প্রবল
দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে। আর মাঝেমধ্যেই মাথার মধ্যে ভাবনাচিন্তা উঁকি দিচ্ছে, সে’
ব্যাপারটা মোটে অভিপ্রেত নয়। অফিস যাওয়া, বাড়ি ফেরা, খাওয়াদাওয়া, হ্যাহ্যা,
নেটফ্লিক্স, সোফা, বই; এর বাইরে কোনো চিন্তা মগজে ঘোরাফেরা করলেই ভয় হয়; বখে
যাচ্ছি না তো?
এই
যেমন সকালে পরোটা আর আলুচচ্চড়ি চেবানোর সময় মোবাইলে দেখলাম সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম
কাশ্মীরীদের বয়কট করার দাবীতে। কোথাও আবার তাদের ওপর আক্রমণের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
এগুলো কি গুজব? হতে পারে; আজকাল অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে সুপ্রিম কোর্ট বা মা
মাথায় গাঁট্টা মেরে না বললে কোনো কিছুই মেনে নিতে মন সরে না। তবে এর সামান্য অংশও
যদি সত্যি হয় তা’হলে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে খুব গোলমেলে; অন্যায়ও বটে।
এতটুকু
ভেবেই পরোটা চেবানো থামালাম। মাথায় একটা চিন্তা এসেছে; কাজেই টুক করে সে’টা
সোশ্যাল মিডিয়াতে যদি না লিখি তবে সে চিন্তা ভূত হয়ে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাবে। সাতপাঁচ ভেবেই একটা হোয়্যাটস্যাপ গ্রুপে
লিখেছিলাম; খামোখা কাউকে পেটানো বা কেউ অমুক এলাকার মানুষ বলেই তাকে বয়কট করব –
ব্যাপারটা নেহাত সরেস নয়। আমি বাঙালি বলেই কেউ যখন আমায় আলসে বলে তখন গায়ে একটু
চিড়বিড় করে বইকি (ব্যক্তিগত লেভেলে আমি আলসে হতে পারি, তাই বলে ‘বাঙালি’ বলে খোঁটা
দেবে? স্যাট করে সোফা থেকে দু’টো সঞ্জীবের লাইন ছুঁড়ে প্রতিবাদ করব না?)।
হোয়্যাটস্যাপে
বন্ধুদের একটা গ্রুপে লিখে ফেললাম; “কাশ্মীরিদের গণ-বয়কট বা মারধোর করা অনুচিত”।
ট্যাং
করে এক বন্ধুর উত্তর এলো;
“দেশের
কথা ভাববি কেন রে? তোকে তো আগে সেকু ভাব দেখাতে হবে”।
দেশ,
সেকু এ’সব প্রসঙ্গ এসে পড়ায় নড়েচড়ে বসতে হল। দেড়খানা পরোটা প্লেটেই পড়ে রইল; আমি
হোয়্যাটস্যাপে মন দিলাম।
বললাম;
“দেশের
আবার কী হল। কাশ্মীরিদের দেখলেই রেগে উঠতে হবে কেন”?
ফটাশ
করে উত্তর এলো;
“তোকে
তো গিয়ে জঙ্গিদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হয় না! তুই এ’সব কথা বলতেই পারিস”।
মুখটা
বিস্বাদ হয়ে গেল; মিইয়ে গেল পরোটা, তিতকুটে হল চচ্চড়ি।
প্রমোশন
ইনক্রিমেন্ট নিয়ে রগড়ে থাকা ধান্দাবাজ চাকুরে মানুষ। কাশ্মীরিদের ভালোমন্দ নিয়ে
চিন্তা গেল গুবলেট হয়ে। ঝাঁপিয়ে পড়ে বললাম;
“আহ্,
এতে সেনা আর দেশের কথা এলো কেন। দেশের আমি, দশের আমি। আমি তো দেশের পক্ষেই রে ভাই।
শুধু বলছিলাম...”।
কিন্তু
ততক্ষণে ঘুড়ি সুতো ছিঁড়ে গেছে উড়ে আর লাটাই লটকে ছাতে।
“তুই
কী বলতে চেয়েছিস সে’টা আমি বুঝিনি ভাবছিস”?, হাড়হিম করা উত্তর।
“না
না, ও মা”, মনে হল আক্রমণের চেয়ে কাকুতিমিনতিতে বেশি কাজ হবে, “বিশ্বাস কর ভাই আমি
গোলমেলে কিচ্ছু বোঝাতে যাইনি”।
“তোদের
মত লোকের জন্যই আজ দেশের এমন বিপদ। তোদের জন্যই আজ শত্রুরা লাই পেয়ে পেয়ে মাথায়
উঠে কিতকিত খেলছে। তুই মনে মনে এ’টাই তো চাস, যে ভারতের মাথা খেয়ে পাকিস্তান
চাঙ্গা হোক। সে’টা চাইলেই তো তুই নিজেকে ইন্টেলেকচুয়াল বলে প্রমাণ করতে পারবি”।
“সর্বনাশ!
না না না ! আমি আদৌ তা বলিনি বা বলতে চাইনি”।
“তোকে
তো শত্রুর আরডিএক্স হজম করতে হয় না। বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে পা দোলাবি আর বড় বড়
বাতেলা ঝাড়বি দেশের বিরুদ্ধে”।
“আরে
আমি শুধু বলতে চেয়েছি...”।
“সব
বুঝি। সব বুঝি। ছিঃ”।
“ছিঃ”খানা
হোয়াটস্যাপ থেকে উঠে এসে বুকে অ্যাসিডিটি হয়ে ঝরে পড়ল। বলতে ইচ্ছে হল “আমি শুধু
বলেছি যে কাশ্মীরিদের গণ-বয়কট বা মারধোর করা অনুচিত”। এ’টার মধ্যে দিও কোনো
হাতিঘোড়া চিন্তা পাচার করতে চাইনি, বন্ধুটিকে এ’টাও বলা হল না যে “হাতের কাছে
কাশ্মীরি পেলে তুইও অকারণ তাঁর গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে যাবি না কারণ তুই উন্মাদ নোস”।
তবে
প্লেটে যেহেতু দেড়খানা পরোটা আর পেটে সামান্য খিদে তখনও অবশিষ্ট ছিল, তাই আর
কমনসেন্স নিয়ে বেশি ফেরেব্বাজি না করাটাই সমীচীন মনে হল। মিষ্টি করে বললাম;
“থাক
না ভাই এ’সব কাশ্মীর দেশ আর আরডিএক্স। তার চেয়ে বরং চ’ একদিন একটু অলিপাবে ঘুরে
আসি। কদ্দিন ভালো করে আড্ডা দেওয়া হয় না। কী বলিস”?
অমনি সে
বন্ধুর রাগ গলে জল আর ক্ষোভ ফুড়ুৎ করে হাওয়া।
আমাদের
প্লেটে পরোটা, উইকেন্ডে মদ আর মেজাজে ‘এনটাইটেলমেন্ট’ যদ্দিন আছে; কোনো চিন্তা নেই।
No comments:
Post a Comment