Sunday, February 3, 2019

বইমেলায় গুমখুন


- দত্তবাবু, কলকাতা বইমেলার স্টল সংখ্যা তিনশো চোদ্দ দশমিক এক পাঁচে আপনাকে স্বাগত জানাই।

- স্টল নাম্বার কত?

- তিনশো চোদ্দ দশমিক এক পাঁচ।

- জব্বর গোলমাল পাকিয়েছে দেখছি গিল্ড! ডেসিমালে স্টল নম্বর!

- আপনি বইয়ের জন্য এসেছেন না স্টল নম্বরের জন্য?

- দাঁড়ান দাঁড়ান, তিনশো চোদ্দ থেকে বেরিয়ে তিনশো পনেরো নম্বর স্টলে ঢুকতে যাবো। তিনশো চোদ্দ থেকে বেরোতেই সামান্য হোঁচট খেলাম, আর তারপরেই এই...।

- স্টলে এসে পড়লেন, স্বাভাবিক।  তিনশো চোদ্দ আর তিনশো পনেরোর মাঝখানে ঢুকতে হলে হোঁচট খেতেই হবে।

- ভোজবাজি দেখছি।

- এ'বারে বইগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখুন দত্তবাবু। এসেই যখন পড়েছেন..।

- আপনাদের এ'টা কোন পাবলিকেশন?

- গুমখুন প্রকাশনী।

- সর্বনাশ! এ'টা কোনো নাম হল?

- বইয়ের স্টলের নম্বর আর প্রকাশনার নামগুলোই সব নয় দত্তবাবু, বইয়ের জন্য বইমেলায় আসা। বই দেখুন।

- এক মিনিট, আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?

- আপনিও আমায় চেনেন। অমনোযোগী না হলে দিব্যি চিনতে পারতেন।

- কে আপনি?

- কত টালবাহানা আপনার মশাই। স্টলের নম্বর নাপসন্দ। প্রকাশনার নাম শুনে বিরক্তি। স্টলে বসে থাকা মানুষকে নিয়ে খুঁতখুঁত। বইমেলায় এসে বই ছাড়া সব নিয়েই আপনার আদেখলাপনা রয়েছে দেখছি। বইগুলো মন দিয়ে দেখুন নয়ত...।

- ও কী!  রিভলভার! আপনি উন্মাদ দেখছি।

- সামনের বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখুন। নয়ত ট্রিগার সামলে চলার লোক আমি নই...। রোববার বিকেলে বইমেলায় আকচার খুন হচ্ছে, আপনি টের না পেলেও হচ্ছে। আজ আপনি হবেন।

- প্লীজ, এই পাগলামো বন্ধ করুন। বন্দুক নামান। আমি বই দেখছি।

- গুডবয়। ক্যুইক।

- এ কী! এ তো গুমখুন প্রকাশনীর বই নয়; এ'টা যে আনন্দর বই। সুনীলের নভেল। আর.. আরে...এ যে ছোটমামার উপহার দেওয়া বইটাই..ওই কপিটাই...বছর বারো আগে আমার জন্মদিনে..আর এ'টা নারায়ণ সান্যাল, দে'জের বই। আমার বন্ধু শ্যামলের দেওয়া, "চট করে পড়ে ফেল দেখি' বলে সই করেছে। এই যে বুদ্ধদেব গুহর প্রেমের গল্প; সর্বনাশ। মিতুলের দেওয়া। তখনও আমাদের সম্পর্ক ভাঙেনি। এই যে গোলাপি কালিতে ও দু'কলম লিখে দিয়েছিল...। কিন্তু এই বইগুলো এ'খানে কী ভাবে?

- এ'রকম বহু বই এখানে যাচ্ছে। আপনার না পড়া সমস্ত বই। আপনার হারানো যত বই, অযত্ন ফেলে রাখা কত বই। স্নেহের মানুষদের থেকে উপহার পাওয়া না পড়া বই। সে'সব জড়ো করেই এই স্টল। সংগ্রহটা চমৎকার দত্তবাবু।

- বই না পড়ে ফেলে রাখা মানে গুমখুন?

- না, অত কাব্যিক এ নাম নয়। গুমখুন আপনি আজ হবেন, সে জন্যই আপনাকে এ'খানে টেনে আনা। সে জন্যেই এই প্রকাশনী।  তার আগে ভালো করে ভেবে বলুন দেখি দত্তবাবু; আমায় এখনও চিনতে পারছেন না?

- আপনার মুখটা দিব্যি চেনা ঠেকছে...।

- নিজের মুখ চেনা ঠেকবে সে'টাই স্বাভাবিক।

- আপনি আর আমি.. আমি আর আপনি...?

- এক। কিন্তু এক নই!  আমি পাঠক। বইয়ের এ মলাট থেকে ও মলাট ঘুরে বেড়ানো পথিক। আপনার মত ঘরকুনো কনসিউমারিস্ট বই কিনিয়ের সঙ্গে আমার তুলনা চলে না। এই গুমখুন স্টলে বহু বছর নষ্ট হয়েছে। আর নয়, এ'বারে আমার মুক্তি আর তার জন্য আপনাকে খুন হতেই হবে...।

- ও কী! রিভলভার নীচে নামান...ও কী! থামুন!

- গুডবাই বইখুনি দত্তবাবু!

*দ্রুম দ্রুম দ্রুম*

চোখে মুখে জলের ঝাপটা পড়তে জ্ঞান ফিরল দত্তবাবুর। বইমেলায় তিনশো চোদ্দ নম্বর স্টলের বাইরে হোঁচট খেয়ে পড়ে কিছুক্ষণের জন্য চারপাশে অন্ধকার দেখেছিলেন তিনি। দৃষ্টির ঝাপসা কেটে যাওয়ার পর দেখলেন তাকে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা। আশাপাশে লোকজনকে ধন্যবাদ দিয়ে দ্রুত মেলা ছেড়ে বেরিয়ে এলেন ভদ্রলোক।

তিনশো চোদ্দ আর তিনশো পনেরো নম্বর স্টলের মাঝে যে লাশটা সবার অগোচরে পড়ে রইলো, তার প্রতি বিন্দু মাত্র অনুকম্পা অনুভব করতে পারলেন না তিনি৷ বইমেলা থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি না ধরা পর্যন্ত স্বস্তি নেই; বাড়ির বইয়ের আলমারিটা ততক্ষণে নিশির মত ডাকতে শুরু করেছে।

1 comment:

তন্ময় চট্টোপাধ্যায় said...

ভয় পেয়ে গেলাম! রিভলভার লাগবে না, সত্যি অনেক না পড়া বই এবার পড়ে ফেলব