১।
স্ট্রীট ল্যাম্পের ঘোলাটে হলুদ আলো ভেদ করে ডাবলডেকার বাসটা টুপ করে উদয় হল। প্রায় নিঃশব্দে। প্রথমে বিভূবাবু বিলকুল টের পাননি, তারপর হঠাৎ যেন বাসটা রাস্তা বেয়ে ভেসে উঠলো। তা'তে ঘাবড়ে যাননি বিভূবাবু; এ বাস এমনভাবেই আসে।
যাক, এ'বার অন্তত রাতভর বাসস্টপের বেঞ্চিতে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে না। অবশ্য বাসের অপেক্ষায় রাতভর বাসস্টপে পায়চারী করার অভিজ্ঞতা নতুন নয়; অন্তত হাজার দেড়েক রাত এইভাবে কেটেছে।
সে হাজার দেড়েক রাতের মধ্যে বড় জোর বার চারেক এসেছে এই বাস। কাজেই রাতভর অপেক্ষা করার অভ্যেস তার নতুন নয়।
২।
ফিস শব্দে সে বাস এসে দাঁড়ালো বিভূবাবুর সামনে। যথারীতি ড্রাইভারের সীট খালি; স্টিয়ারিংটা ট্যাওটুই করে এ'দিক সে'দিক পাক খাচ্ছে। এ'বাসে এমনটাই হয় বটে। আগেরবারগুলোর অভিজ্ঞতায় এ'সব হালচাল দিব্যি বুঝে গেছেন তিনি। তাও ভালো, হাজারখানেক রাতের চেষ্টায় অন্তত বারচারেক এ বাসে চড়ে হাওয়া খেয়ে বেরিয়েছেন তিনি।
বিভূবাবুর চেনাজানা প্রায় কেউই এ বাসের খোঁজ পাননি। এমন কী গিন্নীকেও এ বাসের খবর দিতে গিয়ে রীতিমত 'ছিটগ্রস্ত' বলে চোপা শুনতে হয়েছে।
এদ্দিনে তিনি দিব্যি বুঝেছেন যে এ খবর নিয়ে বেশি আলোচনা না করাই ভালো। বাসেই অবশ্য একবার অফিসের দিলু প্রামাণিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল; সেই থেকে মাঝেমধ্যে লাঞ্চের সময় চাপা গলায় বাসযাত্রা নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা তাঁদের মধ্যে।
বিভূবাবুর ধারণা, কলকাতা শহরে আরো অন্তত জনা কুড়ি লোক আছেন যারা এ বাসের খবর জানেন। রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় আশেপাশের মানুষজনকে মন দিয়ে জরীপ করেন তিনি, যদি সেই অদ্ভুত ডাবলডেকার বাসের কোনো সহযাত্রীর দেখা পাওয়া যায়। যদি।
৩।
কন্ডাক্টর বনমালীর একগাল হাসি দেখলেই বুকের ভার লাঘব হয়ে আসে। ঢলা পাজামা আর গোলাপি ফতুয়া পরা বনমালী খৈনি ডলতে ডলতে শুধোয়;
- আরে বিভূতি যে!
- এ বাসের খোঁজে হন্যে হয়ে রাত কাটে গো বনমালীদা, দেখা পাই কোথায় রোজ।
- খোলামকুচি যে নয় ভায়া। খোলামকুচি নয়।
- তা তো বটেই।
- তা এ জয়রাইডে তো তুমি নতুন নয় হে। দেরী না করে সোজা দোতলায় উঠে জানালার পাশে বসে পড়ো। আমি ড্রাইভারদাদাকে বলি বাস ছাড়তে...।
- ড্রাইভারদাদাকে দেখা যায় না যে বনমালীদা। এ বাস আপনি চলে না?
- তুমি দেখতে পাওনা বলে কি তোমার পিঠের আঁচিলটা নেই ব্রাদার?
- ও। ঠিক। ঠিক।
সুড়সুড় করে বাসের ওপরের তলায় উঠে এলেন বিভূবাবু। এ বাসের এ'টাই মজা, সবার জন্য দোতলার জানালা।
৪।
এ যাত্রায় বাসে আরো জনা দশেক লোক দেখতে পেলেন তিনি। সবার চোখে ঢুলুঢুলু আলসেমি, ঠোঁটে মাখাসন্দেশের মত নরম হাসি। কেউ মাথা নেড়ে নিজের মনে বেজে চলা সুরে তাল দিচ্ছেন, কেউ কেউ স্থির হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে; মিঠে বাতাসে সবার চুলে ফুরফুর। পছন্দমত জানালা বেছে বসে পড়লেন বিভূবাবু।
আহ্, বসামাত্রই হাওয়ার ঝাপটায় বড় গান পেল ভদ্রলোকের। তুলতুলে নরম সীটে গা এলিয়ে দিলেন তিনি; নাকে এলো বিকেলের জিলিপি শিঙাড়ার সুবাস।
জানালার বাইরে অন্ধকার, তা'তে টুপটাপ জোনাকির দানা ভেসে বেড়াচ্ছে।
৫।
বিমলের কথা তরতরিয়ে বিভূবাবুর মনের মধ্যে এসে পড়লো। কী সুন্দর বেহালা বাজাতো ছেলেটা, বাজারের মাছ চেনার জুড়ি ছিল না ওর, আর ক্যারমটা বড় ভালো খেলত। সবচেয়ে বড় কথা বিভূবাবুর প্রাণের বন্ধু ছিল বিমল। সেই ক্লাস সেভেন থেকে।
ছিল। ছিল। এখন নেই।
বিকম পাশ করে দু'জনে মিলে একটা ব্যবসা শুরু করেছিলেন; লোহার স্ক্র্যাপ কেনাবেচা৷ টু পাইস পকেটে আসতে শুরু করেছিল। দিব্যি চলছিল সবকিছু। তারপর কীভাবে যেন বিমল পালটে গেল; ঠকিয়ে হাতিয়ে নিলো ব্যবসাটা। অনটনের সংসারে ভার ছিল বটে ওর কাঁধে, কিন্তু তাই বলে নিজের বন্ধুকে এমন ভাবে ঠকাবে? গা গনগনে রাগ আর বিশ্রী ঘেন্না নিয়ে সরে এসেছিলেন বিভূবাবু। বছর তিনেক পর একবার বিমল ফিরেছিল; অপরাধীর মত। একমিনিটের জন্যেও তাকে বরদাস্ত করতে পারেননি বিভূবাবু।
কদ্দিন আগেকার কথা, অন্তত বছর কুড়ি কেটে গেছে তারপর। বিমলের সঙ্গে আর কখনও কোনো যোগাযোগ হয়নি।
৬।
বাস থেকে নেমে প্রতিবারের মত এ'বারেও তিনি সোজা এসে পড়েছেন বিছানায়। পাশে গিন্নী তখনও ঘুমে কাদা। জানলা দিয়ে ভোরের নরম আলো গায়ে এসে পড়ছে।
ভালোলাগায় বড্ড আলুথালু বোধ করছিলেন বিভূবাবু।ততক্ষণে তিনি মনেমনে ঠিক করেই ফেলেছেন যে আজ অফিসে না গিয়ে তিনি সোজা যাবেন বেলঘরিয়া; বিমলের বাড়ি। নিশ্চয়ই তাঁর খোঁজ পাওয়া যাবে সে'খানে। আর এ'বার দেখা হলে আর কোনো ছাড়াছাড়ি নয়, এমন কী বিমল নিজে ফসকে বেরিয়ে যেতে চাইলেও তাকে ছাড়া হবে না। জাপটে জড়িয়ে রাখবেন বিভূবাবু। ঠিক আছে, বিমল না হয় একবার একটা বড় ভুল করেই ফেলেছে, কিন্তু তা বলে ছোটবেলার অমন বন্ধুত্ব গোটা জীবনের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে? বিভূবাবুর বন্ধুত্ব কি অতই খেলো? রাগধাপ গজরগজর অনেক হয়েছে; বিমলকে কম কথা শোনাননি বিভূবাবু। এ'বার সব ফেলে ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। আজ বিমলের বেহালা বাজানো শুনেই ছাড়বেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, কথা জমানো আড্ডা সাতপুরনো রাগের পাল্লায় পড়ে নষ্ট হচ্ছে; এর একটা হিল্লে করা দরকার।
তবে অফিসের বদলে বেলঘরিয়া যাওয়ার প্ল্যান গিন্নীকে এখনই বলা যাবেনা, বিমলের নাম শুনলেই সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে। জ্বলে উঠবেই। তার জন্য অবশ্য গিন্নীকে দোষ দেওয়া যায়না। আর যাই হোক, সে বেচারি তো আর বনমালী কন্ডাক্টরের বাসের খোঁজ পায়নি।
No comments:
Post a Comment