জয়ন্ত সমাদ্দার লোকটা যে সুবিধের নয় তা আমি আগেই আঁচ করেছিলাম। বছর দুয়েক আগে সে আমাদের অফিসে জয়েন করেছিল। আমার চেয়ে বয়সে বছর খানেক ছোটই হবে, এখনও চল্লিশে ছুঁয়েছে বলে মনে হয়না। এমনিতে হাসিখুশি আর চটপটে; আড্ডা জমাতেও ওর জুড়ি নেই। আর তার নেশা বলতে হিন্দি সিনেমা আর জর্দা পান। সবসময় জাবর কেটে চলেছে; আড্ডায় বসলে নিজের পকেট থেকে পান বিলি করে লোকের মন জয় করতেও ওর জুড়ি নেই। তবে যে ব্যাপারটা আমার বিরক্তিকর ঠেকে তা হল ওর অকারণে ফাজলামোর অভ্যাসটা। লাঞ্চ-টাইমে লোক-ঠকানো বাজে গল্প যা কিছু ফেঁদে বসে তা নিতান্ত নিরস অবশ্য নয়, কিন্তু গত বছর পয়লা এপ্রিল সে আমার সঙ্গে যা করেছিল তা ক্ষমার অযোগ্য।
সে’দিন সকালে অফিস পৌঁছেই দেখি টেবিলের ওপর বড়সাহেবের চিঠি; তা পড়ে তো আমার চক্ষু-চড়কগাছ। আমি নাকি একটা জরুরী ফাইলে বড়সড় ভুল করে ফেলেছি, তা’তে কোম্পানির লাখ-খানেক টাকা ক্ষতি হয়েছে। সে কারণে আমার একমাসের মাইনে কাটা হবে। তার ওপর আমায় শো’কজও করা হয়েছে। সাতদিনের মধ্যে সদুত্তর দিতে না পারলে সাসপেনশন; বরখাস্তও হতে পারি। কথা নেই বার্তা নেই; এমন আকস্মিক খবরে স্বাভাবিক ভাবেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। হার্ট-অ্যাটাক যে হয়নি তা চোদ্দপুরুষের ভাগ্যি। কতবার মনে করার চেষ্টা করলাম কোন ফাইলের কাজে তেমন গোলমেলে ভুল হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না। এ’দিকে এই বাজারে চাকরী নিয়ে টানাটানি পড়লে যে কী বিশ্রী ব্যাপার হবে তা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়। একটানা সতেরো বছর এই কোম্পানিতে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছি; কী কারণে এমন ভাগ্য বিপর্যয় ঘটল তা কিছুতেই ঠাহর করতে পারছিলাম না। সাতপাঁচ ভাবনাচিন্তা করেও কূলকিনারা না পেয়ে অবশেষে রওনা দিয়েছিলাম বড়সাহেবের চেম্বারের দিকে; তাঁর হাতেপায়ে ধরে এর একটা বিহিত করতেই হবে। বড়সাহেবের চেম্বারের ঠিক বাইরে আমার জামায় একটা হ্যাঁচকা টান পড়ায় ঘুরে দেখি জয়ন্ত সমাদ্দার; মুখে হাড়জ্বালানো বিশ্রী হাসি।
“আরে দত্তদা, সক্কাল সক্কাল বড়সাহেবের ঘরের দিকে কী মনে করে”
বুঝতে পারছিলাম না আমার ভাগ্যবিপর্যয়ের কথা সমাদ্দারকে জানানো ঠিক হবে কিনা, তবে আজ বাদে কাল সবাই জানবেই। খোলাখুলিই বললাম;
“কিছুই বুঝতে পারছি না ভাই, সকাল বেলা অফিসে এসে দেখি আমার টেবিলের ওপর এই শোকজের চিঠি রাখা। খোদ বড়সাহেবের সই করা। কী এমন গোলমাল করেছি যে... “।
আমার কথা শেষ করার আগেই জয়ন্ত সমাদ্দার বিশ্রীভাবে হেসে উঠেছিল, ওর কালচে-লাল দাঁতগুলোকে তখন রীতিমত হিংস্র মনে হচ্ছিল।
“দত্তদা, আপনি অল্পেতেই বড্ড কেঁপে যান। সে সুযোগ নিয়েই আমি একটু মস্করা করার প্ল্যান কষেছিলাম। বড়সাহেবের সইটা আসল নয়, ও চিঠি আমারই লেখা। প্র্যাক্টিকাল জোক, কিছু মনে করবেন না। আজকের দিনটা খেয়াল করেছেন তো? পয়লা এপ্রিল, ফুলস ডে”!
ততক্ষণে আমার মাথার ভিতর আগুন জ্বলতে শুরু করেছিল। এই সে’দিনের ছোকরার এত বড় সাহস? সমাদ্দারও হয়ত তখন বুঝতে পেরেছিল যে কাজটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে; কারণ যাই হোক, বড়সাহেবের সই জাল করাটা তো রীতিমত অপরাধ। এপ্রিল ফুলের ঠাট্টার জন্যেও সে’টা করা রীতিমত অনুচিত হয়েছে। আমিও ঠিক সেই সুযোগটাই নিলাম; সে চিঠি নিয়ে গিয়ে সোজা কমপ্লেন ঠুকে দিলাম বড়সাহেবের অফিসে। সমাদ্দার বাজে-ঠাট্টার জন্য তাঁর সই জাল করেছে শুনে তিনি তো একেবারে তেলে-বেগুন; উলটে জয়ন্ত সমাদ্দারকে শো-কজ করলেন তৎক্ষণাৎ। আর আমার সামনেই তাকে ডেকে যা-নয়-তাই বলতেও ছাড়লেন না। রাগের মাথায় অভিযোগ জানালেও, বড়সাহেব যে এতটা কঠোর কিছু করে ফেলবেন সে’টা আমি ঠিক ভাবতে করতে পারিনি। সে’দিন জয়ন্ত সমাদ্দারকে লিখিত ভাবে ক্ষমা চাইতে হয়। গোটা অফিসের সামনে তাঁকে বেশ অপমানিত হতে হয় আর সে’টা যে সে হজম করতে পারেনি তা বুঝতে পারি যখন সে একমাসের মাথায় ইস্তফা দেয়। একটু যে খারাপ আমার লাগেনি তা নয়, তবে বাড়াবাড়িটা যে সে নিজেই করেছিল সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত ছিলাম।
জয়ন্ত সমাদ্দারের কথা প্রায় ভুলেও গেছিলাম। বহুদিন পর তার কথা মনে পড়ল পার্সেলটা পেয়ে। জুতোর বাক্সের সাইজের পার্সেলটা আমি পাই আজ বিকেলে; বেশ হাল্কা; সঙ্গে একটা পোস্টকার্ড।
“দত্তদা,
আজ আবার পয়লা এপ্রিল। এই দিনটাই আদর্শ ক্ষমা চাওয়ার জন্য। বোকা আপনি নন দাদা, বোকা আমিই। একবছর আগে একটা চরম ভুল করে ফেলেছিলাম। অবিশ্যি স্রেফ ঠাট্টাই করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু পরিমিতি বোধ আমার কোনও কালেই নেই। আপনাকে বড্ড বিব্রত করে ফেলেছিলাম সে’দিন। অফিসে মুচলেকা দিয়ে যে ক্ষমা চেয়েছিলাম তা ছিল অন্তঃসারশূন্য। তাই এই পোস্টকার্ড পাঠালাম।
বড্ড মনখারাপ নিয়ে চাকরীটা ছেড়ে ছিলাম, তবে এখন ভালোই আছি। ঈশ্বর চাইলে আমি নিশ্চিত আমাদের আবার দেখা হবে। তখন গল্পাআড্ডা হবে’খন। আপাতত একটা ছোট উপহার পাঠালাম আপনার জন্য। ফিরিয়ে দেবন না।
ইতি আপনার প্রাক্তন সহকর্মী এবং চিরকালের বন্ধু,
জয়ন্ত সমাদ্দার”।
বলাই বাহুল্য, আমি নিশ্চিত এই পার্সেলের মধ্যে কোনও গোলমাল রয়েছে। পার্সেল আসার সময় আমি থাকলে তা ফিরিয়েই দিতাম, কিন্তু যখন এ’টা আসে তখন আমি বাড়ির বাইরে। আর আমার ব্যাচেলর-প্যাডের অধীশ্বর নন্দ “দাদাবাবুর নামে পার্সেল” শুনে হাসি মুখে তা পোস্টম্যানের থেকে রিসিভ করে নিয়েছে। নন্দকে আমার চাকর বললে ওকে ছোট করা হবে। ওই আমার লোকাল গার্জেন প্রায়। গত কুড়ি বছর ধরে আমার সঙ্গে আছে, তবে গ্রামের সারল্য এখনও যায়নি। আমার প্রতিটি কথা বেদবাক্য মনে করে মান্যি করে।
বাক্সে আরডিএক্স গোছের কিছু হবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। জয়ন্ত সমাদ্দার গোলমেলে হতে পারে, ফাজিল হতে পারে; কিন্তু খুনি নয়। কিন্তু কিছুতেই নীল কাগজে মোড়া সে বাক্সটা খোলার সাহস আমি পাচ্ছিলাম না। আমার শোওয়ার ঘরের টেবিলের ওপর মোড়ক-সহ রেখে দিয়েছি; নন্দ একবার খোলার কথা বলেছিল, তাকে কড়া সুরে নিরস্ত করেছি। প্রায় ধমক দিয়ে নন্দকে বলেছিলাম; “খবরদার! এ বাক্স আমি অনুমতি না দিলে কেউ যেন না খোলে, বুঝেছিস”? অনুগত ছাত্রের মত মাথা নেড়েছিল নন্দ।
****
ঘুম যখন ভাঙল তখন বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িতে দেখলাম সকাল সাড়ে ন’টা। কী মুশকিল, এত বেলা হয়ে গেছে অথচ ঘরের মধ্যে নিকষ অন্ধকার। এই সময় আমার এই শোওয়ার ঘর রোদে ভরে যাওয়ার কথা। শশব্যস্ত হয়ে খাট থেকে নামতেই টের পেলাম এ’টা আমার শোওয়ার ঘর নয়। খাটটা ছাড়া অন্য কোনও আসবাবপত্র ঘরের মধ্যে নেই। এমন কী সেই টেবিলটা যার ওপরে নীল কাগজে মোড়া পার্সেল ছিল; সে’টাও হাওয়া।
“নন্দ” বলে বার তিনেক হাঁক পাড়লাম, কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। তবে রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম যখন দেখলাম এই ঘরে না আছে কোনও জানালা আর না আছে কোনও দরজা। এমন কী কোনও ঘুলঘুলিও চোখে পড়ছে না। এখানে আমি এলাম কী করে?
আমার কেমন গা গুলিয়ে আসছিল যেন। একটা প্রবল অস্বস্তি আমায় চেপে ধরেছিল। সেই অন্ধকার ঘরে পায়চারী করতে করতে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে মেঝেটা সিমেন্টে বাঁধানো নয়, মাটিরও নয়। কিন্তু বিস্তর গুঁতোগুঁতি করেও মেঝে বা দেওয়ালের কোনও ক্ষতি করা যাচ্ছে না।
***
কতক্ষণ বা কত ঘণ্টা বা কতদিন কেটেছে আমি জানি না। হাতঘড়িটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি ঘরের এক কোণে; সময়ের হিসেবে এ’খানে অদরকারী এবং বিরক্তিকর।। অবাক লাগছে এই ভেবে যে খিদে বা ঘুম; আমার কোনটাই পাচ্ছে না। প্রবল অবসাদে শরীর মন ভারী হয়ে এসেছে। খাটের এক কোণে পড়ে রয়েছি। ভাবনা আর লজিক; দু’টোই মনে হয় ক্রমশ বিকল হয়ে আসছে।
***
আজ প্রথম ঘরের ছাতের ওপর থেকে আমি কোনও কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। চেনা মানুষ।
“দাদাবাবু গো, পুলিশ আসার আগেই আমি তোমার এই বাক্স সরিয়ে রেখেছি। ওর জানতেও পারবে না এই নীল কাগজে মোড়া বাক্সের কথা। বেশ করেছি আমার নিজের কাছে লুকিয়ে রেখে, তাই না? পুলিশ যেই শুনত যে এ বিটকেল বাক্স বাড়িতে আসার রাত থেকেই তুমি বেপাত্তা, অমনি তারা এ বাক্স খুলে দেখতে চাইত । এ’দিকে তুমিই তো বলে গিয়েছ যে তুমি অনুমতি না দিলে যেন কেউ এ বাক্স না খোলে। নন্দ থাকতে তোমার কথার খেলাপ কখনও হবে না, দেখো। কিন্তু আমি বড় একা হয়ে গেছি গো দাদাবাবু, তুমি ছাড়া যে আমার কথা বলার কেউ নেই। কবে ফিরবে? বাধ্য হয়ে একা একা বিড়বিড় করে যাই। তাড়াতাড়ি ফিরে আসো দেখি, তোমায় বড়ি দিয়ে ট্যাংরার ঝোল রেঁধে খাওয়াবো”।
নন্দর কথাগুলো ছাতের এককোণ থেকে ভেসে আসছিল, কিন্তু আমি জানি যে আমি চিৎকার করলেও নন্দ আমার কণ্ঠস্বর কিছুতেই শুনতে পাবে না।
(ওপরে বহৃত ছবিটা www.deviantart.com থেকে নেওয়া)
No comments:
Post a Comment