- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।
- কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর?
- ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।
- আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।
- না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।
- আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।
- আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।
- এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বাড়িতে একটা জলজ্যান্ত লাশ ফেলে এসেছি...।
- জলজ্যান্ত লাশ?
- আই মীন। খুনটা বেশিক্ষণ আগে হয়নি। এ'বারে আর দেরী না করে গাড়িটা বের করুন ইন্সপেক্টর। বেলা বাড়ছে।
- দাঁড়ান। সামারিটা শেষ হয়নি। আপনার নাম অনিল দত্ত। তিনটে সিমেন্টের কারখানা রয়েছে। দু'টো কলকাতার আশেপাশে আর একটা ছত্তিসগড়ে। আপনার চারতলা বাড়ি বাইশ নম্বর ডগলাস পার্ক রোড, কলকাতা আটষট্টি।
- করেক্ট।
- আপনার স্ত্রীর নাম রেবা। আপনার দুই ছেলে; বড় ছেলে দীপক আপনার পাশে থেকে ব্যবসা সামলাচ্ছে। ছোটছেলে দিলীপ; টলিউডে অভিনয়টভিনয় করে নাম করেছে। দু'জনেই বিবাহিত, বড় জনের দুই ছেলে আর ছোটছেলে ছেলে-বৌ নিঃসন্তান। আপনার সেক্রেটারির নাম মৃণালকান্তি ঘোষ, ব্যাচেলর। সবাই মিলে ঐ বাইশ নম্বর ডগলাস পার্ক রোডের বাড়িতেই থাকেন। সাব-ইন্সপেক্টরকে এইসবই বলেছেন তো?
- অফ কোর্স। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এ'সব কথা এখানে আলোচনা করে সময় নষ্ট করছেন কেন? এর চেয়ে দেখছি গোয়েন্দা অনির্বাণ সান্যালকে তলব করলেই বেটার রেসপন্স পেতাম।
- গোয়েন্দা অনির্বাণ?
- যাহ্! আরে অনির্বাণ সান্যাল। নর্থ কলকাতার ছেলে। পুলিশে আছেন যখন নিশ্চয়ই খবর পেয়েছেন যে গতমাসেই সে বর্ধমানের সিরিয়াল মার্ডারটা সল্ভ করে পুলিশকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
- বর্ধমানের সিরিয়াল মার্ডার?
- কেমন পুলিশ আপনি যে এ'সব বেসিক খবরাখবরটুকু রাখেন না? এ'দিকে যে কোনও গোলমেলে কেস পেলেই তো লালবাজারের বড়কর্তারা ইদানীং নির্দ্বিধায় অনির্বাণকে কনসাল্ট করছেন। ওর বর্ধমানের কেসটার ওপর তো একটা থ্রিলার সিনেমাও তৈরি হচ্ছে। আসলে বিট্টু...মানে আমার ছোট ছেলে দিলীপই স্ক্রিনে অনির্বাণের ভূমিকায় অভিনয় করবে।
- থ্রিলিং ব্যাপারস্যাপার। বেশ করিতকর্মা ডিটেকটিভ বলে মনে হচ্ছে।
- তাকে ফোন করলেই কাজের কাজ হত। এই থানায় এসে বাজে প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করতে হত না। গত চার ঘণ্টা ধরে মৃণালকান্তির লাশ আমার ড্রয়িং রুমে পড়ে আছে। বাড়ির প্রতিটা মানুষ তটস্থ হয়ে রয়েছে অথচ এখানে বসে আমরা অযথা সময় নষ্ট করে চলেছি। দেখুন, আর একবার আপনাকে বলব...আপনি যদি টীম নিয়ে এখনই রওনা না দেন তা'হলে...।
- কী করবেন?
- একজন রেস্পেক্টেবল সিটিজেনকে এইভাবে হ্যারাস করা। আপনি জানেন পাড়ার এমপি এমএলএ শুধু নয়; রাজ্যের ক্যাবিনেট মিনিস্টার মনোহর সিংহ আমার ছেলেবেলার বন্ধু? একটা ফোন কলে...।
- মনোহর সিংহ? ক্যবিনেট মিনিস্টার? সে আবার আপনার বন্ধু? ওর পোর্টফোলিওটা কী যেন?
- আমি আপনার হরিবল লেবেলে অফ জেনারেল নলেজ ইম্প্রুভ করার জন্য থানায় আসিনি ইন্সপেক্টর। আপনি যখন কুওপারেট করবেনই না ঠিক করে নিয়েছেন, তখন আমাকেই নিজের ব্যবস্থা করতে হবে। অনির্বাণকে ডেকে নিচ্ছি আর মনোহরকে বলছি আপনাকে টাইট দিতে...।
- টাইট? থানায় বসে পুলিশের সঙ্গে পাঁয়তারা কষা? নেহাত বয়স্ক মানুষ নয়ত থাবড়ে চোয়াল ভেঙে দিতাম।
- হাউ ডেয়ার ইউ? হাউ ডেয়ার ইউ...?
- এই শুনুন...আপনি উন্মাদ না চিটিংবাজ আমি জানি না...কিন্তু আর একটা গুল দিলে আমি আপনাকে থানায় পচিয়ে মারব।
- আমায় চিটিংবাজ বলা? এই আপনার ল্যাঙ্গুয়েজ? আমি আপনাকে...। আমি আপনাকে...।
- শুনুন। আর সহ্য করব না।
- এই...।
- চোপ! আর একটাও কথা নয়। এ'বার আমি বলব আর আপনি শুনবেন। এই বয়সে পুলিশের লেগপুল করতে থানায় এসেছেন? দেব দু'ঘা? সিমেন্ট টাইকুন অনিল দত্ত, নাকি? অনিল দত্ত নামে কোনও ব্যবসায়ীই এ অঞ্চলে নেই। আর বাইশ নম্বর ডগলাস পার্ক রোডের চার তলা বাড়ি, নাকি? ধুর মশাই, ও নামে কোনও রাস্তা এ অঞ্চলে কেন, গোটা কলকাতাতে নেই...।
- শাট আপ!
- ইউ শাট আপ! আরও শুনুন। আপনার ছোটছেলে নামকরা টলিউড অভিনেতা? শুনুন, দিলীপ দত্ত নামে কোনও অভিনেতাই আপাতত টালিগঞ্জে নেই। আর অনির্বাণ গোয়েন্দা? বর্ধমানের জোড়া খুন? ফাজলামোর আর জায়গা পাননি? ভোরবেলায় থানায় এসে ফুল হিলে হ্যায় গুলশন গুলশন? এমন রুলপেটা করব যে...।
- আই...আই উইল...আই উইল...মনোহর আপনাকে...।
- আরে ধুর। ওই নামেও কোনও ক্যাবিনেট মিনিস্টার কেন...এমএলএও নেই এ রাজ্যে। তা আপনার এই আপনার এই মনোহর সিংহ কোন পার্টির?
- রুলিং পার্টি। বাংলা বিপ্লব সঙ্ঘ।
- উফ...আর গাঁজা নেওয়া যাচ্ছে না। রমাপদ, এই মালটাকে বের করে দে ভাই। এখুনি।
***
- ইন্সপেক্টর সুবিমল মিশ্র, তাই তো? নাইস টু মীট ইউ মিস্টার মিশ্র। তা, চুপ করে রইলেন যে। সমস্যাটা কী হয়েছে বলুন...।
- না মানে মিস্টার চ্যাটার্জী, ব্যাপারটা যাকে বলে খুবই সিলি। খুবই। আর আদৌ কোনও অফিসিয়াল কেসের বিষয়ে নয়। তাই এমন দুম করে আপনার মত স্বনামধন্য লেখকের সঙ্গে দেখা করতে আসাটা হয়ত আদৌ ঠিক হয়নি।
- প্লীজ ডোন্ট ওয়ারি ইন্সপেক্টর। তবে সকাল সকাল বাড়িতে পুলিশ এসে পড়ায় একটু ঘাবড়ে গেছিলাম বইকি। এ'বার একটু ঝেড়ে কাশুন দেখি মশাই...ব্যাপারটা কী?
- আসলে একটা সামান্য আগ্রহ...।
- নিশ্চিন্তে বলুন। ইয়ে ,চা খাবেন?
- না থাক। প্রসঙ্গে আসি। লজ্জারই ব্যাপার...তবে...জানেন, আমি তেমন গল্পের বইটই পড়িনা।
- বেশ করেন। গল্পের বই পড়া ছাড়াও পৃথিবীতে অনেক জমাটি কাজ রয়েছে। তবে...লোকে পড়লে আমাদের পকেটে টু পাইস ঢোকে আর কী। সিগারেট?
- থ্যাঙ্কস।
- বলুন ইন্সপেক্টর।
- তবে ইয়ে...আমার স্ত্রী কিন্তু আবার গল্পের বইয়ের পোকা। আর আপনার লেখার ভক্ত।
- এক্সট্রিমলি কাইন্ড অফ হার।
- এ'বারে ওই অদ্ভুত প্রশ্নটা করেই ফেলি। আপনি কি গোয়েন্দা গল্প লিখছেন আজকাল? না মানে...আমার স্ত্রী বলছিল আর কী...।
- আই হোপ দ্যাট ইজ নট আ ক্রাইম। হেহ্ হেহ্। এমনিতে অবিশ্যি আমার বেশির ভাগ লেখাই রোম্যান্টিক। কিন্তু গতবছর একটা পুজো সংখ্যায় একটা ডিটেকটিভ গল্প লিখে জব্বর রেসপন্স পেয়েছি। ইন ফ্যাক্ট সেই গোয়ন্দাকে নিয়েই একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চার লিখেছি। আশা করি এই পুজোতেই...।
- ইয়ে...আপনার এই গোয়েন্দাটির নাম বোধ হয় অনির্বাণ, তাই না?
- অনির্বাণ সান্যাল।
- আর আপনার গল্পের প্লটটা ছিল সিরিয়াল মার্ডার নিয়ে। বর্ধমানের সিরিয়াল মার্ডার। তাই না?
- আসলে আমি ভাবলাম কলকাতার পটভূমিতে গোয়ান্দাদের ছোটাছুটি করতে দেখতে পাঠকরা বেশ অভ্যস্ত। মফস্বল বরং একটা ফ্রেশ এলিমেন্ট হতে পারে। তাই বর্ধমান। কিন্তু এই যে আপনি বললেন আপনার বইটই পড়ার দিকে তেমন ঝোঁক নেই? অনির্বাণ গোয়েন্দার ব্যাপারে জানলেন কোথা থেকে?
- আমার স্ত্রীর মুখেই শুনলাম গতকাল। তাই আজ সকালেই আপনার কাছে ছুটে এলাম। ইয়ে, যদি কিছু মনে না করেন...অনির্বাণ গোয়েন্দাকে নিয়ে লেখা পরের গল্প...সে গল্পের প্লট সম্বন্ধে কোনও হালকা আভাস কি আপনার পক্ষে দেওয়া সম্ভব? না মানে আমি জানি যে প্রশ্নটা খুবই বেআক্কেলে কিন্তু বিশ্বাস করুন...।
- ইন্ট্রিগিং তো বটেই। আর এখনও যেহেতু লেখা শেষ হয়নি, সেহেতু প্লট নিয়ে কিছু বলা...।
- আমি কিন্তু আর কারুর সঙ্গে শেয়ার করব না চ্যাটার্জীবাবু...। কথা দিচ্ছি...।
- আপনি খুবই ইন্টারেস্টিং লোক ইন্সপেক্টর মিশ্র। হিন্ট কিছু দিতেই পারি। তবে এ'বারে মফস্বলও নয়, সিরিয়াল মার্ডারও নয়। স্বাদ না পালটালে মার্কেট নেবে কেন বলুন। এ'বারের গল্পটা কলকাতাতেই ফেঁদেছি। একজন বিজনেস টাইকুনের সেক্রেটারি খুন হয় মাঝরাতে, এই টাইকুনের বাড়িতেই। বিশাল বাড়ি, বড় পরিবার। চাকরবাকর মিলে প্রচুর লোকজন। হরেকরকমের মোটিভ, বিভিন্ন চরিত্র।
- এই বিজনেস টাইকুন...এর ব্যবসাটা কি...ব্যবসাটা কি...সিমেন্টের?
- হোয়াট! আপনি...আপনি তা জানলেন কী করে...।
- আর তাঁর চারতলা বাড়ি? কাল্পনিক ডগলাস পার্ক রোডের ওপর। তাঁর স্ত্রীর নাম রেবা। ছোট ছেলে দিলীপ সিনেমায় অভিনয় করে। তাঁর বন্ধু মনোহর সিংহ ক্যাবিনেট মিনিস্টার।
- ইন্সপেক্টর! চুপ করুন! এ'সবের মানেটা কী। আমি লিখছি আমার নিজস্ব ল্যাপটপে...অথচ...। এ'সব হচ্ছেটা কী?
- কিচ্ছু হ্যাক হয়নি। আসলে...আসলে..। অনিল দত্ত বলে একজন...আজ থেকে ঠিক মাসখানেক আগে...আমার থানার সামনে...।
- গোয়েন্দা গল্পে একজন অপদার্থ পুলিশ অফিসারের ভূমিকা খুব ক্রিটিকাল, সে'টা জানেন তো? যা'তে তাঁর কন্ট্রাস্টে গোয়েন্দার চরিত্রটা পাঠকের কাছে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আপনার সঙ্গে আলাপ না থাকা সত্ত্বেও আজ আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে কেন রাজী হয়েছিলাম জানেন? কারণ আপনার নাম! আপনার নামটার জন্য।
- মানে?
- অনির্বাণের এই নতুন অ্যাডভেঞ্চারে যে অপদার্থ পুলিশ অফিসারটির কথা আমি লিখেছি তাঁর নামও দিয়েছি...সুবিমল মিশ্র...ইন্সপেক্টর সুবিমল মিশ্র।
- সে...সে কী...।
- যাক গে...আপনি এখন আসতে পারেন। ও গল্প আর আমি শেষ করব না।
- মিস্টার চ্যাটার্জী বিশ্বাস করুন আমি কিন্তু...।
- আপনি এখন আসুন ইন্সপেক্টর। কী কুক্ষণেই যে গোয়েন্দা গল্প লেখার ভূত মাথায় চেপেছিল...। উফ! যত্তসব!