হারারিদার লেখা পড়া মানে মগজকে সমুদ্রস্নান করিয়ে আনা। বই শেষ করার পর কিছুদিন অন্তত হারারি-মোডে সমস্ত কথাবার্তা,থিওরি,খবরকে অ্যানালাইজ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সে ব্যাপারটা রীতিমত আননার্ভিং। এক বন্ধুর রেকমন্ডেশনে বছরখানেক আগে পড়েছিলাম সেপিয়েন্স। গত বছরের শেষে পড়েছি 'হোমো ডেউস' আর এ বছরের শুরুতে 'টুয়েন্টি ওয়ান লেসনস ফর দি টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি'। এ দু'টো বই পরপর পড়ে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
হারারি থরেথরে কনসেপ্ট সাজিয়ে দেওয়ার লোক নন; কাজেই মুখে'উরিব্বাস' অথচ মনের মধ্যে অসহায় 'এ বই শেষ হচ্ছেনা' গোছের হাঁসফাঁস থাকার সম্ভাবনা নেই। ভদ্রলোক সম্ভবত চেয়েছেন তাঁর পাঠক অবজেক্টিভ আর সাব্জেক্টিভের তফাৎগুলো স্পষ্টভাবে চিনতে শিখবেন; অন্তত চেষ্টা করবেন। অসুবিধে হচ্ছে আমরা প্রায়শই ভেবে থাকি সাব্জেক্টিভ আর অব্জেক্টিভের তফাৎ কী এমন হাতিঘোড়াডাইনোসোর; আমরা দিব্যি বুঝি। কিন্তু হারারিদা এই কনফিডেন্সের কলার নাচিয়ে ডিগবাজি খাওয়াতে ওস্তাদ। ব্যাপারটা কিন্তু নেহাত মজার নয়; কত কিছু নিয়ে আজীবন নিশ্চিন্তে ছিলাম, হারারিদা গোলমাল পাকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
এই যেমন রাজস্থানের কোনো নেতা বললেন 'সবার আগে আমার জাত, তারপর অন্যকিছু'। এ'টা শুনে আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগল; খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। আবার 'সবার আগে আমার দেশ, তারপর অন্যকিছু'; এ'টা শুনলে বেশ লাগে। কিন্তু দু'টোর মধ্যে কি আদৌ কোনো মিল নেই? তফাৎ থাকলে কোথায় আছে? হারারিদা এই সন্দেহগুলো বিশ্রীভাবে ইঞ্জেক্ট করেছেন। লিবারেলরা আদৌ কতটা লিবেরাল? প্রাইভেসি কি সত্যিই দরকারি? নাকি গুগলকে নিজের সমস্ত হাঁড়ির খবর বিলিয়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ যাতে গুগলের এআই আমায় আগাম বলে দিতে পারে কে আমার আদর্শ বন্ধু হতে পারে বা ভবিষ্যতে আমার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা? সন্ত্রাসবাদ কি আজকের দিনে আদৌ তেমন দুশ্চিন্তার কারণ নাকি আমরা বাতিকগ্রস্ত; পরিসংখ্যান কী বলছে?
বিভিন্ন গল্পে, আলোচোনায়, থিওরির ডিসেকশনে; মোদ্দা কথাটায় বার বার ফিরে গেছেন হারারিদা - সাব্জেক্টিভ আর অব্জেক্টিভের ফারাকটা প্রত্যক্ষ করে আমরা সঠিক প্রশ্নগুলো করতে পারছি কিনা।
তবে একটা হারারিদার একটা থিওরির কথা উল্লেখ করতেই এতটা গল্প ফাঁদা। ভদ্রলোক বলছেন সমস্যা কোনো ইজমে নয়, সমস্যাটা সেই ইজম-বাদীদের অনমনীয় একরোখা বিশ্বাসে। অর্থাৎ আপনি অমুক-ইজমে আস্থা রাখতেই পারেন, কিন্তু আপনার সে আস্থাকে তখনই সিরিয়াসলি নেওয়ার প্রশ্ন আসবে যখন আপনি স্পষ্টভাবে বলতে পারবেন অমুক-ইজমের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলোর সম্বন্ধে। কাজেই আপনার বিজেপি-কংগ্রেস-তৃণমূল-সিপিএম সমর্থনকে তখনই সিরিয়াসলি নেওয়া যেতে পারে যখন আপনি আপনার প্রিয় রাজনৈতিক দলের কুপ্রভাব সম্বন্ধে দিব্যি একটা মনোগ্রাহী লেকচার দিতে পারবেন। হিন্দুত্ববাদী হতে পারেন, ইসলামপন্থী হতে পারেন, সেকিউলার হলেও আপত্তির কিছু নেই; কিন্তু ওই, আপনাকে স্পষ্টভাবে জানতে হবে আপনার স্টান্সের গড়বড়ে দিকগুলোর সম্বন্ধে।
আর নিজের মতামতের গড়বড়গুলো ঘেঁটে দেখা যে কী অস্বস্তিকর ভাই, কী বলব।
No comments:
Post a Comment