Sunday, February 10, 2019

ইন অর্ডার টু লিভ


পৃথিবীটা সত্যিই ছোট।

কিছুদিন আগেই পড়েছিলাম সুদানের লোপেজ লোমংয়ের দুর্ধর্ষ লড়াইয়ের কথা। অকথ্য অত্যাচারের কবল থেকে কোনোক্রমে পালিয়ে বেঁচেছিলেন; গিয়ে পড়েছিলেন কিনিয়ার উদ্বাস্তু শিবিরের ভয়াবহ অভাব ও চরম অব্যবস্থায়। তবে সমস্ত বাধাবিঘ্ন জয় করে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিলেন লোপেজ; নতুন দেশ খুঁজে পেয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সে'খানে নিজেকে নতুন ভাবে গড়ে তুলেছিলেন।তিনি। লোপেজের জীবনের উজ্জ্বলতম অধ্যায়  ২০০৮য়ের চীন অলিম্পিক; যে'খানে আমেরিকার পতাকাবাহক ছিলেন তিনি। আর ঠিক সেই অলিম্পিকের সময়ই চীনের সরকার সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল সে দেশের নারী-ব্যবসা রুখতে। যে ব্যবসার মূলে ছিল উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তু মেয়েরা, যারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল বাঁচতে। সে মেয়েদের তখন ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমির অবস্থা; হয় কুচক্রে পেষাই হওয়া আর নয়তো চীনে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে উত্তর কোরিয়ায় ফেরত যাওয়া যা নিশ্চিত মৃত্যুর সামিল। সেই সব দুর্ভাগা মেয়েদের একজন য়েওনমি পার্ক। যে অলিম্পিক লোপেজের জীবনে এনে দিয়েছিল আলোর স্পর্শ, সে সময়টার অন্ধকারেই হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল য়েওনমির।

য়েওনমির জন্ম ১৯৯৩ সালে, আমার চেয়ে কত ছোট। অথচ  যে বয়সে আমি সঠিক ভাবে গুলতানিও আয়ত্ত করতে পারেনি; সে বয়সে সে দেখেছে কী ভাবে তাকে বাঁচাতে তার মা নিজেকে সঁপে দিয়েছেন ধর্ষকদের হাতে। ২০০৮য়ে আমি চাকরী পেয়েছি; বিহারের ছোট্ট শহরে যেতে হবে বলে বেশ গাঁইগুঁই করছি।  আর ঠিক সেই সময় পনেরো বছরের য়েওনমি শিখেছে নিজেকে বারবার বিক্রি করে কী'ভাবে নিজের পরিবারের মানুষগুলোকে টিকিয়ে রাখা যায়। য়েওনমি একা নয়, সবচেয়ে বড় কথা; উত্তর কোরিয়ার বন্দীদশা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা বেশিরভাগ মানুষের কপাল য়েওনমির চেয়েও বহুগুণ মন্দ।

উত্তর কোরিয়া নিয়ে ইন্টারনেটে প্রচুর প্রতিবেদন পড়েছি আগে, কিন্তু এ বইয়ে বর্ণিত ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সে'সবের তুলনা চলেনা। প্রোপাগান্ডার চশমা চোখে জন্মানো যে ঠিক কতটা দুর্বিষহ,  তা এ বই না পড়লে বোধ হয় কল্পনা করাও অসম্ভব।  আর 'আমার দেশই সেরা'; এই মহামন্ত্র বোধ হয় এলএসডির মত গোলমেলে। উত্তর কোরিয়ায় ছেলেমেয়েরা যোগ বিয়োগ শেখে রামের দু'টো আপেলের সঙ্গে শ্যামের তিনটে আপেল জুড়ে নয়। তারা শেখে যদি আজ তুমি তিনজন 'আমেরিকান বাস্টার্ড' কোতল কর আর আগামীকাল চারজন; তা'হলে ক'জন নিকেশ হল? ঈশ্বরে অবিশ্বাস ছাপিয়ে তারা তৈরি করেছেন সুপার-ঈশ্বর যিনি অবলীলায় হাজারে হাজারে বই লিখে ফেলেন বা যার অঙ্গুলি হেলনে আকাশের মেঘ সাফ হয়ে যায়। সেই সুপার-ঈশ্বরের প্রতি অভিবাদনে উচ্ছাসের পরিমাণ যদি সামান্যও কম হয়, তো সোজা কনসেনট্রেশান ক্যাম্প। ঘরে ঘরে সরকারি রেডিও যা বন্ধ করা যাবে না, আর সে রেডিওতে একটাই চ্যানেল; ঈশ্বরপুত্রের। যৌথখামারের খুড়োর কলের আড়ালে ভেঙেচুরে যাওয়া পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম। গোটা অর্থনীতি দাঁড়িয়ে ঘুষ, কালোবাজারের ওপর। 

হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা হওয়ার কথা, কিন্তু ডাক্তাররা মাইনেটাইনে তেমন পাননা; তাঁদের ঘুষ না দিলে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু। শিক্ষক, পুলিশ; ঘুষ ছাড়া কোথাও দু'পা এগোনোর  উপায় নেই। আর ডায়ে বাঁয়ে সামান্য ভুলচুক হলেই অজস্র চোখ কান রয়েছে 'পার্টি অফিসে' খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এবং যে কোনো ভেঙেচুরে পড়া দেশের মানুষের মূল যন্ত্রণার নাম খিদে। খুনে তরবারির মত ঠাণ্ডা নিরেট খিদে। সে খিদের তাড়না থেকে বাঁচতে য়েওনমিরা পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল।

এই বইয়ের তিনটে মূলভাগ। প্রথম, উত্তর কোরিয়ার বন্দীদশায় য়েওনমির বড় হয়ে ওঠা। দ্বিতীয়,  চীনে য়েওনমির সংগ্রাম এবং ছিন্নভিন্ন হওয়া। তৃতীয়,  চীন থেকে মঙ্গোলিয়া হয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছনো; মুক্তি ও আলো। আর য়েওনমির বইতে একটা জিনিস স্পষ্ট; অসহনীয় উদ্বাস্তু জীবনেও নীলকণ্ঠ হওয়ার দায় কাঁধে নিতে হয় নারীদেরই।

No comments: