Saturday, November 30, 2019

অনমিত্রবাবুর প্রত্যাবর্তন

কফি হাউসের দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমের ওপার থেকে রবীন্দ্রনাথ গাইছিলেন। 
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায়”। 
টোস্টটা বিস্বাদ। দুপুরটার মতই। অনমিত্র নিজের অস্বস্তি চেপেচুপে কোনোক্রমে বসেছিলেন। কিন্তু সুরটা ক্রমশ তাঁর গায়ে আঁচড় কাটছিল যেন। ওয়েটারকে বিল দিতে বলে নোটবুকটা বন্ধ করে সাইডব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন তিনি। 
এ’বারে কফি হাউস আসাটা বন্ধ করতে হবে। এতদিন কেটে গেল অথচ একদিনের জন্যেও মিতার দেখা পাওয়া গেল না। কিন্তু একসময় এ’দিকে মিতার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সে সবই ওর সাহিত্যিক বন্ধুদের হাত ধরে অবশ্য। মিতা নিজেও একসময় লেখালিখি করত। গত বছর দশেকে রিসার্চের কাজে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লো মেয়েটা। তবু সময় সুযোগ করে মাঝেমধ্যেই চলে আসত কফি হাউস। 
অথচ কতদিন হয়ে গেল মিতার দেখা নেই। ধুস্‌। 
কফিহাউস থেকে বেরোতে বেরোতে বিকেল চারটে বেজে গেল। অনমিত্র রোজকার মত হাঁটতে হাঁটতে মেডিক্যাল কলেজের পিছনের দিকটায় চলে গেল। এখন ভাঁটার সময়, ঢেউ কম। আকাশ আর সমুদ্রের ফ্যাঁকাসে রঙ মিলেমিশে একটা অদ্ভুত গা ছমছম তৈরি করে; সে’টা দিব্যি লাগে অনমিত্রর। কলেজ স্কোয়্যারের দিক থেকে ঘটিগরমওলারা এ’সময় সমুদ্রের দিকে হেঁটে আসে। দশটাকার এক ঠোঙা গরম চানাচুর মাখা নিয়ে বসে আরও ঘণ্টাখানেক কেটে যায়। সন্ধ্যের ঠিক আগে জুটিয়ে নেওয়া যায় এক কাপ লেবু চা। অন্ধকার নামার ঠিক আগে অনমিত্রর থেকে হাতদশেক দূরে এসে বসেন গায়ে কালো শাল জড়ানো ভদ্রলোক। মিতা থাকলে পাগলের মত গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত ভদ্রলোকের পাশে। কিন্তু মিতা নেই। আছে শুধু সমুদ্র, কলকাতার ডিজেল পোড়ানো গন্ধ আর খানিক দূরে বসে থাকা সুনীল গাঙ্গুলি।     

আপনিই বটু দত্ত?
আজ্ঞে। বসুন। 
গোয়েন্দা বটু দত্ত?
একই বাড়িতে দু’জন বটু দত্তের থাকার সম্ভাবনা খুব একটা রয়েছি কি? 
মাফ করবেন আপনাকে দেখে ঠিক...। 
গোয়েন্দা বলে মনে হয় না, তাই তো?
না ঠিক সে’ভাবে বলতে চাইনি। 
আপনার টিশার্টের গেভারা দেখে কে বলবে যে আপনি প্রতি শনিবার কালী মন্দির না গেলে চলে না? আর গোয়েন্দারা বেঁটে হলেই গোলমাল?
হ্যাঁ...মানে...পাড়ার কালীমন্দিরটা বেশ জাগ্রত...তবে মানে...আপনি কী’ভাবে...? 
আপনার পায়ের চটিতে রক্তফুলমাখা কাদার ছিটে। মোটামুটি ফ্রেশ ছিটেগুলো সম্ভবত গতকালের অর্থাৎ শনিবারের। আবার পুরনো ছিটে যেগুলো চটির গায়ে বসে গেছে সেগুলো বলে দিচ্ছে ও’দিকে আপনার যাতায়াত নিয়মিত। 
ওহ্‌ আই সী। আপনাকে আমি ঠিক সে’ভাবে বলতে চাইনি কিন্তু।
ও আমার শুনে অভ্যাস আছে। বসুন। 
আসলে খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে আসা...। 
শুধু চা খেতে আমার কাছে আসার কোনও মানে হয় না। একে দুধ নেই, তা’তে সস্তা চা পাতা। আর লোকে বিপদে না পড়লে আমার বাড়ির চা পাতার কোয়ালিটি ইম্প্রুভ করার চান্স খুব সীমিত। 
ওহ। হ্যাঁ। তা তো বটেই। 
খাবেন? চা? 
না থাক্‌। 
আমাকে চা বানাতে যেতে হবে না। ফ্লাস্কে করা আছে। দিই এক কাপ?
আচ্ছা। 
আসুন। স্টিলের কাপটা মাইন্ড করবেন না। 
না না। চমৎকার। 
হুঁ। আপনার সমস্যা শুনব। তার আগে আপনার পরিচয়টা যদি...। 
আমি অনমিত্র চ্যাটার্জি। ব্রেন সাইনটিস্ট। 
সিগারেট?
না থ্যাঙ্কস। 
আমি স্মোক করলে ইয়ে নেই তো?
না না, প্লীজ।
থাকেন কোথায়?
টালিগঞ্জ। 
এ’বার সমস্যাটা শুনি। 
ব্যাপারটা আসলে এতটা অদ্ভুত। 
শুনছি। 
আপনি...আপনি হয়তো আমায় পাগল ঠাওরাবেন। 
আপনি মক্কেল। টু পাইস দেবেন। ইলিশের সিজন সামনে। অতএব মক্কেল ভগবান। বলুন। 
বেশ। পুরোটা শোনার আগে আমায় গলাধাক্কা দেবেন না প্লীজ। 
ওই যে বললাম। আমার কনসালটেন্সি ফীজ আছে। সে’টুকু না ভুললেই চলবে। তবে একটু তাড়াতাড়ি করবেন। লেক থানার ইন্সপেক্টর মহাপাত্রর সঙ্গে একটা জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে। 
বেশ। আমার সমস্যাটা ভারী অদ্ভুত বুঝলেন। এই যে মুহূর্তটা, এই যে...আমি আপনি মুখোমুখি বসে রয়েছি।  এই বিকেলবেলা। এই আপনার বসার ঘর, ওই নিউ হরাইজন  ক্যালেন্ডারে জুন মাস, এই ফ্লাস্কের চা...এগুলো সমস্তই একটা স্বপ্ন।
এই যে ইজিচেয়ারে আমি বসে...ওই যে আপনি সোফায় বসে...আমরা দু’জনেই আদতে...আপনার স্বপ্নে? 
হ্যাঁ। 
রাতে রান্না নেই। দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে রুটি তড়কা নিয়ে ফিরব ভাবছিলাম...তার আর দরকার নেই বলছেন...। 
নির্ভর করছে আপনি এই স্বপ্নে কতক্ষণ থাকছেন তার ওপর।
ওহ্‌। আচ্ছা, স্বপ্নটা কি...আমার?
নাহ্‌।
আপনার স্বপ্ন? আপনার স্বপ্নে আপনি আমার ড্রয়িংরুমে এসে বসেছেন? 
না। স্বপ্নটা মিতার। 
মিতা? 
মিতা সেন। আমার স্ত্রী। 
আচ্ছা। বেশ। আপনার স্ত্রীর স্বপ্নে আপনি আমার বাড়ি এসেছেন কোনও ব্যাপারে পরামর্শ নিতে। বেশ। বেশ। কিন্তু আপনি টের পেলেন কী করে যে এ’টা স্বপ্ন? 
খুলে বলি। 
পারবেন? খুলে বলতে? বৌয়ের স্বপ্নে এসে এত কথা বলাটা সমীচীন হবে? 
আসলে এই স্বপ্নে সব কিছুই হল আ ফিগমেন্ট অফ ইম্যাজিনেশন। শুধু আমি বাদে। আমি সজ্ঞানে মিতার স্বপ্নে এসে ঢুকেছি। 
আর এক কাপ চা খাবেন?
দিন। 
নিন। এবারে বলে যান। 
সবার আগে আমার এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা বলা দরকার। আবিষ্কারটা এখনও জনসমক্ষে আনিনি। কারণ ব্যাপারটা এতটাই গুরুতর যে দেশনেতাদের হাতে সে আবিষ্কার পড়লে গোটা পৃথিবীটা একটা মগজধোলাই যন্ত্রে পরিণত হবে। আমি আপনাকে বলতে পারছি এই বিশ্বাসে যে আপনি সমস্ত ব্যাপারটাকে গোপন রাখবেন। 
থামবেন না। বলে যান। ফ্লাস্কের চা বড় বেশি নেই। 
আবিষ্কারটা হল সাসিল্যা। অর্থাৎ সাবকনশাস সিমুলেশন ল্যাবরেটরি। এই ল্যাবরেটরিতে যেকোনো মানুষের অবচেতন মনের চলমান ছবি আঁকা সম্ভব। ব্যাপারটা সিনেমার মত, শুধু এমন সিনেমা যে’টা অন্যের মগজে চালান করা যায়।
সাসিল্যা। অবচেতনের চলমান ছবি। যা অন্যের মগজে চালান করা যায়। চন্দ্রবিন্দুর চ। বেড়ালের...। 
পুরোটা শুনুন বটুবাবু। প্লীজ।
ফীজ্‌টা।
এখন যত চান তত দিতেই পারি। তবে কাজে লাগবে না। স্বপ্নের টাকার আবার মূল্য কোথায়। তবে আমার মনে থাকবে, স্বপ্ন কেটে গেলেও। আর তখন আপনার ফীজটা আমি...। আপনি আমায় বিশ্বাস করতে পারেন বটুবাবু। 
শেষ কাপ ঢালছি ফ্লাস্ক থেকে। এই নিন।
থ্যাঙ্কস। 
এই যে আমি চা ঢাললাম...সে’টা মিতাদেবীর অবচেতনে বসে। তাই তো?
কারেক্ট। মিতার সাবকনশাসকে সিমুলেট করতে যত ইনফর্মেশন দরকার সে সবটুকু যোগাড় করতে আমার ঠিক পাঁচ বছর লেগেছে, আমাদের বিয়েও ওই পাঁচ বছরেরই। ইন ফ্যাক্ট, আমার প্রথম সাবকনশাস সিমুলেশন এটাই। আসলে আমার মনে হয়েছিল আরও বছরখানেক দরকার রিসার্চের জন্য। কিন্তু ব্যাপারটা এমন জরুরী জায়গায় চলে গেল যে আর...। মিতার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা। 
চিড়?
ডিভোর্সের আপিল করা হয়ে গেছে, মাস খানেকের ব্যাপার। মিউচুয়াল তবে ওরই রিকুয়েস্টে।  
ওহ্‌ আই সী। 
মিতা নিজেও ব্রেন সায়েন্টিস্ট, আমাদের পড়াশোনা রিসার্চ সমস্তই একই সঙ্গে। এই গবেষণায় ওর ভূমিকা কম নয়। ইন ফ্যাক্ট মিতাও জানত যে এই সিমুলেশনের প্রথম সাবজেক্ট ও নিজে। তবে ও বহুদিন ধরেই চাইত ব্যাপারটার অর্থনৈতিক সুবিধে নিতে। আসলে আবিষ্কারটা তো কম বৈপ্লবিক নয়। কিন্তু আমার চিন্তা তো বলেইছি। এ আবিষ্কারের কথা ছড়িয়ে পড়লে মানুষের অকল্যাণ ঘটার সুযোগ অনেক বেশি। মিতা যে সহজ ব্যাপারটা কেন বুঝতে চাইত না। 
ডিভোর্সটা কি সে’জন্যেই?
না। তৃতীয় ব্যক্তি। তবে আমার দিক থেকে নয়। 
দাঁড়ান। আপনার দেওয়া ইনফরমেশনগুলো আগে সাজিয়ে নিই। আপনি অনমিত্রবাবু একজন ব্রেন সায়েন্টিস্ট। আপনার স্ত্রী মিতাও তাই। আপনাদের ল্যাবরেটরিতে আপনারা যে কোনও মানুষের অবচেতনের চলমান প্রবাহ তৈরি করতে পারেন, অবশ্যই তার জন্য সে মানুষের ব্যাপারে যথেষ্ট ইনপুট দরকার। 
রাইট। 
আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না, তার কারণ কোনও তৃতীয় ব্যক্তি, সম্ভবত আপনার স্ত্রী অন্য কারুর প্রতি অনুরক্ত। সম্ভবত শব্দটা সহানুভূতি থেকে জুড়েছি। এবং এর মধ্যে কোনও গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে যার জন্য আপনি আপনার স্ত্রীর অবচেতনের সিমুলেশন তৈরি করেছেন। সে’টুকু বুঝলাম। এ’বারে দু’টো প্রশ্ন। 
বলুন। 
এক নম্বর, আপনার স্ত্রীর অবচেতনের প্রবাহ আপনার মনে প্রবাহিত হল কী ভাবে? মানে, সিস্টেমটা ঠিক কী’রকম?
দেখুন চেতনার বহনক্ষমতা সীমিত। প্রয়োজনীয় খবর আর অনুভূতিগুলো চেতনার স্তরে থাকলেও,আমাদের গভীরতম অনুভূতিগুলোর বাস অবচেতনে। আর এই অবচেতনই আমাদের চেতনাকে পরোক্ষভাবে চালিত করে। আমাদের বেশির ভাগ ভয়, অচেনা টান এই অবচেতন থেকেই উঠে আসে চেতনায়। অবচেতনের অনুভূতি আর ইনফরমেশন বহনক্ষমতা অসীম। খুব গোদা স্তরে অনেকে সাবজেক্টের ওপর হিপনোটিজম ফলিয়ে এই সাবকনশাস থেকে খবর বের করে এনেছেন। কিন্তু আমার এই ল্যাবরেটরি অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে একজনের সাবকনশাস থেকে খবর তুলে আনতে পারে আর তার জন্যই তৈরি করে একজনের সাবকনশাসের বহমান চিত্র প্রবাহ। প্রচণ্ড উন্নত ভাবে তৈরি অবচেতনের থ্রি ডাইমেনশনাল ম্যাপ। খুব সহজ ভাষায় বললে সেই ম্যাপটা একটা কম্পিউটারে ট্রান্সফার করা যায়, ওই আর পাঁচটা কম্পিউটার ফাইলের মতই। শুধু এ ক্ষেত্রে কম্পিউটারটাও একটু বিশেষ ধরণের, তার সঙ্গে অন্য কারুর মগজকে দিব্যি কনেক্ট করা যায় এবং অন্যের অবচেতনের ফাইলটা সেই কম্পিউটার তার মগজে চালান করে দিতে পারে। যেমন এ ক্ষেত্রে মিতার অবচেতনের সিমুলেশনকে একটা ফাইলে পুরে আমার ল্যাবরেটরি সেই কম্পিউটারে ট্রান্সফার করেছি। তারপর নিজের মগজকে সেই কম্পিউটারের সঙ্গে জুড়ে আমার ব্রেনে ইম্পোর্ট করে নিয়ে মিতার অবচেতন, আমার মগজে সেই সাবকনশাসের ফাইল ইম্পোর্ট হওয়া মাত্রই আমি শারীরিক ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছি আমার ল্যাবে। সে’টা জানা কথা। আর আমার মগজ অর্থাৎ এই আমি; আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি মিতার অবচেতনে। 
বাপ রে। 
অবিশ্বাস করছেন বটুবাবু?
কিউরিওসিটি অবিশ্যি ষোল আনা। আচ্ছা বেশ, আর একটা কথা জানার ছিল। 
বলুন। 
মিতাদেবীর অবচেতনে আমি এলাম কোথা থেকে? 
মিতা আপনার খুব বড় ভক্ত। সেই রসগোল্লা রস চিপে খাইয়েদের সিরিয়াল মার্ডার মিস্ট্রি সল্ভ করার সময় থেকেই। কাগজে আপনার যে কোনও তবে খবরই ও খুঁটিয়ে পড়ে। বলতে পারেন, ফ্যান। সেই থেকেই এই আপনার উৎপত্তি। আর ইয়ে, ফ্যাক্ট মিতা মা কালীরও খুব বড় ভক্ত। ওর অবচেতনে অনেকটা জুড়ে দেখছি কালী মন্দির। রিয়েলি। আমারও অবাক লাগত, ব্রেন সায়ন্টিস্ট হয়ে মিতা কী করে এত...। ইন ফ্যাক্ট, ওর অবচেতনে আসার পর থেকেই আমার মধ্যে সামান্য কালীভক্তি জেগেছে বইকি। তাই রোজ একটু একটু ঢুঁ মেরে আসি। 
রোজ রোজ ঢুঁ মেরে আসেন মানে? আপনি তো আপনার ল্যাবরেটরিতে শুয়ে মিতাদেবীর সাবকনশাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, স্বপ্নটা কদ্দিন ধরে চলছে?
এই স্বপ্নে দিনকালমাসবছরের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে রিয়েল লাইফের কোনও যোগাযোগ নেই বটুবাবু। আমার সেই ল্যাবরেটরি ঘুমের বয়স হয়তো কয়েক সেকেন্ডও হয়নি বা হয়ত কেটে গেছে কয়েক সপ্তাহ। কিন্তু আমি এখানে বহু বছর ধরে ঘুরে চলেছি। আর বটুবাবু, সমস্যাটা সেখানেই...। 
কী’রকম? 
দেখুন কারুর সাবকনশাসে ঘুরে বেড়ানোটা একটা সাইক্লিক রিয়ালিটি। অর্থাৎ আপনি সে’খানে ঘুরেই চলবেন ঘুরেই চলবেন যতক্ষণ না সেই সাইকেলটা নষ্ট হচ্ছে। আমার এখানে আসার মূল লক্ষ্য ছিল অনিন্দ্যর প্রতি মিতা ঠিক কতটা অনুরক্ত সে’টা যাচাই করা। বিশ্বাস করুন বটুবাবু, আমি এখনও মিতাকে আগের মতই...। সে যাক গে। কিন্তু এসে আবিষ্কার করলাম অন্য একটা গোলমাল। সাইক্লিক রিয়ালিটি ভাঙছে বটুবাবু, আমার মগজ মিতার সাবকনশাস ছিঁড়ে বেরোতে পারছে না। 
সাইক্লিক রিয়ালিটিটা ভাঙবে কী ভাবে?
আমার থিওরি অনুযায়ী, নিজের সাবকনশাস ম্যাপে নিজের মগজে ইম্পোর্ট করলে যখন তখন বেরিয়ে পড়া যায়। কিন্তু অন্যের অবচেতন নিজের মনে গ্রহণ করলে কেস একটু জটিল।  যার অবচেতনের ম্যাপে আমি ঘুরছি, যতক্ষণ না তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে ততক্ষণ সে রিয়ালিটি  ভাঙার কোন চান্স নেই। মিস্টার বটু, বহুদিন কেটে গেছে এই বিটকেল রিয়েলিটিতে অথচ মিতার দেখা নেই। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। প্লীজ! প্লীজ আমায় সাহায্য করুন। মিতাকে খুঁজে বের করতেই হবে, প্লীজ। একমাত্র আপনিই পারেন আমায় বাঁচাতে। 
দাঁড়ান মশাই। ফ্লাস্কের চা শেষ। আর এক রাউন্ড চা বানিয়ে আসি।  

অনমিত্রবাবুকে ছাতে এনে ধাতস্থ করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু ছাতে এসে নিজেই বেশি খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করলেন বটুগোয়েন্দা। আকাশ জুড়ে যে সবজে আলোর মন মাতানো খেলা যে’টাকে বলে অরোরা বোরিয়ালিস। 
মিতা নরওয়ে গেছিল বটুবাবু। 
ওহ, আচ্ছা।          
আমি কিন্তু কোনও তুকতাক করছি না। 
আমি তুকতাকেবল নইও অনমিত্রবাবু। কিন্তু এ’টা ভাবে অবাক লাগছে যে এই যে আমি, আই অ্যাম অনলি আ ফিগমেন্ট অফ মিতাদেবীর কল্পনা। 
চারিদিকটাই তাই বটুবাবু। আপনি। আপনার শহরটা। শহরের মানুষজন সবটাই মিতার অবচেতন। মিতার ভয়, ভালোবাসা, স্নেহ, হাহাকার মিলে এই সবটুকু। একটা ব্যাপার বুঝেছি যে মিতা কলকাতাকে মনঃপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো। তাই ওর গোটা অবচেতন জুড়ে একটা আস্ত কলকাতা তৈরি হয়ে রয়েছে। অসুবিধে হল যে যে এ শহরে সবাই মিতার মনের টুকরো এক আমি বাদে। আমি এখানে রয়েছি নিজের স্বতন্ত্র মগজ নিয়ে এবং বেরোতে পারছি না। এ ব্যাপারটা শুধু আপনাকেই জানালাম। বাকিদের জানিয়ে লাভ হত না। মিতার অবচেতনেও একটা গ্যালাক্সি আছে, সেই গ্যালাক্সির কোনও এক প্রান্তে এই শহরে ওর ভাবনা চিন্তার মানুষজন। বাস ট্রাম ইকনমি। চিৎকার করে সক্কলকে বললে সমস্তটাই ভেস্তে যাওয়ার চান্স। অ্যাপোক্যালিপ্সের দায় নিতে হবে। ইন ফ্যাক্ট, আনরিয়েল ব্যাপারটা কাউকে ধরিয়ে না দিলে কেউ দেখতে পাবে না। যেমন আমি আপনাকে না ধরিয়ে দিলে আপনি অরোরা বোরিয়ালিসটা খেয়াল করতেন না। কফি হাউস ভরতি লোকজন যেমন ফ্রেমের রবীন্দ্রনাথের চলাফেরা টের পান না। 
বুঝলাম। একটা ভালো ব্যাপার কী জানেন অনমিত্রবাবু?
কী? 
রিয়েলিটি স্বপ্ন যাই বলুন, নতুন রাউন্ডে ফ্লাস্কের গলা পর্যন্ত চা রয়েছে। ঘণ্টাখানেক নিশ্চিন্ত। এ’বারে একটা কথা বলুন দেখি, মিতাদেবীর অবচেতনে ঢুকতে চাইছিলেন কেন? শুধুই কি তাঁর আপনার প্রতি ভালোবাসা যাচাই করতে? 
সে’টা একটা কারণ। তবে মূল কারণ হচ্ছে; সেই ভদ্রলোকের খবর নিতে। 
তৃতীয় ব্যক্তি? ডিভোর্সের কারণ?
সম্ভবত। মিতা ইদানীং আমার কাছে হঠাৎ করে যেন কোনও কিছু গোপন করা আরম্ভ করেছিল। মাঝেমধ্যেই না বলে কয়ে কোথাও চলে যেত। রাতবিরেতে ফিরত। আমারই কয়েক বন্ধু ওকে বেশ কয়েকবার অন্যকারুর সঙ্গে বিভিন্ন কফিশপে দেখেছিল। সে’টা নিয়ে ওকে প্রশ্ন করতেই ও এমন অদ্ভুত ভাবে রিয়্যাক্ট করে যে সব গোলমাল হয়ে যায়। ডিভোর্সের চাপটাও ওর দিক থেকেই আসে। তাই ভাবছিলাম ওর অবচেতনে এসে যদি সেই অচেনা ব্যক্তির রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়। 
লাভ হয়েছে কিছু? 
সাবকনশাস অতি জটিল ব্যাপার। বোকামিটা আমারই, কে কোন কম্পার্টমেন্টে পড়ে রয়েছে সে’টা আঁচ করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু মিতার সঙ্গে আমার দেখা হওয়াটা ভীষণ জরুরী বটুবাবু। 
আপনাদের বাড়ি টালিগঞ্জে বলেছিলেন। 
আদত জীবনে, হ্যাঁ। 
সে’খানে গিয়ে মিতাদেবীর দেখা পাননি? 
মিতার অবচেতনে আমাদের বাড়ির ও’খানে একটা কেরোসিনের ডিপো। বহু খুঁজেও আমাদের বাড়িটা খুঁজে পাইনি।  আমি এই মুহূর্তে কলেজ স্ট্রীট ঘেঁষা একটা মেসবাড়িতে রয়েছি। 
মিতার বাপের বাড়ি?
মিতার ছোটবেলাতেই ওর মারা যায়। বাপের অনেক বদগুণ ছিল শুনেছি। মিতার সঙ্গে সম্পর্ক বিশেষ ভালো ছিল না। মদে লিভার পচে মারা যান যখন তখন মিতা কলেজে। ওদের বাড়ি ল্যান্সডাউনের কাছে ছিল, অদ্ভুতভাবে সে’খানে গেলে এখন একটা ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল দেখতে পাই। আর একটা মরা নদী। 
মিতার বন্ধুবান্ধব? 
দু’একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কেউই ওর খবর দিতে পারেনি ঠিকঠাক। সবারই এক কথা, বহুদিন মিতার কোনও খবর নেই। 
গোটা ব্যাপারটায় দু’টো সমস্যা রয়েই গেল অনমিত্রবাবু। 
কী কী? 
এক, মিতাদেবীর অবচেতনের দুনিয়ায় বটু গোয়েন্দার আদত দুনিয়ার নিয়ম কানুন কতটা কী খাটবে সে’টা আমি জানি না। আর দ্বিতীয়ত, এই অবচেতনের দুনিয়ায় বটু গোয়েন্দার বুদ্ধি কিন্তু মিতাদেবীর অবচেতনের বুদ্ধির স্পীডলিমিটে আটকে। অর্থাৎ আমি আপনাকে কতটা সাহায্য করতে পারব মিতাদেবীকে খুঁজে বের করতে, সে’টা নির্ভর করছে মিতাদেবীরই বুদ্ধির ওপর। 
বেশ। কিন্তু আমি আর ভাবতে পারছিলাম না বটুবাবু। বছরের পর বছর আমি এই গোলকধাঁধায় আটকে রয়েছে। আমায় বাঁচান। 

৪ 
ময়দানে এ মরশুমের প্রথম তুষারপাত। এই ব্যাপারটা অনমিত্রর সমস্ত মনখারাপের উপশম। এ দুনিয়ায় এসে ময়দানে অনেকটা সময় কাটালেও ভিক্টোরিয়ার দিকটায় যাওয়া হয়নি।
আজ হঠাৎ ইচ্ছে হল। মিতা কতটা যত্নে রেখেছে ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিগুলো? সেই কবেকার কথা। শীতের দুপুরগুলো বড় মোলায়েম ছিল তখন, মিতার নীল সুতির শাড়িটা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। কত গল্প, কত ঘাসের ডগা চেবানো অপেক্ষা। মিতা গুনগুন করে যেত; বেশির ভাগ সময় পুরনো হিন্দী গানের সুর। সন্ধ্যে নেমে আসতো কপালে চুলের মত এলোমেলো ভাবে। 
জানে উয়ো ক্যায়সে লোগ থে যিনকে প্যার কো প্যার মিলা,
হমনে তো যব কলিয়া মাঙ্গি কাঁটো কা হার মিলা।
খুশিও কি মঞ্জিল ঢুঁঢি তো গম কি দর্দ মিলি, 
চাহত কে নগমে চাহি তো আঁহে সর্দ মিলি।

আকাশের লালে কালো মিশে যেতো, আঙুলে আঙুল। কিন্তু অত কাছে থেকেও অনমিত্র কোথাও যেন ছুঁতে পারতনা মিতাকে। কোনও কোণে পড়ে থাকা কোনও দুঃখ, কোনও সুর। শতচুমুতে যে কোণে আঁচড় কাটা যায় না।  
ঠিক সে’রকমই ঝুমঝুমি সুর আজ বাতাসে। বরফকুচি উড়ছে। মনের তেতো ভাবটা বেশ কয়েক দাগ কম। ওভারকোটের বোতামগুলো আঁটতে আঁটতে ভিক্টোরিয়ার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। হোঁচট খেলেন ভিক্টোরিয়ায় পৌঁছে, টিকিট কাউন্টারে বসে রয়েছেন মা কালী স্বয়ং। কাউন্টারের মুখ থেকে অনমিত্র ফিরে যেতেই মা জিভটা বের করলেন। 
    


৫ 
নমস্কার বটুবাবু। 
উঁ। হুঁ। 
অবাক হচ্ছেন?
আমি সহজে অবাক হই না বটুবাবু। 
আমারই মত। 
স্বাভাবিক। বটু গোয়েন্দারা সহজে অবাক হয় না।  
অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বটুবাবু।
কী’রকম। 
প্রায় প্ল্যানচেট। 
প্ল্যানচেট? জ্যান্ত বটুকে ধরতে আপনার প্ল্যানচেট করতে হল? উম! এক মিনিট! এক মিনিট!
এক মিনিট?
আপনি কোথা থেকে আসছেন বলুন তো? এই মীন, এর আগে ঠিক কোথায় ছিলেন?
প্যারামাউন্টে গিয়ে খান দুয়েক ডাব শরবৎ খেয়ে এলাম। কেন বলুন তো?
ডাব শরবতের গন্ধ আমার নাক ঠিক ক্যাপচারই করেছে। প্যারামাউন্ট। নর্থ ক্যালক্যাটা। অথচ আপনার পায়ে সদ্য সৈকত চষা বালি। আর আপনি আসার পর থেকেই পারফিউম...সেই সুবাস...এলিজাবেথ আর্ডেন...এলিজাবেথ আর্ডেন...দ্বিতীয় বটু! মিতাদেবীর মনের মধ্যে আছেন আপনি...আপনি যোগাযোগ করেছেন আমার সঙ্গে...আমার সঙ্গে...। এ’টা তাহলে বেসিক্যালি...বেসিক্যালি...। 
টেলিপ্যাথেটিক। ঠিক ধরেছেন। আমি মিতাদেবীর অবচেতনের বটু। আপনার সঙ্গে, অর্থাৎ রিয়েল বটুর সঙ্গে যোগাযোগ করার দরকার আমার খুব হয়ে পড়েছিল বটুবাবু। 
চা খাবেন?
সেই তো ফ্লাস্কের। যাক গে, দিন। 
আসুন। এ’বার বলুন। আমায় যোগাযোগ করলেন কারণ অবচেতনে বটু হলেও আপনার বোধবুদ্ধি সমস্তই মিতাদেবীর বুদ্ধিতে সীমিত। কাজেই ফাঁপরে পড়েই আপনাকে টেলিপ্যাথেটিক যোগাযোগের রাস্তা খুঁজে নিতে হয়েছে আর যেহেতু আপনি মিতাদেবীর সাবকনশাসে বসে, সেহেতু আপনার কাছে গোটা ব্যাপারটা আদতে প্ল্যানচেটের মতই। অন্য জগতের কারুর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। বেশ। এ’বার বলুন। 
মিতাদেবীর সাবকনশাসে অনমিত্রবাবু...। 
আটকা পড়েছেন। জানি। মিতাদেবী ওঁদের ল্যাব থেকে অনমিত্রবাবুর কোমায় পড়ে থাকা দেহ উদ্ধার করেছেন। আমিই সঙ্গে গেছিলাম। কারণটাও মিতাদেবীর কাছে স্পষ্ট, কাজেই আমিও জেনেছি। 
বলেন কী! তাহলে তো মিটেই গেল। মিতাদেবীর অবচেতনে অনমিত্রবাবুর চেতনা ঢুকে পড়েছে। যতক্ষণ না সেই অবচেতনে অনমিত্রবাবুর চেতনা মিতাদেবীকে খুঁজে পাচ্ছেন ততক্ষণ অনমিত্রবাবুর মুক্তি নেই কোমা থেকে। 
কী মিটে গেল অবচেতনবটুবাবু?
আপনার মক্কেল ম্যাডামকে বলুন ঝপ করে নিজের অবচেতনে এসে অনমিত্রবাবুর সামনে দেখা দিতে। মিটে গেল। 
অবচেতনকে স্যুইচ টিপে ইন্সট্রাকশন দেওয়া যায় না বটুবাবু। রিল্যাক্স। ওইসব জারিজুরি এখানে খাটবে না। অন্য উপায় ভাবতে হবে। 
তাঁর আগে আমার একটা প্রশ্ন আছে। 
শুনি। 
মিতাদেবীর আচমকা গোয়েন্দার দরকার হল কেন?
সে কী! গোয়েন্দা কেন দরকার হল; সেই খবর মিতাদেবীর অবচেতনেই পৌঁছয়নি?
ওই যে, অবচেতনে তো আর সেন্ড বাটন টিপে কমিউনিকেশন পাঠানো যায় না। 
রাইট। রাইট। কিন্তু সে খবর আমি আপনাকে জানাতে যাব কেন? আপনি অবচেতনের বটু, আপনার মক্কেল অনমিত্রবাবু। আমার মক্কেল মিতাদেবী। 
জানাবেন। জানাতে আপনি বাধ্য।
বাধ্য? কেন?
কারণ আপনার মক্কেল মিতাদেবী আমার মক্কেল অনমিত্রবাবুকে সরিয়ে ফেলতে চাইছিলেন। আর মিতাদেবীর গোয়েন্দার দরকার আদৌ ছিল না। মিতাদেবীর দরকার ছিল আপনাকে। 
ননসেন্স। 
বটুগোয়েন্দা! পরাস্ত হয়েছেন। স্বীকার করুন। 
গেট আউট। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে পত্রপাঠ বিদেয় হোন দেখি। 
আমিই আপনার শেষ আশা মিস্টার বটুবাবু অফ রিয়েল লাইফ। মিতাদেবীর অবচেতনের বটু গোয়েন্দা, যে আজও আপোষ করতে শেখেনি, সেই আপনার শেষ সম্বল ঘুরে দাঁড়ানোর। কিন্তু মিতাদেবী যে আদত জীবনের মানুষটিকে আপোষের কুয়োয় ঠেলে ফেলেছেন, সে’টা দেখে ভালো লাগছে না বটু গোয়েন্দা। আবারও বলছি, আমিই আপনার শেষ আশা। আমায় সাহায্য করুন। নয়তো জেনে রাখুন বটু গোয়েন্দা; আপনার খেল খতম!

৬ 
মাঝরাতে আমায় ময়দানে ডাকার কী মানে বটুবাবু ? আর যে পরিমাণে বরফ পড়ে চলছে...। 
ফ্লাস্কে চা এনেছি অনমিত্রবাবু। খাবেন?
আপনি কি পাগল হলেন? চা খেতে ময়দানে নেমন্তন্ন! 
না খেলে খাবেন না। বসুন। 
বরফের স্তূপ চারিদিকে। বসব কোথায়? চলুন বাড়ি ফিরি। ওই ট্রামটা ছাড়বে কিছুক্ষণের মধ্যেই। 
জানেন অনমিত্রবাবু, আমার ঘর জুড়ে আজকাল একটা পারফিউমের গন্ধ থাকে। আর তার সঙ্গে মিশে থাকে ঘাসের গন্ধ। সে ঘাসের গন্ধে বিকেল, সুর, ময়দান মিলেমিশে থাকে। সে জন্যেই আপনাকে ময়দানে ডাকা। আসুন। এক কাপ। রিফিউজ করলে ঠকবেন। আজ আদা দিয়েছি। 
থ্যাঙ্কস। এ’বার বলুন তো ব্যাপারটা কী?
ব্যাপারটা সিরিয়াস অনমিত্রবাবু। এ’দিকে এসে আপনার আদত সময়ের জ্ঞান নেই। এ’দিকে আপনার চেতনা মিতাদেবীর অবচেতনে বন্দী আর ও’দিকে আপনার দেহ আজ মাস দেড়েক হলো কোমায়। গত এক মাস ধরে আপনি লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। আর কিছুদিন এ’ভাবে চললে আপনার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হবে। 
কী বলছেন বটুবাবু? 
ঠিকই বলছি। 
কিন্তুও আপনিও তো মিতার অবচেতনেই রয়েছেন। আদত জীবনে কী ঘটছে, সে খবর আপনি পেলেন কী করে?
প্ল্যানচেট। 
প্ল্যানচেট?
ও’সব ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই অনমিত্রবাবু। মোদ্দা কথা হচ্ছে, মিতাদেবীর অবচেতনে আর বেশিক্ষণ আটকে থাকা মানে আপনার আদত জীবনটা নিকেশ হয়ে যাওয়া। 
কিন্তু মিতার সঙ্গে এখানে আমার দেখা না হওয়া পর্যন্ত আমি এই সাইক্লিক মেটাফিজিকাল রিয়ালিটি থেকে বেরোতে পারব না। সে জন্যেই তো আমি আপনার শরণাপন্ন হয়েছি বটুবাবু। আপনি কি মিতার কোনও খবরই পান নি?
খবর পেয়েছি কিনা সে’টা বলতে পারব না। তবে মিতাদেবীকে টেনে বের করে আনার একটা টোপ আবিষ্কার করেছি।       
টোপ?
টোপ! এই নিন!
রি...রিভলভার!
লোডেড!
ওহ মাই গড! আমি বিজ্ঞানী বটুবাবু। রিভলভারটিভলভার আমায় দিচ্ছেন কেন?
অ্যাটম বোমা কি কুলিমজুরেরা আবিষ্কার করেছিল অনমিত্রবাবু? নিন, ধরুন! 
ধরলাম, কিন্তু এ’বার কী!
এ’বার আমার দিকে তাক করুন। আনকোরা মানুষ। বুকে ঠেকিয়ে ফায়ার করবেন। কেমন? 
আপনি উন্মাদ হয়ে গেছেন। 
উন্মাদ এক বটু হয়েছেন বটে। তবে আমি না। দ্য বটু অফ রিয়েল লাইফ। আপোষ করতে শুরু করেছিলেন রিয়েল বটু গোয়েন্দা। যেই আপোষের নেশায় একটা অপরাধ দেখেও তার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন সেই বটু। কিন্তু এ’বার ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। 
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না বটুবাবু। 
আমি টেলিপ্যাথি ব্যবহার করে মিতাদেবীর অবচেতন ডিঙিয়ে আদত বটুগোয়েন্দার ঘরে ঢুঁ মেরে এসেছিলাম। অবিকল এ অবচেতনের জগতে যে ঘর সেই ঘরের মতই। এমন কী ফ্লাস্কের চা’টাও বাদ যায়নি। অর্থাৎ আদত জীবনে বটুগোয়েন্দার বাড়ি নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেছিলেন মিতাদেবী। 
মিতা গোয়েন্দা লাগিয়েছিল? কী কারণে?
আমিও কিছুক্ষণ তেমনই ভেবেছিলাম, তবে ধোঁয়াশা কাটতে সময় লাগেনি। মিতাদেবী বটুগোয়েন্দার প্রেমে পড়েছেন অনমিত্রবাবু। আর মিতাদেবীর মায়ায় এই প্রথম বটুগোয়েন্দারও পদস্খলন ঘটে গেছিল। উনিও প্রেমে সাড়া দিয়েছিলেন। আপনাদের সম্পর্কে চিড় ধরানো তৃতীয় ব্যক্তি আর কেউ নয় অনমিত্রবাবু, বটু গোয়েন্দা নিজে। 
এ’সব কী বলছেন আমি কিছুই...। 
মিতাদেবী চাইছিলেন আপনাকে সরিয়ে ফেলতে। এবং আপনি যখন আপনাদের ল্যাবে আপনাদেরই আবিষ্কার ব্যবহার করে ওঁর অবচেতনে প্রবেশ করতে চাইলেন, উনি সে সুযোগটা দিব্যি ব্যবহার করলেন। আপনার স্ত্রী তন্ত্র পথে বহুদূর এগিয়েছেন অনমিত্রবাবু, নিজের অবচেতনে নিজেকে আপনার থেকে লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা তাঁর আছে। এবং মিতাদেবীর ঠাণ্ডা মাথার প্ল্যানে খুব শীগগির আপনি আদত জীবনে মারা যাবেন, মিতাদেবীর দেখা এখুনি না পেলে। মিতাদেবী নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন নিজেরই অবচেতনে। কী ভাবে, কী সাজে; সে’টা জানা সম্ভব নয়। তাই এই টোপ। তাঁর অন্তরের বটুকে খুন হতে দেখলেও কি তিনি এগিয়ে আসবেন না?
যদি না আসে?
তাহলে অন্তত ওঁর অন্তরের প্রেমটিকে খুন করে তবে আপনি মরবেন। 
মিতা আমায় হয়তো আর ভালোবাসে না। কিন্তু আমি ও’কে ভালোবাসি। ওর অন্তরের ভালোবাসাকে আমি খুন করতে চাইব বটুবাবু? 
ইম্প্র্যাক্টিকাল হবেন না অনমিত্রবাবু। ইউ মাস্ট শুট্‌ মি।ও কী! নিজের মাথা বন্দুক কেন অনমিত্রবাবু! কেন? না! না! শুনুন! 
মিতা ভালো থাকুক বটুবাবু। আর আপনার ফীজটা দিয়ে যেতে পারলাম না। সরি। 
**
বন্দুকের নলটা মুখে পুরে অনমিত্রবাবু আঙুলটা সবে ট্রিগারে রেখেছেন, তখনই একটা প্রবল ধাক্কায় ময়দানের বরফে লুটিয়ে পড়লেন ভদ্রলোক। রিভলভারটা দূরে ছিটকে পড়লো। অনমিত্র ঘুরে দেখলেন মা কালী, তাঁর দু’চোখ বেয়ে জল। 
“গুড ইভনিং, মিতাদেবী! নিজের অবচেতনে আপনি সর্বশক্তিময়ী। স্বাভাবিক। আমার আগেই আন্দাজ করা উচিৎ ছিল”! বটুবাবুর কথাগুলো অগ্রাহ্য করলেন না কালী, কিন্তু তাঁর চোখ একটানা রইলো অনমিত্রর উপর । 
“আই অ্যাম সরি”, অনমিত্রর পাশে এসে বসলেন মিতা, ওর চেহারার কালী কালী ভাবটা ততক্ষণে কেটে যেতে শুরু করেছে, “আমি বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেম। মনে হচ্ছে ওই ল্যাবরেটরিটা আমায় গিলে খাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল আমি তোমায় হারিয়ে ফেলেছি। গোটাদিন শুধু নোটস, অবজার্ভেশন, ক্যালকুলেশন! আমি আর পারছিলাম না! আচমকা একদিন কফিহাউসে দেখা হয়েছিল বটুবাবুর সঙ্গে, ছুটে গিয়ে আলাপ করেছিলাম। সেই থেকেই কী’ভাবে যেন...। আমি চেয়েছিলাম যে তুমি যাতে আর কোমা থেকে না ফেরো...কিন্তু তুমি...তুমি যে এই ভাবে...তুমি যে হারিয়ে যাওনি...আমি বুঝতে পারিনি অনমিত্র। আমায় ক্ষমা করবে প্লীজ? প্লীজ অনমিত্র? একটা সুযোগ দেবে”?
দুম শব্দে সম্বিত ফিরল দু’জনের। ময়দানের বরফ রক্তে প্যাচপ্যাচ করে দিয়ে উপুড় হয়ে পড়েছে বটুগোয়েন্দার লাশ। 

হ্যালো! বটু?
বলো মিতা!
শোন! আজ সকালে অনমিত্রর জ্ঞান ফিরেছে। 
আই সী। 
আর...। 
আর?
আমাদের আর দেখা না হওয়াটাই সমীচীন হবে। আমার যে মাথায় কী গণ্ডগোল হয়েছিল। 
আই আন্ডারস্ট্যান্ড। 
আমরা ডিভোর্সের আপিলটা উইথড্র করব। বটু, আই অ্যাম সরি। কিন্তু আমার মনে শুধু...। 
অনমিত্র আছেন। থাকুন। ভালো থেকো মিতা। 
ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে ঢালতে গুণগুনিয়ে উঠলেন বটু গোয়েন্দা;
জানে উয়ো ক্যায়সে লোগ থে যিনকে প্যার কো প্যার মিলা,
হমনে তো যব কলিয়া মাঙ্গি কাঁটো কা হার মিলা।
খুশিও কি মঞ্জিল ঢুঁঢি তো গম কি দর্দ মিলি, 
চাহত কে নগমে চাহি তো আঁহে সর্দ মিলি”।

হরিহর সামন্তের আবেদন


- নাম?
- হরিহর সামন্ত।
- হরিহর। ও লেখেন না এ?
- আজ্ঞে?
- নামের ইংরেজি বানানে, দুটোই ও না দুটোই এ না কম্বিনেশন?
- মার্কশিটে দুটোই এ। সামন্ততেও দুটোই এ।
- বয়স?
- একশো বত্রিশ।
- একশো বত্রিশ? অনলি?
- অনলি বলবেন না স্যর। মনের দিক থেকে কিন্তু আমি জেনুইনলি বুড়িয়ে গেছি। বিশ্বাস করুন।
- দেখুন, আপনার মৃত্যুর আবেদন নাকচ হবেই। গোটা শহরে মাত্র দুটো সরকারি ডেথ মেশিন। অন্তত আড়াই হাজার মানুষ ওয়েটলিস্টে আছেন। আর যারা ওয়েটলিস্টে আছেন তাঁদের প্রত্যেকের বয়সই অন্তত দেড়শো। কাজেরই আপনার আবেদন…নাহ, চান্সই নেই।
- অমন বলবেন না স্যর। আমার বড় ইচ্ছে আমি মারা যাব। তাছাড়া একশো বত্রিশ নেহাত কম কিসে। আমার পিসতুতো দাদা একশো চল্লিশে ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্টের জন্য আবেদন করেছিল, দিব্যি মঞ্জুর হয়ে গেছিল। তাছাড়া ভাবুন, এককালে তো মানুষ আশিতেই বুড়িয়ে যেত। যেত না কি?
- ও মা। সে তো কয়েকশো বছর আগে মানুষের জ্বরও হত। ক্যান্সারট্যান্সার গোছের কিছু হলেই দিব্যি টক্‌ করে মরে যেত। সেসময় তো দেশে দেশে ইলেকশনও হত শুনেছি। আর তার কিছুদিন আগে মানুষ গুহার দেওয়ালে ছবি আঁকত। কবে কোন মান্ধাতা আমলে কী হত, তাই দিয়ে কি এখনকার হিসেব চলে হরিহরবাবু? সেসময় এ যুগের মত জন্মের পরেই ইম্মর্টালিটি ভ্যাক্সিনেশন ছিল? সরকারি কন্ট্রোল রুম থেকে বার্থ কন্ট্রোল করা যেত সে সময়? সে সময় পপুলেশন কন্ট্রোল একটা বিশাল হ্যাপা ছিল, টুকটাক মানুষ মরলেই বরং সুবিধে ছিল। কিন্তু এখন পপুলেশন মেন্টেন করাটাই চ্যালেঞ্জ। অমন কচি বয়সে যদি দুমদাম মানুষে মরার আবদার করে, সরকারকে রোবট প্রডাকশন বাড়াতে হবে কাজকর্ম চালাতে। সে তো আর এক ঝামেলা।
- বুঝি বুঝি। রোবটের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে মানুষের হাত থেকে কোনদিন পার্লামেন্টটাই বেরিয়ে যাবে।
- যেতেই পারে। অথচ এত কিছু বুঝে আপনি মরার আবেদন করতে এসেছেন? ভারী স্বার্থপর তো মশাই আপনি।
- বিশ্বাস করুন স্যর, আমার বড় সাধ মারা যাওয়ার। আমার একদম বাঁচতে গা করে না। প্লীজ স্যর, আবেদনটা অন্তত করতে দিন।
- মাফ করবেন, অকারণ আবেদন লিখিয়ে নেওয়ার কোনও মানেই হয়না। সার্ভারে আপনার মেডিকাল রিপোর্ট যা দেখছি তাতে আপনাকে দিয়ে অনায়াসে আরও অন্তত আশি বছর কাজ করানো যেতে পারে। এই লেবার-লস সরকার মেনে নেবে না।
- কোনও উপায় কি নেই?
- উপায়?
- উপায়। নেই কি?
- আপনি আন্ডার দ্য টেবিল কিছু ছাড়তে পারলে…।
- সে চিন্তা করবেন না স্যর। আপনি শুধু আমায় উপায় বাতলে দিন…।
আমায় হাফ কিলো ইলিশ কিনে দিতে হবে।
- হাফ কিলো?
- আচ্ছা, চারশো গ্রাম চলবে।
- সে তো খান তিনেক প্রমাণ সাইজের হীরে কেনার সমান।
- তবে থাকুন আরও আড়াইশো বছর বেঁচে। খামোখা আমায় জ্বালানো কেন।
- চটবেন না প্লীজ। চটবেন না। ওই চারশো গ্রাম ইলিশের কথাটাই ফাইনাল রইল। এবার উপায়টা যদি দয়া করে বাতলে দেন…।
- বেশ। হরিহরবাবু, মৃত্যুর আবেদন মঞ্জুর করার একটাই উপায়। আপনার নিজের মনকে বুড়িয়ে নিতে হবে। এমন গাঁট্টাগোঁট্টা জোয়ান মন নিয়ে সরকারবাহাদুর আপনাকে মরতে দেবে না।
- কিন্তু স্যর, মনকে বুড়োনোর উপায়টা কী?
- উপায় আমার কাছে আছে। ইলিশটা নিয়ে আসুন, আমি আপনাকে উপায় হাতে ধরিয়ে দেব’খন।
- আমি এখুনি নিয়ে আসছি স্যর। এখুনি…কিন্তু…জিনিসটা কী?
- দশঘণ্টার ভিডিও। সাড়ে তিনশো বছরের গোপন আর্কাইভ থেকে চুরি করা। মৃত্যুকামীদের ব্ল্যাকে বিক্রি করে আমি একটু ফুর্তি করি। এই আর কী।
- কীসের ভিডিও?
- একুশ শতকে নিউজ চ্যানেল বলে একটা ব্যাপার ছিল জানেন তো? ইতিহাসের সে গা কাঁপানো চ্যাপ্টারটা ভুলে যাননি আশা করি। সেইসব নিউজ চ্যানেলের বিভিন্ন পলিটিকাল ডিবেটের রেকর্ডিং; দশ ঘণ্টা শুনলেই মনের বয়স ডবল হয়ে যাবেই। গ্যারেন্টি।
- মার দিয়া কেল্লা।
- এবার চটপট ইলিশ নিয়ে আসুন দেখি হরিহরবাবু। দেখবেন, যা দিনকাল পড়েছে, কোল্ডস্টোরেজের মাল যেন না গছিয়ে দেয়।

Thursday, November 21, 2019

ট্যাক্সের হিসেব

- দাঁড়িয়ে কেন? বসো।
- গুড মর্নিং স্যর। ইয়ে…সোফায় বসব? আপনার পাশে? নাকি উল্টো দিকের চেয়ারটায়?
- যেখানে খুশি। মেঝেতেও বসতে পারো।
- নভেম্বর…একটু শীত শীত ভাব পড়ে গেছে কিন্তু, মার্বেলের মেঝে তো…পায়ের তলেই কেমন ছ্যাঁত ছ্যাঁত…। আমি বরং ওই চেয়ারেই…। থ্যাঙ্ক ইউ।
- শশাঙ্ক সাহা, তাই তো?
- আজ্ঞে হ্যাঁ, ফ্রম রসুলপুর। কাল আপনার সেক্রেটারির ফোন পেয়েছিলাম তাই…তাই আজ সিধে ভোর সোয়া পাঁচটার ট্রেনে…।
- দ্যাখো শশাঙ্ক, আমার হাতে সময় বড় কম।
- সময় বাড়তি থাকা মোটেও কাজের কথা নয় দাসগুপ্ত স্যর। হাতে অঢেল সময় থাকলেই চোদ্দ গণ্ডা আজেবাজে চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়; ঘুম কমে আসে, হজমে গোলমাল…।
- আর বাড়তি কথাও ভারী অপছন্দ।
- বাড়তি ব্যাপারটা অবশ্য রিলেটিভ বুঝলেন স্যার। আমার মেজকাকা “অল্প ভাত” বলতে যে পরিমাণ বোঝাতেন তা দিয়ে তিনজনকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো যায়। আবার কাটোয়ার পিসেমশায়ের কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার মানে অনলি চারটে লুচি আর হাফবাটি ছোলার ডাল। ভাবতে পারেন?
- হুহ্‌।
- অবিশ্বাস করছেন? চলুন না একদিন কাটোয়া। দেখবেন পিসেমশাই কেমন...।
- শশাঙ্ক…বুড়ো বয়সে এসে ধৈর্যটা একটু কমেছে। আমি বরং সোজা কাজের কথায় আসি।
- বেশ, বেশ। সেই ভালো।
- তুমি জানো আমি তোমায় কেন ডেকেছি?
- ডেমোক্রেসির মধ্যে বাস করে এটুকু জানবো না স্যর? আর না জানলে এদ্দূর ছুটে আসবই বা কেন।
- তবু, তোমার জানার বহরটা একটু জেনে নিই।
- টুয়েন্টি টুয়েন্টিজের অন্ধকারে তো আর আমরা পড়ে নেই দাসগুপ্ত স্যর। সে যুগের চরম অব্যবস্থা এখন আবছা ইতিহাস বললেই চলে। আর তাছাড়া আমাদের গভর্নমেন্টের নতুন আইনে এখন প্রতিটি আয়করদাতা নিজেই ঠিক করে নিতে পারবেন যে তাঁদের দেওয়া আয়কর ঠিক কোন খাতে ব্যবহৃত হবে। হোয়াট আ ব্রেকথ্রু। আইনটা যদিও নতুন, তবে বেশ ইন্ট্রিগিং, তাই না স্যর? আমার কিন্তু দারুণ লেগেছে; এই আইনের জোরেই হয়ত আমি একটা সুযোগ পেয়ে যাব। আহ! কী এক্সাইটিং। আচ্ছা স্যর, টুয়েন্টি টুয়েন্টিজ তো আপনি দেখেছেন। তখন ট্যাক্সপেয়ারদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত, তাই না?
- প্রতিনিয়ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় আগুন জ্বলত এই সামান্য বিষয়টা নিয়ে। অমুকে নিজের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় রাস্তা মেরামত করতে চায় তো তমুকে তা দিয়ে তাজমহল রং করাতে চায়। কেউ রসগোল্লায় সাবসিডি চায় তো কেউ সাবসিডি চায় অক্সিজেন সিলিন্ডারে। আর সেই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লাঠালাঠি। রাস্তাঘাটেও যে রক্তপাত ঘটত না তা নয়।
- শুনে মনে হচ্ছে রীতিমত রুল অফ জাঙ্গল। যাক, সে দুঃসময় তাহলে কেটেছে বলুন। এখন প্রতিটি ট্যাক্সপেয়ার ঠিক করে নিতে পারবে তাঁর দেওয়া ট্যাক্স দিয়ে সে তাজমহল রং করাবে না সস্তায় রসগোল্লা বিলি করবে। ব্রিলিয়ান্ট। হোয়াট আ টাইম টু বি অ্যালাইভ স্যার।
- কাজেই বুঝতেই পারছ আমি তোমায় কেন ডেকেছি।
- বুঝিনি আবার? নিশ্চয়ই বুঝেছি স্যর। দেশের সেরা চারটে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছি আমি, অবশ্য এন্ট্রান্স পরীক্ষা যা দিয়েছিলাম; সুযোগ না পাওয়াটাই আশ্চর্যের ব্যাপার হত। কিন্তু সুযোগ পেয়ে সমস্যা। বাড়ির যা অবস্থা, তাতে নিজেদের বিক্রি করেও অত দামী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে আমি পারব না। তবে আপনি বিশাল অঙ্কের ট্যাক্স জমা করেন, তার সামান্য অংশ পেলেই…।
- পেলেই?
- পেলেই? একটা অন্য জীবন দাশগুপ্ত স্যর। বাস স্ট্যান্ডে চা বিক্রি করে আর জিন্দেগি গুজরান করতে হবে না। কদিন পর একটা ভালো চাকরী, বাপ মায়ের চিন্তা তাতে অনেকটা দূর হবে। আর আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি স্যর, আপনার দেওয়া সুযোগের মান আমি রাখব। আমি যখন চাকরী পাব; আমার ট্যাক্সের টাকায় অন্তত তিনজনকে সহায় সম্বলহীন ছাত্রকে পড়াব। কথা দিচ্ছি স্যর। এইভাবে এক থেকে তিন, তিন থেকে নয়…।
- রিল্যাক্স শশাঙ্ক, রিল্যাক্স।
- ওই একটু…।
- এক্সাইটেড হয়ে গেছিলে আর কী। তবে অস্বাভাবিক নয়। দীপঙ্করও হয়েছিল; এভাবেই সেও উত্তেজিত হয়েছিল। সেও তোমার মত দেশের সেরা চারটে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল কিনা।
- ওহ, তাহলে তো আপনি আমায় আরো ভালো ভাবে বুঝবেন স্যর।
- সত্যিই বুঝি।
- তা আপনার ছেলে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল?
- একটাতেও না।
- ও মা, এই যে বললেন সেও ভীষণ খুশি হয়েছিল এ সুযোগ পেয়ে। আর আপনার তো…আপনার তো…।
- না, টাকাপয়সার অভাব আমার নেই। তখনও ছিল না। কিন্তু তাকে ভর্তি হতে দিইনি।
- দেননি?
- ও ইতিহাস নিয়ে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম ও ফিজিক্স নিয়ে পড়ুক। মেধা ওঁর কিন্তু পড়বার খরচটা যেহেতু আমার যোগানোর কথা; তাই আমার নিদান অমান্য করার উপায় তার ছিল না।
- কিন্তু তাই বলে…।
- আমার অনুতাপ হয় শশাঙ্ক। অনুতাপ হয়। আমি অমন ভাবে গোঁ না ধরলে দীপঙ্করের এ দশা হত না।
- আমি…আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না স্যর।
- দীপঙ্কর আমার কথার অমান্য করতে পারেনি। হি ওয়াজ আ গুড বয় আফটার অল। একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে প্রচুর টাকা দিয়ে আমি ওকে ফিজিক্স স্ট্রিমে ভর্তি করি। টাকা বেশি দিতে হয় কারণ ফিজিক্সের এন্ট্র্যান্স ক্লিয়ার করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। বছরখানেক সে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করেছিল…কিন্তু…।
- কিন্তু? কিন্তু কী?
- কমপ্লিট মেন্টাল ব্রেকডাউন। সাইনগুলো ধরার মত সেনসিটিভিটি বা সময় আমার ছিলনা তখন শশাঙ্ক। দীপঙ্কর সাসটেন করতে পারল না। আমার মা-মরা ছেলেটা এখন পাগল। সম্পূর্ণ পাগল। আর সে জন্য দায়ী শুধু আমি…।
- আমি সত্যিই দুঃখিত স্যর। আমি শুধু এটাই বলতে চাই, আপনি যে আপনার দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় আমার ইউনিভার্সিটিতে পড়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন; তা আমি কোনোদিনও ভুলব না। জানপ্রাণ দিয়ে পড়াশোনা করব, শুধু কেরিয়ারের কথা ভেবে নয়, শুধু আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় নয়; দীপঙ্করের কথা ভেবে।
- থ্যাঙ্ক ইউ শশাঙ্ক। আমি চাই তুমি দীপঙ্করের কথা ভাবো। সে কারণেই আমার তোমায় ডাকা। ট্যাক্স খরচের কথা ভেবেই তোমায় আমি ডেকেছি। তবে শশাঙ্ক, তোমায় ইউনিভার্সিটিতে পড়াবার অভিপ্রায় আমার নেই।
- আমি ঠিক বুঝলাম না স্যর।
- দীপঙ্করের প্রতি আমি যে অন্যায় করেছি, স্রেফ কয়েকজন ছাত্রের পড়ার ব্যবস্থা করে সে পাপস্খলনের সম্ভাবনাই নেই।
- দাসগুপ্ত স্যর, তাহলে আপনি আমায় ডেকেছেন কেন?
- আমার ভুল যাতে অন্য কেউ না করে, আর একটা দীপঙ্করও যাতে নষ্ট না হয়; তার জন্য গোটা দেশে বার্তা পৌঁছে দেওয়া দরকার। প্রতিটা মানুষের মধ্যে ইন্সপিরেশন পৌঁছে দিতে হবে, বুঝেছ? টু ঈচ অ্যান্ড এভ্রি পার্সন। আর সামান্য কিছু ছাত্রের পড়ার ব্যবস্থা করে সেই ইন্সপিরেশন তৈরি করে অসম্ভব।
- কীসে আসবে ইন্সপিরেশন? আদৌ আসবে কী?
- অবশ্যই আসবে। আমি আনব সেই ইন্সপিরেশন। আমি আমার ট্যাক্সের টাকায় একটা বিশাল মূর্তি তৈরী করব…।
- মূ…মূর্তি?
- বিশাল…বিশাল…যার পাশে মনুমেন্টকেও পোস্টবাক্সের মত মনে হবে, যার রোয়াবের পাশে দেশপ্রিয় পার্কের পুজোর প্যান্ডেলও ফিকে পান দোকানের মত দেখাবে। অমন মূর্তি ছাড়া এ দেশে এমন তাবড় ইন্সপিরেশন আসবে না হে শশাঙ্ক। আসবে না আসতে পারে না।
- কিন্তু…কিন্তু কার মূর্তি গড়াবেন?
- তোমার শশাঙ্ক। তোমার মূর্তি। একজন সুযোগ্য ছাত্র যে স্রেফ সুযোগের অভাবে উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে; স্রেফ সিস্টেমে পেষাই হয়ে যার সমস্ত কোয়ালিটি দুমড়েমুচড়ে গেছে; তার করুণ মুখ সবার চেনা উচিৎ। প্রতিটি করদাতা তোমার সেই এভারেস্ট লেভেল মূর্তির কথা ভেবে নিজের ট্যাক্সের টাকা এগিয়ে দেবে শিক্ষার দিকে। তুমি শশাঙ্ক, ইউ উইল ব্রিং দ্য চেঞ্জ। আই মীন, ইয়োর স্ট্যাচু উইল ব্রিং দ্য চেঞ্জ। ম্যামথ, গ্র্যান্ড, ইনক্রেডিবল স্ট্যাচু অফ শশাঙ্ক সাহা।
-ও কী! আপনার হাতে পিস্তল কেন? আপনি কি পাগল হলেন নাকি?
- অন দ্য কন্ট্রারি, আমি ভীষণ ভাবে সুস্থ শশাঙ্ক। এ প্ল্যানও নিখুঁত। জ্যান্ত মানুষের গায়ে ঠিক শহিদ গন্ধ সেঁটে দেওয়া যায় না হে। যায় না। আর শহিদ না হলে ওই মূর্তিটা গ্র্যান্ড হয়ে উঠবে কী করে বলতে পারো?