"তা ব্যাপার কী হে রমাপদ, আজকেও কি স্পেশ্যাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল নাকি"?
ইঙ্গিতটা রমাপদর সুপরিচিত আর এ বিষয়ে সে রীতিমত লাজুকলতা৷ এমনিতে আড্ডার ব্যাপারে সে বেশ তৎপর, অন্য সকলের আগেই সে পৌঁছে গিয়ে একটা ব্ল্যাককফি আর অমলেট নিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু যেদিন সে অর্পিতার সঙ্গে অফিসের বাইরে দেখা করতে যায়; সে'দিন দেরী হবেই। আর ভজহরিদা বোধহয় রমাপদর লাজুক হাসিটা বেশ উপভোগ করেন, তাই তাঁর এহেন প্রশ্ন।
ডিসুজার সামনের প্লেটে তখনও একটুকরো স্যান্ডুইচ পড়ে আছে দেখে তার পাশ ঘেঁষেই বসল রমাপদ, বড্ড খিদে পেয়েছে। ডিসুজা হেসে প্লেটটা তার দিকে সামান্য ঠেলে দিল।
" হ্যাঁ রে রমা, এ'বছর তোর একটা প্রমোশনও তো হল, তা এ'বার অন্তত বিয়ের কথাটা কি পাড়তে পেরেছিস না এখনও সেই অফিস থিয়েটার রিহার্সালের প্রেমালাপেই আটকে রয়েছিস..", সুজাতার যাবতীয় আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে 'কবে বিয়ে করছিস' গোছের প্রশ্ন। ব্যাপারটা খানিকটা বিরক্তিকর। স্যান্ডুইচ চিবুতে চিবুতেই রমাপদ বলেই ফেলল "একটা পেল্লায় বাড়ি আর মস্ত চাকরীওলা পাত্র জোগাড় করে নিজেকে সঁপে দিয়েছিস; ভালো কথা। কিন্তু তা বলে কি জগতসংসারের সব্বাইকে ছাদনাতলায় গিয়ে জড়ো হতে হবে? অর্পিতা চাকরীতে আরো থিতু হতে চায়..আরোকিছুটা সময় দরকার ওর, আর আমারও কোনো তাড়া নেই"।
"বোগাস, তোদের যত সিউডো-সোশ্যালিস্ট প্রপাগান্ডা"! টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে অমলের আচমকা চড়ানো কণ্ঠস্বর গমগমিয়ে উঠলো। অমলের টেবিল চাপড়ানিগুলো না শুনলে কফিহাউসটাকে বড্ড শুনশান লাগে রমাপদর। আর তার এড়ে তর্কগুলোয় যথাযথ সঙ্গ দেয় নিখিলেশ। অমলের ঠোঁটে সর্বক্ষণ ঝুলে থাকা চারমিনার আর নিখিলেশের দিকে তাক করা ধারালো শ্লেষ। দু'জনেই বামপন্থী অথচ দু'জনেরই ধারনা অন্যের ইডিওলজিটুকু স্রেফ দেখনাই আর সেই নিয়েই দু'জনের যত গুঁতোগুঁতি। প্রত্যেকদিন আড্ডার মাঝে ওরা যে একে অপরের কলার ধরে ঝুলে পড়ে না; সে'টাই আশ্চর্যজনক। স্কুলমাস্টার আর শখের কবি অমলকে স্রেফ 'আ কগ ইন দ্য স্টেট মেশিনারি' বলে উড়িয়ে দেয় নিখিলেশ। আর অন্যদিকে একটা পেল্লায় বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ টীমে কাজ করা নিখিলেশের বামপন্থাটুকুকে স্রেফ ধান্দাবাজের মুখোশ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারত না অমল।
" এই সান্যাল একটা সুযোগ পেলেই এই শহর আর দেশকে লাথি মেরে বিদেশে কেটে পড়বে এক্সট্রা টু পাইসের জন্য। আমার কথাটা মিলিয়ে নিস রমা"! বেশি উত্তেজিত হলে নিখিলেশের পদবী ধরে আক্রমণ করত অমল। আর অমলের রেগে যাওয়াটা বাকি সকলে দিব্যি উপভোগ করত, নিখিলেশও হয়ত সে কারণেই অমলকে বাড়তি কাঠি করত। অবশ্য যাবতীয় ঝগড়াঝাটি সত্ত্বেও, অমলকে চারমিনার ধার দেওয়ার বেলায় কোনোরকম কিপটেমো করত না নিখিলেশ।
"বটে? নেহরুভিয়ান সোশ্যালিজমের কথা বললেই সে'টা প্রপাগান্ডা? হ্যাঁ রে মইদুল! তুই তো রিপোর্টার, দেশের হালহকিকত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তোর কী মনে হয়"? আলতো করে মইদুলের দিকে বলটা ঠেলে দিল নিখিলেশ।
" আবার আমায় নিয়ে টানাটানি কেন", কাগজ থেকে মুখ তুলতে হল মইদুলকে, "আমি জার্নালিস্ট। ফ্যাক্ট সাজিয়ে দেওয়াটা আমার কাজ। ওপিনিওন ফর্ম করবে পাঠক। আমি তো আর পলিটিকাল কমেন্টেটর নই। তোমাদের মত স্যাটিরিস্টও নই"।
" তোমাদের ঝগড়ায় ফোকাস করতেই হবে দেখছি, তবে তার আগে আর একটা কবিরাজি অর্ডার করি। টেবিলে দেখছি স্রেফ স্যান্ডুইচের প্লেট আর কফির কাপ...কেমন ম্যাড়মেড়ে লাগছে"।
রমাপদও একটা কাটলেট অর্ডার করল। ভোর চারটেয় শুরু হওয়া আড্ডা অন্তত সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত চলবে। অবশ্য একসময় রমাপদরা সন্ধ্যেবেলাতেই আসত, তখনই আড্ডা বসত; জানালার বাইরে তখন আলো ঝলমলে সরগরম কলেজ স্ট্রীট। কিন্তু সে সব বহুযুগ আগের কথা। মারা যাওয়ার পর থেকে অন্যান্য ভূতেদের মত এই সময়টা ছাড়া আর কফিহাউসে জমায়েত হওয়ার উপায় থাকে না। বেলা বাড়লেই সাফসাফাইয়ের জন্য মানুষদের আনাগোনা শুরু হয়।
রমাপদ নিজে অবশ্য অমল-নিখিলেশের তর্কের ক্রস-ফায়্যারটুকু এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। তার আগ্রহ বরং ভজহরিদার গল্পে। ভজহরিদাই তাঁদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। রেলের চাকুরে এবং এই সাতজনের দলে একমাত্র তিনিই উত্তর কলকাতার আদিবাসিন্দা। তাঁর ছেলেবেলার গল্পগুলো যেমন আজগুবি, তেমনই মজাদার। ভদ্রলোক গুলবাজিতে যে অদ্বিতীয় তা অনস্বীকার্য কিন্তু মনটা বড় ভালো। গল্প বলাতেও সবিশেষ এলেম আছে ভজহরিদার। বিশেষত তার ছোটবেলার তিন স্যাঙাত; প্যালা, হাবুল ও ক্যাবলাদের গ্যাংলীডার হিসেবে তিনি যে'সব অ্যাডভেঞ্চারের মুখোমুখি হয়েছিলেন সে'গুলো শুনলেও গায়ে কাঁটা দেয়। তবে গল্পগুলো এমনই গ্যাসবেলুন লেভেলের যে তাঁর স্যাঙাৎরা বর্তমানে কে কোথায় আছে বা আদৌ আছে কিনা তা জিজ্ঞেস করতেও সাহস হয়না।
বেঁচে থাকতে ভজহরিদা নাকি এই কফিহাউসের সাতজনকে নিয়ে একটা জবরদস্ত ছড়াও লিখেছিলেন এবং পরে তা'তে সুরও জুড়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সে ছড়া বা সুর মনে করতে পারেননা তিনি। রমাপদর স্থির বিশ্বাস যে ভজহরিদার বাকি গল্পগুলোর মত এই কফিহাউসের গান লেখার গল্পটাও গাঁজাখুরি।
No comments:
Post a Comment