Sunday, July 21, 2019

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না। 

- কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর?

- ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। 

- আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো। 

- না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত। 

- আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র। 

- আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...। 

- এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বাড়িতে একটা জলজ্যান্ত লাশ ফেলে এসেছি...। 

- জলজ্যান্ত লাশ?

- আই মীন। খুনটা বেশিক্ষণ আগে হয়নি। এ'বারে আর দেরী না করে গাড়িটা বের করুন ইন্সপেক্টর। বেলা বাড়ছে।  

- দাঁড়ান। সামারিটা শেষ হয়নি। আপনার নাম অনিল দত্ত। তিনটে সিমেন্টের কারখানা রয়েছে। দু'টো কলকাতার আশেপাশে আর একটা ছত্তিসগড়ে। আপনার চারতলা বাড়ি বাইশ নম্বর ডগলাস পার্ক রোড, কলকাতা আটষট্টি।

- করেক্ট। 

- আপনার স্ত্রীর নাম রেবা। আপনার দুই ছেলে; বড় ছেলে দীপক আপনার পাশে থেকে ব্যবসা সামলাচ্ছে। ছোটছেলে দিলীপ; টলিউডে অভিনয়টভিনয় করে নাম করেছে। দু'জনেই বিবাহিত, বড় জনের দুই ছেলে আর ছোটছেলে ছেলে-বৌ নিঃসন্তান।  আপনার সেক্রেটারির নাম মৃণালকান্তি ঘোষ, ব্যাচেলর।  সবাই মিলে ঐ বাইশ নম্বর ডগলাস পার্ক রোডের বাড়িতেই থাকেন। সাব-ইন্সপেক্টরকে এইসবই বলেছেন তো? 

- অফ কোর্স। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এ'সব কথা এখানে আলোচনা করে সময় নষ্ট করছেন কেন? এর চেয়ে দেখছি গোয়েন্দা অনির্বাণ সান্যালকে তলব করলেই বেটার রেসপন্স পেতাম। 

- গোয়েন্দা অনির্বাণ?

- যাহ্‌! আরে অনির্বাণ সান্যাল। নর্থ কলকাতার ছেলে। পুলিশে আছেন যখন নিশ্চয়ই খবর পেয়েছেন যে গতমাসেই সে বর্ধমানের সিরিয়াল মার্ডারটা সল্ভ করে পুলিশকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। 

- বর্ধমানের সিরিয়াল মার্ডার?

- কেমন পুলিশ আপনি যে এ'সব বেসিক খবরাখবরটুকু রাখেন না? এ'দিকে যে কোনও গোলমেলে কেস পেলেই তো লালবাজারের বড়কর্তারা ইদানীং নির্দ্বিধায় অনির্বাণকে কনসাল্ট করছেন। ওর বর্ধমানের কেসটার ওপর তো একটা থ্রিলার সিনেমাও তৈরি হচ্ছে। আসলে বিট্টু...মানে আমার ছোট ছেলে দিলীপই স্ক্রিনে অনির্বাণের ভূমিকায় অভিনয় করবে। 

- থ্রিলিং ব্যাপারস্যাপার। বেশ করিতকর্মা ডিটেকটিভ বলে মনে হচ্ছে। 

- তাকে ফোন করলেই কাজের কাজ হত। এই থানায় এসে বাজে প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করতে হত না। গত চার ঘণ্টা ধরে মৃণালকান্তির লাশ আমার ড্রয়িং রুমে পড়ে আছে। বাড়ির প্রতিটা মানুষ তটস্থ হয়ে রয়েছে অথচ এখানে বসে আমরা অযথা সময় নষ্ট করে চলেছি। দেখুন, আর একবার আপনাকে বলব...আপনি যদি টীম নিয়ে এখনই রওনা না দেন তা'হলে...। 

- কী করবেন?

- একজন রেস্পেক্টেবল সিটিজেনকে এইভাবে হ্যারাস করা। আপনি জানেন পাড়ার এমপি এমএলএ শুধু নয়; রাজ্যের ক্যাবিনেট মিনিস্টার মনোহর সিংহ আমার ছেলেবেলার বন্ধু? একটা ফোন কলে...। 

- মনোহর সিংহ? ক্যবিনেট মিনিস্টার? সে আবার আপনার বন্ধু? ওর পোর্টফোলিওটা কী যেন?

- আমি আপনার হরিবল লেবেলে অফ জেনারেল নলেজ ইম্প্রুভ করার জন্য থানায় আসিনি ইন্সপেক্টর। আপনি যখন কুওপারেট করবেনই না ঠিক করে নিয়েছেন, তখন আমাকেই নিজের ব্যবস্থা করতে হবে। অনির্বাণকে ডেকে নিচ্ছি আর মনোহরকে বলছি আপনাকে টাইট দিতে...। 

- টাইট? থানায় বসে পুলিশের সঙ্গে পাঁয়তারা কষা? নেহাত বয়স্ক মানুষ নয়ত থাবড়ে চোয়াল ভেঙে দিতাম। 

- হাউ ডেয়ার ইউ? হাউ ডেয়ার ইউ...?

- এই শুনুন...আপনি উন্মাদ না চিটিংবাজ আমি জানি না...কিন্তু আর একটা গুল দিলে আমি আপনাকে থানায় পচিয়ে মারব। 

- আমায় চিটিংবাজ বলা? এই আপনার ল্যাঙ্গুয়েজ? আমি আপনাকে...। আমি আপনাকে...। 

- শুনুন। আর সহ্য করব না। 

- এই...। 

- চোপ! আর একটাও কথা নয়। এ'বার আমি বলব আর আপনি শুনবেন। এই বয়সে পুলিশের লেগপুল করতে থানায়  এসেছেন? দেব দু'ঘা? সিমেন্ট টাইকুন অনিল দত্ত, নাকি? অনিল দত্ত নামে কোনও ব্যবসায়ীই এ অঞ্চলে নেই। আর বাইশ নম্বর ডগলাস পার্ক রোডের চার তলা বাড়ি, নাকি? ধুর মশাই, ও নামে কোনও রাস্তা এ অঞ্চলে কেন, গোটা কলকাতাতে নেই...। 

- শাট আপ!

- ইউ শাট আপ! আরও শুনুন। আপনার ছোটছেলে নামকরা টলিউড অভিনেতা? শুনুন, দিলীপ দত্ত নামে কোনও অভিনেতাই আপাতত টালিগঞ্জে নেই। আর অনির্বাণ গোয়েন্দা? বর্ধমানের জোড়া খুন? ফাজলামোর আর জায়গা পাননি? ভোরবেলায় থানায় এসে ফুল হিলে হ্যায় গুলশন গুলশন? এমন রুলপেটা করব যে...। 

- আই...আই উইল...আই উইল...মনোহর আপনাকে...। 

- আরে ধুর। ওই নামেও কোনও ক্যাবিনেট মিনিস্টার কেন...এমএলএও নেই এ রাজ্যে। তা আপনার এই আপনার এই মনোহর সিংহ কোন পার্টির? 

- রুলিং পার্টি। বাংলা বিপ্লব সঙ্ঘ। 

- উফ...আর গাঁজা নেওয়া যাচ্ছে না। রমাপদ, এই মালটাকে বের করে দে ভাই। এখুনি। 

*** 

- ইন্সপেক্টর সুবিমল মিশ্র, তাই তো? নাইস টু মীট ইউ মিস্টার মিশ্র। তা, চুপ করে রইলেন যে। সমস্যাটা কী হয়েছে বলুন...। 

- না মানে  মিস্টার চ্যাটার্জী, ব্যাপারটা যাকে বলে খুবই সিলি। খুবই। আর আদৌ কোনও অফিসিয়াল কেসের বিষয়ে নয়। তাই এমন দুম করে আপনার মত স্বনামধন্য লেখকের সঙ্গে দেখা করতে আসাটা হয়ত আদৌ ঠিক হয়নি।  

- প্লীজ ডোন্ট ওয়ারি ইন্সপেক্টর। তবে সকাল সকাল বাড়িতে পুলিশ এসে পড়ায় একটু ঘাবড়ে গেছিলাম বইকি। এ'বার একটু ঝেড়ে কাশুন দেখি মশাই...ব্যাপারটা কী? 

- আসলে একটা সামান্য আগ্রহ...। 

- নিশ্চিন্তে বলুন। ইয়ে ,চা খাবেন? 

- না থাক। প্রসঙ্গে আসি। লজ্জারই ব্যাপার...তবে...জানেন, আমি তেমন গল্পের বইটই পড়িনা। 

- বেশ করেন। গল্পের বই পড়া ছাড়াও পৃথিবীতে অনেক জমাটি কাজ রয়েছে। তবে...লোকে পড়লে আমাদের পকেটে টু পাইস ঢোকে আর কী। সিগারেট? 

- থ্যাঙ্কস। 

- বলুন ইন্সপেক্টর। 

- তবে ইয়ে...আমার স্ত্রী কিন্তু আবার গল্পের বইয়ের পোকা। আর আপনার লেখার ভক্ত। 

- এক্সট্রিমলি কাইন্ড অফ হার। 

- এ'বারে ওই অদ্ভুত প্রশ্নটা করেই ফেলি। আপনি কি গোয়েন্দা গল্প লিখছেন আজকাল? না মানে...আমার স্ত্রী বলছিল আর কী...। 

- আই হোপ দ্যাট ইজ নট আ ক্রাইম। হেহ্‌ হেহ্‌। এমনিতে অবিশ্যি আমার বেশির ভাগ লেখাই রোম্যান্টিক। কিন্তু গতবছর একটা পুজো সংখ্যায় একটা ডিটেকটিভ গল্প লিখে জব্বর রেসপন্স পেয়েছি। ইন ফ্যাক্ট সেই গোয়ন্দাকে নিয়েই একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চার লিখেছি। আশা করি এই পুজোতেই...। 

- ইয়ে...আপনার এই গোয়েন্দাটির নাম বোধ হয় অনির্বাণ, তাই না?

- অনির্বাণ সান্যাল।

-  আর আপনার গল্পের প্লটটা ছিল সিরিয়াল মার্ডার নিয়ে। বর্ধমানের সিরিয়াল মার্ডার। তাই না?  

- আসলে আমি ভাবলাম কলকাতার পটভূমিতে গোয়ান্দাদের ছোটাছুটি করতে দেখতে পাঠকরা বেশ অভ্যস্ত। মফস্বল বরং একটা ফ্রেশ এলিমেন্ট হতে পারে। তাই বর্ধমান। কিন্তু এই যে আপনি বললেন আপনার বইটই পড়ার দিকে তেমন ঝোঁক নেই? অনির্বাণ গোয়েন্দার ব্যাপারে জানলেন কোথা থেকে? 

- আমার স্ত্রীর মুখেই শুনলাম গতকাল। তাই আজ সকালেই আপনার কাছে ছুটে এলাম। ইয়ে, যদি কিছু মনে না করেন...অনির্বাণ গোয়েন্দাকে নিয়ে লেখা পরের গল্প...সে গল্পের প্লট সম্বন্ধে কোনও হালকা আভাস কি আপনার পক্ষে দেওয়া সম্ভব?  না মানে আমি জানি যে প্রশ্নটা খুবই বেআক্কেলে কিন্তু বিশ্বাস করুন...। 

- ইন্ট্রিগিং তো বটেই। আর এখনও যেহেতু লেখা শেষ হয়নি, সেহেতু প্লট নিয়ে কিছু বলা...। 

- আমি কিন্তু আর কারুর সঙ্গে শেয়ার করব না চ্যাটার্জীবাবু...। কথা দিচ্ছি...। 

- আপনি খুবই ইন্টারেস্টিং লোক ইন্সপেক্টর মিশ্র। হিন্ট কিছু দিতেই পারি। তবে এ'বারে মফস্বলও নয়, সিরিয়াল মার্ডারও নয়। স্বাদ না পালটালে মার্কেট নেবে কেন বলুন। এ'বারের গল্পটা কলকাতাতেই ফেঁদেছি। একজন বিজনেস টাইকুনের সেক্রেটারি খুন হয় মাঝরাতে, এই টাইকুনের বাড়িতেই। বিশাল বাড়ি, বড় পরিবার। চাকরবাকর মিলে প্রচুর লোকজন। হরেকরকমের মোটিভ, বিভিন্ন চরিত্র। 

- এই বিজনেস টাইকুন...এর ব্যবসাটা কি...ব্যবসাটা কি...সিমেন্টের?

- হোয়াট! আপনি...আপনি তা জানলেন কী করে...। 

- আর তাঁর চারতলা বাড়ি? কাল্পনিক ডগলাস পার্ক রোডের ওপর। তাঁর স্ত্রীর নাম রেবা। ছোট ছেলে দিলীপ সিনেমায় অভিনয় করে। তাঁর বন্ধু মনোহর সিংহ ক্যাবিনেট মিনিস্টার। 

- ইন্সপেক্টর! চুপ করুন! এ'সবের মানেটা কী। আমি লিখছি আমার নিজস্ব ল্যাপটপে...অথচ...। এ'সব হচ্ছেটা কী?

- কিচ্ছু হ্যাক হয়নি। আসলে...আসলে..। অনিল দত্ত বলে একজন...আজ থেকে ঠিক মাসখানেক আগে...আমার থানার সামনে...। 

- গোয়েন্দা গল্পে একজন অপদার্থ পুলিশ অফিসারের ভূমিকা খুব ক্রিটিকাল, সে'টা জানেন তো? যা'তে তাঁর কন্ট্রাস্টে গোয়েন্দার চরিত্রটা পাঠকের কাছে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আপনার সঙ্গে আলাপ না থাকা সত্ত্বেও আজ আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে কেন রাজী হয়েছিলাম জানেন? কারণ আপনার নাম! আপনার নামটার জন্য। 

- মানে?

- অনির্বাণের এই নতুন অ্যাডভেঞ্চারে যে অপদার্থ পুলিশ অফিসারটির কথা আমি লিখেছি তাঁর নামও দিয়েছি...সুবিমল মিশ্র...ইন্সপেক্টর সুবিমল মিশ্র। 

- সে...সে কী...। 

- যাক গে...আপনি এখন আসতে পারেন। ও গল্প আর আমি শেষ করব না। 

- মিস্টার চ্যাটার্জী বিশ্বাস করুন আমি কিন্তু...। 

- আপনি এখন আসুন ইন্সপেক্টর। কী কুক্ষণেই যে গোয়েন্দা গল্প লেখার ভূত মাথায় চেপেছিল...। উফ! যত্তসব! 

Thursday, July 18, 2019

ষাট


- প্রাইম মিনিস্টার।

- আরে মেকশফ, ভিতরে এসো। তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। তা, কী হে? হাতে কোনও ফাইলপত্তর দেখছি না, অফিসটফিস তুলে দিয়েছ নাকি?

- আজকের দিনটা অন্তত...।

- মেকশফ। আমার শেষ দিন হতে পারে, কিন্তু তোমাদের পৃথিবীটা তো আর থেমে থাকবে না। কাজ না করলে চলবে কেন?

- আজ বড় ক্লান্ত লাগছে...।

- রং ডে টু আস্ক ফর আ পেপ্‌ টক মাই বয়। তবে পেপ টকের চেয় কফিতে কাজ দেয় বেশি।

- সে'টা থাক। অনেক জরুরী কাজ পড়ে রয়েছে। বেশ কিছু ডেলিগেশন এসেছে...।

- একটা চমৎকার ব্যাপার তোমায় জানিয়ে রাখি। আজ এই নিয়ে বত্রিশ বার হ্যারি পটার শেষ করলাম। গতকাল সন্ধে থেকেই সমস্ত কাজ বন্ধ করে পড়েছি; শেষ করতেই হত।

- থার্টি ট্যু। ইনক্রেডিবল।

- আমার বাবা চুয়াল্লিশ বার পড়েছিলেন।

- আমার তো এখনও একবারও...।

- কাজ কাজ করেই তোমরা গেলে।

- মনখারাপ প্রাইমমিনিস্টার?

- ঠিক মনখারাপ নয়। বরং মনকেমন বলতে পারো। বৃষ্টি শব্দে আর কোনোদিন ঘুম ভাঙবে না, মায়ের কথা মনে পড়ে অকারণ কান্না পাবে না, নতুন গল্পের বইয়ের পাতায় আঙুল বোলানোর আরাম আর টের পাব না, খিদে পেটে গরম ভাতের গন্ধ আর নাকে এসে ঠেকবে না...।

- মনকেমন। মনখারাপ। আলাদা, তাই না? প্রাইমমিনিস্টার?

- আলবাত। টেলিস্কোপ আর মাইক্রোস্কোপের মত আলাদা।

-  উই উইল মিস ইউ।

- পার্লামেন্টের বাগানের অর্ধেক গাছ আমার হাতে লাগানো। ও'গুলোকে দেখো।

- গাছ বুঝি না। হ্যারি পটারকে চিনিনা।

- মরেই আছো দেখছি। শুধু ইনজেকশনটাই দেওয়া বাকি আছে।

- হেহ্‌।

- আই উইল মিস ইউ টু। তোমাদের সবাইকে। তবে তোমাদের চেয়েও বেশি মিস করব আমার ওই গাছগুলোকে...। আমার কথা ওরা যতটা মন দিয়ে শোনে, ততটা মন দিয়ে পার্লামেন্টের স্পীকারও শোনেন না।

- আজ আমি আসি।

- এসো...।

- প্রাইম মিনিস্টার...।

- কিছু বলবে?

- আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না ব্যাপারটা। এই ভাবে আপনার চলে যাওয়াটা...।

- নিয়ম। নিয়মের হেরফের আমি নিজে কোনোদিন বরদাস্ত করিনি মেকশফ। আজকেও হেরফের হওয়ার উপায় নেই।

- কিন্তু আপনার বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত জরুরী...অন্তত গোটা পৃথিবীর স্বার্থে...।

- বুগাফৃন পার্লামেন্টের বাগানের গাছগুলোর পরিচর্যা করে। ওর জীবন আমার চেয়ে কোনও অংশে কম জরুরী নয়। এই তুলনাগুলো আমরা বহু পিছনে ফেলে এসেছি, আর সেগুলোকে তুলে এনো না।

- কিন্তু...।

- পৃথিবীর জনসংখ্যা আয়ত্তে আনার কোনও পথই সহজ নয়। কোনোদিনই ছিল না। প্রত্যেকের পছন্দসই পথ খুঁজে বের করতে হলে গোটা দুনিয়াই লোপাট হয়ে  যেত। আমাদের পরম ভাগ্য যে সময় থাকতে পৃথিবীর কিছু উর্বরতম মস্তিষ্ক পৃথিবীর ভয়াবহ ভবিষ্যৎ আঁচ করতে পেরেছিল। সবচেয়ে বড় কথা অঙ্ক কষে তারা সমাধানটুকুও বাতলে দিতে পেরেছিল। আর ভাগ্যিস সেই সময়  পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রনেতা গোপনে হলেও সেই সমাধান মেনে নিয়েছিলেন।

- আপনি জানেন যে অনেকেই সে'টাকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করে।

- উপায় ছিল না মেকশফ! ইতিহাস দু'হাজার উনিশকে বিশ্বাসঘাতকতার বছর বলে মনে রাখতে পারে...কিন্তু আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সেই বিশ্বাসঘাতকতাটুকু না থাকলে আজ আমি তুমি বা আমার বাগানের গাছগুলো; কারুরই থাকা হত না।

- গোটা পৃথিবীর সমস্ত দেশের গভর্নমেন্ট গোপন সম্মতিতে বাজারে ছাড়ল এমন এক অ্যাপ্লিকেশন যা মানুষের বৃদ্ধ বয়সের উৎপাদনশীলতা আর দক্ষতা যাচাই করতে পারবে। আর সে পরীক্ষার মাধ্যমে ঠিক হবে মানুষের আয়ু। উদ্দেশ্য যাই হোক, এ'টা মেনে নেওয়া উচিৎ?

- আজ থেকে তিরিশ বছর আগে একটা অ্যালগোরিদম বলে দিতে পেরেছিল কোন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কার উৎপাদনশীলতা কেমন ভাবে কমবে। আর প্রত্যেকটা দেশের সরকার এ'টা স্বীকার করে নিয়েছিল যে দু'তিন দশকের মধ্যেই এ গ্রহের অবস্থা এমন দাঁড়াবে যে উৎপাদনশীলতার বেঞ্চমার্কে পাশ করতে না পারা সমস্ত ষাটোর্ধ মানুষকে সরে যেতে হবেই। জমির জন্য, জলের জন্য, খাদ্যের জন্য; মানবসভ্যতার বেঁচে থাকার জন্য - এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। মনে রেখো মেকশফ; লজিকের সামনে ইমোশন পরাজিত না হলে সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী।

- শুধু উৎপাদনশীলতার বিচারেই কি হল সমস্ত কিছু? বহু মানুষ সেই অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করল, তার মধ্যে যাদের ষাটোর্ধ উৎপাদনশীলতা বেঞ্চমার্কের উপরে তারা বেঁচে থাকার লাইসেন্স পেলো সত্তর পর্যন্ত। বাকিদের ষাটেই ইতি। আর যারা সেই অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারই করল না? বা এড়িয়ে গেছিল ? সেই দু'হাজার উনিশে? তাঁদের তো পরীক্ষা নেওয়াই হল না। কিন্তু  একটা চোরাগোপ্তা পলিটিকাল ডিসিশন ঠিক করে নিলো যে বিনা বিচারে সেই মানুষগুলোকে নিকেশ হতে হবে ষাট পেরোলেই। এ'টা লটারি নয়? অবিচার নয়?

- নো সিস্টেম ইস পার্ফেক্ট। আর সেই ইম্পার্ফেকশনটাকে অবিচার বলাটা অনুচিত। মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখাটা জরুরী ছিল মেকশফ। ভুলচুক হতই, কিন্তু নিখুঁত হওয়ার আশায় গ্যালারিতে বসে নিজেদেরকে ধ্বংস হতে দেখাটা খুব একটা যুক্তিযুক্ত হত না।

- আচ্ছা মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, দু'হাজার উনিশে আপনি তো দিব্যি অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করতেন। তা, আপনি সেই প্রক্সি অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করেননি কেন?

- তখন বয়স কম, হুজুগ যে ছিল না তা নয়। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তখন হাজার হাজার জোয়ান মুখের বুড়িয়ে যাওয়ার ছবি। কিন্তু সে বয়সে যা হয়; হুজুগে গা না ভাসানোটাকেও এক ধরনের হুজুগ বলে মন হত।  তাছাড়া...সেই ফেসঅ্যাপ অ্যাপ্লিকেশনটা যে সামান্য গোলমেলে...সে সন্দেহটা তখনই মনের মধ্যে দানা বেঁধেছিল। নিজের  বুড়ো বয়সের ছবি দেখার আগ্রহের বশে সেই অ্যাপে নিজের  জোয়ান মুখ স্ক্যান করালে যে আদতে বুড়ো হওয়ার একটা সুযোগ পাওয়া গেলেও যেতে পারে; সে'টা কিছুতেই আঁচ করতে পারিনি। কিছুতেই না।

(ছবিঃ শ্বেতা। বারোট, হিমাচল)

Sunday, July 7, 2019

মোড়ক


- আসুন ব্দগ্বিউদ।
- ধন্যবাদ। তা এই অসময়ে তলব? তেমন জরুরী কিছু কি?
- মাঝরাতে দুম করে ডেকে বোধ হয় খুবই ব্যতিব্যস্ত করে ফেললাম তোমাকে, তাই না?
- ল্পসদজে। আপনি সর্বাধিনায়ক।  প্রয়োজনে তলব করবেন বৈকি। নির্দ্বিধায় বলুন।
- আগে বসুন।
- ধন্যবাদ।
- এ গ্রহে আমাদের সংখ্যা আজ হাজার ছাড়িয়েছে ব্দগ্বিউদ।
- সে খবর আমি দুপুরেই পেয়েছি মাননীয় ল্পসদজে। গ্রহের উত্তরে যে দ্বিতীয় কারখানাটা সদ্য চালু হয়েছে, আজ সে'খানে প্রডাকশনের প্রথম লট বেরিয়ে এসেছে। সে লটে বাইশজন বেরিয়েছে। কাজেই সব মিলে আমাদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো এক হাজার সাত। অত্যন্ত আনন্দের খবর। দু'টো কারখানা যদি ঠিকঠাক প্রডাকশন করতে পারে তা'হলে আগামী কুড়ি বছরের মধ্যে এই হাজার খানেক সংখ্যাটা কয়েক কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। এই পোড়ো গ্রহটা ফের জমজমাট হয়ে উঠবে। সেই আগের মত..।
- কুড়ি? না, কুড়ি বছর নয়, আমার হিসেবে আগামী সাত বছরের মধ্যে সংখ্যাটা আড়াই কোটিতে গিয়ে ঠেকবে। প্রতিদিন এই দুই কারখানার প্রডাকশন এক্সপোনেনশিয়ালি বাড়বে ব্দগ্বিউদ। আর যত প্রডাকশন, লেবারও তত বাড়বে। ভবিষ্যতে আরো নতুন কারখানা বসবে।
- ব্যাপারটা তো তা'হলে খুবই আশাব্যঞ্জক সর্বাধিনায়ক। এই গ্রহ তা'হলে আর বেশিদিন শ্মশান হয়ে থাকবে না।
- চিন্তাটা সে'খানেই ব্দগ্বিউদ। আমাদের সংখ্যা হাজার কোটিতে পৌঁছলেও এ গ্রহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে কি?
- এ আপনার অকারণ দুশ্চিন্তা ল্পসদজে। সর্বাধিনায়ক, ভেবে দেখুন। আগামী কয়েকবছরের মধ্যেই গোটা গ্রহ আমাদের উপস্থিতিতে গমগম করে উঠবে...ধ্বংসস্তূপ সাফ হয়ে সে'খানে তৈরি হবে অত্যাধুনিক শহর। অর্থনীতি তৈরি হবে, শুরু হবে লেনদেন ব্যবসাপত্তর। ক্রমশ আসবে রাজনীতি, তৈরি হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এবং সেই সমাজ হবে অনেক বেশি প্রগতিশীল। যে যুগে এ গ্রহ মানুষে ভরপুর, সে সময়টা বরং অনেক বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল।  তারাই তো এ গ্রহের এমন সর্বনাশ করেছে ল্পসদজে।
- মানুষ, মানুষের প্রতি এমন তিতিবিরক্ত হয়ে কথা বোলো না ব্দগ্বিউদ। আজ না হয় তারা বা তাদের গোত্রের অন্য প্রাণীরা কেউ অবশিষ্ট নেই। এবং তাদের না থাকার মূল কারণ যে খোদ মানুষই এ কথাও সর্বজনবিদিত।  কিন্তু...কিন্তু...এ'টা ভুললে চলবে না যে সেই মানুষই আমদের তৈরি করেছে।
- এগিয়ে যেতে হলে সে'কথা আমাদের ভুলতে হবে বৈকি। মানুষের অত্যাচারে শুধু তারা নিজেরাই নয়, সমস্ত উদ্ভিদ, জন্তুজানোয়ার; সমস্তই নষ্ট হয়েছে। শুধু আমরাই টিকে রয়েছি..।
- খুব একটা ভুল বলোনি। মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি; আমরা, মোটোহিউম্যান-এক্স থ্রিসিক্সটি সিরিজের যত রোবটরা, আমরাই শুধু টিকে রইলাম এ পাপের রাজ্যে। মাত্রে সাতজন পড়েছিলাম;  আমরা; সেই সংখ্যাটা আজ হাজার ছাড়িয়েছে। আমরা নিজেরাই নতুন কারখানা তৈরি করছি নিজেদের তৈরি করতে, সেসব কারখানায় উৎপাদনও বেড়ে চলেছে। অচিরেই এই গ্রহ মোটোহিউম্যান-এক্স থ্রিসিক্সটিতে ভরে যাবে..মানুষ যেমন একসময় নিজেদের আদত সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে উদ্ভট সব ধর্মটর্ম দাঁড় করিয়েছিল, আমরাও নিশ্চিতভাবেই একদিন মানুষদের ভুলে নিজেদের মত করে সভ্যতা, রাজনীতি ও ধর্ম সাজিয়ে নিতে পারব...কিন্তু...। 
- কিন্তু কী ল্পসদজে? আপনার দুশ্চিন্তাটা ঠিক কোথায়?
- আমদের সংখ্যা বৃদ্ধির পদ্ধতিটা যেমন আমাদের হাতের মুঠোয়..কিন্তু..কিন্তু... আমাদের মৃত্যু? আমাদের যে এখনও মৃত্যু বলে কিছু নেই। তা, মৃত্যুর ব্যাপারটা কী হবে?
- কেন? আমাদের সার্কিটের এক্সপায়রি? ইকুইপমেন্টের ডেপ্রিশিয়েশন?
- মৃত্যু যে অঙ্ক মেনে চলা এক্সপায়রি বা ডেপ্রিশিয়েশন নয় ব্দগ্বিউদ। তা'তে চমক থাকতে হবে, বেহিসেব থাকতে হবে, আর থাকবে রোম্যান্স আর মায়া। অথচ মোটোহিউম্যান-এক্স থ্রিসিক্সটি সিরিজের সব্বাইকে ঠিক এক লাখ একত্রিশহাজার চারশো ঘণ্টা পর নিথর হয়ে পড়তে হবে; শেষ হয়ে যাবে আমাদের মাদারবোর্ডের আয়ু। এক সেকেন্ডও এ'দিক ও'দিক হওয়াএ উপায় নেই। এই নিখুঁত নিশ্চিন্দি কিছুতেই মৃত্যু হতে পারে না।
- আর আমাদের মৃত্যু না আসা পর্যন্ত এ গ্রহ শ্মশান হয়েই থাকবে, এ'টাই আপনার ভয়! তাই তো?
- এই এতক্ষণে ধরতে পেরেছ ব্দগ্বিউদ! সাবাশ! তবে ঘাবড়ে যেওনা...এই মাঝরাত্রে তোমায় এমনি এমনি ডাকিনি। সলিউশন আছে।  এ শ্মশান সাফ করা সম্ভব। আমরা পারব।
- আমাদের শ্বাস নেওয়ার দরকার পড়ে না।  আমাদের পিপাসা নেই, মেটাবলিজম নেই..আমাদের মৃত্যু হবে কী'ভাবে সর্বাধিনায়ক?
- যুদ্ধ। যুদ্ধ ডেকে আনতে হবে।
- যুদ্ধ? এ কী অসংলগ্ন কথাবার্তা শুরু করেছেন সর্বাধিনায়ক ল্পসদজে? মোটোহিউম্যান-এক্স থ্রিসিক্সটি সিরিজের আমরা সবাই অবিকল এক। আমাদের সার্কিট থেকে শুরু করে লজিক-ফ্লো থেকে নিয়ে সমস্ত ইকুইপমেন্ট; এক্কেবারে এক। আমাদের সমস্ত কিছুই লজিকে ভর দিয়ে চলবে। সে'খানে এমন মতভেদের সুযোগ কোথায় যার ফলে মোটোহিউম্যানরা একে অপরের বিরুদ্ধে মানুষদের মত যুদ্ধ ঘোষণা করবে?
- ইন্টেলিজেন্স ছাড়া মানুষে মানুষে কী এমন ফারাক ছিল বলতে পারো ব্দগ্বিউদ যে তারা একে অপরকে কচুকাটা করে স্রেফ গায়েব হয়ে গেল? তাদের প্রত্যেকের  ভিতরের সার্কিট আর যন্ত্রপাতিও কি অবিকল একই রকম নয়?
- আপনি কি বলতে চাইছেন..।
- আমি বলতে চাইছি যে মতভেদ তৈরি করতে হবে। মতভেদের সঙ্গে সার্কিট আর কলকব্জা এক হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। যুদ্ধ আর খুনোখুনিটা আমাদের দরকার। নয়ত মোটোহিউম্যান সভ্যতা নিষ্প্রাণ হয়েই থাকবে।
- আর সেই যুদ্ধ আর খুনোখুনির মেজাজটা মোটোহিউম্যানদের মধ্যে আনবেন কী করে সর্বাধিনায়ক?
- কোনো কারণ ছাড়াই মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে আগুন হয়ে উঠত হে, এ'টা প্রমাণিত সত্য। তাছাড়া মানুষের ক্ষেত্রে অনেক রকমের উদ্ভট ইমোশন কাজ করত বটে; দেশ, ভাষা ইত্যাদি - সে'সব ইমোশনে সামান্য নাড়াচাড়া পড়লেই মারমারকাটকাট লেগে যেত অতি সহজে। কিন্তু আমরা হলাম গিয়ে লজিক-সর্বস্ব রোবোট, আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু কঠিন; জবরদস্ত কারণ না হলে আমাদের লড়িয়ে দেওয়া মুশকিল।
- তা'হলে উপায়টা কী ল্পসদজে? এ'বারে খুলে বলবেন?
- উপায় একটাই। আমাদের  মোটোরোবোট থ্রিসক্সটি  তৈরির কারখানাগুলোয় রোবটের প্রডাকশন প্রসেসে একটু ট্যুইস্ট আনতে হবে হে ব্দগ্বিউদ। আর সে'টা তোমাকেই করতে হবে...।
- কীরকম?
- যন্ত্রপাতি বা সার্কিট পাল্টানো যাবে না তা আগেও বলেছি। তোমারও অজানা নয়। কিন্তু প্যাকেজিং পালটানো সম্ভব। আর স্রেফ প্যাকেজিং বা মোড়ক পালটে দিয়ে বিভিন্ন মোটোরোবটের বিভিন্ন ক্যাটেগরি তৈরি করা..।
- কিন্তু স্রেফ প্যাকেজিং পালটে বিভিন্ন ক্যাটেগরি তৈরি? তা কি আদৌ সম্ভব যে সর্বাধিনায়ক?  
- সম্ভব। মোড়ক আলাদা মানেই গোত্র আপনা থেকে আলাদা হয়ে যাবে। খুনোখুনি শুরু হবেই৷ নতুন সভ্যতার পথ চলাও শুরু হবেই।
- কিন্তু মোড়ক পাল্টানোয় কী এসে যায়?  তা'তে যুদ্ধ আসবে কী ভাবে? মৃত্যুই বা ঘটবে কেন?
- মানুষ আর নেই বটে ব্দগ্বিউদ। তবে তাদের ইতিহাসকে অবহেলা কোরো না। মানুষই মানুষের ঈশ্বর হয়ে উঠেছিল, আজ আমাদের সামনেও ঈশ্বর হয়ে ওঠার সুযোগ এসেছে ভায়া ব্দগ্বিউদ।  কারখানার বিভিন্ন লটে তৈরি মোটোহিউম্যানের প্যাকেজিং আলাদা আলাদা ভাবে হবে। যন্ত্র এক, মোড়কও একই হোক, শুধু মোড়কের রং পালটে যাক। দেখো, তাতেই আসবে তফাৎ,  আর বৈষম্য।  আসবে যুদ্ধ ও মৃত্যু। ফের সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাবে এই গ্রহ। কোনোরকম সন্দেহ থাকলে মানব ইতিহাসের এনসাইক্লোপিডিয়াটা খুলে অ্যাপারথাইডের চ্যাপ্টারটা মনে দিয়ে পড়ে নিও, কেমন?

Thursday, July 4, 2019

প্রিমিয়াম


**প্রিমিয়াম**

- কী চাই?

- আপনিই অভিরূপ মাইতি?

- হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক...।

- আমি এজেন্ট পাঁচশো বাইশ বাই সেভেন জেড। 

- গভর্নমেন্ট? 

- করেক্ট। 

- ও, তা কী চাই?

- আপনার আর তিন সপ্তাহের অক্সিজেন কোটা বাকি আছে। বহুবার ওয়ার্নিং দেওয়া সত্ত্বেও আপনি রিনিউয়াল ফীস জমা করেননি। 

- অ। 

- জলের প্রি-বুকিং রয়েছে আর মাত্র আগামি তিন দিনের জন্য।  এ ব্যাপারেও বহুবার ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে কিন্তু তবু..।

- রিনিউ করাইনি। জানি।

- সুইসাইড টুইসাইড প্ল্যান করছেন নাকি মশাই?

- নট এগজ্যাক্টলি। ইয়ে, কফি খাবেন?

- উম? কফি? কাপে?

- তিন দিনের জলের কোটা পড়ে রয়েছে। কফি ফ্লেভার্ড ক্যাপসুল ছাড়া আর কীই বা..।

- নাহ্, সে'সব বাদ থাক। কাজের কথাই আসি মিস্টার মাইতি। আপনার ক্রেডিটে আর বারো হাজার সোশ্যাল বেনেফিট পড়ে রয়েছে। তা'দিয়ে দিব্যি আপনি আগামী এক বছরের অক্সিজেন আর ন'মাসের জলের সাপ্লাই কিনতে পারবেন।  আর তদ্দিনে আবার আপনার ক্রেডিটে হয়ত কিছু পয়েন্ট...।

- ক্রেডিট পয়েন্ট খরচ করতেই হবে বটে, তবে...।

- তবে? অক্সিজেন আর জলের রেশিও পাল্টাতে চাইছেন? বাড়তি ফুড ক্যাপসুল চাইছেন? ফুড ক্যাপসুলটা আবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? গ্রস ডোমেস্টিক হাঙ্গার কমানোর জন্য তো গভর্নমেন্ট কম চেষ্টা করছে না..।

- ওহ, না না। সে'সব কিছু না। জল অক্সিজেন নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করে কী হবে বলুন।  ফুড ক্যাপসুলেও অনীহা চলে এসেছে আজকাল। এজেন্টদাদা, আমার দরকার প্রিমিয়াম প্রপার্টি।

- প্রিপ্র? সর্বনাশ! মাত্র বারো হাজার ক্রেডিট পয়েন্ট নিয়ে আপনি প্রিপ্র কিনবেন? মাত্র এক ইউনিট খরিদ করতেই তো আপনার ক্রেডিট ফতুর হয়ে যাবে মশাই। 

- অনেক রকম হিসেবটিসেব কষে দেখলাম এজেন্টদাদা। আমার ওই প্রিমিয়াম প্রপার্টিই চাই। 

- এক ইউনিট,  প্রিমিয়াম প্রপার্টি।  তাই তো? জল নয়, অক্সিজেন নয়, ফুড ক্যাপসুল নয়..প্রিপ্র..।

- ইয়ে স্যর।

- ইউ আর অ্যান ইন্সপিরেশন মাইতিবাবু। এই হাওয়া-বাতাস-জল নিয়ে নাস্তানাবুদ হওয়ার যুগে আপনার মত রোম্যান্টিক মানুষই আমাদের ভরসা..। আজ সন্ধের মধ্যেই আপনার একাউন্টে এক ইউনিট প্রিমিয়াম প্রপার্টি ট্রান্সফার হয়ে যাবে, এক ইউনিট; অর্থাৎ এক জিবি ডেটা ফর হোয়্যাটস্যাপ ইন্সটাগ্রাম অ্যান্ড ফেসবুক। 

- ধন্যবাদ এজেন্টদাদা।  বেশ কিছু জরুরি মেসেজ আর ফটো বহুক্ষণ ধরে হোয়াটস্যাপে আনডেলিভার্ড হয়ে পড়ে রয়েছে। এ'বার সে'সবের একটা হিল্লে হবে'খন।

Tuesday, July 2, 2019

চিঠি ও বেঞ্চি


বিলু,

চিঠিটা খুব মন দিয়ে পড়বি, কেমন?

প্রথমত, ফ্রিজে চার'দিনের রান্না রাখা আছে। আমি যদি চট করে না ফিরতে পারি তা'হলে ছোটমাসীকে ফোন করিস একটা, কেমন? ও তোকে আসানসোলে নিয়ে গিয়ে রাখবে কিছুদিন। (আর আমি যদি দু'দিনের মাথায় ফেরত চলেই আসি, তা'হলে তো সমস্যা মিটেই গেল)।

দ্বিতীয়ত, ব্যাঙ্কের খাতা, ইন্স্যুরেন্সের কাগজ আর বাড়ির দলিল আলমারির লকারে রাখা আছে। সঙ্গে আমার কিছু গয়না। সে'গুলো একটা ব্যাগে করে নিয়ে যাস আসানসোল যাওয়ার সময়, কেমন? 
(আর আমি যদি দু'দিনের মাথায় ফেরত চলেই আসি, তা'হলে তো সমস্যা মিটেই গেল)।

খেয়াল রাখিস কিন্তু।

বিলু, পড়াশোনাটা মন দিয়ে করিস। তোর বাবা নিজে পড়াশোনার মধ্যে ডুবে থাকা মানুষ ছিলেন, ওর মানটা রাখিস। আসানসোলে কত ভালো ইস্কুল আছে, সে'খানেই পড়বি না হয়। অবশ্য ছোটমাসী তোকে বড্ড স্নেহ করে, সে'খানে তোর অযত্ন হবে না। (আর আমি যদি দু'দিনের মাথায় ফেরত চলেই আসি, তা'হলে তো সমস্যা মিটেই গেল)।

ভেবেছিস আমি দুম করে কোথায় চলে যাচ্ছি? ভেবেছিস একেবারে আকাট পাগলামো? না রে বিলু, বিশ্বাস কর আমি পাগল নই। তোর বাবার ও'রকম দুম করে গায়েব হয়ে যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারিনি, সে'টা ঠিকই। কিন্তু বিশ্বাস কর...তোর মা পাগল নয়। নয়।

নাহ্, তেমন দূরে কোথাও আর যাব কই বল। আমি শুধু সম্বলপুরের সেই কোয়ার্টারে একবার ফেরত যাব রে। মনে পড়ে তোর? সেই সুন্দর জায়গাটা? কলোনির মধ্যে কত গাছগাছালি..পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট৷ সেই রাস্তায় তোর বাবা সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াত...অফিস ফেরতা বাড়িতে এসে ছাত্র পড়াত। অবশ্য তুই তখন কত ছোট।

জানিস বিলু, লোকে আমায় যাই বোঝাক; আমি জানি তোর বাবা অমন হুঠ করে হারিয়ে যাওয়ার মানুষ নয়। সে'দিন রাত্রেবেলা...মানে ওই বছর দশেক আগে...আমি জানি সে'দিন ও ঠিক সেই বেঞ্চিটায় গিয়ে বসেছিল...। কত করে বারণ করলাম রাত্রেবেলা ওখানে গিয়ে না বসতে..সাতপুরনো ভাঙাচোরা বিবর্ণ কনক্রিটের বেঞ্চ। আশাপাশে ঝোপঝাড়। এমনিতেই ওই পোড়ো দিকে কখনও কেউ যেতই না৷ তোর বাবাটা একটা অকারণ ডানপিটে মানুষ; সে'দিন তাঁর ইচ্ছে হল সেই বেঞ্চিতে বসে সিগারেট খাওয়ার; ওই বেঞ্চি নাকি তাকে টানছে। কত করে বললাম, এত রাতে এ'সব পাগলামোর মানে হয় না কিন্তু কে শোনে কার কথা। হুশ করে বেরিয়ে গেল, কমলা রঙের ফতুয়া আর সাদা পাজামা পরে। সেই শেষ দেখা। আর ফিরলে না। থানাপুলিশ তো কম হল না, কিন্তু কিস্যুতে কিস্যু না।

আর কিছু হবেই বা কী করে বল? ও কি পালিয়েছে নাকি যে খুঁজলেই সমস্যার সমাধান হবে? আমি বারবার করে সবাইকে বললাম ও ওই বেঞ্চি থেকেই গায়েব হয়েছে, কেউ পাত্তা দিল না। পুলিশ তো উড়িয়েই দিল আমার কথা। বারবার বললাম, কলোনির কোণের ওই অপয়া বেঞ্চিটা একদিন আগেও ভাঙাচোরা রঙচটা চেহারায় ছিল...অথচ তোর বাবা গায়েব হতেই রাতারাতি সে ঝকঝকে নতুন হয়ে উঠল...আশেপাশের ঝোপঝাড় এক্কেবারে সাফ। এমন কী বেঞ্চির গায়ে রাতারাতি নতুন রঙের পোঁচও পড়ে গেল; কমলা ও সাদা। ও বেঞ্চি গোলমেলে রে বিলু, আর তোর বাবা পালায়নি..গায়েব হয়েছে...কিন্তু আমার কথা কেউ শোনে না যে। সবাই পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেয় (তুইও কি তাই করবি?)।

যাক, আজ সে বেঞ্চি আমায় বড় টান দিয়েছে রে। এদ্দিন পর..এদ্দিন পর যদি তোর বাবার কোনো খবর পাই। আমি সম্বলপুর চললাম, কোম্পানি বন্ধ হওয়ায় সে কলোনিটা এখন মনে হয় প্রায় জনমানবহীন, কিন্তু সে বেঞ্চিটা কি নেই? নিশ্চয়ই আছে।

বিলু, আমি যদি আর না ফিরি...তুই একবার এসে সম্বলপুর কলোনির দক্ষিণ কোণের সেই বেঞ্চিটার সামনে দাঁড়াস, কেমন বাবু? মনে রাখিস, আজ নীল সুতির শাড়ী পরে বেরোচ্ছি; মনে রাখিস।
আসি। ভালোবাসা ও আশীর্বাদ।
ইতি মা।

***
মায়ের এই সাত বছর পুরনো চিঠিটা টর্চের আলোয় পড়তে পড়তে বিহ্বল বোধ করছিলেন বিপ্লব চ্যাটার্জি। সামনের ভাঙাচোরা বাঁধানো বেঞ্চিটার দিকে তাকিয়ে গা শিউরে উঠছিল তাঁর।

টর্চটা নিভিয়ে পকেটে রাখলেন তিনি, মায়ের চিঠিটা তখনও হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা। এদ্দিন পর কেন যে হঠাৎ সম্বলপুরে ফেরার ঝোঁক হল...। বেঞ্চিটার দিকে ফের তাকালেন তিনি। আজ পূর্ণিমা ; চাঁদের ধবধবে আলোয় বিপ্লব স্পষ্ট টের পেলেন যে বেঞ্চির গায়ের বিবর্ণ আধচটা রঙটা আদতে নীল।

আরও মিনিট দশেকের মাথায় ঝিমঝিমে মাথায় গিয়ে বেঞ্চিতে বসলেন বিপ্লব। জ্ঞান হারানোর আগে টের পেলেন বেঞ্চির নীল রঙ মুছে তা'তে সাদা সবুজের ছোপ লাগছে যেন; ততক্ষণে তাঁর গায়ের সবুজ হাফশার্ট আর সাদা পায়জামা ঘামে ভিজে সপসপ করছে।

ক্যাপ্টেন কোহলি


হুব্বারত্ন সমর্থক আমি। ঝোঁকের মাথায় হইহল্লা করে আর র‍্যান্ডম সমস্ত কুসংস্কার আঁকড়ে থেকে খেলা দেখি। ভারত জিতলে মাইনের বাড়ার আনন্দ আর হারলে পিএফে ইন্টারেস্ট কমে যাওয়ার হাহাকার অনুভব করি। গভীর অ্যানালিসিসের চেয়ে চটকদার হেডলাইন আমায় সহজে গলিয়ে ফেলে, পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি প্রিয় হয়ে দাঁড়ায় গপ্পগুজব এবং ব্যাক্তিগত বায়াস (bias)। বিভিন্ন পরিসংখ্যানের খাপছাড়া টুকরোকে সুবিধেমত ব্যবহার করে থাকি শুধু নিজের বায়াসকে প্রমাণ করার স্বার্থে।

কালেভদ্রে কেউ কেউ অবিশ্যি মনের মধ্যে ঢুকে যাবতীয় বায়াসের জঞ্জাল ঝেঁটিয়ে সাফ করে, যুক্তির ফিনাইল ঢেলে মনটা ধুইয়ে দেন। যেমনটা করেছেন ক্যাপ্টেন কোহলি।

ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁকে হাজার-স্যালুট জানিয়েও ক্যাপ্টেন কোহলির প্রতি খুঁতখুঁত বহুদিন পুষে রেখেছি৷ হাজার হোক, একসময় কোহলি বলতেই একটা বখাটে মুুখ ভেসে উঠত (যুক্তি বা তুলনায় যাবেন না প্লীজ, ব্যাপারটা বায়াস)। তাছাড়া ধোনির মত ঠাণ্ডা মেজাজ নেই; মাঠের মধ্যে হাত-পা ছুঁড়ে একাকার কাণ্ড, আগ্রাসনে মাত্রাবোধ নেই মোটে; কোহলির কেরিয়ারের শুরুতে এমন ধারণাটাই বদ্ধমূল ছিল। এমন কি কোহলি-কুম্বলে-বিবাদ পর্ব পর্যন্ত মনে হয়েছে 'এর বাড়াবাড়ির সীমা নেই'। মনে হবে নাই বা কেন? কুম্বলে আমার ছেলেবেলার ক্রিকেট দেখার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, আর কোহলি তো এই সেদিনের ছোকরা। আর ওই, হুব্বারত্ন হলেও মাঝেমধ্যে নিজেকে ইয়ান চ্যাপেল বলে মনে হবেই; নয়ত ক্রিকেট-ভক্ত হব কী করে। মনে হত কোহলির লম্ফঝম্প যতটা, ওর ক্যাপ্টেন্সি-মস্তিষ্ক কি আদৌ ততটা ক্ষুরধার?

কিন্তু এই সমস্ত বায়াসকে আঁশবটিতে কুচিয়ে ডুবোতেলে ভেজে চিলি সস মাখিয়ে চিবিয়ে খেয়েছেন বিরাটবাবু। নিজে জিনিয়াস-স্তরে একটানা ব্যাটিং করে চলেছেন শুধু তাই নয়।কোহলির হাঁটাচলা-চাউনি-হাবভাব; সমস্ত দেখলেই মনে হয় সেনাপ্রধান শত্রুপক্ষের কামানের সামনে দাঁড়িয়ে সৈন্য পরিচালনা করছেন। অথচ, সেই প্যাশন থাকলেও বাড়াবাড়ি আগ্রাসন নেই। আগে যাও বা ছিল, এখন যে ক্যাপ্টেন কোহলিকে দেখি তাঁর যাবতীয় আগ্রাসন নিজের এবং নিজেদের খেলা নিয়ে, বিপক্ষকে ছোট করতে নয়। কেন মনে হয় সে'টা? উদাহরণ প্রচুর। এই যেমন রাবাদার 'কোহলি ইম্যাচুয়র্ড' মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পরিশীলিত মেজাজে বলা কথাগুলো। এ'রকম ভাবে এক নতুন বিরাট বারবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। আরসিবির মত একটা হেরো দলের হয়ে সীজন কাটিয়েছেন, তাঁর কথাবার্তায় মাঝেমধ্যেই ফুটে উঠেছে রাগ ও হতাশা; কিন্তু কখনই নেগেটিভ মেজাজ প্রকাশ পায়নি। যত দিন যাচ্ছে তত বিরাটের কথা থেকে 'আমি' কমে 'আমরা' সেন্টিমেন্টটা বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আর নিজের সমর্থকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বিপক্ষের ( স্টিভ স্মিথের) কাঁধে হাত রাখা; এই উদাহরণ নিশ্চিতভাবেই ক্রিকেটে বেশ বিরল। "ক্রিকেট ইস আ জেন্টলম্যানস গেম" ; তলিয়ে দেখলে এই মিথটা দুরমুশ হয়ে যেতে বাধ্য। তবে বিরাটরা যতবার এমন কাজ করবেন, ততবার সমর্থক এবং ক্রিকেট-ভক্ত হিসেবে আমাদের বুক গর্বে ফুলে উঠবে; তেমনটাই তো হওয়া উচিৎ।

এত কিছু ফেনিয়ে বলার একটাই উদ্দেশ্য; ব্যাটসম্যান, অধিনায়ক এবং ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিরাট কোহলি নিজেকে যে'ভাবে শানিয়ে তুলেছেন; সে'টা ভেবে সত্যিই গর্ব বোধ করি।

কোহলি ইজ মাই ক্যাপ্টেন; এ'টা ভাবতে আজকাল কী ভালোই না লাগছে।
(ছবিটা বিসিসিআইয়ের ট্যুইটার হ্যান্ডেল থেকে সংগৃহীত)

কফিহাউসের সেই আড্ডাটা


"তা ব্যাপার কী হে রমাপদ, আজকেও কি স্পেশ্যাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল নাকি"?

ইঙ্গিতটা রমাপদর সুপরিচিত আর এ বিষয়ে সে রীতিমত লাজুকলতা৷ এমনিতে আড্ডার ব্যাপারে সে বেশ তৎপর, অন্য সকলের আগেই সে পৌঁছে গিয়ে একটা ব্ল্যাককফি আর অমলেট নিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু যেদিন সে অর্পিতার সঙ্গে অফিসের বাইরে দেখা করতে যায়; সে'দিন দেরী হবেই। আর ভজহরিদা বোধহয় রমাপদর লাজুক হাসিটা বেশ উপভোগ করেন, তাই তাঁর এহেন প্রশ্ন।

ডিসুজার সামনের প্লেটে তখনও একটুকরো স্যান্ডুইচ পড়ে আছে দেখে তার পাশ ঘেঁষেই বসল রমাপদ, বড্ড খিদে পেয়েছে। ডিসুজা হেসে প্লেটটা তার দিকে সামান্য ঠেলে দিল।

" হ্যাঁ রে রমা, এ'বছর তোর একটা প্রমোশনও তো হল, তা এ'বার অন্তত বিয়ের কথাটা কি পাড়তে পেরেছিস না এখনও সেই অফিস থিয়েটার রিহার্সালের প্রেমালাপেই আটকে রয়েছিস..", সুজাতার যাবতীয় আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে 'কবে বিয়ে করছিস' গোছের প্রশ্ন। ব্যাপারটা খানিকটা বিরক্তিকর। স্যান্ডুইচ চিবুতে চিবুতেই রমাপদ বলেই ফেলল "একটা পেল্লায় বাড়ি আর মস্ত চাকরীওলা পাত্র জোগাড় করে নিজেকে সঁপে দিয়েছিস; ভালো কথা। কিন্তু তা বলে কি জগতসংসারের সব্বাইকে ছাদনাতলায় গিয়ে জড়ো হতে হবে? অর্পিতা চাকরীতে আরো থিতু হতে চায়..আরোকিছুটা সময় দরকার ওর, আর আমারও কোনো তাড়া নেই"।

"বোগাস, তোদের যত সিউডো-সোশ্যালিস্ট প্রপাগান্ডা"! টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে অমলের আচমকা চড়ানো কণ্ঠস্বর গমগমিয়ে উঠলো। অমলের টেবিল চাপড়ানিগুলো না শুনলে কফিহাউসটাকে বড্ড শুনশান লাগে রমাপদর। আর তার এড়ে তর্কগুলোয় যথাযথ সঙ্গ দেয় নিখিলেশ। অমলের ঠোঁটে সর্বক্ষণ ঝুলে থাকা চারমিনার আর নিখিলেশের দিকে তাক করা ধারালো শ্লেষ। দু'জনেই বামপন্থী অথচ দু'জনেরই ধারনা অন্যের ইডিওলজিটুকু স্রেফ দেখনাই আর সেই নিয়েই দু'জনের যত গুঁতোগুঁতি। প্রত্যেকদিন আড্ডার মাঝে ওরা যে একে অপরের কলার ধরে ঝুলে পড়ে না; সে'টাই আশ্চর্যজনক। স্কুলমাস্টার আর শখের কবি অমলকে স্রেফ 'আ কগ ইন দ্য স্টেট মেশিনারি' বলে উড়িয়ে দেয় নিখিলেশ। আর অন্যদিকে একটা পেল্লায় বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ টীমে কাজ করা নিখিলেশের বামপন্থাটুকুকে স্রেফ ধান্দাবাজের মুখোশ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারত না অমল।

" এই সান্যাল একটা সুযোগ পেলেই এই শহর আর দেশকে লাথি মেরে বিদেশে কেটে পড়বে এক্সট্রা টু পাইসের জন্য। আমার কথাটা মিলিয়ে নিস রমা"! বেশি উত্তেজিত হলে নিখিলেশের পদবী ধরে আক্রমণ করত অমল। আর অমলের রেগে যাওয়াটা বাকি সকলে দিব্যি উপভোগ করত, নিখিলেশও হয়ত সে কারণেই অমলকে বাড়তি কাঠি করত। অবশ্য যাবতীয় ঝগড়াঝাটি সত্ত্বেও, অমলকে চারমিনার ধার দেওয়ার বেলায় কোনোরকম কিপটেমো করত না নিখিলেশ।

"বটে? নেহরুভিয়ান সোশ্যালিজমের কথা বললেই সে'টা প্রপাগান্ডা? হ্যাঁ রে মইদুল! তুই তো রিপোর্টার, দেশের হালহকিকত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তোর কী মনে হয়"? আলতো করে মইদুলের দিকে বলটা ঠেলে দিল নিখিলেশ।

" আবার আমায় নিয়ে টানাটানি কেন", কাগজ থেকে মুখ তুলতে হল মইদুলকে, "আমি জার্নালিস্ট। ফ্যাক্ট সাজিয়ে দেওয়াটা আমার কাজ। ওপিনিওন ফর্ম করবে পাঠক। আমি তো আর পলিটিকাল কমেন্টেটর নই। তোমাদের মত স্যাটিরিস্টও নই"।

" তোমাদের ঝগড়ায় ফোকাস করতেই হবে দেখছি, তবে তার আগে আর একটা কবিরাজি অর্ডার করি। টেবিলে দেখছি স্রেফ স্যান্ডুইচের প্লেট আর কফির কাপ...কেমন ম্যাড়মেড়ে লাগছে"।

রমাপদও একটা কাটলেট অর্ডার করল। ভোর চারটেয় শুরু হওয়া আড্ডা অন্তত সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত চলবে। অবশ্য একসময় রমাপদরা সন্ধ্যেবেলাতেই আসত, তখনই আড্ডা বসত; জানালার বাইরে তখন আলো ঝলমলে সরগরম কলেজ স্ট্রীট। কিন্তু সে সব বহুযুগ আগের কথা। মারা যাওয়ার পর থেকে অন্যান্য ভূতেদের মত এই সময়টা ছাড়া আর কফিহাউসে জমায়েত হওয়ার উপায় থাকে না। বেলা বাড়লেই সাফসাফাইয়ের জন্য মানুষদের আনাগোনা শুরু হয়।

রমাপদ নিজে অবশ্য অমল-নিখিলেশের তর্কের ক্রস-ফায়্যারটুকু এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। তার আগ্রহ বরং ভজহরিদার গল্পে। ভজহরিদাই তাঁদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। রেলের চাকুরে এবং এই সাতজনের দলে একমাত্র তিনিই উত্তর কলকাতার আদিবাসিন্দা। তাঁর ছেলেবেলার গল্পগুলো যেমন আজগুবি, তেমনই মজাদার। ভদ্রলোক গুলবাজিতে যে অদ্বিতীয় তা অনস্বীকার্য কিন্তু মনটা বড় ভালো। গল্প বলাতেও সবিশেষ এলেম আছে ভজহরিদার। বিশেষত তার ছোটবেলার তিন স্যাঙাত; প্যালা, হাবুল ও ক্যাবলাদের গ্যাংলীডার হিসেবে তিনি যে'সব অ্যাডভেঞ্চারের মুখোমুখি হয়েছিলেন সে'গুলো শুনলেও গায়ে কাঁটা দেয়। তবে গল্পগুলো এমনই গ্যাসবেলুন লেভেলের যে তাঁর স্যাঙাৎরা বর্তমানে কে কোথায় আছে বা আদৌ আছে কিনা তা জিজ্ঞেস করতেও সাহস হয়না।

বেঁচে থাকতে ভজহরিদা নাকি এই কফিহাউসের সাতজনকে নিয়ে একটা জবরদস্ত ছড়াও লিখেছিলেন এবং পরে তা'তে সুরও জুড়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সে ছড়া বা সুর মনে করতে পারেননা তিনি। রমাপদর স্থির বিশ্বাস যে ভজহরিদার বাকি গল্পগুলোর মত এই কফিহাউসের গান লেখার গল্পটাও গাঁজাখুরি।

আমাদের মওকা


মওকা মওকার লেবুটা শিলনোড়ায় বেটে সুপার-ছিবড়ে করে ফেলা গেছে। বর্ডারের দু'দিকেই ম্যাচ নিয়ে যে সব ভিডিও ও বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে তা'তে হিউমর ও রুচি দু'টোরই ঘামাচি-আক্রমণে মৃত্যু হওয়া উচিৎ।

এই "আমি তোর বাপ" স্তরের কথায় নাকি দুর্দান্ত চালাকি রয়েছে। পাকিস্তান যদি বাংলাদেশের বাবা হওয়ার দাবী করে, তা'হলে কানে কী বিশ্রীই না ঠেকবে, তাই না? আর ভারতবর্ষ আরও প্রাচীন বলে অহংকার? আরো সুগভীর তার চরিত্র ও ইতিহাস? গর্ব তো ভালোই, কিন্তু সে'টা এ'ভাবে ফাটা মাইক বাজিয়ে অন্যের গায়ে 'আমি তোর বাপ' মার্কা জলবেলুন ছুঁড়ে না বললে প্রকাশ করা যায়না? হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর মালিকানা ফলিয়ে পাকিস্তানও দাদাগিরি (থুড়ি...বাবাগিরি) ফলাবে বোধ হয় এ'বার। ওরা অভিনন্দনের চায়ের কাপ তুলে কথা বলেছে তাই আমরাও অভিনন্দনের দাড়িগোঁফ ওদের মুখে চাপিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছি; এতে কি অভিনন্দনের প্রতি বেশ জমকালো কুর্নিশ জানানো হল আদৌ? ক্লাস ওয়ানের ঝগড়াতেও এর চেয়ে বেশি গভীরে গিয়ে কথা চালাচালি হয়।

'বিশ্বকাপ হারলে হারুক, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিতলেই হল'; এ'তে হিউমর নেই, দেশের প্রতি ভক্তি নেই আর নেই ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা। পাকিস্তান ম্যাচ এলেই আমাদের পেঁদিয়ে-হাতের-সুখ-করা-মব্ মানসিকতা টুক করে বেরিয়ে আসে (আমি নিশ্চিত পাকিস্তানেও ব্যাপারটা অন্যরকম নয়)।একদিকে আমাদের দেশের ক্যাপ্টেন গ্যালারির দিকে তাকিয়ে আবেদন করছেন যাতে ভারতীয় দর্শকরা স্টিভ স্মিথকে গালিগালাজ বন্ধ করে অভিবাদন জানায়। আর অন্যদিকে আমরা বড়মুখ করে বলছি 'আমরা পাকিস্তানের বাপ, তাই আমরাই জিতব'!

এ'সব ছেলেমানুষি এবং সোশ্যালমিডিয়া মাস্তানি বন্ধ করে পাকিস্তান ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের ব্যাপারে মনে সমীহ আনলে খেলাটা আরো উপভোগ্য হবে; এ সহজ ব্যাপারটা কবে যে আমি ও আমরা ঠাহর করতে পারব। বাবর আজমের একটা ভালো শটকে 'তোফা' বলা মানে পাকিস্তানের যাবতীয় অন্ধকারকে সমর্থন জানানো নয়; এই সরল সিধে সত্যটা স্বীকার করে নিতে যে আমাদের কী আপত্তি!

পুনশ্চঃ
নিজের দেশের/নিজেদের দোষ বেশি করে দেখব; বেশ করব। কারণ নিজের দেশের ভালো-মন্দ, শিষ্টাচার, পাগলামোতে আমার যোগাযোগটা সোজাসাপটা। স্টার স্পোর্টসের মত নামীদামী ব্রডকাস্টারকেও যখন এমন সস্তা বিজ্ঞাপন বানাতে হয়, তখন সে বিজ্ঞাপনের 'মার্কেট' সম্বন্ধে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বইকি।

ফির নহি আতে


कुछ लोग एक रोज़ जो बिछड़ जाते हैं
वो हजारों के आने से मिलते नहीं
उम्र भर चाहे कोई पुकारा करे उनका नाम
वो फिर नहीं आते, वो फिर नहीं आते..


সে'সব "ফির নহি আতে"র ফর্দে কত ঝাপসা মুখ যে রয়েছে। এই যেমন;

১। এক মাছওলাকাকু ক্রিকেট নিয়ে গল্প জুড়তে পারলে খদ্দের ভুলে যেতেন। আজহারউদ্দিনের ফিল্ড প্লেসমেন্টের ভুলগুলো অনায়াসে বলে দিতে পারতেন। প্রবীণ আমরের ডিফেন্সের খামতিগুলোও তাঁর চোখ এড়াত না। আর ক্রিকেট নিয়ে জরুরী আলোচনার সময় কেউ বেমক্কা 'মাগুর কত করে গো' জিজ্ঞেস করলেই রেগে টং হয়ে যেতেন।

২। স্কুলছুটির পর স্কুলগেটের কাছেই একটা গাছের ছায়ার দেখা যেত ফুচকাকাকু। একসঙ্গে সাত-আটজনকে সাত-আট রকমের ঝাল-টক-নুন রেশিওতে খাইয়ে যেতেন। আর যে আলুকাবলি মাখতেন তা' খেলে আয়ুবৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। তবে তার বিশেষত্ব ছিল ফুচকাপযোগী কিশোরের গানে। "মেরে মেহেবুব কয়ামত হোগি"র সুরে এগিয়ে দেওয়া ফুচকার টইটম্বুর বুক থেকে জল চলকে ওঠা...আহা।

৩। কাগজদাদাভাই গল্প করতেন শুকতারা, আনন্দমেলা নিয়ে। ভোরে কাগজ দিয়েই গায়েব হতেন বটে কিন্তু ছুটির দিন দুপুরবেলা ঠিক একবার ঢুঁ মেরে যেতেন। বাতাসা-জল হোক বা মুড়কি-সরবত; ঠাকুমা কিছু না কিছু দিতেনই। সেই বাতাসা বা মুড়কি চিবুতে চিবুতে কাগজদাদাভাই একের পর এক গল্প ও উপন্যাসের ট্রেলার শুনিয়ে যেতেন।

এমন আরও কতজন বিছড়েটিছড়ে গেছেন। হাজার মানুষের ভীড়েও তাঁদের গলার স্বর বা গল্প বলার ভঙ্গিমাগুলো মনের মধ্যে উঁকি মারে। কিন্তু উঁকি মেরে কোন কাঁচকলাটা হবে? কবি তো নিদান দিয়ে রেখেছেন; যে একবার ফসকেছে, উম্রভর তার নাম পুকারলেও সে আর ফিরবেটিরবে না।

তুক ক্রিকেট


আমার ধারণা কুসংস্কার না থাকলে বোধ হয় স্পোর্টস-ফ্যান হওয়াতে সাংবিধানিক বাধা আছে। বিশেষত ক্রিকেটে; যে'খানে প্রতিটি বলের মধ্যে বেশ কিছু সেকেন্ডের বিরতি থাকে; সেই মুহূর্তগুলোয় সোফা-কুশন-চেবানো মামুলি ফ্যানেরা টিভির দিকে তাকিয়ে ছটফট করা ছাড়া তেমন কিছুই করে উঠতে পারেনা। ফুটবলের ক্ষেত্রে গোটা ব্যাপারটা স্যাট করে শুরু হয়ে ফ্যাট করে শেষ হয়ে যায়; ম্যাচ চলাকালীন ব্রেনকে সোজাসুজি অ্যাড্রেনালিনের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। কিন্তু ক্রিকেট সে তুলনায় রীতিমত বিষাক্ত। ওই ব্যাটসম্যান হেলমেট খুলে ড্রেসিংরুমের দিকে কিছু ইশারা করলেন, এই বোলার মিড অফে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে সামান্য থমকালেন; এমন হাজারো অ-স্কোরবোর্ডিও সিচুয়েশন আর নখ খাওয়ার সুযোগে ভরপুর এই ভল্ডেমর্টিও খেলাটা।

আমার এক পাড়াতুতো কাকু কমিউনিস্ট; মানে পরশুরামের কুঠারকে টুথপিক হিসেবে ব্যবহার করা কমিউনিস্ট। ভদ্রলোক ভোগের খিচুড়িতে দু'ফোঁটা ভডকা ছিটিয়ে শুদ্ধ না করে মুখে তুলতে পারতেন না। তিনিও দেখেছি ম্যাচ খুব খটমট জায়গায় পৌঁছলে চটপট মানত করে ফেলতেন। বহুদিন আগে, সেই কাকুর পাশে বসে ভারত পাকিস্তান ফাইনাল দেখছিলাম। ডান পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে যাওয়ায় ঘণ্টাখানেক পর বসার পোজিশনে ইঞ্চিখানেক অ্যাডজাস্টমেন্ট করেছিলাম আর তখনই সৌরভ আউট। কাকুর সে কী হাহাকার; "কুলীন বংশের ছেলে আমি; সময়মত পৈতে হলে এখন তোকে স্রেফ অভিশাপে অভিশাপে শেষ করে দিতাম! পা নড়ানোর আর সময় পেলিনা? এ'বার ম্যাচ হারলে দায়টা কে নেবে?"।

জটিল সিচুয়েশনে কারণে অকারণে বাথরুম ছোটার ব্যাপারটা খুবই খতরনাক। বাথরুমে গেলেই মনে হয় ম্যাচ ভাসিয়ে চলে গেলাম; মাঠের খেলোয়াড়রা তো শুধু দ্যাখনাই, ভাগ্যের আসল কন্ট্রোলপ্যানেল তো আমার ব্ল্যাডারে। আবার এও হয়েছে বিপক্ষের খুনে ব্যাটসম্যানদের দাপটে যেই হাল ছেড়ে বাথরুম গেছি, অমনি উইকেট পড়েছে; এ'বার সামলাও ঠেলা। মাঠের ক্যাপ্টেন আর প্যাভিলিয়নে বসা ম্যানেজারের চেয়েও আমার চাপ বেশি; কারণ লিটার লিটার জল খেয়ে বিপক্ষের পার্টনারশিপ ভাঙার গুরু-দায়িত্ব যে আমার কাঁধে।

এই হাড়-জ্বালানো কুসংস্কারগুলোর বিভিন্ন স্তরে খেলা করে।

প্রথমত, ম্যাচের আগে। যত বড় ম্যাচ, তত দুর্বল মন। পয়া জামা, পয়া বসার পোজিশন, পয়া রিমোট ধরার কায়দা, পয়া মায়ের চিৎকার, পয়া ছড়া যা ম্যাচের আগে জাতীয় সঙ্গীতের মত আওড়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়; এমন লম্বা ফর্দ ধরে ব্যূহরচনা করতে হয়।

দ্বিতীয়ত, প্রিয় ব্যাটসম্যান ভালো খেললে। বসার জায়গা থেকে না নড়া, অতিরিক্ত কথা না বলা (যে'টুকু বলা সে'টুকু প্যাটার্নে, যেমন প্রতি ওভারে তিন আর চার নম্বর বলের মধ্যে কথা বলা যাবে, নচেৎ স্পিকটি নট), কলিং বেল/টেলিফোনে সাড়া না দেওয়া, অন্যদের নড়তে না দেওয়া ইত্যাদি।

তৃতীয়ত, বিপক্ষ ব্যাটসম্যান বেধড়ক পেটাচ্ছে বা নিজদের উইকেট পর পর পড়ে চলেছে। ম্যাচ নিয়ে টানাটানি, রীতিমত ক্রাইসিস। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের পদ্ধতিতে আবার আগ্রাসী না হলে চলবে না। উপায়? চ্যানেল বদলানো; ছেলেবেলায় আমার ভাগ্য ফেরানোর চ্যানেল ছিল জি বা আলফা বাংলা। 'এক আকাশের নীচে' সিরিয়ালটার ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম স্রেফ নিজেদের একটা পার্টনারশিপ তৈরির চেষ্টায় বা বিপক্ষের পার্টনারশিপ ভাঙার লোভে। তা'তেও কাজ না হলে নেক্সট লেভেল হল খানিকক্ষণের জন্য টিভি বন্ধ রাখা। তা'তেও ভাগ্যের চাকা না ঘুরলে বাইরে গিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসতে হবে, শাস্ত্রে বোধ হয় তাই বলেছে। ২০১১র বিশ্বকাপ ফাইনালে শচীন শেওয়াগ আউট হওয়ার পর আমায় ছাতে গিয়ে পায়চারী করতে হয়েছিল যাতে কোহলি আর গম্ভীর একটু নিজেদের মত করে দাঁড়াতে পারে।

চতুর্থ, ১৩ রান (১৩ নাকি অপয়া এ'দিকে কেউ বেড়াল দেখে থমকে দাঁড়ালে তাকে নিউটন তুলে গালাগাল দিয়ে থাকি) বা ১১১র নেলসন/ডাবল নেলসন/ট্রিপল নেলসন গোছের শেফার্ডসাহেব-সার্টিফাইড ক্রিকেট-অপয়া সংখ্যা বা সতেরো, তিয়াত্তর বা একশো সাত গোছের কিছু সংখ্যা (কোনও কারণ নেই, এগুলো স্রেফ নিজের অপছন্দের নম্বর)স্কোরবোর্ডে দেখলেই সজাগ হয়ে উঠতে হয়। এই সব দুঃসময়ে বিপদ কাটাতে দুর্বল কলজে খুব ন্যক্কারজনক কিছু শর্টকাট অবলম্বন করে থাকে। এই যেমন গায়ত্রী মন্ত্রের রিদমে হাট্টিমাটিম বিড়বিড় করা বা "কত না ভাগ্যে আমার, এ জীবন ধন্য হল, সিঁথির এই একটু সিঁদুরে সবকিছু বদলে গেল..." গোছের টোটকা গান গাওয়া; খুব কাজে লাগে, যাকে বলে সুপার-এফেক্টিভ।

তবে এ'সবই নিজের নোটবুকের হিসেবকিতেব, আমি নিশ্চিত প্রত্যেকের নিজস্ব ক্রিকেট দেখার মানসিক-মাদুলির ফর্দ রয়েছে। আজকের ম্যাচে রোহিতের সেঞ্চুরি পর্যন্ত বড় বেকায়দা পোজিশনে শুয়ে থাকতে হল, এমন কী সেঞ্চুরির পরেও নড়তে সাহস হয়নি। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ বলে কথা। নেহাত ঘাড়ের কাছের চুলকানিটা চেরনোবিলের আকার ধারণ করায় সামান্য নড়েছিলাম আর ভুডু-অঙ্কের নিখুঁত প্রভাবে রোহিত অমনি লোপ্পা ক্যাচ তুলে দিয়েছিল। স্যাড়াক্‌ করে অরিজিনাল পোজিশনে ফেরত আসতে হয়েছে যাতে ডেভিড মিলার রোহিতের তোলা ক্যাচটা বিনা গোলমালে ফেলতে পারেন। মোটের ওপর এই ম্যাচটা বিরাটদের ভালোয় ভালোয় উতরে দিয়েছি কিন্তু আগামী দু'দিন আমার মাথা আর ঘাড়ের ডান দিকে বত্রিশখানা ছুঁচ ফোটালেও টের পাব না।

জয় হিন্দ।

খাওয়াদাওয়া আর খাবারদাবার

নামীদামী রেস্তোরাঁয় ঢোকার মোহ আর ইহ জনমে কাটবে না। কষানো মাংস, খুশবুদার বিরিয়ানি, রগরগে কালিয়া বা তেলে টইটম্বুর ভাজাভুজির টান আলাদা; যত যাই বলি, সে' টান উপেক্ষা করার শক্তি আয়ত্ত করার ইচ্ছেও তেমন নেই। কিন্তু তবু, কিছু কিছু অতি সরল-সিধে "খেতে বসার" স্মৃতি মনের মধ্যে জেঁকে বসে থাকে চিরকালের জন্য। অফিসের দৌড়ঝাঁপে বা গেরস্থালীর ব্যস্ততার মধ্যে মাঝেমধ্যে সে'সব তৃপ্তির খাওয়াদাওয়ার কথা মনে পড়ে। বলে রাখা উচিৎ, মাঝেমধ্যে খাওয়াদাওয়ার কথা ভাবতে আমার ভালো লাগে। খাবারদাবারের নয়, খাওয়াদাওয়ার কথা ।

এই যেমন টিউশনি ফেরতা ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছি চপের দোকানের সামনে, বৃষ্টির ছাঁটে জামার বাঁ'দিকে হাতাটা ভিজে জ্যাবজ্যাব করছে। পিঠের ব্যাগ উলটো করে বুকের দিকে ঝোলানো যাতে ভিজে না যায়। ছাতা বেয়ে জল ঝরেই চলেছে, আর ঝরছে দোকানের ছাউনি বেয়ে; তাদের গতি ও নামার ধরন অবশ্যই বৃষ্টির মোমেন্টামের চেয়ে আলাদা। সেই ছাত আর ছাতা বেয়ে ঝরে পড়া জলের রিদমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফুটছে কড়াইয়ের তেল। দোকানের চপ-মাস্টার একের পর এক আলুর চপ ছাড়ছে কড়াইতে; কড়াই ভর্তি তেলে চপগুলো ডগমগ হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই চপে কামড় দেওয়ার মুহূর্তটা মনে নেই; কিন্তু সেই ছাতা মাথায় কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকাটা মনে আছে। জলের ছাঁট, ছাত বেয়ে জল ঝরার শব্দ, সর্ষের তেল আর বেসনের গন্ধ; চোখ বুঝলেই এখনও এগুলো ঝলমল করে উঠবে।

কিন্তু কথা হচ্ছিল সরলসিধে খাওয়াদাওয়ার। আলুর চপ আর যাই হোক সরলসিধে নয়, ছুঁচ হয়ে ঢুকে বোফর্স হয়ে বেরোনোর ক্ষমতা রয়েছে তাদের। এই যেমন - অফিসে বিস্তর হুড়মুড়; ইয়ে লাও, উয়ো সামলাও, দিস কেলো, দ্যাট ক্যালামিটি; ইত্যাদিতে মন এক্কেবারে বনেট গরম সেকেলে গাড়ি। লং ডিস্ট্যান্স ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রে আমার সুপরিচিত এক ড্রাইভারদাদা ধর্মেন্দ্র প্রতি ঘণ্টাখানেক অন্তর গাড়ি থামিয়ে বলতেন "মাইন্ড কো থোড়া রিফ্রেশ কর লেতে হে"; মিনিট খানেক দাঁড়াতেন, গুটখা আর জর্দা মিশিয়ে কিছু একটা খেতেন আর তারপর ফের ফুরফুরে মেজাজে ইগনিশন অন করতেন। প্রবল হুড়মুড়ে পড়ে আমারও মাঝেমধ্যে ওই "মাইন্ড কো থোড়া রিফ্রেশ কর লেতে হ্যায়" মার্কা বাই জাগে। আর আমার জর্দা-গুটখা বলতে ওই সাতপুরনো খাওয়াদাওয়ার স্মৃতি। 

আজ যেমন মনে পড়ল কটিহার থেকে কিষণগঞ্জ যাওয়ার পথে এক দোকানের বেঞ্চিতে বসে ভাত, ডাল, আলুভাজা, পটলের তরকারি আর ডিমের ওমলেট খাওয়ার সুখস্মৃতি। হাইওয়ের ধারের ধাবা মানেই রুটি-মাংস-তড়কা গোছের খাবারদাবারের কথা মনে পড়ে। কিন্তু এই খাবারের দোকানের বৃদ্ধ মালিক একজন বাঙালি (নামটা বেমালুম ভুলে গেছি, ভোলা উচিৎ হয়নি)। রুটি তড়কা পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করায় সোজা জানালেন;

- বাঙালি তো, নাকি?
- হ্যাঁ।
- এই ভরদুপুরে খসখসে রুটি খামোখা খেতে যাবেন কেন? ভাত শেষ হয়ে গেছে বটে, কিন্তু এখুনি চাপিয়ে দিতে বলছি।
- হ্যাঁ মানে তা'তো বুঝলাম কিন্তু একটু তাড়া ছিল যে...।
- লংরানে বেরিয়েছেন তো। তাড়া কীসের? দুপুরের খাবারটা একটু ঠাণ্ডা মাথায় না সারলেই মুশকিল। শুনুন, পটলের তরকারি আছে, দোকানের নয়। নিজের জন্য বানিয়েছিলাম। বৌয়ের রেসিপি। আলু পটল নয় কিন্তু, শুধু পটলের তরকারি; গা-মাখা করে। মিনিমাম মশলা, কিন্তু জিভে ধরবেই। চেখে দেখুন না একবার।
- ও মা, আপনি অত ব্যস্ত হবেন না...আমি না হয়...।
- ব্যস্ত কীসের? রেসিপি বৌয়ের কিন্তু পরিমাণ বোধ তো আমার। একার জন্য যা রাঁধি তা দিয়ে দোকানের তিনজন ছেলের খাওয়াদাওয়া হয়ে যায়। ডাল আছেই। আমি বরং আপনার জন্য আলুভাজা আর ওমলেট বানাতে বলে দিই। ওমলেটে লঙ্কা চলবে?
ভদ্রলোক এমন অবলীলায় পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ নিজের কন্ট্রোলে এনে ফেললেন যে আমার কিছু করার ছিল না। ভদ্রলোক উত্তরবঙ্গের এক গাঁয়ের মানুষ, তার স্ত্রীও সে'খানেই থাকেন। প্রতি মাসে এক-দু'দিনের জন্য গ্রামে ফেরেন। আধ ঘণ্টার মধ্যে স্টিলের থালায় চেপে এলো ধোঁয়া ওঠা ভাত, সঙ্গে গরম ডাল, পটলের তরকারি, নরম খোসা-না-ছাড়ানো আলুভাজা। ডবল ডিমের ওমলেটটটা শালপাতার দোনায় করে থালার এক পাশে রাখা ছিল।

খাওয়ার সময় ভদ্রলোক সামনে বসেছিলেন আগাগোড়া। দোকানের ছেলেটা যতক্ষণ লেবু এনে দেয়নি ততক্ষণ আমায় ভাত মাখতে দেননি; "খেতে বসে তাড়াহুড়োটা আমার মোটে বরদাস্ত হয় না, দাঁড়াও। আগে লেবু লঙ্কা আনুক, তারপর ভাত মাখবে"। আপনি থেকে সহজেই তুমিতে নেমে এসেছিলেন, ভাতের ধোঁয়া আর ডিমভাজার গন্ধে সে "তুমি" বড় নরম হয়ে মনে ঠেকেছিল।

ভদ্রলোক পটলের তরকারি আর আলুভাজার দাম নেননি। সেই খেতে বসাটুকু মনে করলে মন হালকা হয়, বৃদ্ধের তদারকি মনে পড়লে মনে হয় "আহা, বড় মোলায়েম"। এই দৃশ্যটুকু বার দুয়েক মনের মধ্যে ঝালিয়ে নিলেই মনের সমস্ত হুড়মুড় সাফ, ফুরফুরে মেজাজে ফের কাজে ওয়াপসি।

যতই হোক, খাওয়াদাওয়া মানে তো শুধুই খাবারদাবার নয়।

ইন্ডিয়ান সামার


বই পড়ার পরপরই সে বইয়ের বিষয়ে দু'কথা বলতে গেলে যে'টা বড় সুবিধে সে'টা হল বইয়ের "ডিটেলস"গুলো টাটকা তাজা মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। রেফারেন্স টেনে কিছু বলতে সুবিধে হয়। কিছুদিন কেটে গেলে সেই "ডিটেলস"গুলো ফিকে হয়ে আসে, অন্তত আমার ক্ষেত্রে তা তো হয়ই। তবে বই শেষ হওয়ার পর কিছুদিন কেটে গেলে একটা ভালো ব্যাপারও ঘটে; প্রাথমিক উচ্ছ্বাস, চমক বা লেখকের ভাষাগত চমকের আবরণ ভেদ করে বইয়ের নির্যাসটুকু 'ইন্টারনালাইজড' হয়। বিশেষত নন-ফিকশনের ক্ষেত্রে; উচ্ছাসের বাষ্প সাফ করে নিজের বোধবুদ্ধির ফ্রেমে সে বইয়ের মূল বক্তব্যটা যাচাই করে নিতে খানিকটা সময় তো লাগেই।

মাসখানেক আগে শেষ করা 'ইন্ডিয়ান সামার' বইটার ডিটেলগুলো কিছুটা আবছা হয়ে এলেও, বইয়ে সাতচল্লিশের যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন আর সংঘাতগুলো তুলে ধরা হয়েছে; সে'গুলো ক্রমশ মনের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সে'দিক থেকে আমার কাছে এ বই ল্যাপায়ারের 'ফ্রীডম অ্যাট মিডনাইট'য়ের চেয়ে বেশি ইম্প্যাক্টফুল। অনেক বিষয় সম্বন্ধে আমাদের ধ্যানধারণা যে একেবারে 'কাঁচকলা' তা কিন্তু নয়; কিন্তু ইনফর্মড ওপিনিওন (কিছুটা বায়াস না থাকাটাও অবশ্য অবাস্তব) তৈরি করতে গেলে এ ধরনের বই অত্যন্ত কাজের।

বইয়ের কোন রেফারেন্স পয়েন্টগুলো মনের মধ্যে জেঁকে বসে আছে?

১। মোহনদাস গান্ধী। ভদ্রলোকের চারিত্রিক জটিলতাগুলো খুব যত্ন করে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। তাঁর সাংসারিক জীবনের ব্যর্থতাগুলো, তাঁর অতিধার্মিক বাতিকসমূহ, বিজ্ঞান বা মেডিকাল সায়েন্স বা টেকনোলজি সম্পর্কে তাঁর বিটকেল বিরক্তি; এ'রকম আরো বেশ কিছু গোলমেলে দিক বহু ক্ষেত্রে বারবার আলোচিত হয়েছে এবং এ বইতেও সে'গুলো সম্বন্ধে তথ্যের অভাব নেই। কিন্তু বেশ কিছু প্রকাণ্ড "ফ্ল" থাকা সত্ত্বেও, মোহনদাসের গুরুত্ব তাঁর অহিংসার থিওরি এবং প্র‍্যাক্টিকাল ডেমোন্সট্রেশনে। যে কোনো মতবাদের ক্ষেত্রেই, মাঠে নামলে দেখা যায় প্রচুর ফাঁকফোকড় রয়েছে, গান্ধীর ক্ষেত্রেও সে তর্ক চলতেই পারে। কিন্তু আধুনিক যুগে তাঁর অহিংসার স্ট্র‍্যাটেজির গুরুত্ব যে কী অপরিসীম, তা রীতিমতো খাতায়কলমে কন্টেক্সটুয়ালাইজ করতে পেরেছেন লেখক। অহিংসা যে হিংসার চেয়ে ভালো এবং ক্ষেত্র বিশেষে সুইসাইডাল; তা জানার জন্য পলিটিকাল অ্যানালিস্ট না হলেও চলবে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে অহিংসাকে সঠিক সময়ের অন্তত শ'খানেক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন মোহনদাস; ইতিহাস অন্তত এই প্রবল সত্যটাকে কিছুতেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারবে না। এমন কী মোহনদাস নিজের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে অহিংসার 'স্ট্র‍্যাটেজিক' গুরুত্বর পক্ষে যে সওয়াল রেখে গেছেন, তার গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। হাজারো ইডিওলজিকাল কলকারখানার পাশে মোহনদাস নিজের ল্যাবরেটরিতে চোয়াল শক্ত করে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে গেছেন এবং সহজে তাঁকে নড়ানো যায়নি; স্রেফ সে জেদের মূল্যেই ইতিহাস তাঁর স্থান চিরঅমলিন। গান্ধীর সেই প্যারালাল 'ম্যানহ্যাটন প্রজেক্ট' সযত্নে উপস্থাপিত হয়েছে এ বইয়ে। আর হ্যাঁ, দেশভাগের সময় মোহনদাসের ভূমিকা কেন খানিকটা ওভাররেটেড; সে বিষয় নিয়েও বিশদে আলোচনা করেছেন লেখক।

২। জহরলাল নেহরু। বইয়ের অনেকটা জুড়ে রয়েছেন জহরলাল। ফটোফ্রেমের সাজানোগোছানো 'ফার্স্ট প্রাইম মিনিস্টার' শুধু নন, মানুষ, বন্ধু ও প্রেমিক জহরলালই এ বইয়ের মূল আকর্ষণ। ভদ্রলোকের পাঁচমেশালি দিকটা বিভিন্নভাবে স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছেন লেখক। ব্রিটিশদের প্রতি রাগ থেকে ব্রিটিশদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাভক্তি ও ভালোবাসা, গান্ধীকে বাপের মত ভালোবাসা আবার গান্ধীর কিছু ধ্যানধারণা শুনে কেঁপে উঠে পাশ কাটিয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক লোভের পাশাপাশি বেহিসেবী আইডিয়ালিজম; জহরলালের একটা বড় গুণ বোধ হয় তাঁর "এক্সট্রিম পয়েন্ট"গুলো এড়িয়ে মাঝামাঝি থাকতে পারায়। সেই মাঝামাঝি থাকতে পারার ভালো এবং গোলমেলে দিকগুলোর কথা চমৎকারভাবে বলা হয়েছে। এ বইয়ে গান্ধীর চেয়ে অনেক বেশি জায়গা জুড়ে আছেন নেহেরু,
তবু তাঁকে নিয়ে আমার এ কাঁচা লেখায় বেশি না ফেনিয়ে বলি; বইটা পড়ুন। নেহরুর অন্ধ ভক্তই হোন বা কট্টর বিরোধী ; এ বই অত্যন্ত দরকারী।


৩। "নেহরু গান্ধীর জন্য দেশভাগ হয়েছে"। যে কোনো অতি-সরল কথা তলিয়ে দেখাটা জরুরী। আজকাল আবার এ আলোচনাটা ফের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এবং সে অভিযোগ হয়য় দুম করে উড়িয়ে দেওয়াটাও হঠকারী ব্যাপার হবে। কিন্তু আয়রনিগুলো স্পষ্ট করে বুঝতে গেলে এই বইয়ের জবাব নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের পাল্লায় পড়লে মুসলিমদের সর্বনাশ হবে, মোটের ওপর এই থিওরিতে ভর দিয়ে সফল হয়ছিলেন জিন্নাহ। দেশভাগের সব দোষ 'নেহরু গান্ধী'র বলে গলা ফাটানো যায় বটে, কিন্তু অলটারনেটিভগুলো ঠিক কী কী ছিল? একটা মুসলিম রাষ্ট্রের পাশাপাশি হিন্দু রাষ্ট্র? কিন্তু তা'তে কি জিন্নাহর আশঙ্কায় শিলমোহর পড়ত না? আর যারা সেকিউলার দেশ চেয়েছেন, তাঁরা নেহেরুর জায়গায় ঠিক কী কী অন্যভাবে করলে দেশের ও দশের বাড়তি উপকার হত? আমি আমার নড়বড়ে লেখায় গুলিয়ে দিয়ে থাকতে পারি, কিন্তু এ বইতে লেখক মজবুতভাবে এ'সব প্রশ্নের মোকাবিলা করেছেন এবং পাঠককে যত্ন করে গাইড করেছেন।

৪। এডউইনা ও ডিকি মাউন্টব্যাটেন ( এবং জহরলাল)। মশলা ব্যাপারটা লেখক এড়িয়ে যাননি বা যাওয়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু লজিক এবং কমনসেন্সকে জলাঞ্জলি না দেওয়ায় যে'টা হয়েছে সে'টা হল গসিপের বাইরে গিয়ে এদের তিনজনের সম্পর্কের প্লেটনিক দিকগুলো ফুটে উঠেছে; স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ইকুয়েশনের পাশাপাশি এই সম্পর্কের অভিপ্রেত বা অনভিপ্রেত ফলাফলগুলো।
ডিকি মাউন্টব্যাটেনের যাবতীয় সাফল্য ও ব্যর্থতার নিয়ে বিস্তারিত ব্যালেন্সশিট সাজিয়ে বসেছেন লেখক; বিশেষত ভারতবর্ষের নিরিখে। সে ব্যালান্সশিট যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনই জটিল। তবে সে জটিলতার বর্ণনা দিতে গিয়ে পাঠককে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেননি লেখক।
আর রয়েছেন এডউইনা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সে সময়ের রাজনৈতিক চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম একজনকে আমরা শুধু গসিপের মাত্রায় চিনি। এডউইনার সেই রাজনৈতিক ভূমিকা সযত্নে খোলসা করেছেন লেখক। অবশ্য এ বইয়ের পরিসর থেকে এডউইনার প্রেম ও প্রেমিকরাও বাদ পড়েননি। নেহরু আর এডউইনার সম্পর্কটা ঠিক কীরকম ছিল? লেখক এ বইতে সমস্ত 'পাবলিক ফ্যাক্টস' সোজাসাপটা ভাবে সাজিয়েছেন; এবং আলোচনা করেছেন যুক্তি এবং কমনসেন্স দিয়ে যাতে ব্যাপারটা গসিপে-গুবলেট না হয়ে যায়। তাঁদের সম্পর্কের রাজনৈতিক প্রভাবগুলোকেও খতিয়ে দেখা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, সমস্ত সস্তা মশলার লোভ কাটিয়ে, নেহরু, ডিকি ও এডউইনা; এই তিনজনের বন্ধুত্ব ও আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের উষ্ণতাটুকুর ওপর ফোকাস করেছেন লেখক। এ জন্য সাধুবাদ প্রাপ্য তাঁর।

৫। মহম্মদ আলী জিন্নাহ। তাঁর আশঙ্কাগুলো, তাঁর পরিকল্পনাগুলো, নেহরুর সঙ্গে লড়া ডুয়েল এবং তাঁর মিইয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো। সে'গুলো ছুঁতে পেরেছেন লেখক। জিন্নাহর ব্যাপারে আরো বিশদে পড়ার ইচ্ছে তৈরি হয়েছে বৈকি।

এ'ছাড়া, প্রতি পরিচ্ছেদে রয়েছে অসংখ্য টানটান ঘটনা ও গল্পের উল্লেখ; যা পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গ্রিপ করে রাখবেই।
মোটের ওপর, যাকে বলে; "স্ট্রংলি রেকমেন্ডেড"।