলেনা। বাড়িতে শ'দেড়েক প্রতিবেশী ভোগ খেতে আসেন; খিচুড়ি, পাঁচমেশালি তরকারি, লম্বা করে কাটা বেগুনভাজা, গোল আলুভাজা, পায়েস, চাটনি আর মিষ্টি। সবার শেষে পুজোর ঘরে বাড়ির লোকেরা থালা নিয়ে বসে। আমি শুধু খিচুড়ি আর বেগুনভাজায় ফোকাস করি; থালাজুড়ে ইয়াব্বড় খিচুড়ির ঢিপি, তার পাশে লেতকে পড়তে থাকা ডাঁটাওলা বেগুনভাজা। পুজোর ঘরের ধুপধুনো ফলমূল প্রসাদের সুবাস অদৃশ্য দলা পাকিয়ে সে খিচুড়িতে এসে মেশে। দু'তিন গ্রাস মুখে দেওয়ার পরেই মনের মধ্যে ভক্তি ফ্লো করতে শুরু করে। দুধভাত না থাক; এমন খিচুড়ি যেন বছরে অন্তত একবার পাতে এসে পড়ে। পুজোর পরের দিন জলখাবারেও যে এই খিচুড়িই ঠাণ্ডা খাওয়া হবে, তা বলাই বাহুল্য। 

মা এ'বার একজন অনুগত সাকরেদ পেয়েছে; সে মায়ের লেজুড় হয়ে ঘুরেছে গোটাদিন। এ'দিকে আমি  কলকাতা এয়ারপোর্টে কেএফসির সামনে বসে, মনের মধ্যে মায়ের রান্না খিচুড়ির সুবাস ঘুরঘুর করছে। কেএফসির উইংস চিবুতে যে কী বিশ্রী লাগছে।

সান্যালের দাওয়াই

অন্ধকার গলিটায় ঝুপ করে উদয় হলেন সুমন সান্যাল। জমাট নিস্তব্ধতা  ভেদ করে একটা ফস্ শব্দ; সিগারেট ধরালেন ভদ্রলোক। ইলেক্ট্রিক বাতি আর আকাশে চাঁদ সত্ত্বেও এ অন্ধকার বেশ সমীহ করার মত।

হাতঘড়ির দিকে ঘনঘন তাকিয়েও লাভ হচ্ছে না, সময় চলছে কলকাতার ট্র‍্যাফিক জ্যামে পড়া মিনিবাসের গতিতে। রাত সোয়া দু'টো বাজতে এখনও মিনিট তিনেক দেরী।

উফ। তর সইছে না।

'মিস্টার সানিয়াল'! ঘড়ঘড়ে কণ্ঠস্বরটা পরিচিত; রোবুনকেম্প। সেও যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে হুট করে, 'প্লীজ মিস্টার সানিয়াল, স্মোকিং ব্যানঢো ক্রুন'। রোবুনকেম্পের বাংলা বোঝা চাট্টিখানি কথা নয়, তবে সান্যালবাবু অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সদ্য জ্বালানো সিগারেটটা ফেলে দিয়ে রোবুনকম্পের হাত টেনে সামান্য ঝাঁকুনি দিলেন তিনি "ওয়েলকাম টু আর্থ রোবুনকেম্প মশাই, ওয়েলকাম"।

- সানিয়াল, অনেক ডিন পরে দেকা হল।

- তা অনেকদিনই বটে। অন্তত সাড়ে বাইশ বছর তো বটেই।

- ঠুমি তো এখুনও জোয়ান ডেকচি।

- জোয়ান ডেকচি?

- ডুক্কিতো। তোমায় দেকে একুনও জোয়ান মনে হয়।।

- আপনাদের সেই উন্নত গ্রহের ওষুধ। জোয়ান না থেকে উপায় আছে? অবশ্য জোয়ান থাকার চেয়েও বড় সুবিধে হল হুটহাট যে কোনো জায়গায় উড়ে যেতে পারছি৷ ট্রেন বাস রিক্সার খরচ নেই বললেই চলে। আপনার ওষুধের জবাব নেই রোবুনকেম্পবাবু। অনেস্টলি বলছি। স্রেফ সে'টার জোরেই এই দু'শো বাহাত্তর বছর বয়সেও দিব্যি দিনে অন্তত বারো মাইল হাঁটছি।

- ডুরোন্টো। টবে আমরাও টুমার কাচে কৃটজ্ঞ। টুমি সাপ্লাই না ডিলে আমরা বিপডে পড়টম। আমাডের ঘ্রহ ডকে উটতো। টুমাকে এ অষুড ডিটে পেরে আমরা আনন্ডিট।

- আরে ও কিছুই নয়৷ যাক গে, এনেছেন? আপনাদের ওষুধের শিশি?

- হুঁ। এইকানে আচে। আর টুমার সাপ্লাই? সেটা?

- এনেছি। এ'বার একটু বেশি করে এনেছি। আগামী তিরিশ চল্লিশ বছর কেটে যাবে। কোনো  ধুমকেতু আপনাদের গ্রহকে ছুঁতে পারবে না। অব্যর্থ মাদুলি।

- ডোন্নোবাড সানিয়াল্।

- আরে ধুর। আমি এ'টুকু করব না? 

- এ'টা অনেক। লাইফ অ্যান্ড বার্থ-য়ের সাইকেল বন্দ হওয়ার পর আমাদের ঘ্রহ টেকে প্রটেকশন গেল উটে। রোবটের হাটে টেকনলজি আচে, অ্যান্টি ডুমকেটু প্রটেকশন নেই। 

- আহা রে। পৃথিবীর মানুষ যদি জানত, কী ম্যাজিকে পৃথিবী আর সৌরমণ্ডল উবে যাচ্ছে না৷ সবাই শুধু জানে ফিজিক্স।

- পিজিক্স। ও টো আউটডেটেড জ্ঞানের গুডাম। আমাডের ঘ্রহের সবাই সেটা জানে।

- আমরাও জানব রোবুনকেম্পদাদা। আর শ'খানেক বছর যাক। তবে বেশি জেনে ফেলে আবার যেন আপনাদের হাল না হয়।

- টাই যেন হয় সানিয়াল।

- এই যে এই ডিবেতে রয়েছে আপনার সাপ্লাই। আপনার গ্রহের মাদুলি। ফিরে গিয়ে ছড়িয়ে দেবেন গ্রহের চারদিকে। তিরিশ চল্লিশ বছরের জন্য ধুমকেতু বাবাজীরা জব্দ। এফেক্ট কমে এলে আমায় সিগন্যাল পাঠাবেন, তখন ফের এ গলিতে দেখা হবে। কেমন? 

এক কৌটা ভরা "আমি মায়ের কাছে যাব"র আকুতি রেকর্ডিং রোবুনকেম্পের হাতে গুঁজে দিলেন সান্যালবাবু। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ভাষায় যা সংগ্রহ করা। বেচারাদের গ্রহে মা নেই কিনা, সুমন সান্যালের দেওয়া মাদুলি ছাড়া রোবুনকেম্পেরা টিকে থাকবে কী করে?

পুজোর রোল

যাদের কপালে বাড়ি ফেরার ছুটি জোটেনি, যাদের পুজো কাটবে এমএস-এক্সেলে মুখ গুঁজে গজরগজর করে। যাদের খোকাখুকুরা বাইরে বলে মনখারাপ, ঘনঘন পুরনো পুজোসংখ্যাগুলো হাতড়ে খোকার প্রিয় লেখাগুলো উল্টেপাল্টে পড়ে চলেছেন।

পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত যে মানুষটার 'উৎসব' শুনলে মুখে তেতো স্বদ খেলে যায়, পুজোর ছুটি যার কাছে যন্ত্রণার মত।

পুজোর বাতাস বুকে এলে যার পুরনো চিঠির কথা মনে পড়ে, 'কেমন আছিস' মার্কা ফোন করার সাহস আর অধিকার হারিয়েছে যে সাইকেল-সম্রাট।

যার খুব মায়ের কথা মনে পড়ছে। বাবার আঙুল শক্ত করে ধরে রাখার নিশ্চিন্দি হাতড়ে চলেছে যে বেআক্কেলে। 

পুজোয় তাদের সবার জন্য, কোথাও না কোথাও,নিশ্চয়ই একটা এগরোল ভাজা হচ্ছে। ভালোবাসার চাটুতে নেড়েচেড়ে, স্নেহের তেলে উল্টেপাল্টে। তাদের সবার কামড় সে রোলে এসে পড়ুক না পড়ুক, পুজোয় তারাও থাকুক।

শিউলি ও হামানদিস্তা

প্রেমে প্যানপ্যান ঘ্যানঘ্যান করলেই হবে?

যে রোগে যেমন ওষুধ। 

ছোটমামা দুম করে চলে আসায় চিলেকোঠার গোপন সাক্ষাৎ ভেস্তেছে? বুকের মধ্যে চড়া সুরের হাউহাউ? অ্যান্টিডোট একটাই; দু'প্যাকেট বাদামভাজা প্লাস লঙ্কা মেশানো বিটনুন।

ঘণ্টাদুয়েক মণ্ডপে থেকেও নীলশাড়ি একবারটির জন্যেও ভলেন্টিয়ারগিরির প্রাণপাত করা দৌড়োদৌড়িটা খেয়াল করে বাহবা-হাসি ছুঁড়ে দেয়নি? সে মনভার উড়িয়ে দেওয়ার জন্য চট করে জোগাড় করে নিতে হবে মশলাদার মটরভাজার প্যাকেট।

আবহাওয়া দপ্তরের অভয়বাণীর কানমলে নেমে আসা বৃষ্টিঝড়ে অষ্টমীর হাঁটতে যাওয়ায় প্ল্যান ডকে উঠেছে? কপালে রয়েছে বন্ধুদের বাঁকা আওয়াজ আর টুয়েন্টি নাইন? বুক বেয়ে ভসভসিয়ে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাসকে রুখতে দরকার কাঠিভাজার মিউজিকাল মুচমুচ।

সাতপাতা লম্বা 'তোমায় ছাড়া বাঁঁচব না' মার্কা চিঠির জবাবে চাঁচাছোলা চিরকুট এসেছে? হেডস্যারকে বলে দেওয়ার ধমক? আদা লজেন্সকে সর্বিট্রেটের মত জিভের তলে ফেলে চুষতে হবে, যতক্ষণ না বুকের ধড়ফড় কমছে।

ডায়েরীর সমস্ত কবিতা জলে গেছে? সে জানলো না পর্যন্ত? রাস্কেলচন্দ্র ফার্স্টবয়ের সঙ্গে সে প্যান্ডেল আলো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে? ঘুরে দাঁড়ানোর একটাই টোটকা; আড়াই প্যাকেট মৌরি লজেন্স।

বাদাম-লজেন্সওয়ালারা ডিস্পেন্সারি কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। আর তা না চিনলে; প্রেমের শিউলিকে খুনে-দুনিয়ার হামানদিস্তার নীচে ফেলতেই হবে।

পাহাড়ি ও অতুলবাবু

পাহাড়ি সান্যাল মিস্টার সেনকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন৷ বেশ কিছুটা চিনেছিলেন। ভালোবেসেছিলেন অতুলদাকে। সেই স্মৃতিচারণ নিয়েই এই লেখা। 


অতুলবাবু অবিকল তার গানের মত; অন্তত পাহাড়িবাবুর লেখায় তেমনটাই ফুটে ওঠে। সঙ্গীতের মত সুন্দর তার দুঃখের টুকরোগুলোকে গোপনে সাজিয়ে রাখার ক্ষমতা। একদিকে তিনি কর্মব্যস্ত, অন্যদিকে চট করে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরতে পারেন। পরোপকারি, বন্ধুবৎসল। উচ্ছ্বাসের বাড়াবাড়ি নেই, অথচ স্নেহে পরিপূর্ণ। সেই অতুলপ্রসাদের কথা বোধ হয় শুধু পাহাড়িবাবুই লিখতে পারতেন।


পাহাড়িবাবুর ভাষায় সারল্য থাকলেও তা বাহুল্যবর্জিত নয়। কিন্তু কী ভীষণ অনেস্ট। ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে গতে বাঁধা 'পুরুষালি' এক্সপ্রেশনের ধার ধারেননি ভদ্রলোক। বিচ্ছেদে ক্ষতবিক্ষত অতুলপ্রসাদের পাশে থেকেই প্রেম চিনতে শিখেছিলেন তিনি। সে'টুকুর জন্যেই পড়ে ফেলা যায় এই লেখা। তা'ছাড়া লখনৌতে বড় হয়ে পাহাড়িবাবু যে 'তেহজিব' আয়ত্ত করেছিলেন, লেখায় তার ছাপও স্পষ্ট।


এই দু'জনকে নিয়ে সঞ্জীব যদি গোটা একটা নভেল লিখতেন; কী ভালোই না হত।