যথেষ্ট গল্পের বই পড়া হচ্ছে না বা পড়ার সময় হচ্ছে না; এ অনুযোগ আর আফসোস কিছুতেই যাওয়ার নয়। এই ঘ্যানঘ্যানের মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত বেশ কঠিন; যে বই আগেই পড়া আছে, সে বইতে আবার ফেরত যাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? এর উত্তর আমার কাছে স্পষ্ট; পুরনো বই যা এক সময় ভালো লেগেছে, তা নতুন করে আবিষ্কার করার সুযোগ থাকে বৈকি। সে নিয়ে ধন্দ আমার মনে অন্তত নেই, ভালো লাগা বইতে ফেরত যেতে হবেই। এবার প্রশ্ন হচ্ছে নেটফ্লিক্স আর বেহালার ট্র্যাফিক জ্যামের মধ্যে অনবরত পেষাই হওয়ার ফাঁকে যে’টুকু পড়ার সময়; তার মধ্যে কতটুকু ‘রী-রীডে’ খরচ করা উচিৎ আর কতটুকু সময় নতুন বই খুঁজেপেতে পড়ার কাজে ব্যবহার করা উচিৎ? প্রতিটা নতুন বই ধরার আগে এ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় বটে। কিন্তু দু’হাজার উনিশে যেটুকু যা পড়াশোনা হয়েছে; তাঁর অনেকটা জুড়েই রয়েছে এমন সব বই যা আগে পড়া। ইন ফ্যাক্ট, বছরের শুরুতেই ঠিক করেছিলাম এবারের রী-রীড লিস্টে থাকবে সম্পূর্ণ হ্যারি পটার সিরিজ এবং বাংলা ট্রায়ো; শ্রীকান্ত, অপু (পথের পাঁচালী, অপরাজিত) এবং গোরা। হ্যারি পটার পুরোটা শুনেছি। পথের পাঁচালীও পড়া হল। আশা করি অপরাজিতটাও এ বছরেই হবে। কিন্তু শ্রীকান্ত মনে হয় পরের বছরই ধরতে হবে।
সদ্য শেষ করলাম গোরা। শ্রীকান্ত পড়েছিলাম মাধ্যমিকের আগে, গোরা পড়েছিলাম উচ্চ্যমাধ্যিকের পরে সম্ভবত। সে সময় গোরার তুলনায় নিশ্চিতভাবেই শ্রীকান্তকে অনেক বেশি মনে ধরেছিল; শুধু চরিত্রটা নয়, কাহিনীর নিরিখেও শ্রীকান্তই ছিল আমার অন্যতম প্রিয় লেখা। শ্রীকান্তর প্রতি পক্ষপাত যেন কোনোদিন না কাটে; এই ইচ্ছেটাও আন্তরিক।গোরা তখন সামান্য বোরিং ঠেকেছিল বটে। এমন কী কিছু কিছু ব্যাপারে আজও সমান খটমট মনের মধ্যে রয়েই গেছে।কিন্তু সে খটমটে অলোকপাত করার আগে আমার কর্তব্য এ’টা জানিয়ে রাখা যে এই যাবতীয় খটমট প্রকাশ করা মানে রবিস্যারকে ‘ক্রিটিকালি অ্যানালাইজ’ করা নয়। সে সাহস হওয়ার আগে যেন আমার ব্লগে বাজ পড়ে। এ শুধুই আমার মগজে কতটুকু ঢুকেছে আর কতটুকু গোঁত্তা খেয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে; তার হিসেব।
এবার আসি ওই খটকা প্রসঙ্গ। বারো ক্লাসে যা ‘হাইলি সাস্পিশাস’ ঠেকেছিল, তা আজও প্রাণে কেমন ভাবে যেন ঠেকেছে। গোরা আর বিনয় প্রাণের বন্ধু; আল্টিমেট ইয়ারদোস্ত যাকে বলে। অথচ তাদের আড্ডা-আলোচনায় এমন মখমলে সরি/থ্যাঙ্কিউ/এক্সকিউজমি/প্লীজ মার্কা সহবত লেগে যে মনে হয় ‘আগন্তুকে’র উড়ে এসে জুড়ে বসা মামা নেহাত ভুল বলেননি; রবীন্দ্রনাথ সত্যিই আড্ডাটাড্ডার ধার ধারতেন না (সেটা নিয়ে অমন গর্বেরই বা কী আছে কে জানে)। দুই বন্ধু রাত জেগে ছাতে আড্ডা মারছে অথচ সে আড্ডার ভাষা কর্পোরেট শিষ্টতাকেও হার মানায়; এ কেমন রোয়াকবিরোধী রিভোল্ট রে বাবা। গুরুদেবের প্রেমের ভাষাও যে স্যাট করে বুঝে ‘বাহ গুরু কী দিলে’ বলে টেবিল চাপড়াতে পেরেছি তা নয়।
কিন্তু গোরা এবার পড়াটা বড় জরুরী ছিল। রাইট, রাইখ, লেফট, রাষ্ট্রবাদ, সনাতন ধর্ম, ভারতবর্ষ নিয়ে আজকাল এত ডিবেট; অথচ সেসব তর্কে অব্জেক্টিভিটি ব্যাপারটা আমরা এত গুলিয়ে দিই যে একে অপরের কলার ধরে টানা ছাড়া বিশেষ কিছুই আর করা হয়না। সে সব আলোচনায় চোখা চোখা কমেন্টেটররাও বড় বড় কথার আড়ালে “ধ্যার্বাল” সেন্টিমেন্ট গুঁজে দিয়ে সরে পড়েন।
সেইসব ডিবেটের বিষে ‘গোরা’ খানিকটা বোরোলিনের উপশম ছুঁইয়ে গেল বৈকি। এ উপন্যাসে যাবতীয় প্রেম, বন্ধুত্ব ও সামাজিক দোলাচলের মধ্যে মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতবর্ষ।
দেশকে গ্রহণ করব কী ভাবে?
দেশ কে কী বা কারা? গ্রহণ করার প্রয়োজনই বা কী? ভালোটুকুকে যে ভালো বলে সমাদর করতেই হবে তাতে আশ্চর্য কী, কিন্তু দেশের যেটুকু মন্দ; তা এক কোথায় ‘ও আমি নই’ বললেই ল্যাঠা চুকে যায় কি?
এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর রবীন্দ্রনাথ অঙ্কের ভাষায় হয়ত দেননি; কিন্তু কিছু চরিত্র সৃষ্টি করে সেসব নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন। এক চরিত্রের মুখ দিয়ে বলা অকাট্য যুক্তিকে অন্য চরিত্রের বিচক্ষণতা দিয়ে অ্যানালাইজ করেছেন। গোটা উপন্যাসটাই হয়ে উঠেছে একটা টানটান তর্ক; সে তর্কে ভাঁওতা নেই, বাতেলা নেই, সিমেন্টের মত নিরেট লজিক সাজিয়ে প্রতিপক্ষকে দুরুমুশ করাটাই সেখানে সব নয়। সবচেয়ে বড় কথা; এখানে রয়েছে ‘এমপ্যাথি’। প্রেমের বাষ্প আর সম্পর্কের ধোঁয়াশার বাইরে এসে; গোরা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সেই ‘তর্কে’। আগন্তুকের মামা প্রাচীন গ্রীসের আখড়ার আড্ডার কথা বলেছিলেন; আড্ডা অফ দ্য হাইয়েস্ট অর্ডার। এই উপন্যাস একদিক থেকে সেই লেভেলের আড্ডার একটা ডেমনস্ট্রেশনই বটে। আর হবে নাই বা কেন; এখানে ন্যাশনালিজম আর হিঁদুয়ানির স্বপক্ষে আর বিপক্ষে যুক্তি সাজিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বাঘা বাঘা ইন্টেলেকচুয়ালরা যখন নিজেদের বিশ্বাসকে আন্ডারলাইন করে বাকি সমস্ত কিছুকে নস্যাৎ করে ফেলেন; তখন তাদের দিকে তাকিয়ে এ উপন্যাসের পাঠক গোরার বিশ্বাস, বিনয়ের ব্যালেন্স এবং পরেশবাবুর স্নেহ-মিশ্রিত আইডিয়ালিজমের কথা মনে করে স্বস্তি খুঁজে নেবে। এ উপন্যাস প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়; আনন্দময়ী সম্ভবত আমার সর্বকালের প্রিয় চরিত্রগুলোর একটা। তাঁর নিষ্ঠা, তাঁর আধুনিকতা আর তাঁর সাহস; তাঁকে ‘মায়ের মতই ভালো’ না বলে উপায় আছে কি? নেহাত সস্তা ‘পান’য়ের লোভেই যে রবীন্দ্রনাথ এ উপন্যাসের নাম ‘আনন্দময়ী’র বদলে গোরা রেখেছেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
শেষে একটা কথা না বলেই নয়। ব্রাহ্ম সমাজের স্বপক্ষে দুটো কথা যে রবীন্দ্রনাথ বলবেন সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বপক্ষের সেই দুটো কথা বলতে গিয়ে আগে বিভিন্ন ক্রিটিসিজমে ছিন্নভিন্ন করেছেন সে সমাজ এবং তাদের গা বাঁচিয়ে চলার সংস্কৃতি ও তাদের জ্যাঠামোকে। নিজের পাড়া, নিজের ভাষা, নিজের ধর্ম বা নিজের দেশের সমালোচনা করলেই কাউকে ‘ব্যাটাচ্ছেলে গোল্লায় গেছে মার্কা’ মন্তব্যে বিদ্ধ করতে হবে; এমন ব্যাপার শুনলে রবিস্যার ফিক করে হেসে ফেলতেনই। আমি নিশ্চিত।
No comments:
Post a Comment