দিব্যি ছিলাম। বসের ধমক, বৌয়ের খোঁটা, খোকার ঘ্যানঘ্যান শুনে দিনগুলো ছুরিতে মাখনের মত কেটে যাচ্ছিল। বাধ সাধলে ব্যাঙ্ক-দাদা এসে। অফিসে বসে নিশ্চিন্ত মনে একটা পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে একের পর এক অদরকারী স্লাইড জুড়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় সেই মিহি সুরের ডাক;
"স্যর, আসব"?
অমন গদগদ ভক্তি নিয়ে আমায় ডাকার মানুষ তো ভূভারতে বিশেষ দেখিনা, কাজেই প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকাতে বাধ্য হলাম। অবশ্য সামনে খুলে রাখা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে যে তেমন চিত্তাকর্ষক কিছু ছিল তাও নয়।
"কী চাই" প্রশ্নের উত্তরে সামনে দাঁড়ানো সৌম্য-কান্তি মানুষটি গড়গড় করে একটানা বেয়াল্লিশ সেকেন্ড মায়াবী কিছু একটা বললেন।
মনে হল এ'বার কিছু একটা ঘটবে।
মনে মনে "ডেস্টিনি" শব্দটা কেন আওড়ালাম সে'টা ঠিক ধরতে পারলাম না। তবে মনে হল কিছু ঘটবেই; অতএব, নির্দ্বিধায় বললাম; "দাঁড়িয়ে কেন? বসুন”।
সেই প্রথম আমার রাজেশবাবুর সঙ্গে আলাপ। ব্যাঙ্কের চাকরী তাঁর নেহাতই দেখনাই; মনেপ্রাণে তিনি ফিলসফার। ঠিক সাড়ে তিন মিনিট লেগেছিল ভদ্রলোকের আমার বন্ধু হতে আর মিনিট ছয়েকের মাথায় তিনি হয়ে উঠলেন গাইড। সামান্য চা বিস্কুট ছাড়া ভদ্রলোককে তেমন কিছুই দেওয়া হল না অথচ তিনি নিঃস্বার্থ ভাবে একটানা যে'ভাবে জ্ঞান বিলিয়ে গেলেন তা'তে আমার বুকের মধ্যে একটা "কী আর করলাম ওর জন্য" মার্কা অপরাধ বোধ মাঝেমধ্যেই চিড়বিড় করে উঠছিল বটে। ভদ্রলোক আধ ঘণ্টা ছিলেন, সে'টুকু সময় জুড়ে আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর চপ ব্যবসার যোগযোগ থেকে পার্লামেন্টের হালহকিকত; বহুবিধ ব্যাপার নিয়ে কথা বলেছি। আর কথা বলতে গিয়ে বুঝেছি যে ভদ্রলোক আমার Thought-Twin; তাঁকে দু'টো মনের কথা বলেও আরাম। তা সেই চমৎকার আড্ডা শেষে ভদ্রলোক যখন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন; তখন আমার মনে কোনও সন্দেহই রইল না যে ওঁর ব্যাঙ্কে নিজের নামে একটা নতুন অ্যাকাউন্ট না খুললে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমি এও নিশ্চিত ভাবে অনুভব করতে পারলাম যে এই মুহূর্তে যে'টা আমার জীবনে সবচেয়ে দরকারি; সে'টা হল একটা ক্রেডিট কার্ড এবং সে'টা অবশ্যই হতে হবে রাজেশবাবুর ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ডিনামাইট শপার্স কার্ড। সে ক্রেডিট কার্ড তৈরিই হয়েছে আমার জীবনের সমস্ত বিটকেল সমস্যাগুলো ছেঁটে ফেলার জন্য।
পরের দিন সকালে অফিসের চেয়ারে বসার আড়াই সেকেন্ডের মধ্যে ফের সেই মায়াবী "স্যর, আসব”?
ব্যস! চটপট ফর্মটর্ম ভরে দিলাম। আধার কার্ড, প্যান কার্ড, বিয়ের কার্ড, মেনু কার্ড; হাতের কাছে যা যা পেয়েছি সব তিন কপি করে জেরক্স করিয়ে রাজেশবাবুর হাতে তুলে দিলাম। হাতের কাছে থাকলে বাড়ির দলিলও কয়েক কপি জেরক্স করিয়ে দিয় দিতাম; যা হোক, সে প্রয়োজন হয়নি। যাওয়ার আগে রাজেশবাবু বিবেকানন্দ-শিকাগো লেভেলে কনফিডেন্সে বলে গেলেন যে দু'দিনের মাথায় আমার ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড আর আরও অনেক মোহময় জিনিসপত্র আমার কাছে এসে পৌঁছবে।
রাজেশবাবু চলে যাওয়ার পর আচমকা একটা বিহ্বলতা এসে গ্রাস করল যেন, কী ভাবে ছিলাম এদ্দিন এই ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড ও ডেবিট কার্ড ছাড়া?
মোগলাই থেকে বোরোলিন; সর্বত্র ছাড়!
এরোপ্লেনে চড়ার দরকার তেমন পড়েনা বটে; কিন্তু "আমার লাউঞ্জ অ্যাকসেস" আছে, অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে সে'টা নিয়ে ভাবতে কী ভালোই না লাগবে।
এই কার্ড দিয়ে একটা ল্যাপটপ কিনলে দু'টো ডেস্কটপ ফ্রী দেবে নাকি। দশ হাজার টাকার মোবাইল কিনলে সাড়ে আট হাজার টাকার ক্যাশব্যাক।
আর পয়েন্ট? দড়াম দড়াম করে ড্যালা ড্যালা পয়েন্ট ঢুকবে পকেটে! সেই পয়েন্ট দিয়ে ঠিক কী হবে তা অবিশ্যি মুখের ওপর জিজ্ঞেস করে ভদ্রলোককে বিরক্ত করতে মন সরেনি। তবে ও দিয়ে যে চাইলেই বিনে পয়সায় ব্যাংকক বা রউরকেলা ঘুরে আসা যাবে; সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
আর এত কিছু তো সবে টিপ অফ দ্য আইসবার্গ। এই নতুন অ্যাকাউন্ট আর নতুন ক্রেডিট কার্ডের কয়েক হাজার রকমের ফায়দা আমায় রাজেশবাবু জানিয়েছেন। সব চেয়ে বড় কথা, যে কোনও সমস্যায় রাজেশবাবু আমার পাশে থাকবেন।
নতুন কার্ডের জন্য এই দু'দিনের অপেক্ষা যে কী দুর্বিষহ কেটেছে! ফার্স্ট ইয়ারে প্রেমিকার চিঠির জন্য অপেক্ষা করার সময়টাও এমন ঘোরতর কষ্টকর ঠেকেনি। দু'দিন যেন দু'শো স্লাইডের পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের গতিতে গেল।
তিন নম্বর দিনটা ছুটিই নিলাম। আজ কার্ড, চেকবই ইত্যাদি চমৎকার সব জিনিসপত্র কুরিয়রে আমার বাড়ির ঠিকানায় আসবে। রাজেশবাবু যদিও বলেছেন যে "স্পাউস ক্যান রিসীভ অন ইওর বিহাফ"; তবু। ভদ্রলোক এত করলেন, আর তাঁর পাঠানো কার্ড আর চেকবই গ্রহণ করার জন্য আমি নিজে বাড়িতে থাকব না? যদিও গোটা দিন অপেক্ষার পরেও কার্ডটার্ড আসেনি, তবু রাজেশবাবুকে ফোন করে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হল না। এত করেছে মানুষটা আমার মত গবেটের জন্য; আমি বাড়তি একদিন ধৈর্য ধরতে পারব না? ক্যাসুয়াল লীভগুলো এমনিতেই পড়ে পড়ে পচছিল। আর একটা ছুটিই না হয় নেব।
কিন্তু ইয়ে... পরের দিনও সেই কার্ড আর চেকবই ঠিক মত এসে পৌঁছতে পারল না।
পরের দিন সকালে সাহস করে রাজেশবাবুকে কল করেই ফেললাম। ভদ্রলোকের গলার মায়াবী ব্যাপারটায় যেন কোথাও একটু খামতি ছিল। তবে হবে নাই বা কেন, দিনটা যে শনিবার; উইকেন্ড। সরিটরি বলে ফোন রেখে দিলাম।
পরের ফোন করলাম সোমবার! ব্যস্ত মানুষ রাজেশবাবু, চট করে ঠিক চিনতে পারেননি। তবে বুঝিয়ে বলার পর টপ করে মনে পড়ে গেল। দরদ দিয়ে বললাম, দু'দিনের মধ্যে কার্ড আসার কথা ছিল, আপনি বলেছিলেন যে। ভদ্রলোক সামান্য হেসে বললেন; "আমি আপনার বাড়ি গিয়ে দু'টো ভাত খেতে চাইলে কি আপনি কাঁসার থালায় দু'কণা ভাত সাজিয়ে আমায় দেবেন"?
অকাট্য যুক্তি। লজ্জিত হয়ে অজস্র সরিটরি ভাসিয়ে ফোন রেখে দিলাম। কী বিব্রতই না করে ফেলেছি ভদ্রলোককে।
রাজেশবাবুকে এরপরের ফোন করি দু'হপ্তা পর।
- ইয়ে আমার কার্ডটার স্টেটাসটা যদি...।
- কার্ড?
- ওই যে। নতুন অ্যাকাউন্ট আর ক্রেডিট কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করলাম।
- আমাদের ব্যাঙ্কে?
- বটেই তো। আপনারই কাছে।
- করে ফেলেছেন?
- আজ্ঞে।
- তবে?
- না মানে কার্ড তো এখনও কুরিয়রে এসে পৌঁছায়নি।
- ও মা! আমি কুরিয়রের লোক নই তো। ব্যাঙ্কের।
- না না, মানে আমার কার্ডের স্টেটাসটা?
- স্টেটাস?
- আজ্ঞে।
- প্রসেসে আছে।
- প্রসেসে?
- প্রসেসে।
- একটু বেশি সময় লাগছে না?
- বেশি? চীনের দেওয়াল কদ্দিনে তৈরি হয়েছে জানেন?
- না। কদ্দিন লেগেছে চীনের দেওয়াল তৈরি করতে?
- গুগল থাকতে চীনের দেওয়ালের ব্যাপারে জানতে আপনি আমায় ফোন করছেন?
ভেবড়ে গিয়ে আমি নিজেই ফোন কেটে দিলাম। সত্যি তো; হাউ সিলি অফ মি।
তাঁর এক হপ্তা পর সাহস করে ফের ফোন করলাম। এ'বারেও রাজেশবাবু ঠিক ঝেড়ে কাশলেন তা নয় (ফিলোসফিতে ঝেড়ে কাশার ব্যাপারটা ঠিক খাপে খাপ দাঁড়ায় না বটে), তবে এ'বার একটা "ডকেট নাম্বার" দিলেন।
দু'দিন পর ফের ফোন করে ডকেট নাম্বার উল্লেখ করে একটু "আপনার ধৈর্য বড় কম দেখছি" লেভেলে বকুনি শুনতে হল; আহ্, শুনতে হবে নাই বা কেন। যাকে ফ্রেন্ড, ফিলসফার বলে মেনে নিয়েছি, তাঁর থেকে সামান্য বকুনি শুনব না?
এর কিছুদিন পর ফের একবার ফোন করলাম। যতটা ইনিয়েবিনিয়ে সম্ভব জিজ্ঞেস করলাম; "প্রসেস কদ্দূর এগোল"? এ'বারে বেশ মখমলে সুরে রাজেশবাবু বললেন যে "ইওর কল ইজ ইম্পর্ট্যান্ট টু মি। উই আর লুকিং ইন্টু ইট" ।
পরের হপ্তায় "উই আর লুকিং ইন্টু ইট" হয়ে গেল "উই হ্যাভ এস্কালেটেড দ্য ম্যাটার"।
এরপর একদিন গায়ে মার্গো সাবান ডলতে ডলতে একটা জরুরী খটকা আমার মনে এসে ঠেকল। এই যে রাজেশবাবু দু'দিন আমার অফিস বয়ে এলেন, আর আমার এত পায়া ভারী যে একদিনও ব্যাঙ্কে গিয়ে ভদ্রলোকের হালহকিকত জিজ্ঞেস করব না? খোঁজখবর নেব না? যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। লাঞ্চের পর হাফ-ছুটি নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা ব্যাঙ্ক। এমনিতেই এই "লুকিং ইনটু ইট" আর "এস্কালেশন" শুনে সামান্য গলাজ্বালা শুরু হয়েছিল; ভেবেছিলাম হাল ছেড়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে, ছাপোষা মানুষ; কী হবে ওই সাংঘাতিক ক্রেডিট কার্ড দিয়ে? নকুল সহদেবের হাতে কি গাণ্ডীব মানায়?
রাজেশবাবু আমায় দেখে বড্ড খুশি হলেন; নিজে উঠে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে "শুভ বিজয়া" বললেন। আমার মনে মনে একটু খারাপই লাগল; বিজয়ার সময় দেখা করতে এলাম, আমার বোধ হয় এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে আসা উচিৎ ছিল। যা হোক, রাজেশবাবুর মনটা দরাজ, এ'সব ছোটখাটো লৌকিকতা ধরে বসে থাকেন না। আমায় বসিয়ে কত গল্পই না করলেন তিনি। নেহেরুর কবজি কত ইঞ্চির, শ্রীলঙ্কার ডাক ব্যবস্থা কেমন; এমন অজস্র মনোগ্রাহী বিষয় ছুঁয়ে জরুরী সব মতামত সামনে রাখলেন, আমিও সমৃদ্ধ হলাম। কিন্তু,ইয়ে...কিছুতেই ভদ্রলোক ক্রেডিট কার্ড বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের কথা বলছেন না দেখে সাহস করে আর্জিটা জানিয়েই ফেললাম ফেললাম; "রাজেশবাবু, ওই কার্ড বা অ্যাকাউন্ট বরং বাদ দিন। ও'সব আমার দরকার নেই”।
রাজেশবাবু এমন ভাবে চারদিকে দেখলেন যেন আমি আড়াই কিলো আরডিএক্স চেয়ে বসেছি। তবে ভাগ্যিস রাজেশবাবু ছিলেন, একটা বড় গোলমালের থেকে তিনি আমায় বাঁচালেন; আমি তো জানতামই না যে নিজের আবেদন ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা আইনত প্রায় চুরির সমান। বাহাত্তর বার জিভটিভ কেটে ব্যাঙ্ক থেকে যখন বেরলাম তখন মনের মধ্যে রাজেশবাবুর আশ্বাস গমগম করছে;
"ইউ আর ইম্পর্ট্যান্ট টু আস।
উই আর লুকিং ইনটু ইট।
গিভ মি ব্লাড আই উইল গিভ ইউ ফ্রিডম।
উই হ্যাভ এস্কালেটেড দ্য ম্যাটার।
উই উইল গেট ব্যাক টু ইউ শর্টলি”।
No comments:
Post a Comment