নামীদামী রেস্তোরাঁয় ঢোকার মোহ আর ইহ জনমে কাটবে না। কষানো মাংস, খুশবুদার বিরিয়ানি, রগরগে কালিয়া বা তেলে টইটম্বুর ভাজাভুজির টান আলাদা; যত যাই বলি, সে' টান উপেক্ষা করার শক্তি আয়ত্ত করার ইচ্ছেও তেমন নেই। কিন্তু তবু, কিছু কিছু অতি সরল-সিধে "খেতে বসার" স্মৃতি মনের মধ্যে জেঁকে বসে থাকে চিরকালের জন্য। অফিসের দৌড়ঝাঁপে বা গেরস্থালীর ব্যস্ততার মধ্যে মাঝেমধ্যে সে'সব তৃপ্তির খাওয়াদাওয়ার কথা মনে পড়ে। বলে রাখা উচিৎ, মাঝেমধ্যে খাওয়াদাওয়ার কথা ভাবতে আমার ভালো লাগে। খাবারদাবারের নয়, খাওয়াদাওয়ার কথা ।
এই যেমন টিউশনি ফেরতা ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছি চপের দোকানের সামনে, বৃষ্টির ছাঁটে জামার বাঁ'দিকে হাতাটা ভিজে জ্যাবজ্যাব করছে। পিঠের ব্যাগ উলটো করে বুকের দিকে ঝোলানো যাতে ভিজে না যায়। ছাতা বেয়ে জল ঝরেই চলেছে, আর ঝরছে দোকানের ছাউনি বেয়ে; তাদের গতি ও নামার ধরন অবশ্যই বৃষ্টির মোমেন্টামের চেয়ে আলাদা। সেই ছাত আর ছাতা বেয়ে ঝরে পড়া জলের রিদমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফুটছে কড়াইয়ের তেল। দোকানের চপ-মাস্টার একের পর এক আলুর চপ ছাড়ছে কড়াইতে; কড়াই ভর্তি তেলে চপগুলো ডগমগ হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই চপে কামড় দেওয়ার মুহূর্তটা মনে নেই; কিন্তু সেই ছাতা মাথায় কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকাটা মনে আছে। জলের ছাঁট, ছাত বেয়ে জল ঝরার শব্দ, সর্ষের তেল আর বেসনের গন্ধ; চোখ বুঝলেই এখনও এগুলো ঝলমল করে উঠবে।
কিন্তু কথা হচ্ছিল সরলসিধে খাওয়াদাওয়ার। আলুর চপ আর যাই হোক সরলসিধে নয়, ছুঁচ হয়ে ঢুকে বোফর্স হয়ে বেরোনোর ক্ষমতা রয়েছে তাদের। এই যেমন - অফিসে বিস্তর হুড়মুড়; ইয়ে লাও, উয়ো সামলাও, দিস কেলো, দ্যাট ক্যালামিটি; ইত্যাদিতে মন এক্কেবারে বনেট গরম সেকেলে গাড়ি। লং ডিস্ট্যান্স ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রে আমার সুপরিচিত এক ড্রাইভারদাদা ধর্মেন্দ্র প্রতি ঘণ্টাখানেক অন্তর গাড়ি থামিয়ে বলতেন "মাইন্ড কো থোড়া রিফ্রেশ কর লেতে হে"; মিনিট খানেক দাঁড়াতেন, গুটখা আর জর্দা মিশিয়ে কিছু একটা খেতেন আর তারপর ফের ফুরফুরে মেজাজে ইগনিশন অন করতেন। প্রবল হুড়মুড়ে পড়ে আমারও মাঝেমধ্যে ওই "মাইন্ড কো থোড়া রিফ্রেশ কর লেতে হ্যায়" মার্কা বাই জাগে। আর আমার জর্দা-গুটখা বলতে ওই সাতপুরনো খাওয়াদাওয়ার স্মৃতি।
আজ যেমন মনে পড়ল কটিহার থেকে কিষণগঞ্জ যাওয়ার পথে এক দোকানের বেঞ্চিতে বসে ভাত, ডাল, আলুভাজা, পটলের তরকারি আর ডিমের ওমলেট খাওয়ার সুখস্মৃতি। হাইওয়ের ধারের ধাবা মানেই রুটি-মাংস-তড়কা গোছের খাবারদাবারের কথা মনে পড়ে। কিন্তু এই খাবারের দোকানের বৃদ্ধ মালিক একজন বাঙালি (নামটা বেমালুম ভুলে গেছি, ভোলা উচিৎ হয়নি)। রুটি তড়কা পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করায় সোজা জানালেন;
- বাঙালি তো, নাকি?
- হ্যাঁ।
- এই ভরদুপুরে খসখসে রুটি খামোখা খেতে যাবেন কেন? ভাত শেষ হয়ে গেছে বটে, কিন্তু এখুনি চাপিয়ে দিতে বলছি।
- হ্যাঁ মানে তা'তো বুঝলাম কিন্তু একটু তাড়া ছিল যে...।
- লংরানে বেরিয়েছেন তো। তাড়া কীসের? দুপুরের খাবারটা একটু ঠাণ্ডা মাথায় না সারলেই মুশকিল। শুনুন, পটলের তরকারি আছে, দোকানের নয়। নিজের জন্য বানিয়েছিলাম। বৌয়ের রেসিপি। আলু পটল নয় কিন্তু, শুধু পটলের তরকারি; গা-মাখা করে। মিনিমাম মশলা, কিন্তু জিভে ধরবেই। চেখে দেখুন না একবার।
- ও মা, আপনি অত ব্যস্ত হবেন না...আমি না হয়...।
- ব্যস্ত কীসের? রেসিপি বৌয়ের কিন্তু পরিমাণ বোধ তো আমার। একার জন্য যা রাঁধি তা দিয়ে দোকানের তিনজন ছেলের খাওয়াদাওয়া হয়ে যায়। ডাল আছেই। আমি বরং আপনার জন্য আলুভাজা আর ওমলেট বানাতে বলে দিই। ওমলেটে লঙ্কা চলবে?
ভদ্রলোক এমন অবলীলায় পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ নিজের কন্ট্রোলে এনে ফেললেন যে আমার কিছু করার ছিল না। ভদ্রলোক উত্তরবঙ্গের এক গাঁয়ের মানুষ, তার স্ত্রীও সে'খানেই থাকেন। প্রতি মাসে এক-দু'দিনের জন্য গ্রামে ফেরেন। আধ ঘণ্টার মধ্যে স্টিলের থালায় চেপে এলো ধোঁয়া ওঠা ভাত, সঙ্গে গরম ডাল, পটলের তরকারি, নরম খোসা-না-ছাড়ানো আলুভাজা। ডবল ডিমের ওমলেটটটা শালপাতার দোনায় করে থালার এক পাশে রাখা ছিল।
খাওয়ার সময় ভদ্রলোক সামনে বসেছিলেন আগাগোড়া। দোকানের ছেলেটা যতক্ষণ লেবু এনে দেয়নি ততক্ষণ আমায় ভাত মাখতে দেননি; "খেতে বসে তাড়াহুড়োটা আমার মোটে বরদাস্ত হয় না, দাঁড়াও। আগে লেবু লঙ্কা আনুক, তারপর ভাত মাখবে"। আপনি থেকে সহজেই তুমিতে নেমে এসেছিলেন, ভাতের ধোঁয়া আর ডিমভাজার গন্ধে সে "তুমি" বড় নরম হয়ে মনে ঠেকেছিল।
ভদ্রলোক পটলের তরকারি আর আলুভাজার দাম নেননি। সেই খেতে বসাটুকু মনে করলে মন হালকা হয়, বৃদ্ধের তদারকি মনে পড়লে মনে হয় "আহা, বড় মোলায়েম"। এই দৃশ্যটুকু বার দুয়েক মনের মধ্যে ঝালিয়ে নিলেই মনের সমস্ত হুড়মুড় সাফ, ফুরফুরে মেজাজে ফের কাজে ওয়াপসি।
যতই হোক, খাওয়াদাওয়া মানে তো শুধুই খাবারদাবার নয়।
No comments:
Post a Comment