হাসান সাহেব,
এই আমায় শেষ চিঠি। চমকে উঠলেন? বাবুর্চি ইকবালকে আপনি আপনার ছেলের যাত্রাপথের সঙ্গী করে পাঠালেন তাঁর দেখভালের জন্য; হামদা শহরে এক হপ্তার কাটিয়ে, আপনার নয়নের মণি সরফরাজকে নিয়ে আমার ফিরে আসার কথা। অথচ এখন এই শেষ চিঠির বিশ্রী নাটক..কোনো মানে হয়?
হাসানসাহেব, মিথ্যেটুকু এইবেলা সাফ করে নেওয়াই ভালো। আমার হাতে সময় বড্ড কম; কাজেই বাহারে ভাষায় আটকে থাকলে হবে না। আমার আদত নাম ইকবাল নয়, আমি আরিফ আনসারি। আমার আদিবাড়িও নেয়ামতপুরে নয়, আমার কাগজপত্রগুলো ভুঁয়ো ছিল। হ্যাঁ, আমি আপনাদের ঠকিয়ে এই বাবুর্চির চাকরীটা নিয়েছিলাম; গত দু'বছর ধরে আপনার বিশ্বাস অর্জন করেছি প্রাণপণে খেটে।
লোকঠকানোর মত বিশ্রী পাপ আর হয়না, কিন্তু বিশ্বাস করুন; এ ছাড়া কোনো পথ আর আমার সামনে খোলা ছিল না। আপনাদের পাগলামোর জন্য আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, জানেন হাসান সাহেব? আপনি আর আপনার ছেলে সরফরাজ, আপনারা যে কত গরীব মানুষের সর্বনাশ করেছেন তাদের মাথায় ধর্মের নামে পাগলানো পুরে দিয়ে, তার ইয়ত্তা নেই। গোটা দেশ ধ্বংস না করলে আপনাদের শান্তি নেই। আপনাদের জঙ্গি সংগঠন ফুলেফেঁপে উঠছে আর বিপ্লবের ঝুটো জিগির তুলে মুনাফা লুঠছে আপনার ও আপনার পুত্রের মত কিছু ঘৃণ্য ব্যবসায়ী।
আপনার প্ল্যান করা জঙ্গিহানায় আজ থেকে তিন বছর আগে সেনাবাহিনীর বেয়াল্লিশজন সৈন্য মারা যায়; হামদা শহরে। সেই বেয়াল্লিশজনের মধ্যে একজন ছিল আমার আসিফ। তখন ওর বয়স মাত্র বাইশ, জানেন হাসানসাহেব? বাইশ। ঠিক আপনার ছেলে সরফরাজের বয়সী। জন্মের সময় মা হারানো অভাগাটাকে বড় কষ্টে মানুষ করেছিলাম হাসানসাহেব। বড় আদরে, সৎপথে। কত স্বপ্নকে কত সহজে আপনারা খুন করেছিলেন সে'দিন। কত সহজে।
আমার সরকারের হাত পা বাঁধা থাকতে পারে, বদলা নিতে হলে তাঁদের হাজারগণ্ডা জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু এ বুড়ো বাপের যে অত দায়ভার নেই; আমি স্রেফ প্রতিহিংসার জন্যে এ বাড়িতে এসেছিলাম হাসানসাহেব। আমার গলার তাবিজে লুকিয়ে এনেছিলাম অব্যর্থ বিষ। আপনাকে মারা অত্যন্ত সহজ ছিল, কিন্তু টপ করে মেরে ফেললে ঠিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা যেত না। আমি সরফরাজকে মারতে চেয়েছিলাম, মারতে চেয়েছিলাম হামদা শহরেই; যে'খানে আমার আসিফের দেহটাকে আপনাদের উন্মাদ জঙ্গিরা টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল।
অবশেষে সুযোগ এলো। আজ খুব সহজেই পোলাওতে মিশিয়ে ফেললাম সে বিষ। সরফরাজ কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ফেরার কথা। ফিরেই ডিনারে বসবে, পোলাওটা তারই ফরমায়েশে রেঁধেছি।
তবে ছোট একটা গোলমাল ঘটেছে। সরফরাজের তিন বছরের মেয়েটার কথা খুব মনে পড়ছে গো হাসানসাহেব। তারও মা নেই, আমার আসিফের মতই অভাগী সে। দিনে অন্তত দশবার ইকবাল চাচার কাছে গল্প না শুনলে মুন্নির চলে না। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার মুখ। আর কী জানেন, আমার আসিফ যেমন সরফরাজের মত খুনি নয়, আসিফের বাপই বা সরফরাজের বাপের মত ইতর হতে যাবে কেন?
দেশে কত মানুষ না খেতে পেয়ে ঘুমোতে যায়; এ পোলাওকে নষ্ট আমি হতে দেব না। শুধু চিঠিটা লেখা জরুরী ছিল।
পারলে মুন্নির কানে অন্তত জঙ্গিবাদের মন্ত্র জপ করবেন না হাসানসাহেব, সে মন্ত্রের চেয়ে আমার পাতের এ পোলাওয়ে বিষ অনেক কম।
ইতি,
আরিফ।
No comments:
Post a Comment