বিপিন সান্যাল একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে মৌরির কণা বের করার চেষ্টা করছিলেন। চোখ বুজে, গা এলিয়ে; যতটা মন দিয়ে করা সম্ভব আর কী। মানকরের মত ছোট্ট শহর হলে যা হয় আর কী; দুপুরের সময়টা দোকানে খদ্দেরদের আসা-যাওয়া তেমন থাকে না, ক্যাশকাউন্টারে বসে একটু গা এলিয়ে নেওয়ার এ'টাই প্রশস্ত সময়। দাঁত খোঁচানোয় বিঘ্ন ঘটল 'আপনিই বিপিনবাবু? এই সান্যাল মেটাল ট্রেডার্সের মালিক?" ডাকে।
জলদগম্ভীর পুরুষকণ্ঠ। নাম ধরে ডেকেছে কাজেই খদ্দের সম্ভবত নয়। বিপিনবাবু চোখ মেলতে দেখলেন গেরুয়া আলখাল্লা পরা একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক, দাড়িগোঁফে মুখ ঢাকা। সন্ন্যাসী গোছের কেউ, তবে ভিখিরি নিশ্চয়ই নয়; বাঁ হাতের কবজিতে যে ঘড়ি তার ব্যান্ড দেখে মনে হয় বেশ দামী।
- আপনিই বিপিনবাবু?
- আমিই। কী ব্যাপার?
- আজ্ঞে আমার নাম স্বরূপানন্দ।আমি জসিডি থেকে আসছি।
- জসিডি থেকে এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে?
- আজ্ঞে হ্যাঁ। বসতে পারি?
- বসুন। তা, আমার এই লোহালক্কড়ের দোকানে কী মনে করে স্বরূপানন্দজী?
- হ্যাঁ, সোজা সে ব্যাপারটা নিয়েই বলি। গত পরশু জসিডি থেকে এক ট্রাক লোহালক্কড় আপনার কাছে এসে পৌঁছয়।
- লোহালক্কড় বলতে স্ক্র্যাপ। ও'টাই আমার ব্যবসা। ঝাড়খণ্ডে আমার এজেন্ট দীনদয়াল, সেই ও'সব সংগ্রহ করে পাঠিয়েছে।
- জানি। খুলে বলি, সেই সব লোহার মধ্যে একটা পেতলের প্রদীপ এসে পড়েছে।
- গতকাল মালপত্তর ঝাড়াইবাছাইয়ের সময় পেতলের কিছু জিনিসপাতি পাওয়া গেছে বটে, একটা প্রদীপও ছিল হয়ত। কিন্তু সে ভাঙাচোরা পুরনো সব মাল। তার জন্য আপনি অদ্দূর থেকে..।
- ও প্রদীপ আমার দরকার। খুব জরুরী। আমি উপযুক্ত দাম দিতেও রাজী আছি...।
- আমার গুদামের এক কোণে পড়ে আছে হয়ত..কিন্তু ফালতু জিনিস মশাই। তাছাড়া ছোটেলালটাকে দেখছি না কাল বিকেল থেকে। সে না থাকলে গুদামে কিছু খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
- ছোটেলাল?
- ওই, আমার ফাইফরমাশ খাটে। আর গুদাম সামলায়। ছোকরা কাজেকর্মে ভালো, শুধু একটু নেশাভাং করে। অবিশ্যি ভালো বাউল গানও গায়, শুনলে আপনার মনপ্রাণ ভরে যাবেই। কপাল বুঝলেন, কপালের ফের। নইলে কি আর শিল্পী মানুষকে লোহার স্ক্র্যাপের গুদামে কাজ করে দিন কাটাতে হয়? যাক গে, কাল বিকেল থেকে যে কোথায় গায়েব হল। আর সে না থাকলে ওই ছোট্ট প্রদীপ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
- আমি বোধ হয় জানি ছোটেলাল কোথায়। চলুন আপনার গোডাউনে। সময় নষ্ট করা যাবে না।
- আমার দোকান। আমার দোকানের গুদাম। আপনি বলার কে?
- দোকানঘর আর গুদাম থাকবে বটে, কিন্তু দোকানের মালপত্র আর লোকজন, সবই গায়েব হয়ে যাবে বিপিনবাবু। সময় নষ্ট করবেন না। ছোটেলালের ভরসা না করে আমায় নিয়ে চলুন, এখুনি।
- অ্যাই আপনি কি ভণ্ড সাধু নাকি? কী ভেবেছেনটা কী? আমার দোকানে এসে আমায় বিঁধবেন? ছোটেলাল না ফিরলে গুদাম খোলা হবে না।
- আমার ধারণা ছোটেলাল আর ফিরবে না। প্রদীপ একবার কাউকে গিলে ফেললে আর তার নিস্তার নেই। মানুষ জিনিসপত্র জন্তুজানোয়ার; কিছুতেই সে প্রদীপের অরুচি নেই। পারলে গোটা দুনিয়াটাই...। একমাত্র আমিই পারি তাকে আটকাতে...।
***
স্বরূপানন্দকে নিয়ে গুদামে পৌঁছে বিপিনবাবুর ভির্মি খাওয়ার যোগাড় হল, গোটা গুদামঘর ফাঁকা। এক কণা লোহাও কোথাও নেই। শুধু এক কোণে পড়ে আছে পুরনো তোবড়ানো প্রদীপখানা; তার গায়ে বাহারী নক্সা। আর প্রদীপের কাছেই যে কালো সুতোয় ঝোলানো মাদুলিটা পড়ে আছে, সে'টা যে ছোটেলালেরই তা বিলক্ষণ জানেন বিপিনবাবু। বিপিনবাবুকে দূরে দাঁড় করিয়ে প্রদীপের দিকে হেঁটে গেলেন স্বরূপানন্দ।
**
- কী ব্যাপার ভায়া আলাদীন, আজ এত সকাল সকাল তলব?
- জিনি, আমার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে লোহা জোগাড় করতে পারবে? শ্বশুরমশাইয়ের একটা মূর্তি বানাবো, কিন্তু এ দেশে লোহার যে বড় অভাব। এ'দিকে তাঁকে প্রজারা লৌহপুরুষ বলে সেলাম করত কিনা, তাই জেসমিনের বড় ইচ্ছে।
- জেসমিন বৌদিকে বলো আমি লোহা জোগাড় করে মূর্তি বানিয়ে এনে দিচ্ছি, চটপট। আর কোনো হুকুম?
- হুকুম না, তবে আমার বড় শখ হে জিনি...।
- আপনার শখ? আদেশ করুন।
- আমার বড় ইচ্ছে, নতুন দেশের নতুন ভাষার নতুন ধরনের সুরের গান শুনব। বড় ইচ্ছে।
- বেশ। তেমন একজন গায়ক এনে হাজির করছি। আপনার প্রাসাদেই সে থাকবে আর আপনার ইচ্ছেমত গান শোনাবে, অন্য দেশের অন্য ভাষার অন্য সময়ের গান। কেমন?
- বাহ্! আচ্ছা ভাই জিনি, যখন যা চাই, যাকে চাই; তা তুমি ও প্রদীপের মধ্যে থেকে বের করে আনো কী করে?
- ও'সব গোপন কথায় কাজ কী ভাই আলাদীন? তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি চট করে লোহা আর গায়ক নিয়ে আসি।
No comments:
Post a Comment