Saturday, January 26, 2019

লস্ট বয় অফ সুদান


এ বই ছাব্বিশে জানুয়ারি পড়া শেষ হল, সে'টা একটা উপরি পাওনা।

১৯৯০। দক্ষিণ সুদানের এক প্রত্যন্ত গ্রাম; কিমটং।  বিজলিবাতি বা গাড়িঘোড়া বা স্কুল সে গ্রামে ছিল না; শুধু এ'টুকু বললে সে গাঁয়ের অন্ধকার সঠিকভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। আসলে আমি কোনো কিছু বললেই সে পৃথিবীর যন্ত্রণাগুলো যথাযথ ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারব না। তার জন্য লোপেজের আত্মজীবনী 'রানিং ফর মাই লাইফ' পড়া ছাড়া গতি নেই।

ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে তখন সুদান তছনছ; লোপেপে (ভালো নাম; লোপেজ লোমং)  নামে ছ'বছরের এক শিশু কিমটং গ্রামের গীর্জা থেকে অপহৃত হয়। লোপেপে একা নয়, প্রতিদিন বহুসংখ্যক শিশুদের তুলে নিয়ে যেত যুযুধান সেনারা। যে পাশবিক পরিস্থিতিতে সেই অপহৃত শিশু ও কিশোরদের রাখা হত, তা'তে অনেকেই মারা যেত অত্যাচার ও অনাহার সহ্য করতে না পেরে। যাদের মধ্যে বেঁচে থাকার দুঃসাহস ও অমানবিক তাগদ থাকত; তাদের জোর করে ভর্তি করা হত সৈন্য হিসেবে। উইকিপিডিয়ায় 'লস্ট বয়েজ অফ সুদান' সার্চ করলে সে বিষয়ে কিছুটা জানা যায়। বাপ-মায়ের কোল থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল লোপেপেকে। তখন সে দুধের শিশু, বন্দী অবস্থার অকথ্য অত্যাচার সহ্য করে তার বেঁচে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু বরাত জোরে সে পালিয়ে বাঁচে।

লোপেপে সীমানা পেরিয়ে এসে পৌঁছয় কেনিয়ার কাকুমা রিফিউজি শিবিরে। সে'খানে দশ বছর কাটায় লোপেপে। এই দশ বছরের যে বর্ণনা বইতে রেখেছেন লোপেজ লোমং, তা পড়ে শিউরে উঠতে হয়।  যুদ্ধবিধ্বস্ত আফ্রিকার যে ভয়াবহ ছবি তুলে ধরেছেন লোপেপে, তা যে কোনো পাঠককে বাধ্য করবে খাবারের প্রতিটি কণাকে বা সাধারণ প্যারাসেটামলের মত ওষুধকে অন্য মাত্রার সমীহ করতে। কেনিয়ার সেই শরণার্থী শিবিরে লোপেপেদের দিনে একবারের বেশি খাওয়া জুটত না, তাও আধপেটা। রিফিউজি, তাই শিবিরের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করার অনুমতিও ছিল না তাঁদের। হপ্তায় একদিন তাঁরা দিনে দ্বিতীয় বারের জন্য খেতে পারত; কারণ সে'দিন শিবির সংলগ্ন ময়লার স্তুপে কাকুমার অন্য প্রান্ত থেকে উচ্ছিষ্ট,ফেলে দেওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার এনে ফেলা হত। সেই ময়লার স্তুপেও চলত কাড়াকাড়ি, হাতাহাতি।  আর পাশাপাশি ছিল মৃত্যু; লোকজনের মরে যাওয়াটা প্রায় এলেবেলে পর্যায়ের একটা ব্যাপার ছিল। বইয়ের প্রথম অংশ লোপেপের সেই সংগ্রামের; অবশ্য সে সময় বেঁচে থাকা ব্যাপারটাই লোপেপের কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদের মত ছিল। সে ধরেই নিয়েছিল বাপ মায়ের দেখা আর সে পাবে না। আর তার সমস্ত যন্ত্রণার মলম বলতে ছিল তিনটে ব্যাপার; ঈশ্বরে আস্থা, দৌড় আর ফুটবল।

বইয়ের পরের অধ্যায় লোপেপের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ছুটে যাওয়া নিয়ে। লোপেপে প্রথম অলিম্পিকের কথা শোনে পনেরো বছর বয়সে, প্রথম পাউরুটি চেখে দেখার সুযোগ পায় তারও পরে; যখন ভাগ্যের দুরন্ত মোচড়ে সে আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ পায়। আমার খানিকটা মনে আছে প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সময় লালমোহনের উচ্ছ্বাস। লোপেজ 'লোপেপে' লোমং; ষোলো বছর বয়সে বহু কাঞ্চনজঙ্ঘা উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে শুরু করে যখন সে প্রথম জানতে পারে পেট ভরে যাওয়া বলে একটা ব্যাপার থাকে, বাথরুম বলে একটা ব্যাপার আছে, আছে পরিষ্কার কাপরজামা পরার একটা নিশ্চিন্দি। লোপেপের চোখ দিয়ে চারপাশের সাধারণ জিনিসগুলো দেখতে শুরু করলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। গত দু'দিন ধরে চানাচুরের একটা দানা প্লেটের বাইরে পড়লে লজ্জা হচ্ছে।এই লজ্জাটা শৌখিন এবং সাময়িক, সে'টাও স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।

বইয়ের বাকি অংশ জুড়ে 'ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা' আর ফেলে আসা মাটির টান। লোপেপের লেখায় একটা সরল প্রশ্ন বার বার উঠে এসেছে; জন্মসূত্রে পাওয়া পদবীর মতই, জন্মসূত্রে পাওয়া নাগরিকত্বের প্রতি আনুগত্যই দেশাত্মবোধের শেষ কথা হতে যাবে কেন? লোপেপের জীবন ও বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ ভাবে পালটে যায় এক আমেরিকান দম্পতির স্নেহে; আমেরিকায়। লোপেপেও আমেরিকাকে ভালোবাসতে কসুর করেনি; আমেরিকাকে ততটাই আপন করে নিয়েছে যতটা একজন সাতপুরুষ পুরনো মার্কিনীর পক্ষে সম্ভব। লোপেপে যেমন আমেরিকার ছত্রছায়ায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে, হয়ে উঠেছে সে দেশের অন্যতম সেরা ট্র‍্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলিট এবং বেজিং অলিম্পিকে মার্কিন পতাকাবাহক; আমেরিকাও ততটাই সমৃদ্ধ হয়েছে লোপেজ লোমংয়ের মত সুনাগরিক পেয়ে। নিজের পিতৃপরিচয়ের মতই, জন্মভূমি বেছে জন্ম নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু নিজের পছন্দসই দেশ বেছে নেওয়ার পথটা সরল নয় কেন? লোপেজ পেরেছেন, বেশিরভাগ 'লস্ট বয়েজ অফ সুদান' পারেনি।

লোপেজ নিজের ফেলে আসা জগতকে মনে রেখেছেন, স্মৃতি আগলে রেখেছেন; বার বার ফিরে গেছেন। দেখেছেন যুদ্ধ থামলেও সে'খানকার অবিশ্বাস্য অন্ধকার ফিকে হয়নি এতটুকু। সে'খানে আজও সামান্য পেনিসিলিনের অভাবে শয়ে শয়ে শিশু মারা যাচ্ছে, আজও স্কুল নেই। আশা নেই, স্বপ্নও নেই। নিজের জন্মভূমিতে সেই আশা ও স্বপ্ন পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছের কথা লিখেছেন লোপেজ, আর লিখেছেন আমেরিকার প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা। লোপেজের মত কিছু নিবেদিতপ্রাণ নাগরিক পেলে যে'কোনো দেশে বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে যাবেই। এ বই পড়ে মনে হয়, একদিন সমস্ত দেশের ইমিগ্রেশন পলিসি ঢেলে সাজানো হবে। একটা ফুটবল টীমের স্কাউটরা যে'ভাবে গোটা দুনিয়া চষে বেড়াতে পারে ভালো খেলোয়ার 'রিক্রুট' করতে, একটা দেশ আদর্শ নাগরিকদের খোঁজ করবে না কেন?

সবশেষে দু'টো কথা বলা দরকার।

এক, লোপেজের ঈশ্বর-বিশ্বাস। পাঠক নিজে ঈশ্বর-অবিশ্বাসী হতেই পারেন, কিন্তু লোপেজের ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করা অসম্ভব।  মাঝেমধ্যে মনে হবে লোপেজ যেন দাদার কীর্তির কেদার আর ঈশ্বর হলেন ভোম্বলদা; মাঝেমধ্যে ফাঁপরে ফেললেও, উতরে তিনিই দেবেন।

দুই, অলিম্পিকে মেডেল জেতা হয়নি লোপেজের। তবে হেরে যাওয়া রেসের শেষে গেয়েছিলেন আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত, তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন খেলা দেখতে আসা প্রচুর মার্কিনী দর্শক। এই অভিজ্ঞতার কথাটা লোপেজের ভাষায় পড়া দরকার। (প্রসঙ্গত, আজ দেখলাম দীপা কর্মকারের বই বেরিয়েছে, দেখা যাক)।

'হেরে যাওয়া রেস' বললাম কি? লোপেপে হেরে যাওয়ার বান্দাই নন।

No comments: