তখন ক্লাস ইলেভেন বা টুয়েলভ।
আমাদের বসবার ঘরে একটা নীল সোফা আর দু'টো পেল্লায় চেয়ার। এবং একটা কাঠের শোকেসের ওপর একটা সোনি মিউজিক সিস্টেম। যে কোনো ছুটির সকাল বা দুপুর মানেই সোফায় গা এলিয়ে বসে আমি আর পাপাই; পাশের চেয়ারে চিম্পু। নিয়ম করে। আমাদের তেমন কাজ থাকত না তখন, সেই কাজ না থাকার ফুরফুরে স্টেটাসকে আমরা বলতাম 'ফেলু-অবস্থা'। ফেলু কথাটা তখন অ-গোয়েন্দা অর্থে আমাদের মধ্যে বেশ প্রচলিত। কোথাও যাওয়ার নেই, কিছু করার নেই; শুধু হাতে অঢেল সময়। চা-কফির নেশাও আমাদের তেমন ছিল না, মাঝেমধ্যে মিষ্টি-শিঙাড়া-চপ-কাটলেট পেলেই চলে যেত। না পেলেও অবশ্য গল্পগুজব আটকাত না। কত গুলতানি, সবই 'ফেলু' লেভেলে। মাঝেমধ্যেই উঠত বেমক্কা হাসির হিড়িক আর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া। পরীক্ষার আতঙ্ক বা "আমাদের আর হল না" গোছের দীর্ঘশ্বাসও থাকত পাশাপাশি, তবে সে গুমোট চটপট কেটেও যেত কোনো বেফালতু ফেলু ঠাট্টায়।
এ'সবের মধ্যে আর একটা জরুরী অ-ফেলু ব্যাপার থাকত; গান। তখন ক্যাসেটের যুগ, এক একটা নতুন ক্যাসেট এনে তার প্রত্যেকটা গান মন দিয়ে শোনার একটা প্রসেস ছিল; ছিল প্রিয় গান বেছে নিয়ে বারবার শোনা। গানের ব্যাপারে পাপাই বরাবরই বেশ সাহেব-মানুষ; এমএলটিআর আর আরো কত কী ম্লেচ্ছ গান শোনাত আমাদের। আর চিম্পু আমাদের প্রথম শুনিয়েছিল বাংলা ব্যান্ডের গান। পরশপাথর দিয়ে শুরু করেছিল; তারপর একে একে ভূমি, মাইলস আর আরো কত কী। পাপাই আর চিম্পু দু'জনেই বড় ভালো গাইত (এখনও গায়)। 'হলুদ পাখী' বা 'সুজন' দু'জনে যা এত ভালো গাইত; আহা। আমি চেষ্টা করতাম শব্দ না করে সোফার গায়ে তাল ঠুকতে।
যা হোক, সে বয়সে আমাদের 'ভালোবাসা মানে ধোঁয়া ছাড়ার প্রতিশ্রুতি' ঘ্যাম লেগেছিল। গানটা শুনেই মনে হত; যাই, টুক করে গোলাপ ছাপানো গ্রিটিংস কার্ড কিনে আনি। অথবা টাইটানিক উইন্সলেটের চোখের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকি। স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের সেই বসবার ঘরে সে গান লূপে (অর্থাৎ বার বার ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করে) শোনা হত। 'ধোঁয়া ছাড়ার প্রতিশ্রুতি' এ'টা শুনে চিম্পু প্রায়ই থম মেরে যেত। সে জানিয়েছিল যে প্রেমিকা না থাকার ব্যথাটা প্রাইমারি নয়, আসল দুঃখ অন্য জায়গায়। একদিন গান শেষ হল চেয়ার ছেড়ে উঠে একটা পেল্লার দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিম্পুকুমার বলেছিল; "আমরা এতটাই ফেলু রে, যে সামান্য সিগারেটের নেশাটাও ধরতে পারলাম না! যদি কোনোদিন প্রেমিকা জোটে, তা'হলে তাকে কী ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দেব বলতে পারিস"?
No comments:
Post a Comment