হাইওয়ে ঘেঁষা ছোট্ট বসতি। এত রুক্ষ যে আর পাঁচটা বাংলার গাঁয়ের সঙ্গে তুলনা চলে না, আবার শহর যে নয় তা এ অঞ্চলের নিরিবিলিতেই মালুম হয়। খানকয়েক বাড়ি বেয়াড়া ভাবে দাঁড়িয়ে; মানুষজন কে আছে না আছে তা বাইরে থেকে দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়না। দু'চারজন লোক যাও বা দেখা যায়, তা ওই জরাজীর্ণ 'জনতা ধাবা'তেই। পথচলতি কিছু ট্রাক বা অন্যান্য গাড়ি চা জলখাবারের জন্য দাঁড়ায়।
মানুষজনের দেখা পাওয়াই দুস্কর, কাজেই ঝগড়াঝাটির শব্দ সচরাচর কানে ভেসে আসে না। কিন্তু আজ একটা ভালো রকমের তালগোল পাকিয়েছিল, যা শুনে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন অমর মিত্র। তাঁর বাড়ি থেকে দু'পা এগিয়েই একটা পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে নীল টিশার্ট পরা এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক রীতিমত হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়েছেন। আর ভদ্রলোক আঙুল নাচিয়ে যাকে ফালাফালা করতে ফেলতে চাইছেন, সে একজন বিকট জোব্বা পরিহিত ছোকরা; সে ভয়ে প্রায় কাঁদোকাঁদো, ঠকঠক করে কাঁপছে। তম্বি করা ভদ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছে সামনের ছেলেটিকে যে কোনো মুহূর্তে চড়থাপ্পড়ে কষিয়ে দিতে পারেন।
দ্রুত পায়ে নীল টিশার্টের ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলেন অমর মিত্র।
- কিছু গোলমাল হয়েছে নাকি?
- গোলমাল? রাহাজানি! ডাকাতি!
- ব্যাপারটা কী?
- আপনি এই এলাকায় থাকেন?
- হ্যাঁ। আমার নাম অমর। কিন্তু আপনি বোধ হয়...।
- আমি নিমাই দত্ত! নিজে ড্রাইভ করে ইলামবাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। ওই ধাবার চা খাবো বলে দাঁড়িয়েছি..। গাড়িটা এ'খানে পার্ক করে ও'দিকে গেছিলাম...।
- ও'মা! ধাবা তো কিছুটা দূরে৷ আপনি এ'খানে পার্ক করেছিলেন কেন?
- গাছের ছায়া দেখে অফকোর্স। যা রোদ্দুর। মিনিট দশেক পর ফিরে দেখি আমার গাড়ি হাওয়া! হাওয়া! মাত্র দু'বছরের গাড়ি। মারুতি ওয়্যাগনআর, সাদা রঙের। নাইন টু সেভেন ফাইভ। এই দশ মিনিট আগেও ছিল৷ এখন নেই! উবে গেছে জাস্ট। আর এই ব্যাটাচ্ছেলে আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল...।
- আর তাই আপনি ওর ওপর হামলে পড়লেন?
- না মানে, ওর হাবভাব সুবিধের ঠেকছে না! দেখুন না কেমন চুপসে আছে!
- চুপসে আছে আপনার গলাবাজির ভয়ে!
- এই শুনুন, আপনি চেনেন একে?
- না! এ অঞ্চলে একে আগে দেখিনি। তবে আমি নিশ্চিত এ নির্দোষ। গাড়ি চোর তো আর গাড়ি চুরি করে নিজের পকেটে লুকিয়ে রাখতে পারবে না৷ আর চুরির পর গাড়ির মালিকের মুখঝামটা শোনার জন্য পড়েও থাকবে না।
- থামুন মশাই! দেখুন না কেমন মিউমিউ করছে। আর কী বিটকেল এর জামা! হারামজাদা! বল আমার গাড়ি গেল কোথায়! আমি নিশ্চিত এ ব্যাটা গোলমেলে!
- আপনিও তো কম গোলমেলে নন মশাই। দেওয়ালে স্পষ্ট নো পার্কিং লেখা আছে। তবু এ'খানে পার্ক করতে গেলেন কেন?
- কোথাকার আমার ট্রাফিক পুলিশ এলেন গো! চাদ্দিকে একটা সাইকেল পর্যন্ত নেই সেখানে আমায় দেওয়ালে নো পার্কিং লেখা দেখাচ্ছেন? বেশ করেছি এখানে পার্ক করেছি।
- তা'হলে বেশ হয়েছে আপনার গাড়ি গায়েব হয়ে গেছে।
- তবে রে! এত বড় সাহস? তুইও কি গাড়িচোরদের দলে আছিস নাকি?
- দেখুন, ভদ্রভাবে কথা বলুন। এ'খান থেকে দু'মাইলের মধ্যে একটা পুলিশচৌকি আছে। ওই ও'দিকে; সোজা গেলে রাস্তার বাঁ হাতে পড়বে। সে'খানে গিয়ে রিপোর্ট লিখিয়ে আসুন।
- তাই করব! কাউকে ছাড়ব না! নিমাই দত্তের গাড়ি গায়েব করা? দেখাচ্ছি মজা!
দুদ্দাড় করে এগোলেন নিমাই দত্ত। ঘুরে তাকিয়েছিলেন কয়েকবার; বোধ হয় চাউনিয়ে ঝলসে দিতে চাইছিলেন অমরবাবু আর বিদঘুটে জোব্বা পরা ছেলেটাকে। ছেলেটা থরথর করে কাঁপছিল। অমরবাবু ওর দিকে এগিয়ে যেতেই ছেলেটা বলে উঠল;
- আমি কিছু করিনি...বিশ্বাস করুন।
- জানি। আমি চিনি তোমায়।
- চেনেন?
- তোমাকেই নিতে এসেছি ভায়া। বদমানুষের খপ্পর থেকে তোমার মত নিষ্পাপ বন্দীদের মুক্তি দিতেই তো এই নো পার্কিং দেওয়াল। চলো আমার সঙ্গে। অনেক বন্ধুবান্ধব অপেক্ষা করে আছে। তোমার নামটা কী যেন ভাই?
- আজ্ঞে, নদুসাপাঁ।
- নয় দুই সাত পাঁচ। অফ কোর্স। এসো আমার সঙ্গে। আমার গ্যারেজ এখান থেকে খুব দূরে নয়।
No comments:
Post a Comment