- হজৌর।
- কী চাই?
- দুদিনের ছুটির বড় দরকার, হজৌর।
- চৌবে, তোমার বড় বাড় বেড়েছে। এই না গত বছরই তুমি ছুটি নিয়েছিলে?
- জী হজৌর। দেড় বছর আগে তিন দিনের ছুটি নিয়ে দেশে গেছিলাম বৈকি।
- লজ্জা করে না ফের ছুটি চাইতে?
- মিথ্যে বলব না হজৌর। লজ্জা তো করে। তবু…।
- তবু আমায় জ্বলাতন করার ইচ্ছেটুকুকে সামাল দিতে পারো না, তাই না?
- গুস্তাখি মাফ হজৌর। তবে দু-তিন দিনের ছুটিটা নামঞ্জুর করবেন না।
- একশোবার করব। বেশি ট্যাঁফোঁ করলে বাইশ দিনের মাইনে কেটে নেব।
- দুদিনের ছুটির জন্য বাইশ দিনের মাইনে কাটা? হজৌর?
- মুখে মুখে তর্ক? চুয়াল্লিশ দিন।
- হজৌর…।
- ছেষট্টি।
- আপনার হুকুমুই আমার আশীর্বাদ, হজৌর।
- ন্যাকাপনা শুনে আর বাঁচিনা। যত নেকু খাঁ এসে জুটেছে আমার কপালে।
- হজৌর, পরশু রাত্রের ট্রেনে যাচ্ছি। দারভাঙ্গায় একদিনের কাজ সেরে পরের দিনের ট্রেনেই ওয়াপস।
- ওয়াপস না আসলেই বা কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে শুনি? আর দারভাঙ্গা কেন, পারলে লাহোর গিয়েই বসে থাকো না চৌবে। তুমি কী ভেবেছ, তুমি না থাকলে আমি জলে পড়ব?
- তৌবা তৌবা হজৌর। চাকর মানুষের থাকা না থাকায় কি বাবুর বিপদ হতে পারে…।
- হবেই বা কেন। টাকা ছড়ালে খিদমতগারের অভাব হয় নাকি?
- না হজৌর। বিলকুল হয় না।
- আর তোমার মত নেমকহারাম আমি বাপের জন্মে দেখিনি! দুবছরে দুবার ছুটি। এ যে দিনে ডাকাতি, রাতে সিঁদ।
- দশবার গালমন্দ করুন হজৌর, তবে অত উত্তেজিত হবেন না। সান্যাল ডাক্তার বলছিল আপনার প্রেশারের ভাবগতিক ভালো নয়।
- সান্যাল ডাক্তারের ধান্দা বুঝি না ভেবেছ চৌবে? ব্যাটা স্রেফ ফিয়ার মঙ্গারিং করে আমার সঞ্চয় সাফ করে চলেছে। আজ বলে কোলেস্টেরল বেশি, কাল বলে প্রেশার, পরশু বলে শুগার; মহা ফেরেব্বাজ ডাক্তার। কাজেই আমার সামনে ওঁর হয়ে ফোঁপরদালালি করতে এসো না।
- জী। গুস্তাখি মাফ। তবু, বেশি রাগধাপ না হয় নাই করলেন, হজৌর।
- তা এই যে দুদিন আগেই দেশের বাড়ি থেকে ঘুরে এলে…।
- দেড় বছর আগে হজৌর, দেড় বছর আগে।
- ফের যদি কথার মাঝে কথা বলেছ চৌবে, তোমার পিছনে আমি উকিল লাগাবো। এই কদিনের মধ্যেই ফের দেশের বাড়ি যাওয়ার মতলব কেন?
- হজৌর…।
- ব্যাপার কী চৌবে…।
- বড় নাতিটা বোধ হয় আর…।
- সেই যার জন্য তুমি গতবার অমন হন্যে হয়ে ছুটে গেলে?
- জী হজৌর…আপনার দয়ায় সে ব্যাটাকে কলকাতায় এনে কম চিকিৎসা করানো হল না। কিন্তু তবু…।
- সে গণ্ডগ্রামে তাকে ফেরত নিয়ে যাওয়ার বদবুদ্ধি শুনে আমি তখনই পইপই করে বারণ করেছিলাম…। কে না জানে; সান্যাল ডাক্তার অসাধ্য সাধন করতে পারে। তাঁর সুপারভিসন ছেড়ে ওঁকে নিয়ে গিয়ে খুব অন্যায় করেছ।
- সান্যালবাবুই জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন হজৌর। তাই আর…।
- সান্যাল জবাব দিয়েছে? ডাক্তার না ছাই, ব্যাটাচ্ছেলে একটা কোয়্যাক। আহা, অমন ফুটফুটে নাতিটা তোমার; কী নাম যেন? গুড্ডু, আহা। বুক ভরে যায় ওর দুচোখের দিকে তাকালে। জবাব দেওয়ার সাহস পায় কী করে সান্যাল? ব্যাটা হামবাগ! আমি গুড্ডুকেকে বম্বে নিয়ে যাব।
- হজৌর কিন্তু…।
- ফের কথার মধ্যিখানে কথা ? প্রয়োজনে আমি ওকে আমেরিকা নিয়ে যাব। তুমি দেখো চৌবে, গুড্ডুবাবুর কিস্যু হবে না।
- গুড্ডু আপনার কথা প্রায়ই বলে হজৌর।
- কেন বলবে না? ওর মধ্যে তো তোমাদের মত বিষ নেই। ও আমার ভালোবাসা চিনতে পেরেছে, কদর করে। তোমাদের মত ট্রেটার সে নয়। যাক গে, আর বাজে কথা নয়। আমি সান্যালকে খবর পাঠাচ্ছি, তাঁকেও না হয় সঙ্গে নিয়ে নেওয়া যাবে। একটা গাড়ি আর একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আমরা সোজা চলে যাব দারভাঙ্গা, ওসব ট্রেনঠ্রেনের ঘ্যানঘ্যানে বাবুগিরি চলবে না। আমার ওই নতুন সেক্রেটারির নামটা যাই ভুলে…কী যেন…ওই মনোজ না হরগোবিন্দ…।
- সলিল, হজৌর…।
- ওই হল। ওই সমরকে বলো…।
- আজ্ঞে সলিল, হজৌর।
- কে সলিল?
- আপনার সেক্রেটারি হজৌর।
- তার নাম সলিল যখন সলিল বলে ডাকলেই হয়। তাকে বলো সে যেন এখুনি সব ব্যবস্থা করে ফেলে। আমরা আজই রওনা হব।
- হজৌর, সান্যাল ডাক্তার কিন্তু বলেই দিয়েছেন…।
- তোমায় কি সান্যাল মাইনে দিয়ে পুষছে না আমি? চৌবে?
- আপনিই মাইবাপ, হজৌর।
- ফের যদি তর্ক করেছ তো অষ্টআশি দিনের মাইনে কাটব।
- হজৌর, আর কটা দিনই তো, থাক গুড্ডু ঘর আলো করে, মায়ের কোলে।
- না চৌবে, অমন পেসিমিজম তোমায় মানায় না। তুমি সিংহপুরুষ চৌবে।
- হজৌর…।
- চৌবে। তুমি কাঁদছ?
- এ বড় স্বার্থপর কান্না হজৌর। আমার ছেলেটার জন্য বড় কষ্ট হয়, গুড্ডুর কিছু হলে ও বেচারা আর ওর পরিবার যে প্রতিদিন একবার করে মরবে।
- চৌবে। তোমার ছুটি নামঞ্জুর।
- জী হজৌর। আপনি যেমনটি বলবেন।
- আমি ছ’মাসের জন্য দারভাঙ্গায় থাকব, তোমায় আমার খিদমতে সেখানেই থাকতে হবে। কাজেই ছুটি ক্যান্সেল। কথার নড়চড় হওয়ার উপায় নেই কিন্তু। ফের যদি ছুটির জন্য প্যানপ্যান করেছ আমি তোমায় কতল করাবো।
- না হজৌর, আপনি এ বয়সে সেখানে গেলে থাকতে পারবেন না…।
- এ বয়সে কলকাতার পলিউশন এমনিতেও সহ্য হচ্ছে না। তোমাদের বাড়িতে তো দারভাঙ্গা থেকে কিছুটা দূরের সেই অজগাঁয়ে। সেই বরং ভালো। সকাল থেকে সন্ধে গুড্ডুবাবুর সঙ্গে লুডো আর ক্যারম খেলব আর রাত্রে সান্যাল ডাক্তারের সঙ্গে দাবা। থাকার ব্যবস্থা তোমার চিন্তা। আর দেরী নয়, আমার সেক্রেটারি…ওই অনিন্দ্য না মনমোহন কী যেন একটা নাম…ওকে চট করে সব বুঝিয়ে দাও।
- হজৌর, আপনি অতদিন সেখানে থাকবেন কেন? না না…আপনি এখানেই থাকুন…।
- চৌবে, তোমার বাপের কোলেপিঠে মানুষ হলাম। ছেলেবেলায় প্রত্যক্ষ করেছি; কাকার তোমায় নিয়ে সে কী দুশ্চিন্তা। তুমি ছেলেবেলা থেকেই হাড়বজ্জাত কিনা; হপ্তায় চারদিন ভুগতে জ্বরে আর তিন দিন বিছানায় লেপটে থাকতে পেটের গোলমালে। তোমার যন্ত্রণা তুমি কতটা ভোগ করতে জানি না, কিন্তু কাকা কাটা পাঁঠার মত ছটফট করত তোমায় কষ্ট পেতে দেখলে। নিজের বাপকে বেশি দিন কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আমি স্নেহ যেটুকু পেয়েছি তা কাকার কাছ থেকে। তুমি এমন ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললে চৌবে, এ সময় তোমায় আমি ভেসে যেতে দেব ভেবেছ? আর ওপরে কাকা ছটফট করে মরুক আর কী।
- হজৌর…।
- না কোরো না ভাই চৌবে। পায়ে পড়ি তোমার।
- তৌবা হজৌর। তৌবা।
- ধ্যাত্তেরিকা তৌবার নিকুচি করেছে। আজ থেকে ছ’মাস আমি তোমার খিদমতগার। কেমন? সেখানে গিয়ে আমি মোটে বাবুয়ানি করে দিনগুলো নষ্ট করব না...শুধু তোমার ফাইফরমাশ।
- ছিঃ হজৌর।
- ফের কথার মাঝে কথা? তোমার একশো দশ দিনের মাইনে কাটব! হুঁশিয়ার!
1 comment:
Mon voriye dao dada, eirokom lokjon r boro ekta dekhi na
Post a Comment