Tuesday, November 17, 2020

অনুরাগের লুডো



অনুরাগবাবু আমার অত্যন্ত প্রিয়৷ তার মূলে রয়েছে "বরফি"। লোকমুখে ও বিভিন্ন রিভিউয়ের মাধ্যমে জেনেছি যে বরফিতে ভুলভ্রান্তি ও গোলমাল যথেষ্ট রয়েছে৷ কিন্তু গাম্বাট সিনেমা দেখিয়ে হিসেবে আমি বেশ বুঝেছি যে নিজের ভালোলাগাগুলোকে বুক বাজিয়ে আঁকড়ে থাকাটাই কর্তব্য৷  বরফি কতবার দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই৷ সিনেমার টেকনিকালিটি বুঝি না - শ্রুতিদেবীর ছলছলে চোখের পাশাপাশি বরফি আর ঝিলমিলের প্রতি তাঁর অপত্য স্নেহ, ও'তেই এস্পারওস্পার হয়েছি, বারবার। মোদ্দা কথা হল, সিনেমাটি যে আগাগোড়া প্রবল যত্ন আর ভালোবাসায় তৈরি - সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ থাকেনা। সে'খানেই অনুরাগবাবুর ভক্ত হয়ে পড়া৷ 
(আদতে হয়ত অনুরাগবাবু প্রবল অযত্ন আর অ-ভালোবাসায় বানিয়েছিলেন ছবিটা। তাতে আমার কী? আমার মনে হয়েছে 'বরফি'র ফ্রেমে ফ্রেমে রয়েছে স্নেহ, ভালোবাসা আর জ্বরে-জলপটি-মার্কা যত্ন৷ সেই মনে হওয়ার দামই তো লাখ টাকা)। 

যাকগে৷ এতটা পাঁয়তারা কষলাম এ'টা জানাতে যে "লুডো" দেখেছি৷ অনুরাগবাবুর সিনেমার ব্যাপারে আমার একটা বায়্যাস থাকবে, সে সম্ভাবনাও  উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷ কাজেই গোড়াতেই বলে দি যে সিনেমাটা আমার বড় ভালো লেগেছে। সুপারডিলাক্স মার্কা একটা জিগস-পাজলামো আছে। গতি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সুতোয় সুতোয় সিনেমার প্রতিটি কণার জড়িয়ে থাকা৷ তবে আমার ভালো লাগা সেই গতি আর থ্রিলে নয়।

লুডোর কয়েকটা সাদামাটা মুহূর্ত বড় অনাবিল হয়ে মনে গেঁথে গেছে৷ প্লট গপ্প ট্যুইস্ট ক্লাইম্যাক্স- সিনেমা মাত্রই এ'সব থিওরি কপচানো হবে৷ তার ভালো খারাপ থাকবে৷ কিন্তু কিছু কিছু অনস্ক্রিন মুহূর্ত অমূল্য - সে'সব মুহূর্তের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়াটাই আমার সিনেমা দেখা৷ এই যেমন কালপুরুষ সিনেমায় একটা রেস্টুরেন্টে বসে বাবা আর ছেলে খাওয়াদাওয়ার দৃশ্য৷ আপাতদৃষ্টিতে নিরেট৷ ডায়লগেও মারকাটারি তেজ থাকার কথা নয়। রাহুল বসুর বাংলাও  নিখুঁত নয়৷ অথচ সেই সিন থেকে আজও বেরোনো হয়নি, এখনও সে দৃশ্য দেখলে বুকের মধ্যে ওলটপালট হবে৷ হবেই৷ আর সে'খানেই লুডো আমার চোখে অনবদ্য, এমন বেশ কিছু সিকুয়েন্সের জন্য৷ 

একটা ব্যাপার না বললেই নয়, আপাত ক্লিশেগুলো নিয়ে বড় চমৎকার গল্প বলেন অনুরাগবাবু (স্রেফ বরফি দেখে কথাটা বলা৷ এই অপর্যাপ্ত স্যাম্পেলে স্যুইপিং প্রশংসা করতে পারাটাই বোধ হয় আদত ভক্তি)৷ লুডোতেও সেই ব্যাপারটাও ঘটেছে৷ বাপের হাহাকার আর স্নেহ, বদখত মানুষের মনের নরম, আলগোছে পড়ে থাকা একনিষ্ঠ প্রেম - এমন সব প্রবল বলিউডি ক্লিশেগুলোর সরবতে প্যরামাউন্ট সুবাস মিশিয়ে মনভালো করা বেশ কিছু মুহূর্ত তৈরি হয়েছে৷ উয়ো সব ফ্রেম মে ফির সে ওয়াপিস যায়েগা, আবার দেখব 'লুডো'৷ 

আর। সিনেমা জুড়ে যে'টা তুরুপের তাস - সে'টা হল সারল্য৷  প্রতিটি জটিল চরিত্রের সারল্যটুকুকে ছেঁকে তুলে তৈরি হয়েছে এই প্লট৷ 

তাছাড়া৷ ভালো সিনেমার একটা বড় সিগনেচার হল 'শো'-য়ের শেষে দর্শকদের মনে সিনেমার গানগুলোর প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা তৈরি করতে পারা, সুর, গায়কি, লিরক্সের বাইরে গিয়ে৷ আবাদ-বরবাদ আর হরদম-হমদম গানদুটো আমি আদৌ সিনেমা দেখার আগে শুনিনি৷ অথচ সিনেমাটা দেখার পর থেকে মনের মধ্যে এই দু'টো গানের সুর ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়ে চলেছে৷ আর সুরের সঙ্গে চলকে উঠছে সিনেমার এক একটা মুখ, প্রবল ভালোলাগা সহ৷ (আর ওই সাতপুরনো 'ও বেটাজি ও বাবুজি' গানটা এমনভাবে মাখনে-ছুরি লেভেলে ব্যবহৃত হয়েছে, উফ। বাপি লাহিড়ির ক্রেড জিঙ্গলটির ম্যাজিকও হার মানতে বাধ্য)

ক্রিটিসিজম? আলবাত আছে৷ বেশ কিছু জায়গার ডায়লগ শীর্ষেন্দু লিখলে যেন আরও ভালো হত৷ বেশ কিছু দৃশ্যের বর্ণনা সিনেমার বদলে সঞ্জীবে কলমে পড়তে পারলে আরও লাগসই হত যেন।

মনখারাপের দিন


- এই যে ভায়া, মনটন খারাপ নাকি?

- হুম?

- মনখারাপ?

- আমার আবার মনখারাপ৷ ইট পাথর সিমেন্ট বালি আলকাতরা ট্র‍্যাফিক লাইট দোকান বাড়ি প্রমোটার মেট্রোরেল ফ্লাইওভার রাস্তায় তৈরী কেঠো চীজ আমি..আমার আবার মন খারাপ।

- তা'তে কী?শহরদের স্নেহ থাকতে নেই? মনখারাপ থাকতে নেই?

- আমাদের কি আর ফুলফুল প্রিন্টেএ ওয়াড় পরানো নরম বালিশ আছে ভাই? যে'খানে মুখ গুঁজে স্বস্তি পাব? আছে কী? বলো?

- মেঘলা আকাশ চলবে? ভাই কলকাতা?

- আর রুমাল? বালিশে ডাইরেক্ট ফ্যাঁচফোঁচ করাটা আনহাইজেনিক।

- পুরনো ছবি আছে৷ দেব?

- দেবে?

- আর একবার জিজ্ঞেস করেই ফেলি না হয়৷ আজ মনখারাপ নাকি? ভাই কলকাতা?

- একটা টলটলে ভালোবাসা, জানো। টলটলে। আর ছলছলে মনকেমন৷ ছলছলে।

(১৫.১১.২০২০)

Sunday, November 15, 2020

মিত্র

- আপনি টিকটিকি মিট্টার নন?

- আর কতবার বলব? আমি ও নামে কাউনে চিনি না।

- ফেস সেম টু সেম৷ ভয়েস সেম টু সেম৷ ভেরি ফিশি মিস্টার মিট্টার। ভেরি ফিশি।

- কাল সন্ধ্যে থেকে বলে যাচ্ছি আমার নাম অপূর্ব। আমি আপনার ওই মিত্তির নই৷ আর আপনার সঙ্গে এর আগে আমার কখনও দেখা হয়নি।

- বেনারস আপনি ভিজিট করেননি?

- আমি সে'খানে থেকেছি ক'বছর৷ তাও অনেক ছেলেবেলায়।

- ওয়েব অফ লাইজ৷ উ বিজনেস হামার আছে মিস্টার মিট্টার৷ ইউ আর অ্যান অনেস্ট ম্যান৷ খামোখা ঝুট বলে রেপুটেশন নষ্ট করা কেন? হোয়াই? এখন বলবেন কাঠমাণ্ডুতে ভি হামাদের মোলাকাত হয়নি।

- কাঠমাণ্ডু? নেপালে? 

- আরে৷ ইউ আর ফলিং ফ্রম স্কাই।

- দেখুন, বিশ্বাস না হয় আমার বন্ধু পুলুর ঠিকানা দিচ্ছি৷ তার কাছে গিয়ে যাচাই করে আসুন।

- পুলু? আঙ্কিলের নয়া নিকনেম?

- আমায় ছেড়ে দিন। 

- ফর ওয়ান ফাইনাল টাইম৷ ইউ আর নট প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিট্টার?

- ছোটখাটো একটা চাকরী করি। ক্লার্কের৷ সে'টাও খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন৷ ও'সব গোয়েন্দাগিরিটিরি আমার ধাতে সইবে কেন? লেখালিখির একটা বাজে অভ্যাস আছে বটে কিন্তু..। যাক গে৷ মগনলালবাবু, আমায় ছেড়ে দিন।

- ছাড়তে পারি। অন ওয়ান কন্ডিশন। অর্জুনের সামনে দাঁড়াবে আপনার পুলু? সরবৎ পিবে? এন্টারটেন করবে? 

Friday, November 13, 2020

ভূতচতুর্দশীর বাজে গল্প।


- ভূতের গল্প?

- হ্যাঁ মামা। ভূতচতুর্দশীর রাতে একটা জমজমাট গা ছমছমে ভূতের গল্প না হলেই নয়।

- জমজমাট? গা ছমছমে?

- এগজ্যাক্টলি৷ 

- একবার হয়েছে কী, একটা স্কন্ধকাটা গিয়ে পড়েছে টুপির দোকানে..।

- যাহ্৷ এতে গা ছমছম কই?

- স্কন্ধকাটার সিচুয়েশনটা ভাব ভাগনে৷ চারদিকে হাজার হাজার টুপি..অথচ সে ব্যাটা ঠুঁটোজগন্নাথ হয়ে দাঁড়িয়ে৷ ঠিক যেন কেউ কাঁটাচামচ দিয়ে স্যুপ খেতে বসেছে। 

- আহা, এতে ট্র‍্যাজেডি আছে৷ কিন্তু গা ছমছম কই? 

- বেশ৷ বেশ৷ অন্য প্লট।

- ইরশাদ। ইরশাদ।

- একবার হয়েছে কী..একটা মেছোভূত গিয়ে পড়েছে এক ভিগানের বুফেতে৷ আর তারপর ব্রকোলি কালিয়ার গন্ধে গা গুলিয়ে সে মূর্ছা যায় আর কী...।

- মামা, তুমি গল্প বলার ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছ না। 

- কেন রে? সাফিশিয়েন্টলি গা ছমছমাচ্ছে না বুঝি?

- ধুর৷ ভিগান বুফেতে মেছোভূত৷ এ'টা ভূতের গপ্প না জ্যোমাটোর ট্যুইট?

- তুই বড় খুঁতখুঁতে ভাগনে।

- মামা, আর একটু তলিয়ে ভাবো।

- বেশ। শোন মনে দিয়ে৷ অ্যাটেনশন। কেমন?

- টোটাল ফোকাস নিয়ে বসেছি।

- একবার হয়েছে কী..একটা শিব্রাম ভক্ত শাঁকচুন্নির মাথায় পানের ভূত চেপেছিল। হাজার রকম পদের মধ্যে থেকে সে শুধু শাক বেছে নিয়ে গাইত "আঁমি শাঁক চুঁনেছি, আমি শাঁক চুঁনেছি"।

- মামা, আজ বরং গল্পটা থাক।

- ভাগ্নে, গল্পটাকে ফ্লো তো করতে দে৷ থ্রিল আসবে৷ গা ছমছম আসবে৷ 

- হাউহাউ কান্না আসছে মামা। গল্প থাক।

- লাস্ট চান্স৷ লাস্ট।

- ভূতচতুর্দশীর কসম মামা৷ এ'বার কাঁপিয়ে দাও৷ 

- সে অনেকদিন আগের গল্প৷ বহুযুগ আগের, বুঝলি৷ এক ছিল ব্রহ্মদৈত্য আর এক ছিল মামদো৷ তাঁদের একই গাছের পাশাপাশি ডালে বাস।

- পাশাপাশি?  খতরনাক তো!

- তবে আর বলছি কী ভাগনে৷ টোটাল থ্রিল রয়েছে এ'খানে।

- তারপর কী হল মামা?

- সে ব্রহ্মদৈত্য আর মামদোর আবার গলায় গলায় দোস্তি।

- বলো কী৷  ব্রহ্মদৈত্য আর মামদোর দোস্তি? এ যে গল্পের গরু গাছে৷

- গাছ আর এমন কী ভাগ্নে৷ এরপরে পাহাড় বেয়ে উঠবে। আই প্রমিস৷ 

- তারপর মামা?

- ব্রহ্মদৈত্যর ছায়া-শরীরের চিতার গন্ধটা বড় ভালোবাসত মামদো।

- অহো৷ নাজুক মামা। নাজুক। 

- আর জনাব মামদোর আবছা-গায়ে লেপটে থাকা মাটির সুবাসটুকু শুঁকে বড় ফুর্তি পেত বাবু ব্রহ্মদৈত্য।

- কবিতা মামা৷ জাস্ট কবিতা হচ্ছে৷ জয় গোস্বামী কে বারো গোল দেওয়া কবিতা। 

- তারপর..।

- তারপর?

- তারপর একদিন হয়েছে কী..এক বেঁশোভূত এসে হাজির হল তাঁদের গাছে। 

- বেঁশো?

- মর্গ লাগোয়া বাঁশঝাড়ে তেনার বাস। তাই বেঁশো।

- সে ব্যাটা এলো কেন?

- ভোট চাইতে৷ 

- ভোট?

- ভোট৷ ভূতের দেশে ভোট আর বাতেলা নেই ভেবেছিস ভাগ্নে? সব আছে। মরেও মুক্তি নেই রে৷ মুক্তি নেই।

- ভারী মনখারাপ হল মামা৷ মরেও মুক্তি নেই। যাকগে। বেঁশো ভোট চাইতে এলো। তারপর?

- প্রথমে সে বেঁশো ব্যাটা ব্রহ্মদৈত্যকে প্রাইভেটে পাকড়াও করল। বেঁশো বলল, "ওই শালা মামদোর জাতে শয়তানি মিশে আছে, আমাদের নেতা হাতে ক্ষমতা পেলে ওদের চাবকে সিধে করবে৷ তাতে তোমারই ফায়দা৷ কাজেই আমাদের নেতাকে ভোট দাও"। 

- বেশ রিয়েলিস্ট হল এই জায়গাটা৷ এক্কেবারে আর্ট ফিল্ম। তা ব্রহ্মদৈত্য কী বললে?

- ব্রহ্মদৈত্য বেঁশোর কান মলে চ্যাংদোলা করে গাছ থেকে ছুঁড়ে ফেললে। 

- স্টানিং৷ আর্ট ফিল্ম টু রূপকথা৷ 

- এরপর বেঁশো ফের গাছে বেয়ে উঠলে প্রাইভেটে মামদোকে পাকড়াও করতে।  মামদোকে বেঁশো বললে "ওই শালা ব্রহ্মদৈত্যর জাতে শয়তানি মিশে আছে, আমাদের নেতা হাতে ক্ষমতা পেলে ওদের চাবকে সিধে করবে৷ তাতে তোমারই ফায়দা৷ কাজেই আমাদের নেতাকে ভোট দাও"।

- সে কী৷ বেঁশো আদতে কোন মতাদর্শে ভীড়ে আছে বলো তো মামা?

- বেঁশো মতাদর্শ বোঝে ভেবেছিস? সে বোঝে কমিশন। সে সাপের হয়েও সওয়াল করে আবার নেউলের হয়েও৷ 

- ওহ৷ ইউ মীন দ্য হাইয়েস্ট লেভেল অফ পলিটিক্স।

- এগজ্যাক্টলি। 

- তা মামদো কী করলে?

- মামদো? মামদো বেঁশোর কান মলে চ্যাংদোলা করে গাছ থেকে ছুঁড়ে ফেললে। তারপর মামদো আর ব্রহ্মদৈত্য মিলে সে যাকে বলে রোলিং অন গাছের ডাল উইথ লাফটার। চিতার গন্ধ আর মাটির সুবাস মিলে মাখামাখি।

- এই দ্যাখো মামা, গায়ে কাঁটা দিয়েছে। আর বুকে ধুকুরপুকুর।  টোটালি থ্রিলড।

- কী, বলেছিলাম না গল্পের গরু আর্ট ফিল্মের জাবর কাটায় আটকে না থেকে এভারেস্টে উঠবে?

- এক্কেবারে চাঁদে পাঠিয়েছ মামা। টু দ্য সী অফ ট্রাঙ্কুইলিটি।

- বেস্ট উইশেস অন ভূতচতুর্দশী ডিয়ার ভাগ্নে৷ 

- সেম টু ইউ মামা। সেম টু ইউ। 

***

 (বলাই বাহুল্য ছবিট পরশুরাম গল্পসমগ্র থেকে নেওয়া।  "যতীন্দ্রকুমার সেন বিচিত্রিত"।)

বিধুবাবুর কেল্লাফতে


- কে? কে?

- এসেছি ভায়া, এসেছি। 

- কে আপনি?

- পরিচয়টা তো বড় কথা নয়৷ এসেছি৷ এ'টাই বড় কথা৷ তাই না বিধুশেখর? 

- আইশ্লা! মার দিয়া কেল্লা! নামিয়েছি৷ আমি ভূত নামিয়েছি। প্ল্যানচেটের জোর আছে৷ আছে!

- আলবাত আছে। তোমার কনসেন্ট্রেশনের জোরেই তো এলাম।

- বেয়াল্লিশ বছর ধরে চেষ্টা করছি, জানেন৷ বেয়াল্লিশটা বছর৷  শর্টসার্কিট বিধু,  ভূতপাগল বিধু, প্ল্যানচেট পাগলা- এমন কতশত বদনাম বয়ে বেড়াচ্ছি৷ পাড়ার লোক পাত্তা দেয় না, আত্মীয়স্বজন এড়িয়ে চলে৷ তবু, তবু আমি হাল ছাড়িনি৷ 

- সাবাশ ব্রাদার!

- হিয়ার ইজ মাই সাকসেস৷ ভূত! আপনি!

- চা'টা অফার করবে না হে? বিধুশেখর?

- চা? 

- ভূতেরা চা খায়না বটে৷ তবে এই যে তোমার সোফায় এসে বসলাম, এ'টুকু সৌজন্য আমি আশা করতেই পারি৷ তুমি অফার করবে, আমি রিফিউজ করব।

- চা খাবেন স্যার?

- নো, থ্যাঙ্কস।

- ইয়ে, আপনার নামটা? জানতে না পেরে কেমন খচখচ করছে৷ আপনাকে ঠিক দেখতেও পারছি না যে৷ কেমন আবছা আবছা সমস্তটা৷ 

- দেখবেটা কী করে! এখনও পুরোপুরি তৈরি হতে পারিনি তো৷ এখনও ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস।

- ঠিক ইয়ে, ধরতে পারলাম না স্যার..। পুরোপুরি তৈরি হননি মানে?

- মানে, যে ব্যাটা মরে আমি..সে পুরোপুরি মরেনি।

- মা..মানে?

- অর্ধেকটা মরেছে৷ কাজেই আমিও অর্ধেক ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি৷ কিন্তু দুঃখের কথা কী আর বলব ভাই, সে জন্য অন্য ভূতেরা আমায় অত্যন্ত হেয় করে৷ আমায় নিয়ে ঠাট্টা করে৷ তেনাদের লেগপুলিংয়ে এ কী বিষ৷ উফ! এত রাগ হয় ভাই বিধু..।

- আমার না কেমন যেন মনে হচ্ছে..।

- আধমরা মানুষ ভাই তুমি৷ সংসার, সমাজ, ভালোবাসা, স্নেহ সমস্তই ত্যাগ করেছ এই ভূত ধরার তাড়নায়৷ তোমার আবার মন, তায় আবার মনে হওয়া।

- ভালো হচ্ছে না বলে দিচ্ছি..ভালো হচ্ছে না।

- আমি যে হাফভূত হয়ে হেনস্থা হচ্ছি? সে'বেলা? সে'টা বুঝি খুব ভালো হচ্ছে? নাহ্৷ এর বিহিত না করলেই নয়৷ একটু এ'দিকে এসো দেখি বাবা বিধুশেখর।

**

তিরিশ বছর ধরে পুলিশে চাকরী করছেন অবনী দারোগা। অথচ গলায় দড়ি দেওয়ার বদলে কেউ নিজে নিজের গলা টিপে আত্মহত্যা করেছে,  এমন বিদঘুটে কেস এর আগে কখনও দেখেননি৷ অথচ বিধুশেখর মল্লিকের গলায় আঙুলের দাগ মিলিয়ে দেখলে সন্দেহের কোনও অবকাশই থাকে না৷ 

Thursday, November 12, 2020

নিউনর্মালে লোকালে


আমার দুই মামা চাকরীর পাশাপাশি যে'টা করে সে'টা হল ডেলি প্যাসেঞ্জারি৷ ছোটমামা মাঝেমধ্যেই বলে যে তাঁর চাকরীর একভাগ অফিস আর তিনভাগ ডেলিপ্যাসেঞ্জারি৷  সারা বছর লোকাল ট্রেনের ভীড় সামাল দিয়ে কলকাতা পৌঁছে তাদের 'অফিস-করা'৷ লোকাল ট্রেনের চলাচল মফস্বলের মানুষজনের জন্য ধানচাষের মতই জরুরী, কলকাতার চাকরী ধরে রাখতে এই লোকাল ট্রেনের ডেলিপ্যাসেঞ্জারিই অজস্র সংসারের ভরসা। মাসের পর মাস সেই ট্রেন চলাচল বন্ধ আবার ও'দিকে ঠুনকো প্রাইভেট ফার্মের চাকরী। করোনার দুর্বিপাকে পড়ে বেশ কিছু দিন প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটেছে৷ 

বিশ্রী একটা ধুকপুক নিয়ে ফের শুরু হয়েছে লোকাল ট্রেনের যাওয়া-আসা৷ খানিকটা স্বস্তি এসেছে, যাতায়াতের একটা সুরাহা হল, চাকরীটা হয়ত টিকিয়ে রাখা যাবে৷ কিন্তু তার পাশাপাশি রয়েছে প্রবল শঙ্কা- মুণ্ডু গেলে খাবোটা কী? 

নিয়মিত কলকাতা যাতায়াতের সহজতম পথটা যেমন চালু হল, তেমনই এর পাশাপাশি বহুগুণ বেড়ে গেল ট্রেনের ভীড় এবং অসতর্কতায় কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার দুর্বিষহ ভয়৷ 
এই অসহায় পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলাটা নেহাৎ সহজ নয়৷
 
আমি শুধু জানি যে দু'জন সাধাসিধে সরল মানুষ সংসারের জন্য বুক চিতিয়ে লড়ছেন৷ তাঁরা সতর্ক, কিন্তু চোয়াল শক্ত না রেখে উপায় নেই। বেলা বোসকে চাকরীটা পাওয়ার খবর দেওয়ার গানটা আমাদের বড় প্রিয়৷ কিন্তু সে সাধের চাকরীটা ধরে না রাখতে পারলে আটপৌরে সংসারের লাল-নীলটা আর রইবে না৷ অতএব, নিয়মিত যুদ্ধযাত্রা।

আমরা অনেকে বাজারঘাট বা 'শপিং'য়ের জন্য বের হচ্ছি, কেউই তো আর থেমে নেই৷ জুবুথুবু হয়ে মাসের পর মাস বসে থাক সহজও নয়৷ তবে এরই মাঝে আমাদের মাস্কটাও আলগা হয়ে আসছে৷ 'ও হলে হবে'র ভাইরাস করোনাকে টেক্কা দিচ্ছে৷ অথচ ও'দিকে, কত মানুষ বেরোচ্ছেন সংসার যুদ্ধে কোনওক্রমে টিকে থাকতে। 

যুদ্ধ মাত্রই সিয়াচেনের বরফ বা কুরুক্ষেত্রর ব্যূহ  নয় - সেই যুদ্ধগুলোর প্রতি সেলাম ঠুকতে আমাদের মাস্কগুলো থাক। 

Wednesday, November 11, 2020

এখন অবসন্ন যারা


- ও নিতাইদা, টুয়েন্টি নাইন হবে নাকি? ভজা আর রতন রেডি৷ 

- না রে মধু। এই সবে অফিস থেকে ফিরলাম। বড় ক্লান্ত৷ ভাবছি সাততাড়াতাড়ি ডিনারটা সেরে লম্বা হব। 

- আজ মেসে নতুন রাঁধুনি এসেছে৷ তার হাতে ডাল আর ঝোলের নাকি একদর। 

- অমিয়বাবুর কাছে এ'বার একটা প্রটেস্ট না জানালেই নয়। মাস গেলে এতগুলো টাকা দিই আমরা। অথচ আজ ছ'মাস হল একটা ভালো রাঁধুনি জোগাড় করতে পারছেন না উনি? 

- মাথা গরম করে আর কী হবে গো নিতাইদা।

- সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর মেসে ফিরে যদি তৃপ্তি করে ভাত মাছেরঝোলটুকুও না খেতে পারি, মেজাজ ঠিক থাকবে কী করে। ধুরছাই। 

- বড় ক্লান্ত তুমি। তাই না নিতাইদা?

- কাজের যা চাপ রে মধু। আর ভাল্লাগেনা। 

- তোমার মেজাজটা ঠিক..উঁহু৷ শুধু কাজের চাপ তো নয়। মনখারাপ নিতাইদা? বাড়ির জন্য?

- কদ্দিন বাড়ি যাইনা বল দেখি। কদ্দিন। 

- খোকা কত বড় হল?

- এই পৌষে ছয়ে পড়বে।

- ফোনে কথা হয় তো ওর সঙ্গে রোজ৷ তাই না?

- খোকার গায়ের মিষ্টি গন্ধ কী আর ফোনে পাওয়া যায় রে মধু। তাছাড়া কদ্দিন তোর বৌদির পাশে বসে তার সঙ্গে প্রাণ খুলে গপ্প হয়না৷ আমার ভাই সামনের মাসে পার্ট টু পরীক্ষা দেবে, সে ব্যাটা কেমন প্রিপেয়ার করছে, সে'খবরটুকু পর্যন্ত রাখতে পারিনা। 

- নিতাইদা, একটা শ্যামাসঙ্গীত শুনবে?

- সে কী রে। ভজা রতনকে বসিয়ে রেখে এসেছিস তো টুয়েন্টি নাইনের জন্য৷ অনিন্দ্য ফিরেছে কিনা দেখ, ট্যুয়েন্টি নাইনের পার্টনার পেয়ে যাবি।

- গলার সুর না থাকে, বুকে দরদটুকু তো আছে৷ টুয়েন্টি নাইন হবে'খন৷ শ্যামাসঙ্গীতটা ধরি?

- ধরবি? বহুত অচ্ছা।

- জ্যেঠু বলতেন আমার গলার টেক্সচারে কোথাও যেন সামান্য পান্নালাল মিশে আছে।

- নাহ্৷ এই ভালো। তোর গানই ভালো। মেসের ওই বিস্বাদ ভাত খেয়ে তো আর  দিনগত পাপক্ষয়ের ক্লান্তি মিটবে না। শ্যামাসঙ্গীতে যদি একটা হিল্লে হয়।

**

'আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠনা ফুটে মন" ধরলে মধু। মেসের জানালা দিয়ে ভেসে আসা উত্তর কলকাতার গলি কাঁপানো শোরগোল ভিজে নরম হয়ে পড়ল মধুর দরাজ কণ্ঠস্বরে। 

আর বিছানায় ও'পাশ ফিরে শুলেন নিতাই কর্মকার৷ বাড়ির জন্য মনকেমনে একজন দামড়া কেরানী মানুষের চোখ ভিজে যাওয়াটা সামান্য লজ্জার বলে মনে হয় তাঁর। মনভারটা এতক্ষণ দিব্যি চেপেচুপে রেখেছিলেন, কিন্তু ব্যাটাচ্ছেলে মধুর শ্যামাসঙ্গীতে সমস্ত হিসেব গোলমাল হয়ে গেল। বড় একা লাগে নিতাইবাবুর, বড্ড একা লাগে। 

ও'দিকে মধু জানে ভজা আর রতন দাবা খেলতে ব্যস্ত, তারা মোটেও ট্যুয়েন্টি নাইনে সন্ধ্যে নষ্ট করতে উৎসুক নয়। টুয়েন্টি নাইন নিমন্ত্রণের অছিলায় শুধু অবসন্ন নিতাইদার পাশে এসে কিছুক্ষণ থাকা৷ আহা, বাড়িঘরদোর পরিবার ছেড়ে মানুষটা এতদূরে পড়ে আছে৷ আজ সন্ধেবেলা নিতাইদাকে দেখেই মনে হয়েছে আজ যেন সে একটু বেশিই অবসন্ন, আজ যেন নিতাইদার একটু বাড়তি মনখারাপ। এই মনখারাপের গুমোটে নিতাইদা যে একা আটকে নেই,  এ কথাটা তো আর গায়ে পড়ে বলা যায়না৷ কিন্তু গায়ে পড়ে শ্যামাসঙ্গীত দিব্যি গাওয়া যায়৷  

Tuesday, November 10, 2020

ফেরা

- এই যে ভায়া৷ এই যে।

- রবিদা? আপনি?

- আমি ট্রেন ধরতে আসিনি। 

- আমায় ধরতে এসেছেন?

- তুমি তো আর চোর-ডাকাত নও৷ তোমার মাথার ওপর তেমন কোনও ইনামও নেই যে পাকড়াও করে দু'টো বাড়তি টাকা পিপিএফে রাখতে পারব৷ 

- তবু। আপনার কাছে হাজার তিরিশেক টাকা ধার রয়ে গেছে। এখুনি চাইলে কিন্ত দিতেও পারব না। তবে, টাকাটা মেরে দেব না৷ কোনও না কোনও ভাবে ঠিক..। তা সে আমি যে'খানেই থাকি।

- ইয়ং জেনারেশনের এ এক মস্ত বড় অসুবিধে হে৷ গিভ অ্যান্ড টেক ছাড়া কিছুই দেখতে পাওনা। আমি ধান্দাবাজ হতে পারি, তবে চশমখোর নই। 

- ছি ছি রবিদা৷ বাবা মারা  যাওয়ার পর এমন অথৈ জলে পড়েছিলাম৷ চাকরীটাও ছাই এমন সময়..। রবিদা, আপনি সে'সময় পাশে এসে না দাঁড়ালে..৷ 

- তা, এমন ভরদুপুরে..পাততাড়ি গুটিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আমার এজেন্ট খবর দিলে তুমি আন্ডারগ্রাউন্ড হওয়ার তাল করছ৷ 

- মুঙ্গেরে একটা চাকরীর সম্ভাবনা আছে৷ বিশুর মামা সে'খানে কন্ট্রাক্টরি করছেন৷ উনিই ডাকলেন তাই..।

- তা, তোমার তো ছাত্র পড়ানোয় বেশ রেপুটেশন তৈরী হয়েছে আজকাল৷ আর বেঙ্গলে তো আজকাল টিউশনিই হল ইন্ডাস্ট্রি৷   আচমকা সে'সব ছেড়ে মুঙ্গেরে আবার কেন।

- রবিদা৷ আমি সত্যিই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ৷ কিন্তু সিদ্ধান্তটা একান্তই ব্যক্তিগত৷ এ পাড়ায় আমার আর মন টিকবে না।

- তা অবিশ্যি ঠিক৷ ছেলেছোকরাদের আজকাল প্রাইভেসি নিয়ে হাজার রকমের টালবাহানা শুনি৷ গুরুজনদের সদুপদেশও দিব্যি প্রাইভেসির অছিলায় পাশ কাটিয়ে দেওয়া যায়৷ যাক গে৷ সোয়া চারটের এক্সপ্রেসটা ধরছ কি?

- হ্যাঁ।

- রাত পৌনে আটটায় আর একটা মেল ট্রেন আছে৷ ওই ও'দিকেরই।

- কী ব্যাপার বলুন তো?

- একটি বারের জন্য যে তোমার পাড়ায় ফিরতে হবে ভায়া।

- কিন্তু কেন?

- তোমার বাড়ির দলিলটা আমার কাছে রয়ে গেছিল৷ সে'টা ফেরত দিতে চাই৷ কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মে তো সে'টা দেওয়া সম্ভব নয়৷ কিছু সইসাবুদেরও ব্যাপার রয়েছে৷ তোমায় একটি বারের জন্য আমার অফিসে আসতেই হবে।

- সে কী৷ পুরো টাকাটা এখনও শোধ দেওয়া হয়নি৷ বন্ধক রাখা দলিল ফেরত দেবেনই বা কেন? 

- তিরিশ হাজার তো মাত্র বাকি৷ ও নিয়ে তুমি ভেবো না৷  শুধু দলিলটা নিয়ে আমায় মুক্তি দাও।

- রবিদা আমি কিছুই বুঝছি না৷ শুনুন, বাকি তিরিশ হাজারটাকা ফেরত দিয়েই আমি ও দলিল ফেরত নেব৷ কেমন? 

- সে'টি হওয়ার নয় ভায়া৷ ও দলিল তোমায় আজই নিতে হবে৷ বিপদে তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি, তুমি নিজের মুখেই স্বীকার করলে৷ করলে তো?

- নিশ্চয়ই৷ 

- তা'হলে তুমি আমার জন্য এ'টুকু করবে না? ও দলিল আমার থেকে নিয়ে তুমি আমায় মুক্তি দাও ভায়া।

- আমায় দয়া করে ব্যাপারটা খুলে বলবেন?

- আমাদের বাড়ির নারায়ণ কিডন্যাপ হয়েছে ভাই৷ 

- মানে আপনাদের ওই নারায়ণ শিলা? ঠাকুরঘর থেকে নারায়ণ শিলা চুরি হয়েছে?

- র‍্যানসম ডিমান্ড করে চিঠিও এসেছে৷ পুলিশ কিছুতেই নারায়ণ শিলা চুরি যাওয়ার কেস নিতে চাইছে না। এ'দিকে নারায়ণ না ফিরে পেলে নির্মূল হয়ে যাব ভাই৷ 

- র‍্যানসম?

- ওই৷ তোমার দলিল তোমায় ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত নাকি নারায়ণ ফেরত আসবেন না৷ 

- সর্বনাশ। আপনি বিশ্বাস করুন রবিদা আমি কিন্তু এ ব্যাপারে কিছুই..।

- আমি বিশ্বাস করতেই চাই ভায়া৷ কিন্তু নারায়ণের অভাবে ঘর যে আমার অন্ধকার। ও দলিল ফেরত নিয়ে তুমি আমায় মুক্তি দাও..।

- কিন্তু এ'টা তো অন্যায়। এক্সটর্শন।

- তুমি নিজের মানুষ ভাই৷ লুকোছাপার আর কী আছে৷ সুদের ব্যাপারে একটু চোরাগোপ্তা গুঁতো মারাটা আমার বিজনেস৷ তোমার ধারের টাকাটা সত্যিই অনেকদিন হল শোধ হয়ে গিয়েছে৷ সুদটা আমি একটু চড়াই রেখেছিলাম, সে'দিক থেকে দেখতে গেলে তোমার বিপদ থেকে একটু মুনাফা কামিয়ে ফেলেছিলাম৷ সে'টাও তো এক্সটর্শন৷ কে জানে, নারায়ণ রেগে ফায়্যার হয়ে নিজেই গায়েব হয়ে ওই মুক্তিপণের চিঠি পাঠিয়েছেন কিনা৷ তিরিশ হাজার বাকি কী হে, পাওনাগণ্ডা ইতিমধ্যেই কড়ায়গণ্ডায় উশুল হয়ে গিয়েছে৷ এ'বার ওই দলিলটা ফেরত নিয়ে আমায় রক্ষে কর ভায়া৷ না বললে কিছুতেই শুনছি না৷ ওই দ্যাখো, দু'জন পালোয়ান নিয়ে এসেছি৷ তুমি নরম কথায় ফিরতে রাজী না হলে আমি তোমায় চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাব৷ কিন্তু ও দলিল আমি আর রাখব না৷ 

**

- এত রাত্রে ফোন করার কী মানে?

-  হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর ইন্সপিরেশন, দাপুটে প্রফেসর আর সান্যাল বাড়ির বৌ আজকাল হাতসাফাই শুরু করেছে। 

- এ'সব বাজে কথার কী মানে?

- শুধু হাতসাফাই নয়৷ রীতিমতো মুক্তিপণ চেয়ে হুমকি।

- ফোন রাখ দীপু৷ 

- ছিঃ। শেষ পর্যন্ত নিজের ভাশুরের ঠাকুরঘর থেকে চুরি করতে গেলি?

- ফোন রাখ৷ তোর মাথা গেছে৷ আমি সুস্থ আছি।

- আমি দলিলটা ফেরত পাওয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই রবি সান্যালের নারায়ণ শিলা ফেরত এসেছে৷ ভোজবাজি৷ তাই না?

- দীপু, পাড়া ছাড়িস না।

- তুই কী ভেবেছিস, আমি কৃতজ্ঞ থাকব? তুই আমার হয়ে গুণ্ডামি করেছিস বলে? আর কেউ না জানুক, আমিও জানব না ভেবেছিলিস?

- আমি ভেবেছিলাম কাকীমার স্মৃতিটুকুকে অত সহজে তুই ভাসিয়ে দিবি না৷ 

- মা আর নেই৷ 

- মা নেই তাই সব মিথ্যে? বাউণ্ডুলে হয়ে সমস্ত ভাসিয়ে দিবি?

- তোর কী?

- তোর কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব আমি৷ খুব লায়েক হয়েছিস না? সব ভুলে ফ্যা ফ্যা করে দুনিয়া চষে বেড়াবি? বাপ-মায়ের সমস্ত স্মৃতি ভাসিয়ে দিয়ে ড্যাংড্যাং করে নেচে বেড়াবি?

- মানুষগুলোই তো নেই, স্মৃতির নামে ওই পুরনো আধভাঙা বাড়ি আগলে রেখে করবই বা কী?

- আমিও নেই, না রে দীপু?

- নেই৷ তোর থাকতেও নেই।  

- পাড়ায় ফের বাবু৷ তোর বাড়ি, তোর শহর৷ তোর সমস্তকিছু৷ ফের।

- ও বাড়িতে আর ফেরা হবে না রে। ও পাড়াতেও না।

- তুই সত্যিই আর ফিরবি না?

- তুই কান ধরে টানলেও না। যাক গে, আমার একটা কাজ করবি?

- আমি? আমি করব? তোর কাজ?

- মা নেই৷ গার্জেন বলতে স্রেফ তুই। তাই, তোকেই বলি৷ তিরিশ হাজার টাকা কোনওক্রমে জোগাড় করেছি৷ তবে রবিদা ও টাকা আর নেবে বলে মনে হয়না। তুই তো অনেক এনজিওর সঙ্গে কাজ করিস, টাকাটার একটা হিল্লে করে দে দেখি৷ লোকের উপকারে লাগুক৷ বাবার নামে নেওয়া ধার, শোধ না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না৷ 

- যাস না।

- হেহ্৷ এ ঘ্যানঘ্যানের দায় শুধু আমার৷ 

- যাস না বাবু৷ আমি মন্দ নই৷ 

- তুই মন্দ হলে যে সমস্ত মাটি৷ কভি নহি৷ তুই অ্যান্টি-মন্দ। তুই ভালো-য়েস্ট৷ 

- যাস না।

- আসি৷ টাকার ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি জানাস৷ টাকাটার হিল্লে হলে এই যন্ত্রণার মোবাইল ফোনটা ত্যাগ করব। মুঙ্গেরে শ্রমিক তদারকির কাজ, মোবাইল ছাড়াও দিব্যি চলে যায়৷ 

- আচ্ছা৷ আয়। 

- জানিস, তোর সঙ্গে কথা হলেই বড় মায়ের কথা মনে পড়ে৷ মা তোকে বড় ভালোবাসত।

- আমি ভালো মা হব, কেমন বাবু?

- একশো বার হবি৷ দি বেস্ট। 

- যাস না বাবু।

- ইয়ে, টাকার ব্যাপারটা ভাবছি এই মুঙ্গেরেই মিটিয়ে নেব৷ গরীব অসহার মানুষ তো এ'খানেও কম নেই৷ কারুর উপকারে ঠিক লেগে যাবে৷ তুই ও নিয়ে আর ভাবিস না।

- আয় বাবু।

- আসি৷

Saturday, November 7, 2020

দড়ি


- ও দাদা..দাদা গো৷ ও দাদা।

- কী চাই?

- ওই দড়িটা..একটু ধরব?

- সে কী৷ ভূতের মুখে রামনাম যে৷ তা, তোমার এই দড়িতে কাজ কী? তুমি তো বিপক্ষ শিবির৷ উলটে তোমার তো উচিৎ  আমাদের পিঠের চামড়া তুলে নেওয়া। 

- বিপক্ষে? তা বটে। পিঠের চামড়া তুলে নেওয়া? সে'ও হবে'খন৷ তবু৷ তার আগে৷ দাদা গো, একটু ধরে দেখব? দড়িটা?

- মতলবটা কী বলো তো ভায়া? তোমার ভাবগতিক তো সুবিধের ঠেকছে না।

- দড়িটা বড়..বড় ভালো৷ ধরি না একটু। একটু ছুঁয়ে দেখব।

- বেশ৷ ধরো। তবে ধান্দাবাজি ফলালে ভালো হবে না।

- আমার কলজেতে জোর নেই৷ ধান্দাবাজি ছাড়া আমার গতিও নেই৷  তবে দড়িটা একটু ছুঁয়ে না দেখলেই নয়। মনটা বড় হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করছে গো দাদা 

- বেশ৷ এই ধরো৷ হাত লাগাও ভায়া।

- এই৷ এই যে৷ আহ্৷ ছুঁয়ে এক্কেবারে ঝিলিক লাগছে যে হাতে৷ 

- জোরসে ধরো না হে৷ জোরসে৷ লজ্জা কীসের।

- লজ্জার কিছুই নেই৷ তাই না? 

- কিছুমাত্র না৷ এই তো চাই।

- শুধু কলজেটা বুঝলে দাদা..কলজেটা একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে..। 

- কলজেই তো৷ শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেই হবে'খন৷ খামচে ধরো দেখি দড়িখানা৷ 

- ধরি৷ জোর লাগিয়ে৷ কী বলো?

- একদম।

- ইয়ে দাদা..টেনে দেখব?

- দড়িতে টান? সে'টা কলজেতে সইবে? ভায়া?

- টেনেই দেখিনা...ইয়ে৷ দাদা? হবে নাকি? খানখান?

- সাহস করে এগিয়ে এসেছ৷ হবে না কেন?

- যদি না হয়?

- আজ না হোক৷ কাল হবে৷ দড়িটা তো মিথ্যে নয়৷ ছুঁয়ে দেখলে তো। 

- তাই তো৷ খানখান হলে ভালো, না হলেও ভেসে তো যাচ্ছিনে৷ দড়ির টানে আমার হেঁইয়োটুকু অন্তত লেগে থাকবে৷ তাই বা কম কীসের৷ 

- এসো ভায়া৷

- বাঁচালে গো দাদা৷ বাঁচালে৷ 

Thursday, November 5, 2020

ব্যস্ত নাকি?

"ব্যস্ত নাকি"?

অফিস-পরিসরে এই প্রশ্নটা অত্যন্ত বিপদজনক। মামুলি দায়সারা উত্তর দিয়ে এ'সব প্রশ্ন পাশ কাটাতে গিয়ে বহু রথী-মহারথী ধরাশায়ী হয়েছেন৷ মনে রাখবেন, এই প্রশ্ন যাঁরা করেন তাঁরা উত্তর নয়, সুযোগসন্ধানে ব্যস্ত। 

হয়ত সত্যিই আপনি কোনও জরুরী কাজে ব্যস্ত। সাদা মনে কাদা নেই তাই টপাৎ করে বলে দিলেন "হ্যাঁ দাদা, ব্যস্ত আছি বটে। শ্বাস ফেলবার সময় নেই মাইরি"। আবারও বলি, প্রশ্নকর্তাটি আপনার ব্যস্ততা বুঝতে চেয়ে প্রশ্ন আদৌ করেননি৷ তিনি আপনার সহকর্মী,  পাড়ার বন্ধু নয় যে আপনি ব্যস্ত না থাকলে আপনাকে জোর করে নিয়ে গিয়ে স্টেশন রোডের ধারের মহেশদার চাইনিজ স্টল থেকে মোমো খাওয়াবে। আপনি কাজে ব্যস্ত না মনে মনে টুয়েন্টিনাইনের স্ট্র‍্যাটেজি সাজাতে ব্যস্ত, তা জেনে আপনার সহকর্মীর কোনও লাভ নেই৷ প্রশ্নটা নেহাতই প্রি-কাঁঠালভাঙা-মাথায়-হাতবুলোনো। কোনও দরকারেই আপনার কথা তাঁর মনে পড়েছে। কাজেই আপনি ব্যস্ত আছেন, সে'টা শুনলে ওঁর হাড় জ্বলবে৷ আর তিনি যদি 'ওপরওলা' হন, তা'হলে সেই হাড় জ্বলা গন্ধ আপনার নাকেও এসে ঠেকবে। তিনি মুখে হয়ত বলবেন " ওহ, আই সী" কিন্তু মনে মনে ভাববেন "কী এমন আমার ব্যস্তবাগীশ খাসনবিশ এলেন হে। খালি বাতেলা। ইনএফিশিয়েন্ট নিনকমপুপ"। আর তারপর আপনার ব্যস্ততার লেবুজলে কেরোসিন ঢেলে নিজের কাজের হ্যারিকেনটি আপনার হাতে ধরিয়ে নির্দ্বিধায় কেটে পড়বেন। ওই যে, আপনার ব্যস্ততায় কারুর কিছু এসে যায় না।

আর হ্যাঁ। যদি আপনি ভুলক্রমে ভালোমানুষির পালক-বোলানো সুরে বলে ফেলেন " না, না! ব্যস্ত আর কী৷ বলুন না৷ হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ" - জানবেন আপনি আপনি ফাইভস্টার চকোলেট ভেবে মৌমাছির চাকে কামড় দিয়েছেন। প্রশ্নকর্তা সেই সুযোগে কাজ, অকাজ যত আছে সব আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে খানিকক্ষণ দেখনাই বাজে গপ্প ফাঁদবেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, তিনি মনে মনে আপনার সম্বন্ধে ভাববেন "একটা ইউজলেস ইডিয়ট। কাজকম্ম নেই, সবসময় ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে"। জানবেন, ভালোমানুষদের নিয়ে বড়জোর সঞ্জীবের গল্প-উপন্যাস হতে পারে, অফিসের পেল্লায় সব কাজে তারা অচল। 

অতএব?

অফিসের " ব্যস্ত নাকি" মার্কা প্রশ্নের কি আদর্শ উত্তর নেই?

আছে। তবে মাছ ধরবেন উইদাউট টাচিং দ্য ওয়াটার। 

"ব্যস্ত? ওই আর কী"।

"ইকনমিকে রিভাইটালাইজ করতে গেলে তো আমাদের সবাইকেই সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হবে। তাই না"?

"আর বলবেন না..ব্যস্ততাটাই তো এখন নর্ম"।

অর্থাৎ বাজে প্রশ্নের মোকাবিলা বাজে উত্তরের মাধ্যমেই হওয়া উচিৎ।  তবেই অফিসের সম্পর্কগুলো সুন্দর ও মজবুত হয়৷

Friday, October 30, 2020

লক্ষ্মী

- কে? বিমল?

- হ্যাঁ ভজাদা।

- বাইরে দাঁড়িয়ে কেন। ভেতরে আয়।

- না, মানে..ঠিক বলেকয়ে আসার সুযোগ পাইনি তো।  তুমি মক্কেলদের নিয়ে ব্যস্ত আছ কিনা এই ভেবে একটু হেসিটেট করছিলাম আর কী।

- কাতলা আর ওয়াসাবি দিয়েএকটা এক্সপেরিমেন্টাল রেসিপি ফ্রেম করছিলাম।  সে'দিক থেকে বলতে গেলে ব্যস্ত তো বটেই। আয়, বস। এ, কী। ভিজে কাক অবস্থা যে।

- অসময়ের বৃষ্টি। আর এমন ঝমঝমিয়ে নামল। ট্যাক্সি থেকে নেমে গিয়ে গলির ভিতর দৌড়ে আসতে গিয়েই..।

- উকিলের চেম্বারে ব্যাকআপ শার্ট  এক্সপেক্ট করিস না, গামছাও নেই। তুই বরং শার্টটা খুলে টেবিল ফ্যানের সামনের ওই চেয়ারটায় মেলে দিয়ে বস। আর আমি কফি বানাই গিয়ে। ফ্লাস্কের নয়, টাটকা। সে'সরঞ্জাম আজকাল অফিসেই রাখছি। তবে ব্ল্যাককফি।

- না না। অত ব্যস্ত হয়ো না। আমি এখুনি বেরোব। গলির মুখে ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে এসেছি।

- সে কী৷ এমন শশব্যস্ত হয়ে এ'খানে এলি? আমি ভাবলাম ওই ইউসুয়াল তাস আর আড্ডার টানে এসেছিস। তা, কোনও আইনি ফাঁপরে পড়লি নাকি?

- না ভজাদা। 

- তবে?

- ব্যাপারটা খুবই পাতি..।

- বলেই ফেল না বিমল। ভেজা গায়ে অত ভূমিকা ফাঁদার কোনও দরকার নেই।

- আজ সন্ধ্যেবেলা একবার আমার ফ্ল্যাটে ঢুঁ মেরে যেও৷ যদি খুব ব্যাস্ত না থাকো।

- সে কী৷ উইকেন্ড গুলজার? স্কচটচ এনে রেখেছিস নাকি? তা ফোনে বলে দিলেই তো হত..।

- তা হত। তবু, এ'দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম তাই..। তবে ইয়ে, আসরটা ঠিক স্কচ ফিশফ্রাইয়ের নয় কিন্তু।

- ব্যাপারটা কী বল তো?

- আজ লক্ষ্মীপুজো। জানো তো?

- আমি তো জানি। কিন্তু সে'খবরে তোর কী কাজ কে জানে। 

- সকালের দিকে একটা একটা মূর্তি এনেছি জানো। সঙ্গে ধুপ, ধুনো, ফুল আর সামান্য ফল। এই এখন ফিরে গিয়ে খিচুড়ি আর লাবড়া রাঁধব। সময় পেলে লুচি আর পায়েসও।

- প্রবল নাস্তিক শ্রীমান বিমল হালদারের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো? অথচ আমি কতদিন বলেছি চ' একবার আমার বেনারসের গুরুজির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ফ্যাসিনেটিং ক্যারেক্টার আর ব্রিজ চ্যাম্পিয়ন। সে'বেলা যত বইপড়া বাতেলা।  

- ব্যাপারটা ঠিক তা নয়৷ পুরুতঠাকুর কেউ আসছে না৷ সে অর্থে পুজোও হবে না।  তবে আমি পাঁচালি পড়ব। তুমি আসবে ভজাদা? আর কাউকে ডাকতে ঠিক সাহস পাচ্ছিনা।

- তোর শরীর ঠিক আছে? তুই পাঁচালি পড়বি? আমার গুরুজির চেয়েও হাইক্লাস কারুর পাল্লায় পড়লি নাকি?আর তাছাড়া হঠাৎ এই পুজো..।

- খুব মায়ের কথা মনে পড়ছিল ভজাদা। খুব। 

- আই সী।

- এই পুজোর দিনটায় মা উপোস করত। নির্জলা। গোটাদিন কেটে যেত ভোগ রান্না আর পুজোর জোগাড়যন্ত্রে৷ সন্ধ্যেবেলা পুরুতমশাই এলে শুরু হত লক্ষ্মীপুজো। তারপর মায়ের পাঁচালী পড়া। দুলে, দুলে। সে কী অপূর্ব রিদম ভজাদা। ভোগের ভুনো খিচুড়ি, বেগুনভাজা, সুজির হালুয়া, লুচি, পায়েসের পাশাপাশি ধুপ, ধুনো, ফুলফুলের গন্ধ মিশে যে কী মনভালো করা একটা ব্যাপার হত। তবে সমস্ত সুগন্ধ ছাপিয়ে যে'টা মনে লেগে থাকত সে'টা হল মায়ের সুবাস। মায়ের সুবাস অবশ্য রিক্রিয়েট করা সম্ভব নয়৷ কিন্তু বাকি গন্ধগুলোর জন্য হঠাৎ কেমন করে উঠল। ঈশ্বর বিশ্বাস নয়..। 

- তোরও বুঝি নির্জলা উপোস আজ? তাই কফি রিফিউজ করলি? বেশ, আমি বরং একটু আগেই যাব। পায়েসটা আমিই চাপাব'খন৷ আমার তাসের পার্টনার রতন মল্লিক গেলে কোনও অসুবিধে নেইতো? পুরুত সে নয়। তবে বড় ভালো বাউল গায়। আজ রাতে তোকে একা রাখব না ভাবছি। তোর পাঁচালী পাঠের অডিয়েন্সও একজন বাড়বে আর রাতের আড্ডায় তোর মনখারাপ বাড়লে বাউলেরও বন্দোবস্ত থাকবে।

- শেষের কয়েকবছর লক্ষ্মীপুজোয় বাড়ি ফিরতে পারিনি জানো। কাজের চাপে। মা অবিশ্যি কোনওদিনও অভিযোগ করত না।

- অভিযোগ করলে ভালো হত, তাই না রে বিমল?

- হেহ্। হয়তো। এই লক্ষ্মীপুজোর দিনটায় এমন দড়াম করব মায়ের কথা মনে পড়ে গেল..। এমন একটা অদ্ভুত আনচান। যাকগে, এখন আসি। দশকর্মার দোকান থেকে কিছু জিনিসপত্র নিতে হবে। 

- ঈশ্বরবিশ্বাসে তোর কাজ নেই। তবে এই আনচানটুকুও আস্তিকতা। বুঝলে বিমলচন্দ্র? নাহ্, আজ আর মক্কেলের অপেক্ষায় চেম্বারে বসে থেকে লাভ নেই। চ', আমিও বরং তোর সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ি।

সেতু কার

- কে? বিমল?

- হ্যাঁ ভজাদা।

- বাইরে দাঁড়িয়ে কেন। ভেতরে আয়।

- না, মানে..ঠিক বলেকয়ে আসার সুযোগ পাইনি তো।  তুমি মক্কেলদের নিয়ে ব্যস্ত আছ কিনা এই ভেবে একটু হেসিটেট করছিলাম আর কী।

- কাতলা আর ওয়াসাবি দিয়েএকটা এক্সপেরিমেন্টাল রেসিপি ফ্রেম করছিলাম।  সে'দিক থেকে বলতে গেলে ব্যস্ত তো বটেই। আয়, বস। এ, কী। ভিজে কাক অবস্থা যে।

- অসময়ের বৃষ্টি। আর এমন ঝমঝমিয়ে নামল। ট্যাক্সি থেকে নেমে গিয়ে গলির ভিতর দৌড়ে আসতে গিয়েই..।

- উকিলের চেম্বারে ব্যাকআপ শার্ট  এক্সপেক্ট করিস না, গামছাও নেই। তুই বরং শার্টটা খুলে টেবিল ফ্যানের সামনের ওই চেয়ারটায় মেলে দিয়ে বস। আর আমি কফি বানাই গিয়ে। ফ্লাস্কের নয়, টাটকা। সে'সরঞ্জাম আজকাল অফিসেই রাখছি। তবে ব্ল্যাককফি।

- না না। অত ব্যস্ত হয়ো না। আমি এখুনি বেরোব। গলির মুখে ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে এসেছি।

- সে কী৷ এমন শশব্যস্ত হয়ে এ'খানে এলি? আমি ভাবলাম ওই ইউসুয়াল তাস আর আড্ডার টানে এসেছিস। তা, কোনও আইনি ফাঁপরে পড়লি নাকি?

- না ভজাদা। 

- তবে?

- ব্যাপারটা খুবই পাতি..।

- বলেই ফেল না বিমল। ভেজা গায়ে অত ভূমিকা ফাঁদার কোনও দরকার নেই।

- আজ সন্ধ্যেবেলা একবার আমার ফ্ল্যাটে ঢুঁ মেরে যেও৷ যদি খুব ব্যাস্ত না থাকো।

- সে কী৷ উইকেন্ড গুলজার? স্কচটচ এনে রেখেছিস নাকি? তা ফোনে বলে দিলেই তো হত..।

- তা হত। তবু, এ'দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম তাই..। তবে ইয়ে, আসরটা ঠিক স্কচ ফিশফ্রাইয়ের নয় কিন্তু।

- ব্যাপারটা কী বল তো?

- আজ লক্ষ্মীপুজো। জানো তো?

- আমি তো জানি। কিন্তু সে'খবরে তোর কী কাজ কে জানে। 

- সকালের দিকে একটা একটা মূর্তি এনেছি জানো। সঙ্গে ধুপ, ধুনো, ফুল আর সামান্য ফল। এই এখন ফিরে গিয়ে খিচুড়ি আর লাবড়া রাঁধব। সময় পেলে লুচি আর পায়েসও।

- প্রবল নাস্তিক শ্রীমান বিমল হালদারের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো? অথচ আমি কতদিন বলেছি চ' একবার আমার বেনারসের গুরুজির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ফ্যাসিনেটিং ক্যারেক্টার আর ব্রিজ চ্যাম্পিয়ন। সে'বেলা যত বইপড়া বাতেলা।  

- ব্যাপারটা ঠিক তা নয়৷ পুরুতঠাকুর কেউ আসছে না৷ সে অর্থে পুজোও হবে না।  তবে আমি পাঁচালি পড়ব। তুমি আসবে ভজাদা? আর কাউকে ডাকতে ঠিক সাহস পাচ্ছিনা।

- তোর শরীর ঠিক আছে? তুই পাঁচালি পড়বি? আমার গুরুজির চেয়েও হাইক্লাস কারুর পাল্লায় পড়লি নাকি?আর তাছাড়া হঠাৎ এই পুজো..।

- খুব মায়ের কথা মনে পড়ছিল ভজাদা। খুব। 

- আই সী।

- এই পুজোর দিনটায় মা উপোস করত। নির্জলা। গোটাদিন কেটে যেত ভোগ রান্না আর পুজোর জোগাড়যন্ত্রে৷ সন্ধ্যেবেলা পুরুতমশাই এলে শুরু হত লক্ষ্মীপুজো। তারপর মায়ের পাঁচালী পড়া। দুলে, দুলে। সে কী অপূর্ব রিদম ভজাদা। ভোগের ভুনো খিচুড়ি, বেগুনভাজা, সুজির হালুয়া, লুচি, পায়েসের পাশাপাশি ধুপ, ধুনো, ফুলফুলের গন্ধ মিশে যে কী মনভালো করা একটা ব্যাপার হত। তবে সমস্ত সুগন্ধ ছাপিয়ে যে'টা মনে লেগে থাকত সে'টা হল মায়ের সুবাস। মায়ের সুবাস অবশ্য রিক্রিয়েট করা সম্ভব নয়৷ কিন্তু বাকি গন্ধগুলোর জন্য হঠাৎ কেমন করে উঠল। ঈশ্বর বিশ্বাস নয়..। 

- তোরও বুঝি নির্জলা উপোস আজ? তাই কফি রিফিউজ করলি? বেশ, আমি বরং একটু আগেই যাব। পায়েসটা আমিই চাপাব'খন৷ আমার তাসের পার্টনার রতন মল্লিক গেলে কোনও অসুবিধে নেইতো? পুরুত সে নয়। তবে বড় ভালো বাউল গায়। আজ রাতে তোকে একা রাখব না ভাবছি। তোর পাঁচালী পাঠের অডিয়েন্সও একজন বাড়বে আর রাতের আড্ডায় তোর মনখারাপ বাড়লে বাউলেরও বন্দোবস্ত থাকবে।

- শেষের কয়েকবছর লক্ষ্মীপুজোয় বাড়ি ফিরতে পারিনি জানো। কাজের চাপে। মা অবিশ্যি কোনওদিনও অভিযোগ করত না।

- অভিযোগ করলে ভালো হত, তাই না রে বিমল?

- হেহ্। হয়তো। এই লক্ষ্মীপুজোর দিনটায় এমন দড়াম করব মায়ের কথা মনে পড়ে গেল..। এমন একটা অদ্ভুত আনচান। যাকগে, এখন আসি। দশকর্মার দোকান থেকে কিছু জিনিসপত্র নিতে হবে। 

- ঈশ্বরবিশ্বাসে তোর কাজ নেই। তবে এই আনচানটুকুও আস্তিকতা। বুঝলে বিমলচন্দ্র? নাহ্, আজ আর মক্কেলের অপেক্ষায় চেম্বারে বসে থেকে লাভ নেই। চ', আমিও বরং তোর সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ি।

অরুর গান

- একবার গান গাইতে বসলে অরুর আর সময় জ্ঞান থাকেনা।

- তাই নাকি?

- একদম৷ এই দেখ। বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে। সেই তিনটে নাগাদ গলা সাধতে বসেছে। 

- বটে।

- জানিস মন্টু, অরুর সুরে বড় মায়া আছে৷ অনেকটা ব্যথাও মিশে আছে অবিশ্যি। এমনিতে হাসিখুশি ছটফটে হলে কী হবে, ছেলেবয়সে মাকে হারানোর যন্ত্রণাটা কি সহজে ভোলা যায়? মিনুর না থাকার ব্যথাটা ও সর্বক্ষণ বয়ে বেড়ায়। হ্যাঁ রে মন্টু, তুই এলেই মিনু কতরকমের পদ রান্না করতে বসত..মনে আছে?

- বৌদির হাতের রান্না ভোলা অসম্ভব। 

- না হয় সে চলেই গেছে। মানছি, আমার হেঁসেল বিদ্যেয়  ডাল ডিমের অমলেটের বেশি রেঁধে খাওয়ানো সম্ভব নয়৷ তাই বলে দাদা ভাইপোর খবর নিতে মাঝেমধ্যে আসবি না? বছর দুয়েক পর তুই এ বাড়িতে এলি মন্টু।

- ফোন তো নিয়মিত করি রে দাদা।

- তা করিস। নাহ্, খোঁজখবর তুই রাখিস বটে। আমিও অরুকে তাই তো বলি, রক্তের টান ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আর তাছাড়া..। ওহ্। আহা৷ এই যে।

- কী হল রে দাদা?

- অরু এ'বার একটা নজরুলগীতি ধরেছে৷ শুকনো পাতার নুপুর পায়ে৷ আহা। মিনু খুব গাইত। 

- দাদা, অরু গান করছে না।

- তুই শুনতে পারছিস না হয়ত। কিন্তু অরু গান গাইছে মন্টু৷ ওই যা না পাশের ঘরে, দেখ কেমন দরদ দিয়ে গাইছে।

- কিছু মনে করিসনা দাদা। তোর মাথাটা গেছে৷ আর আমার চিন্তা হচ্ছে যে তোর এই পাগলামো অরুকে আরও এফেক্ট করবে।

- কিন্তু অরু গান গাইতে বসে রে মন্টু৷ বিশ্বাস কর..।

- কারণ ওর মাথাটাও ঠিক ব্যালেন্সড নেই। আর সেই গোলমালকে তুই আরও প্রশ্রয় দিচ্ছিস।

- কী বলছিস তুই মন্টু!

- ঠিকই বলছি। অরু কথা বলতে পারেনা৷ বৌদির মারা যাওয়ার শকে হি লস্ট হিস স্পীচ। এই রিয়ালিটি থেকে পালিয়ে বেড়ালে ওর মঙ্গল হবে ভেবেছিস? বৌদির হারমোনিয়াম আঁকড়ে মাঝেমধ্যে সে পাগলামো শুরু করে আর তুই সেই পাগলামোকে তোল্লাই দিচ্ছিস এই সব করে৷ 

- না রে মন্টু। শুনতে পাই তো। বিশ্বাস কর। অনুভব করতে পারি ওর সুরের স্পর্শ। আমার চামড়ায় এসে ঠেকে সে সুর। অরু ওর মায়ের হারমোনিয়াম আঁকড়ে গান করার ভান করেনা, সে গান গায়। গতকাল সন্ধ্যেয় সে অতুলপ্রসাদ ধরেছিল। চোখে জলে এসে গেছিল মন্টু। বিশ্বাস কর।

- দ্যাখ দাদা, অরু এখন বোবা।

- মন্টু। তুই এ'বার আয়।

- দাদা! 

- আয়। আর নয়। 

**

অরুর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন বিমলেন্দু। সাদা নীল চাদরে ঢাকা বিছানার ওপর বসে অরু চোখ বুজে গাইছে, হারমোনিয়ামটা ছুঁয়ে আছে শুধু। 
শব্দ নেই, আছে শুধু সুরের শিহরণ।  

"আহা রে, খোকার মা নেই"। মিনুর ওপর মাঝেমধ্যেই বড় রাগ হয়। বদ্ধ কালাদের দুনিয়ায় অরুকে ফেলে চলে গেল সে। 

ততক্ষণে অরু রবীন্দ্রনাথে এসেছে। 

"আমার সুরের রসিক নেয়ে-
তারে ভোলাব গান গেয়ে..."।

Wednesday, October 28, 2020

সুবিনয়বাবু আর মনু


- আরে। মনু না?

- মনু? 

- তুই মনুই তো? প্রেসিডেন্সি? বারুইপুর বুলেটসের সেন্টার ফরওয়ার্ড? ফুচকা চ্যাম্পিয়ন? 

- জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ছেলেবেলা থেকে ক্রনিক হাঁপানি, তাই ফুটবল জীবনে খেলিনি।  বারুইপুরের ছোটপিসি থাকে বটে তবে ও'দিকে  বড় একটা যাওয়া হয়না। আর ক্লাস সেভেন থেকে গ্যাস্ট্রিক আলসারে জেরবার, একবারে ম্যাক্সিমাম তিনটে ফুচকা খেতে পারি, আলু আর টক জল ছাড়া।

- তা'হলে তো মনুর সঙ্গে মিলছে না। কিন্তু চেহারায় কোথায় যেন একটা স্ট্রাইকিং ইয়ে আছে। 

- স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার হল,আপনকে দেখেও আমার ঠিক তেমনই একটা ইয়ে বোধ হয়েছিল। চেহারায় ঠিক কোথায় যেন..।

- আপনি শিওর আপনি মনু নন?

- সেন্ট পার্সেন্ট৷ মানিব্যাগে আধার কার্ড আছে৷ চাইলে দেখতে পারেন।  আমি সুবিনয় দত্ত৷। কিন্তু ব্যাপারটা খুব ইন্ট্রিগিং, এই আপনার চেহারা দেখেও আমার এমন এই ইয়ে হওয়াটা৷ চেনা চেনা যেন। যাক গে, ভেরি সরি ভায়া৷ আমি মনু নই। খুব আশা করেছিলেন নিশ্চয়ই..পুরনো চেনামুখের সঙ্গে দেখা হল ভেবে। 

- কী আর করা যাবে বলুন।

- তা আপনার নামটা তো জানা হল না।

- আমার নাম? মনু। 

- এক্সকিউজ মি?

- মনু।

- আপনিই মনু? 

- প্রেসিডেন্সি। বারুইপুর বুলেটস। ফুচকা চ্যাম্পিয়ন৷ 

- কিন্তু তবে যে এই..।

***

গড়িয়াহাটের মোড়ে হঠাৎ দেখা৷ আর সামান্য গোলমেলে কথাবার্তার পর ভদ্রলোক যেন স্রেফ উবে গেলেন৷ এই মিস্টরিয়াস মনুকে নিয়ে সুবিনয়বাবুর মনে এক বিশ্রী অস্বস্তি তৈরি হল। সে অস্বস্তি কাটাতে সুবিনয়বাবু গিয়ে দাঁড়ালেন  দাস কেবিনের সামনে। গায়ে পড়ে এমন ফাজিল আলাপ করার কোনও মানে হয়?

দোকানের ভিতর থেকে স্পেশ্যাল মোগলাইয়ে সুবাস নাকে আসতেই সুবিনয়বাবুর ব্রেনে লাগল হাইভোল্টেজ স্পার্ক। তাই তো! মনু তো অচেনা নয়৷ বছর কুড়ি আগে, কলেজে পড়ার সময় নিজের ডায়েরীতে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন। দেড়শো পাতা পর্যন্ত তরতর করে সে'উপন্যাস এগিয়েওছিল। কিন্তু আর পাঁচটা ছেলেমানুষি ঝোঁকের মত সে লেখাটাও অসম্পূর্ণই রয়ে গেছিল। সেই অসম্পূর্ণ উপন্যাসের নায়ক মানবেন্দ্র ওরফে মনু চেহারায় ও স্বভাবে সুবিনয়েরই মত। কিন্তু সুবিনয়ের দুর্বলতাগুলো মনুর মধ্যে আদৌ নেই৷ মনু যেমন স্মার্ট, তেমনি সাহসী, তেমনি রোম্যান্টিক আর তেমনি চাবুক তার স্বাস্থ্য। 

 নিশ্চয়ই কোনও ব্যাটা সে ডায়েরী হাতিয়ে সে লেখা পড়েছে। আর তারপর আজ এসে গায়ে পড়ে সুবিনয়বাবুর ওপর এমন একটা বিচ্ছিরি প্র‍্যাক্টিকাল জোক চাপিয়ে সরে পড়ল। একটা তেতো স্বাদ সুবিনয়বাবুর গোটা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। দাস কেবিনের মোগলাই সুবাসও তার মনের চনমন ফেরাতে পারল না। কিন্তু ট্রাঙ্কে রাখা পুরনো ডায়েরী খুলে পড়ল কে? সর্ষের মধ্যে এমন ঘোড়েল ভূত এলো কী করে? প্রথমেই সন্দেহটা গিয়ে পড়ল নিজের ফিচেল শ্যালকটির প্রতি৷ 

যা হোক, মিনিবাসের বদলে ট্যাক্সি ধরে সোজা বাড়ি ছুটলেন সুবিনয়বাবু। 

**

ট্রাঙ্কের তালা ভাঙতে হল। সেই সাতপুরনো বহুবছরের জং পড়া তালার চাবি অনেক আগেই হারিয়েছে। কাজেই ডায়েরীটা বেহাত হওয়ার কথা নয়। ডায়েরী খুলতেই সুবিনয়ের চক্ষু চড়কগাছ।  উপন্যাসের জন্য লেখা দেড়শো পাতা লেখা গায়েব৷ পাতা গায়েব নয়, শুধু লেখা গায়েব। অথচ প্রথম পাতায় নিজের নাম দেখে বুঝতে অসুবিধে হয়না এ ডায়েরী সে ডায়েরীই।

তার বদলে পড়ে রয়েছে বিটকেল দু'লাইন। নিজের জঘন্য হাতের লেখা নিয়ে সুবিনয়বাবুর লজ্জার সীমা নেই৷ কিন্তু এই দু'লাইন লেখা রয়েছে মুক্তোর মত হাতের লেখায়৷ 

"সরকারী চাকরী, সংসার, হাঁপানি আর গ্যাস্ট্রিকে সুবিনয় বন্দী থাকতে পারে। কিন্তু ট্রাঙ্কের তালায় বা ডায়েরীর পাতায় এ শর্মাকে আটকে রাখা যাবে না।

- ইতি মনু"।

Thursday, October 22, 2020

দ্য গ্র‍্যান্ড তুকতাক

- কী চাই?

- হুঁ?

- কী চাই? চাকরীতে টপাটপ প্রমোশন বাগানোর মাদুলি? শুগার কন্ট্রোলে রাখার তাবিজ? হাড়বজ্জাত মানুষজনের বদনজর এড়িয়ে চলার জন্য কবচ?

- কই, না তো।

- তা'হলে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসা কেন?

- দ্যাখ বুড়ো..।

- আমার সঙ্গে যারাই দেখা করতে আসে তারা আমায় চমৎকারিবাবা বলে ডাকে। আপনি-আজ্ঞে করে নুয়ে পড়ে। 

- তাঁরা তো আর তোর বাপ নয় বুড়ো।

- উফ। আদত তন্ত্রসাধকের বাপ-ঠাকুরদা থাকতে নেই।

- প্রায় এক বছর হতে চলল বাড়ি ছেড়ে এইসব ফোরটুয়েন্টিগিরি শুরু করেছিস।  আর কতদিন!

- ফোরট্যুয়েন্টিগিরি?  আমি রেগে গেলে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটে যাবে কিন্তু। 

- মানছি আমি একসময় তোর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছি৷ পারিবারিক ব্যবসায় ফাঁকি দিচ্ছিস দেখে মেজাজ খিঁচড়ে গেছিল, না হয় ভালোমন্দ চারটে কথা বলেই দিয়েছি। কিন্তু তাই বলে তুই তারাপীঠে এসে পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙার ব্যবসা শুরু করলি রে বুড়ো? 

- আর একটাও আজেবাজে কথা শুনলে এমন বাণ মারব..।

- বাড়ি ফিরে চল বুড়ো। আমি না হয় মায়াদয়াহীন স্ক্র‍্যাপের দালাল। মায়ের কথা ভেবে অন্তত বাড়ি ফের।

- তন্ত্রসাধকের আবার বাড়ি। তন্ত্রসাধকের আবার মা।

- তুই না হয় বাড়িতে গিয়েই একটা এই হোকাসপোকাসের চেম্বার খুলে বসিস বুড়ো। আমি নিজের সমস্ত ব্যবস্থা করে দেব। নীচের তলার একটা ঘরে সর্ষের তেলের গোডাউন করব ভাবছিলাম। সে'খানে বসেই না হয় তুই  মাদুলি বেচিস।

- সাধনাটাকে ধান্দাবাজি বলে হ্যাটা করাটা রীতিমত অন্যায়৷  শ্মশানের মড়াপোড়া হাওয়া গায়ে না ঠেকলে তন্ত্রসাধনা চলে না। আর তাছাড়া গেরস্থালির গুমোট পরিবেশে আর আমায় বাঁধা সম্ভব নয়৷ 

- সম্ভব নয়?

- কভি নহি।

- কোনও ভাবেই আর তোকে বাড়ি ফেরানো যাবে না?

- শ্মশানকালী প্রাইভেটলি স্বপ্নে এসে রিকুয়েস্ট করলেও নড়ছি না। 

- হ্যাঁ রে বুড়ো, কাল থেকে পুজো। পুজোয় বাড়ি ফিরবি না?

- হুঁ?

- পুজোয় বাড়ি ফিরবি না?

- পুজো? বাড়ি। পুজো। বাড়ি।

- কী হল বুড়ো?

- না মানে...যদিও তন্ত্রসাধনায় পুজো পুজো আদেখলামো থাকতে নেই..।

- কাল থেকে পুজো। বাড়ি ফিরবি না তুই?

- বাবা।  পুজো সত্যিই এসে গেল। তাই না?

- তাই তো। এসেই গেলো।

- আমি বাড়ি যাব বাবা। বাড়ি যাব।

- আলবাত যাবি। পুজোয় বাড়ি না গেলে চলে?

বুড়োকে বাড়ি ফেরানোর তুকতাকটি চমৎকারিবাবার বাপ দিব্যি জানতেন। বাড়ি ফেরার নিশির ডাক - "পুজো"।

Tuesday, October 13, 2020

মামা ও বিরিয়ানি রহস্য


- কী হল মামা! বিরিয়ানিতে কবজি না ডুবিয়ে অমন গুম মেরে বসে রইলে যে?

- ক্যালামিটি!

- সে কী।

- ক্যাটাক্লিজম।

- আরে হয়েছেটা কী?

- রাহাজানি। 

- উফ! বিরিয়ানির খুশবুতে গড়বড়? 

- না। পার্ফেক্ট সৌরভ নাকে বুকে কভারড্রাইভ চালাচ্ছে৷ সমস্যা অন্য জায়গায়৷ 

- কোথায়?

- আমি নিজে দু'প্লেট বিরিয়ানি প্যাক করিয়ে এনেছি ভাগ্নে। নিজের হাতে করে বয়ে এনেছি সেই দু'প্যাকেট।

- তবে?

- তোর প্লেটে পরিমাণ ঠিক আছে৷ কিন্তু আমার প্লেটে..।

- কম? 

- কম।

- কিন্তু আমার চোখে তো..।

- শুধু চোখ দিয়ে বিরিয়ানির তল পাবি নাকি রে রাস্কেল?

- স্পষ্ট দেখছি তো, সেম কোয়ান্টিটি। 

- কাঁচকলা। আমার প্লেটে কম।

- কতটা কম?

- এককণা চাল কম। 

- তুমি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছ মামা?

- ডেড সিরিয়াস। বিরিয়ানি নিয়ে ফচকেমো আমি বরদাস্ত করতে পারিনা।  

- তোমার সামনেই তো প্যাকেট থেকে প্লেটে ঢাললাম। এই দেখো বাক্স। এক কণাও চাল এখানে পড়ে আছে কি? নেই। শেষ কণাটুকু  প্যাকেট থেকে থালায় ট্রান্সফার করেছি। আর টেবিলেও ভালো করে দেখো। এক কণাও কোথাও পড়ে নেই। উফ, আমি এই আজগুবি অভিযোগের উত্তরই বা কেন দিচ্ছি কে জানে।

- একসময় পৃথিবীর রোটেশন আর রিভোলউশন ব্যাপারটাও মানুষ আজগুবি বলে মনে করত। যাকগে। নাহ্, বিরিয়ানি ঢালতে গিয়ে তুই কোনও রকম অযত্ন করিসনি। কিন্তু তবু, একদানা অমৃত চাল যে কোথায় গায়েব হল রে ভাগ্নে...।

- যত্তসব পাগলামো। এক কণা চাল নাকি পাতে কম পড়েছে। তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে মাম,  মামী ঠিকই বলে। তুমি বিরিয়ানির প্লেট থেকে হারিয়ে যাওয়া এককণা হারানো চাল নিয়ে শোকসভা বসাওগে যাও৷ আমি বরং  খাওয়া শুরু করছি।

- হাই-ক্লাস বিরিয়ানির থালা থেকে হাপিস হওয়া এক কণা চালের দাম বোঝার বয়স তোর হয়নি ভাগ্নে। হয়নি। 


*****

- এই যে কেষ্টা! পাঞ্চালী কতক্ষণ ধরে টেলিপ্যাথেটিকালি তোমায় ডেকে ডেকে হন্য হচ্ছে৷ আর এতক্ষণে তোমার আসার সময় হল?

- যুধিদা। তোমার সবেতেই টেনশন। কেসটা কী?

- আরে ফরেস্ট ক্যাম্পের লাঞ্চমেনুতে আজ খিচুরি মামলেট ছিল। খেয়েদেয়ে আয়েস করে সবে লম্বা হওয়ার তাল করছি- এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত। দুর্বাসা স্যার হাজির। এক্কেবারে সদলবলে।

- এই সেরেছে। খিটখিট বুড়ো আবার এই ভরদুপুরে জঙ্গলে কেন? দু'দিন আগেই তো তাঁকে দুর্যোধনের বাড়িতে ফুর্তি করতে দেখলাম। 

- ওই রাস্কেল দুর্যোরই কারসাজি এ'টা। খেপচুরিয়াস দুর্বাসাকে অসময়ে এ'খানে লাঞ্চে করতে পাঠিয়েছে যাতে আমরা খাওয়াতে না পেরে অপদস্থ হই। আর তারপর একটা অভিশাপ-টভিশাপ দিলেই চিত্তির। 

- তা দুর্বাসা আর তাঁর দলবল এখন কই?

- নদীতে নাইতে গেছে। তবে ফিরে এলো বলে। এ'দিকে হেঁসেল খালি। পাঞ্চালী গোঁ ধরে বসে আছে - কিছুতেই সে এই অসময়ে গেস্টদেরর জন্য নতুন করে রান্না চাপাতে পারবে না। 

- কেসটা সিরিয়াস। তবে চাপ নিওনা যুধিদা। ম্যায় হুঁ না। খিচুড়ির হাঁড়িটা আমার কাছে  নিয়ে এসো দেখি।

- তা'তে কী হবে? সে হাঁড়ি খালি পড়ে আছে।

- ও একদানা চাল পড়ে থাকলেও হবে।

- ভীম ওই হাঁড়ি থেকে ডাইরেক্টলি খায় কেষ্টা। এককণাও পড়ে থাকার চান্স নেই। হাঁড়িখানা পড়ে আছে তাই বাপের ভাগ্যি।

- আরে আনো না হাঁড়িটা। আমি না হয় মন্ত্রবলে এক কণা চাল সে'খানে নিয়ে আসব'খন। যে সে চালের কণা নয়- এক্কেবারে সুপার ইস্পেশ্যাল ভাতের কণা। সেই এক দানা চাল আমি নিজের মুখে চালান করলেই জগৎসংসারের খিদে গায়েব হবে। দুর্বাসা আর তাঁর চ্যালাচামুণ্ডারাও ঢেঁকুর তুলতে তুলতে কেটে পড়বে, পাতপেড়ে খাওয়ার সাহস আর তাঁদের থাকবে না।

- বাহ্। তুকতাক ভালোই শিখেছ কিন্তু কেষ্টা। তা, এই ইস্পেশাল ভাতের কণাটা আসবে কোথা থেকে?

- বিরিয়ানি নামের একটি পদ থেকে তুলে আনতে হবে যুধিদা। স্ট্রেট ফ্রম দ্য ভবিষ্যৎ। যাও, এ'বার ফাঁকা হাড়িটা নিয়ে এসো দেখি।

Monday, October 5, 2020

অমলকান্তির অফিসে


সকাল সকাল বসের তলব। 

অমলকান্তি তড়িঘড়ি ছুট দিলেন বসের ঘরের দিকে। পৌঁছে দরজায় একটা মোলায়েম টোকা। তারপর গুলকন্দ মেশানো গলায় শুধোলেন
"স্যার, আসব"?

উত্তর এলো টিনের ওপর ইটপাটকেল পড়া বাজখাঁই সুরে।

"আপনাকে নিশ্চয়ই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নজরুলগীতি গাওয়ার জন্য ডাকিনি। ভিতরে এসে উদ্ধার করুন"।

অমলকান্তি বুঝলেন হাওয়া সুবিধের নয়। নিজের গোবেচারা না-ঘরকা-না-ঘাটকা হাসিখানা মুখে সেঁটে ঘরের মধ্যে পা রাখলেন।

"আচ্ছা অমলকান্তিবাবু, আপনি কি আমায় বোকা ভাবেন? ডু ইউ থিঙ্ক আই অ্যাম আ ড্যাম ফুল"?

ভেবড়ে গেলেন অমলকান্তি। এই ধরণের প্রশ্নের সামনে অধোমুখ নেকুসম্রাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোনও উপায় থাকেনা৷ কিন্তু সকাল সকাল এই রাফায়েল-বোফর্স মেশানো আক্রমণের কারণটা ধরতে পারলেন না৷ 
শর্মা অ্যান্ড শর্মার ফাইলটা জমা হয়ে গেছে৷ 
গতকাল সন্ধ্যেয় ঘণ্টা দুই বাড়তি বসে গতমাসের স্টেটমেন্টখানাও রিকনসাইল করা হয়ে গেছে। 

তবে? 

সেই 'তবে'র তল আর পেলেন অমলকান্তি। কী একটা অতি-খুচরো প্রসঙ্গ তুলে উত্তমমধ্যম শুরু করলেন বস। মিউমিউ করে দু'চারটে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন বটে কিন্তু সেই মিউমিউ বসের মেজাজের আগুনে কেরোসিন হয়ে  ঝরে পড়ল। ঝাড়া মিনিট দশেক কথায় কথায় খড়মপেটা করে তবে অমলকান্তিকে মুক্তি দিলেন বস। 

ইস্তিরি করা পরিপাটি শার্ট প্যান্টের আড়ালে ভাঙচুর হয়ে যাওয়া মনটাকে লুকিয়ে কোনওক্রমে নিজের চেয়ারে এসে গা এলিয়ে দিলেন অমলকান্তি। কড়া করে এক কাপ ব্ল্যাক কফি না পেলেই নয়। সোজা হাঁক পাড়লেন;

- অ্যাই শিবু!

- এই যে অমলদা।

- কথা কি কানে যায় না? অফিসে আসিস কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোতে? মাইনেটা কি কোম্পানি মাগনা দেয়?

- সে কী অমলদা। সাড়া দিলাম তো।

- চোদ্দবার ডাকার পর।

- কই...আমি তো প্রথম ডাক শুনেই..।

- আমি কি মিথ্যে বলছি? অ্যাঁ? ইয়ার্কি হচ্ছে?

- ছি ছি। আপনি মিথ্যে বলবেন কেন।

- তুই কি আমায় বোকা ভাবিস? ডু ইউ থিঙ্ক আই অ্যাম আ ড্যাম ফুল?

- না না..সে কী!

- দ্যাখ শিবু, বাজে কথায় নষ্ট করার মত সময় আমার নেই। সামান্য এক কাপ কফির জন্য যদি এত কথা বলতে হয়, তা'হলে কাজ হয়েছে আর কী।

- আমি এখুনি কড়া করে এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে আসছি অমলদা।

- কে চেয়েছে কড়া করে কফি? কে চায় ব্ল্যাক?

- ইয়ে..আপনি তো ওই কড়া ব্ল্যাক কফিই পছন্দ করেন..।

-  যত আজেবাজে কথা! ব্ল্যাককফি নাকি আমার পছন্দ। ইডিয়ট। বেশি দুধ বাড়তি চিনি দিয়ে এক কাপ নিয়ে আয় এখুনি। চট করে। ক্যুইক। আমার অত সময় নেই। বড়সাহেব একটা জরুরী কাজ দিয়েছেন।

শিবু কফি আনতে যেতেই খানিকটা শান্ত বোধ করলেন অমলকান্তি। 

ও'দিকে ওভেনে কফির সসপ্যানটা চাপাতেই শিবুর পকেটের ফোনটা বেজে উঠল। 
বাবা।

- হ্যালো।

- শিবু, শোন একটা জরুরী কথা ছিল..।

- কতবার বলেছি, অফিসে আমায় ফোন করবে না! হাজার রকমের দায়িত্ব আমার কাঁধে। অমলদা একটা জরুরী কাজ দিয়েছে। এখন ফোনে খেজুর করার সময় আমার নেই।

বলে ফোনটা খটাস্ করে কেটে দিলো শিবু।

চাউমিনার


রাস্তা ঘেঁষা চাউমিনের স্টলগুলোর সবচেয়ে বড় 'প্লাস পয়েন্ট' হলো চাউমিন রান্নাটা আগাগোড়া দেখা যায় এবং উপভোগ করা যায়। বড় রেস্তোরাঁর (বা জোম্যাটোর মাধ্যমে আনানো) চাউমিন প্রথমেই দেখা যায় প্লেটে। চাউমিনের গায়ে কী'ভাবে রং ধরল, সে'টুকু 'অবজার্ভ' করতে না পারলে তৃপ্তি হয়না৷ 

সামান্য পেঁয়াজকুচি আর অনেকটা কুচনো বাঁধাকপি (কিছু ক্ষেত্রে সামান্য রুখাশুখা গাজর কুচিও থাকে) ফায়্যার হবে চাটুর গরম তেলে। মনে রাখা দরকার- 'রাস্তার' চাউমিনে বিনস, বেলপেপার গোছের বাড়তি শখ-শৌখিনতা অদরকারি,সে'খানে চাই মারকাটারি অ্যাকশন । 

চাউমিনের চাটুর ওপর খনখনাখন্ খুন্তি নাড়ার শব্দ, আহা; এর তুলনা শুধু অমলেট বানানোর আগে স্টিলের গেলাসে চামচ দিয়ে ডিম ফেটানোর খটখটর মিঠে শব্দের তুলনা চলতে পারে৷ যা হোক৷ কথা হচ্ছিল চাউমিন নিয়ে। ভাজা পেঁয়াজ আর বাঁধাকপির মধ্যে পড়বে চাউমিন, বাড়বে চাউমিন-ভাজিয়ের ব্যস্ততা৷ পড়বে নুন, মশলা আর (যতই খুঁতখুঁত করুন না কেন) আজিনামোটোর গুঁড়ো। বাতাসে ভেসে বেড়াবে সুবাস। আর সে সুবাসে চড়চড়ে বিদ্যুৎ যোগ হবে ভিনিগার ছড়িয়ে দেওয়া মাত্র। জিভের মধ্যে সুড়ুৎ খেলে যাবে জল। এরপর যেই চাউমিন-ভাজিয়ে সোয়্যাসসের বোতলে হাত দেবেন, আমি হাঁ হাঁ করে উঠব "অল্প, একদম অল্প, কয়েক ফোঁটা মাত্র। কেমন"?

চাউমিন তখন প্রায় তৈরি। চাটুর একপাশে সে চাউমিন সরিয়ে রেখে চাটুর খালি জায়গায় ফের খানিকটা তেল ছড়িয়ে তার ওপর ফেলে দেওয়া হবে ফেটানো জোড়া-ডিম। খুন্তি দিয়ে নির্দয়ভাবে কচুকাটা করা হবে সে ডিমভাজা। বাবলর‍্যাপ ফাটানোর মতই এই চাটুর ওপর ভাজা ডিম ক্ষতবিক্ষত করাটাও অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক কাজ। যা হোক, তারপর সেই চাউমিন আর ভাজাডিম মিলে মিশে একাকার।

চাটু থেকে সে চাউমিন নামানোর আগে চাউমিন-ভাজিয়ের প্রতি নম্র আব্দার ভাসিয়ে দেওয়াটাও রুটিন; "চাউমিনের ওপর দিয়ে লঙ্কাকুচি আর সামান্য কাঁচা পেঁয়াজ ছড়িয়ে দেবেন প্লীজ৷ আর হ্যাঁ, স্যস-ট্যস দেবেন না, কেমন"?

 বুকের মধ্যে তখন কয়েক হাজার জয় গোস্বামী একসঙ্গে মন্ত্রপাঠ করে চলেছেন  
"পাগলী, তোমার সঙ্গে এগচাউমিন কাটাব জীবন"।

টপ ১০ মহালয়া এলিমেন্টস ফ্রম দ্য নাইনটিজ



১। ঢাউস একখানা অ্যালার্ম ঘড়ি। যে ঘড়ির দিকে তাকালেই ঘুমটুম উড়ে যায়। যে ঘড়ি মাথার কাছে রেখে চোখ বুজলেই বুকে ঢিপঢিপ; এই বুঝি বোমা ফাটল। যে ঘড়ির অ্যালার্ম শ্যামবাজারে বাজলে গোলপার্কের ঝিমোনো মানুষজন চমকে ওঠে। 

২। ব্যাকআপ অ্যালার্ম; "দিদা, বাই চান্স অ্যালার্মটা ফেলে করলে একটু ডেকে দিও"। কম্যুনিস্ট দাদারাও এ'দিনটায় মার্ক্স ত্যাগ করে কালচারের তাড়নায় দিদিমাদের দিকে ঘেঁষতেন।

৩। রেডিও। বোনাসঃ আগের দিন সন্ধ্যেয় কাটলেট সহযোগে ফ্রিকুয়েন্সি টেস্টিং।
 
৪। ব্যাকআপ ট্রানজিস্টার। ব্যারাকপুরের মেসো বারবার বলতেন, পলিটিশিয়ান আর যন্ত্রপাতিদের চোখ বুজে ভরসা করতে নেই।

৫। চানাচুর। ভোরবেলা ঝাল চানাচুর হল চাউমিনে পোস্তর সমান। দরকার হল টকমিষ্টি চানাচুর। বাটি অপ্রোয়জন,  বয়াম থেকে ডাইরেক্ট মুঠো করে তুলে নেওয়াটাই ট্র‍্যাডিশন।  তারপর দুলে দুলে বীরেন্দেবাবুর সুরে তাল দিয়ে চেবানো। 

৬। চা। কাপে হবে না। সাপ্লাইলাইন দাঁত খিঁচোবে৷ ফ্লাস্কে ভরে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসাটাই যুক্তিযুক্ত। 

৭। প্রথম দু'মিনিট শোনার পর। গলায় উত্তেজনা! "ভদ্রবাবুর ভয়েসে যে কী ম্যাজিক! দ্যাখ দ্যাখ। এই দ্যাখ। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে"।

৮। দশ মিনিট শোনার পর। মোলায়েম আবেগ এসে চেপে ধরবে, "মা আসছেন"।

৯। পনেরো মিনিট শোনার পর। "এ কী রে মেজদা। ঘুমোলি নাকি? আদত ইয়েটা তো সবে ইন্টেন্সিফাই হচ্ছে"।

১০। কুড়ি মিনিট পর - "চোখটা না..লেগে আসছে৷ তাছাড়া এইচএমভির ক্যাসেটজোড়া তো আছেই। বেলার দিকে লুচি বেগুনভাজা খেতেখেতেই না হয়.."।

পুরানি দিল্লী


২০০৭। দিল্লী।

একটা প্রেম দাঁড় করানোর কিঞ্চিৎ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রোজকার ক্লাস শেষ হতেই ছুট; সোজা গিয়ে ছ'শো একুশ নম্বর বাস ধরে কনট প্লেস। দেখাসাক্ষাতের ব্যাপারটা বেশিরভাগ দিন ও'খানেই সারা হত। তারপর ইনার সার্কেল আর আউটার সার্কেল জুড়ে মাইলের পর মাইল হাঁটা। 

একটানা অকারণ হাঁটা, অর্ধেক দুপুর আর পুরোটা বিকেল জুড়ে। অকারণ; কারণ ওই বয়সের প্রেম-প্রেম হাহুতাশকে লজিকের ফ্রেমে ধরতে যাওয়াটা বাড়াবাড়ি। 

কনট প্লেসের বেশিরভাগ দোকানপাট আর রেস্তোরাঁই কলেজপড়ুয়াদের পকেটের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর৷ সে বয়সে কেএফসির মত রেস্তোরাঁতে ঢুঁ মারার কনফিডেন্সও ছিলনা৷ ওয়েঙ্গার্সের স্যান্ডউইচ বা কেভেন্টার্সের শেকও বড্ড দামী মনে হত। আমাদের ভরসা ছিল মূলত ফুটপাতের খাবার বিক্রেতারা৷  শিঙাড়া, বাদামভাজা, আলুচাট, চিপস, 'স্লাশ', বরফগোলা; এই'সব।  বুকে 'অষ্টমীতে প্রথম দেখা' মার্কা হুহু থাকলে আলুচাটের থেকেও চিকেনরোলের সুবাস পাওয়া যায়। দিব্যি উতরে যেত সেই দুপুর আর বিকেলগুলো।

শুধু কোনও কোনও দিন হাঁটাহাঁটির মধ্যে পেত প্রবল খিদে। প্রবল। সুতীব্র। সে বয়সে খিদেপেটে মনে হত; পারলে মরিচ ছড়িয়ে, মাখন মাখিয়ে চেয়ার টেবিল বা এনসাইক্লোপিডিয়াও চিবিয়ে খেতে পারি বোধ হয়। সেই হাইক্লাস খিদে যে আলুচাট বা বাদামভাজায় বধ হবে না, সে'টাই স্বাভাবিক।  

আমরা গোটা এলাকা চষে ফেলে এমন একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করতে পেরেছিলাম যে'খানে দশ-পনেরো দিনে একবার লাঞ্চ করলে পথে বসতে হবেনা। আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট। সে'খানকার বোলচাল বেশি নয় আর রান্নাবান্না বেশ মশলাদার। আমাদের অবশ্য বেশি এক্সপেরিমেন্ট করবার ক্ষমতা ছিল না। একটা প্রবল ভাবে অ-চৈনিক চিলি চিকেন বানাতো তারা৷ তার সঙ্গে রুমালি রুটি দিব্যি জমে যেত। যে'দিন তেমন মেগা-খিদের খপ্পরে পড়তাম, সে'দিন আমরা গিয়ে বসতাম ন্যাশনাল রেস্টুরেন্টে। এক প্লেট চিলি চিকেনের দাম ওই একশোটাকা মত ছিল, দশ পিস পাওয়া যেত। ছ'পিস আমার প্লেটে, চার পিস তার। রুমালি রুটিও বেশ সস্তাই ছিল।  ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট না থাকলে আমাদের মাঝেমধ্যে অমন আয়েস করে বসে গল্প করা হত না, হেঁটেই হদ্দ হতে হত। 

এক প্লেট চিলি চিকেন আর খান ছয়েক রুটি অর্ডার দিয়ে রহিসি মেজাজে গল্প শুরু হত। দশ মিনিটের মাথায় খাবার সার্ভ হয়ে যেত টেবিলে; সঙ্গে বোনাস - পুদীনার চাটনি আর কুচোনো পেঁয়াজ। ছ'টা রুটির চারটে আমার থালায়। 

খাবার আসা মাত্রই পেটের খিদে চারগুণ, চোখের সামনের জলজ্যান্ত প্রেমিকাটি আবছা হয়ে আসত। জীবনে পড়ে রইত শুধু ওই ছ'পিস চিলি চিকেন আর ছ'টা রুমালি রুটি। স্রেফ চিলি চিকেনের ঝোল ছুঁইয়ে চারটে রুমালি উড়ে যেত, তখনও চিকেনের টুকরোগুলো অক্ষত।  আরও দু'টো রুমালি চেয়ে নেওয়া হত। সাত নম্বর রুমালি শেষ হলে চোখের সামনে প্রেমিকার অবয়ব ফের স্পষ্ট হয়ে উঠত। সে তখনও দু'নম্বর রুমালি রুটি নিয়ে টুকুরটুকুর চালিয়ে যাচ্ছে। আট নম্বর রুমালিতে গিয়ে সামান্য ঝুঁকে ভাসিয়ে দিতাম সেই 'একবার বলো উত্তমকুমার' লেভেলের আর্তি;
"তোমার থেকে হাফ-পিস চিলিচিকেন পাওয়া যাবে"?

ও'দিক থেকে হাফ-পিসের বদলে একটা গোটা পিসই উঠে আসত আমার পাতে। সে কী সহাস্য আস্কারা।  

মুখে বলতাম " আহা, এতটা আবার কেন"? অথচ মনের মধ্যে তখন চিত্রহার, রঙ্গোলী আর সুপারহিট মুকাবলা  একসঙ্গে ফায়্যার হচ্ছে।

**

বহুদিন পর গতকাল আবার গেছিলাম কনট প্লেসের ও'দিকে৷ এক জোড়া রুমালিতে ঘায়েল হওয়া সেই মানুষটাই ডেকে দেখাল; ন্যাশনাল রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডের রংটা এখনও পাল্টায়নি।

আই লাভ ইউ


- তুমি আমায় আই লাভ ইউ টাভ ইউ বিশেষ বলো না কিন্তু।

- ন্যাকাপনা। 

- শেষ যখন বলেছিলে তখন কেন্দ্রে কংগ্রেস,  রাজ্যে সিপিএম। 

- গা জ্বলে যায়।

- ডাইভার্ট করে দিও না সুমি। ডাইভার্ট করে দিও না। 

- হঠাৎ এ'সবের শখ হলো কেন?

- শখ? রাইট বলো। অধিকার অফ আ স্পাউস।

- গাম্বাটদের অধিকার থাকতে নেই।

- আমি গাম্বাট?

- আলবাত।

- আই লাভ ইউ দাবী করেছি বলে আমি গাম্বাট? 

- আই লাভ ইউতে আই লাভ ইউ খুঁজে হদ্দ হচ্ছ বলে।

- এই এক ঝামেলা। যে কোনও তর্কে দিব্যি কেমন ঘুরপাক খাইয়ে গুলিয়ে পেঁচিয়ে দাও।

- সাধে কি বলি? গাম্বাট। উইথ আ ক্যাপিটাল জি।

- আই লাভ ইউতে আই লাভ ইউ খুঁজে হদ্দ হওয়ার কেসটা কী সুমি?

- আই লাভ ইউ বলতে গেলে "আই লাভ ইউ"ই বলতে হবে, এ'সব গোদা আইডিয়াগুলো এ'বার ত্যাগ করো। মনে রেখো, গদা দিয়ে ইয়ারবাডের কাজ চালানো যায়না।

- তুমি আমায় বলো কখনও? আই লাভ ইউ? 

- বলি। তবে হাইক্লাস ট্রান্সলেশনে।

- কী'রকম?

- এই যেমন গতকাল দুপুরে যে বললাম। "তোমার বানানো বিরিয়ানি আরসালানকে টক্কর দেবে"। 

- ও'টা আই লাভ ইউ?

- টপমোস্ট ক্যাটগরির। রীতিমত ব্লাইন্ড।

- আই সী। তা'ছাড়া?

- গত হপ্তায় আদতে বললাম আই লাভ ইউ। কিন্তু শব্দগুলো যখন তোমার কানে পৌঁছল, তুমি শুনলে "আজ কলেজ স্ট্রিট গেছিলাম তোমার জন্য খানকয়েক পুরনো পুজোসংখ্যা জোগাড় করতে"।

- তা বটে। ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া সমস্ত পুজোসংখ্যা,  প্রাইসলেস।

- তারপর ওই যে সে'দিন। তুমি বললে মনখারাপ৷ আমি বললাম "এসো, নবরত্ন তেল দিয়ে মাথা মালিশ করে দিই"। এর চেয়ে হাইকোয়ালিটির আই লাভ ইউ হয়?

- তাই তো। আই উইথড্র মাই অ্যালিগেশন৷ আর ইয়ে, আই কিন্তু লাভ ইউ। মাইরি।

- চলো, দু'জনে মিলে মুড়ি মাখি বরং।

দ্য পুজো পুজো রোব্বারস


দিব্যি কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে খটরখটর কী-বোর্ড চালিয়ে যাচ্ছিল অনিন্দ্য৷ দিব্যি।

সাতটা এক্সেল শিট আর আর তিনটে ওয়ার্ড ফাইল চোখের সামনে খোলা। কনসেন্ট্রেশন তুঙ্গে, কাপের কফি আধঘণ্টা আগেই ফুরিয়েছে অথচ মাঝেমধ্যে সেই খালি কাপেই চুমুক দিচ্ছিল সে। 

এমন সময় হল কী...কম্পিউটারটা আপনা থেকেই রিস্টার্ট হল৷ সমস্ত খোলা ফাইলকে না পাত্তা না দিয়ে সে ব্যাটার স্ক্রিন দুম করে বন্ধ হয়ে আবার জ্বলে উঠলো৷ অনিন্দ্যর মেজাজটাও গেল বিগড়ে। আচমকা সে টের পেল কফির কাপটা ফাঁকা। তারপর খেয়াল হল আশেপাশের কিউবিকেলগুলোও ফাঁকা। কেউ কোত্থাও নেই। অনিন্দ্যর মনে পড়ল আজ রোব্বার। অন্য কারুর অফিসে আসার কথা নয়৷ কিন্তু তাকে প্রায়ই ছুটির দিনে আসতে হয়৷ প্রায়ই তাকে রোব্বারি-তলব পাঠান বড়সাহেব৷ বড়সাহেবের রোব্বারি ডাক সবাই এগিয়ে গেলেও অনিন্দ্য পাশ কাটাতে পারেনা। সে জন্য অবিশ্যি বড়সাহেব তাকে বিশেষ পছন্দ করেন। 

যা হোক। কম্পিউটার রিস্টার্ট হওয়ার সময় কনসেন্ট্রেশনটা গেল গুলিয়ে। আর সে'টাই হল কাল। মুহূর্তের অসাবধানতায় অনিন্দ্যর চোখ গিয়ে পড়ল জানালার ও'পাশে, আকাশের দিকে। এক্সেল, ওয়ার্ড ডক, আউটলুক ইনবক্স সব কেমন ঝাপসা হয়ে পড়ল। কেমন একটা অস্বস্তিকর ঝকঝকে নীল৷ বারো ঘণ্টা অফিস, বাড়ি ফিরে একার সংসারে সামান্য রান্নাবান্না আর রাতের দিকে টিভির পাশাপাশি ল্যাপটপে অফিসের দু'একটা খুচরো কাজ দেখতে দেখতে গা এলিয়ে দেওয়া৷ 

এ'সব কিছুর মধ্যিখানে আকাশের দিকে চোখ যাওয়ার কথা নয়, দৈবক্রমে আজ গেল। রিস্টার্ট হওয়া কম্পিউটারের স্ক্রিনে কিছুতেই আর চোখ আটকে রাখা যাচ্ছেনা৷ অথচ ওই হতচ্ছাড়া আকাশের দিকে তাকানোরও সাহস হচ্ছে না৷ মিনিট সতেরো ছটফট করার পর বড়সাহেবকে একটা ফোনই করে বসল অনিন্দ্য।

- হ্যালো। বলো অনিন্দ্য। 

- হ্যালো স্যার।

- গুপ্তার ফাইলটা কম্পলিট হল? খুব আর্জেন্ট কিন্তু। রাত হলেও ক্ষতি নেই কিন্তু ফাইলটা কম্পলিট করা চাই। অবশ্য, তোমার কাছে তো এ'সব জলভাত।

- হ্যাঁ। স্যার, ওই ফাইলটার ব্যাপারেই একটা কথা বলার ছিল।

- বলো না।

- ফাইলটা আর আজ প্রসেস হবে না।

- সে কী। এনিথিং রং?

- নীল।

- হোয়াট?

- আকাশের রঙটা৷ কেমন একটু অস্বস্তিকর নীল৷ আপনি দেখেছেন?

- আর ইউ ওকে অনিন্দ্য?

- ফাইলটা আজ আর হবে না৷ 

- বাট ইট ইস ভেরি আর্জেন্ট।

- কাঁচকলা। 

- হোয়াট কাইন্ড অফ ল্যাঙ্গুয়েজ ইস দিস?

- গুপ্তাদের ফাইলটা তিনদিন পরে করলেও ক্ষতি নেই। আমি শিডউল চেক করেছি।

- বাট উই মাস্ট স্টে আহেড অফ দ্য শিডিউল।

- ইউ মাস্ট। আমার মাস্ট তো স্রেফ আপনার মাস্টে তালে মিলিয়ে চলা। 

- ব্যাপারটা কী বলো তো? 

- ফাইলটা আজ আর হবে না। আগামীকাল আর পরশু আমি ছুটি নিচ্ছি৷ ক্যাসুয়াল লীভগুলো খামোখা প্রতি বছর নষ্ট হয়। বুধবারের মধ্যে বরং আপনি ফাইলটা পেলেও পেতে পারেন।

- ক্যাসুয়াল লীভগুলো নষ্ট হয় বলেই ইউ আর আ ফাস্ট রাইজার। সে'টা ভুলে যেওনা।

- কেরিয়ারে ফাস্ট রাইজ করব বলে ক্যাসুয়াল লীভ নিই না, আপনা এই ধারণা ভুল৷ ছুটি চাইতে বুক কাঁপে, ঘাড়ে চাপানো আজেবাজে কাজ কেন করব সে লজিকাল প্রশ্ন করতে ভয় পাই। এক্সেলেন্সে মন নেই, কম্পলায়ান্স কম্পল্যায়ান্স করেই ফতুর হচ্ছি৷ প্রমোশনের লোভ আমার নেই স্যার। কিন্তু চাকরীতে এ'দিক ও'দিক কিছু হলে লিলুয়ার মেজপিসি চিমটি কেটে কী বলবে তা ভেবে কেঁপে উঠি। রিয়েলি। "ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার" যে আউড়ে চলি তা কিন্তু স্রেফ ভয়ে। অ্যাম্বিশনে নয়। 

- বটে? এ'সব ফিলোসফিকাল বাতেলা আমায় শোনাতে এসো না। মনে রেখো, সামনেই রিভিউ..।

- আর সামনেই পুজো। জানেন, কিছুক্ষণ আগেই খেয়াল পড়ল। বছর কুড়ি আগে কেনা কয়েকটা পুজোসংখ্যা আমার  পুরনো বইয়ের ট্রাঙ্কে এখনও রাখা আছে। পড়া হয়নি৷ তখন পরীক্ষার নম্বর কমলে মধ্যবিত্ত বাপ-মায়ের মধ্যবিত্ত স্বপ্নভঙ্গ হবে, সে ভয় ছিল। এখন বাপ-মা আর নেই বটে। তবে ভয় বয়ে বেড়ানোর অভ্যাসটা রয়ে গেছে স্যার। কিছু একটা না করলেই নেই।

- য়বাজে বকার সময় আমার নেই। কম্পলিটেড ফাইলটা আমার রাতের মধ্যে চাই।

- আজ রাতের মধ্যে কুড়ি বছর পুরনো শারদীয়া শুকতারার রিভিউ পেতে পারেন। আগামীকাল রাতের মধ্যে সাতপুরনো পুজোবার্ষিকী আনন্দমেলার রিভিউ।  পরশু রাত্রের মধ্যে পাবেন পুরনো কিশোরভারতী পুজোসংখ্যার রিভিউ। তারপরের দিন বোধ হয় এই ফাইলটা পেলেও পেতে পারেন।

- ইউ ইডিয়ট!

- আই এগ্রী স্যার। এমন পুজো পুজো রোব্বারের দুপুরে কোথায় কড়াইতে মটন কষাবো! তা নয়। আমি অফিসে বসে ভিলুকআপ চালিয়ে হদ্দ হচ্ছি। আলবাত আমি ইডিয়ট৷ যাকগে, এখন আসি বরং।

সেল্ফ হেল্প

যে সেলফ হেল্প বইগুলো আমি পড়তে চাই -  

১। দ্য সেভেন হ্যাবিটস অফ হাইলি এফেক্টিভ ল্যাদিস্টস।

২। হাউ টু উইন এক্ট্রা ফাউস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স ফুচকাদাদাস।

৩। দ্য পাওয়ার অফ "ভাল্লাগছেনা"।

৪। দ্য সাটল আর্ট অফ "সোফা ছেড়ে উঠব না"। 

৫। দ্য ম্যাজিক অফ থিঙ্কিং বিরিয়ানি।

নেশা ও সলিউশন


- এই যে অনির্বাণ। ও'দিকে কোথায় ছুটে যাচ্ছ। এ'দিকে এসো। 

- বড়সাহেবের চেম্বারে দিকে যাচ্ছিলাম। জরুরী তলব।

- ব্রাদার। হিউম্যান রিসোর্সে থেকে অমন তাড়াহুড়ো করতে নেই। 

- বস তাড়া দিলেও নয়?

- তা'হলে তো একেবারেই নয়। সিনিয়রদের লাই দিয়ে মাথায় না তোলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

- সান্যালদা, কী যে বলেন আপনি মাঝেমধ্যে। 

- বাইশ বছর এই কোম্পানিতে আছি হে। আজ পর্যন্ত একটা প্রমোশনও মিস করিনি। কাজেই আমি যখন যাই বলি, জানবে সে'গুলো আদতে বাণী। 

- একটু বুঝিয়ে বললে সুবিধে হয় সান্যালদা।

- বড়সাহেব কেন ডেকেছেন। সে'টা জানা আছে?

- কোম্পানির অবস্থা তো সবই জানেন। গতমাস থেকে ফ্যাক্টরির সমস্ত লেবারদের সবার মাইনেকড়ি আটকে আছে। সামনের হপ্তায় কিছু টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ফিনান্স থেকে আজ জানালে আগামী মাসখানেক তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। এ'দিকে আজ বিকেলে খেপচুরিয়াস ইউনিয়নের নেতারা আসছেন বড়সাহেবের সঙ্গে মিটিং করতে। তাঁদের কী ভাবে শান্ত করা যায়..সে'সব নিয়ে আলোচনা করতেই আমায় ডেকেছিলেন বড়সাহেব।

- আই সী। তা, কী ভাবে তাঁদের শান্ত করবে? মিটিংয়ে শিঙাড়া জিলিপি আর সল্টেড কাজুবাদাম খাইয়ে? 

- সান্যালদা। সিচুয়েশনটা বেশ যাকে বলে..অগ্নিগর্ভ। 

- তা, কী সলিউশন অফার করবে বড়সাহেবকে? উনি নিশ্চয়ই তোমায় কফি বিস্কুট খাওবেন বলে ডাকেননি।

-  সলিউশন তো একটাই৷  বকেয়া মাইনে মেটানো৷ 

- কোম্পানির ফিনানশিয়াল স্টেটমেন্টগুলো দেখেছ?

- জানি, পরিস্থিতি আদৌ ভালো নয়। মনে হয় না আগামী তিনমাসের মধ্যে লেবারদের কোনওরকম কিছু দেওয়া যাবে।

- বটে। তিনিমাস মাইনে না হলে, তোমার বড়সাহেবকে টিকতে দেবে কারখানার শ্রমিকরা? আর বড়সাহেব না থাকলে আমাদের টিকিজোড়াই বা আমরা কোথায় বাঁধব?

- লেবারদের কি কোনও ভাবেই ঠাণ্ডা রাখা যায়না?

- এতগুলো মানুষের পেটের খিদেকে কী'ভাবে ঠাণ্ডা করবে বাবু হিউম্যানরিসোর্স? সেল্ফি কন্টেস্ট ঘোষণা করে না স্লোগান রাইটিং কম্পিটিশন অর্গানাইজ করে?

- জাস্ট ছিঁড়ে খাবে কিন্তু আমাদের। আফটার অল, আমাদের মিসম্যানেজমেন্টের জন্যই তো ওদের আজ এই অবস্থা। ফ্যাক্টরির প্রডাকশনে তো কোনও অসুবিধে হয়নি।দে হ্যাভ বিন কোয়াইট এফিশিয়েন্ট।

- সলিউশন ছাড়াই বড়সাহেবের ঘরে ঢুকবে অনির্বাণ? 

- কিন্তু এই সিচুয়েশনে আর তো কোনও উপায়ও নেই সান্যালদা। শ্রমিকদের খাওয়া জুটছে না৷ তারা আমাদের কথা শুনবে কেন?

- শ্রমিকরা তোমার কথা শুনবে না। কিন্তু ইউনিয়ন শুনবে।

- ইউনিয়নই বা আমাদের হয়ে কথা বলবে কেন?

- যুক্তির ভরসায় থাকলে চলবে না। উহাদেরকে ওপিয়াম জোগান দিতে হইবে।

- ওপিয়াম? ঘুষটুষ দিতে বলছেন নাকি?

- ঘুষ খুব পাতি ব্যাপার অনির্বাণ।  ও'দিয়ে এক'দুজন ধান্দাবাজকে কেনা যায়। জনতার আগুন মেজাজকে বশে আনা যায়না।

- তা'হলে ওপিয়ামটা কি?

- বসন্ত ভৌমিক। ওই যে, এই ইউনিয়নের উঠতি নেতা। গত  মাসে ফ্যাক্টরিতে নাইটশিফট করে ফেরার পথে কিছু লুম্পেনদের খপ্পরে পড়ে৷ মারধোর খায়। মোটোরবাইক, রিস্টওয়াচ আর মানিব্যাগ খোয়ায়। 

- তার সঙ্গে আমাদের সমস্যার কী সম্পর্ক?

- পেশেন্স অনির্বাণ।  পেশেন্স। 

- বেশ। বলুন। 

-মাসখানেক পরেও পুলিশ সেই লুম্পেনদের  পাকড়াও করতে পারেনি। লোকাল থানার ওসি সুবিমলবাবু ভারী মাইডিয়ার। আমার সঙ্গে পুরনো যোগাযোগ।  বড়সাহেবের তরফ থেকে সামান্য নজরানা প্রায়ই যায় তার কাছে। তিনি আমাদের সাহায্য করবেন। আমি তার সঙ্গে একপ্রকার সমস্ত কথাবার্তা বলে রেখেছি।

- কী কথা সান্যালদা?

- পুলিশ আজ দুপুরে রাইভাল ইউনিয়নের অমল সমাদ্দারকে অ্যারেস্ট করবে।

- অমল সমাদ্দারকে অ্যারেস্ট করবে? কেন? সে বসন্ত ভৌমিকের রাইভাল নেতা হতে পারে৷ সমাদ্দার লোকটা যে বিশেষ সুবিধের তাও নয়। কিন্তু তাই বলে সে বসন্তবাবুকে মারধোর করার বান্দা নয়৷ আর চোর তো নয়ই।

- আমি নিশ্চিত অমল সমাদ্দার এ কাজ করেনি৷ তবে তা বিচার করার দায় তোমার আমার নয়৷ পুলিশ দুপুরে তাকে তুলে নিয়ে যাবে। দুই ইউনিয়নের মধ্যে খামচাখামচি শুরু হবে। একে অপরকে সন্দেহ করবে। গসিপ করবে। গুজব ছড়াবে। লোকাল নেতারা সে হল্লায় সামিল হবে। আজ বিকেলে যখন আমাদের ইউনিয়নের নেতারা আসবে, তখন মাইনের চেয়েও বেশি আলোচনা হবে অমল সমাদ্দারের শয়তানি নিয়ে। বড়সাহেব বলবেন যে তিনি আমাদের শ্রমিকদের ইউনিয়নের নেতা বসন্ত ভৌমিকের এমন হেনস্থা কিছুতেই বরদাস্ত করবেন না। উই উইল অফার এভ্রি কাইন্ড অফ হেল্প টু আওয়ার ফ্রেন্ডস ফ্রম দি ইউনিয়ন। আমরা উকিল দেব, পুলিশ লাগাব।

- মাইনে নিয়ে আলোচনাটা তা'হলে এ যাত্রা বোধ হয় থামানো যাবে। তাই না সান্যালদা?

- আমাদের তিনমাস দরকার অনির্বাণ। তিনমাস পর খালিপেট থেকে আধপেট হলেই তারা বর্তে যাবে। তারপর কে আসল লুম্পেন সে'টা জানা যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে ভেবে আমাদের কাজ নেই।

- আপনি জিনিয়াস সান্যালদা।

- যুক্তির চেয়ে নেশায় কাজ দেয় বেশি। এই বেদবাক্যটা চিরকাল মনে রেখ হে। এ'বার পা চালোও, বড়সাহেব অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন।

প্রজাপতি

কলকাতা সরগরম।
ফুটপাত জমজমাট।
সন্ধ্যের হইহট্টগোল, ট্রামের ঘরঘর, 
বাসের হর্ন আর অটোর হুড়মুড়। 
ভীড়। ঠেলাঠিল। 
"আরে দাদা, একটু দেখে পা ফেলবেন তো" গোছের খোঁটা।

ব্যস্ততার স্রোত বয়ে যায়, সন্ধ্যের এই সময়টা শ্বাস ফেলার ফুরসৎটুকু পায় না কলকাতা। আহা, মানুষের দল বাড়ি ফিরছে। শহরের গায়ে যে কী অবিশ্বাস্য গতি লেগে থাকে এই সময়।

সেও ছুটছিল। 
অবিশ্বাস্য গতিতে। 
তবে কলকাতার উল্টো দিকে। 

কলকাতা ডাইনে ছুটলে, সে এগোচ্ছে বাঁয়ে। 
কলকাতা ছড়া কাটলে, সে ধরছে খোলতাই টপ্পা।
কলকাতা ধুরন্ধর চালে কিস্তিমাত করতে চাইলে, সে চালছে দু'ছক্কা পাঁচ।
কলকাতার কভার ড্রাইভের জবাবে তার বাইসাইকেল কিক।
কলকাতা উত্তম হাসি হাসলে, সে ভাসিয়ে দিচ্ছে তুলসী চক্কোত্তি মার্কা 'বাপ রে বাপ রে বাপ'।

মোদ্দা কথা হল কলকাতার বয়ে চলা অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ উল্টো খাতে বইছিল সে। গোটা শহরটাকে এক অন্য ডাইমেনশনে ফেলে রেখে অন্য জগতে এসে পড়েছিল সে।

সে ছুটছিল। 
একহাতে কাগজের ঠোঙায় ডিমপাউরুটি৷ পাউরুটি, ডিম আর সর্ষের তেলে ভেজা কাগজের গন্ধ মিলেমিশে তার নাকেবুকে নহবত বসিয়েছিল যেন। অন্য হাতে একজোড়া প্রজাপতি বিস্কুট। 

ডিমরুটির নরম আর প্রজাপতি বিস্কুটের মিঠে মুচমুচ ব্যালেন্স করে সিকি মাইল ছুটে গিয়েছিল সে। শার্টে ঘাম, বুকে ধুকুরপুকুর, আর আলো আলো মুখ। সে ছুটে যাওয়াটা কলকাতার দৃষ্টিগোচর হয়নি। 

তার ছুটে আসা যে দেখেছিল একজোড়া ঝাপসা চোখ। 

- এই যে।

- এ'গুলো কী?

- দু'দিনের জন্য শহরে ঘুরতে আসো। পিটারক্যাটফিটারক্যাট মার্কা লারেলাপ্পাতে কাটিয়ে ওয়াপিস চলে যাও । তাই এই ডিমপাউরুটি। আর চায়ের দোকানের বয়াম থেকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া বিস্কুট। দ্যাট ট্যু প্রজাপতি। কলকাতা মেড-ইজি ফর ইউ।

- তুমি ছুটে আনতে গেলে?

- ডিমপাউরুটির উষ্ণতাটা রিটেন করার জন্য। তাছাড়া, তোমার সময় কম। ছুটলে দু'মিনিট বাঁচে। 

ঝাপসা-চোখজোড়ার শাড়ির আঁচল টেনে ধুকুরপুকুর-বুক নিজের কপালের ঘাম মুছতে চেয়েছিল।
সাহসে কুলোয়নি।

সে সাহসের অভাবটুকুও কলকাতার দৃষ্টিগোচর হয়নি।

Wednesday, September 2, 2020

ধপাস

সাঁইসাঁই।
সাঁইসাঁই।
সাঁইসাঁই।

পড়ছি তো পড়ছিই।
পড়ছি তো পড়ছিই।
পড়ছি তো পড়ছিই।
পড়ছি তো পড়ছিই।

বহুক্ষণ পর আমার পড়া একটা প্রবল 'ধপাৎ' শব্দে; এসে নামলাম নরম স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলাধরা মাটির ওপর। 

এ'খানে দিনের আলো এসে পৌঁছয় বলে মনে হয়না। চারদিকে গুমোট অন্ধকার, চরম অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ। 

খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পর চারপাশটা জরীপ করার চেষ্টা করলাম। কোমরের চিনচিনে ব্যথা একটা আছে বটে, তবে সে'সব পাত্তা দিলে চলবে কেন?

ও মা। 

এই গর্তে আমি একা নই। আর এক ম্যাদামারা ভদ্রলোক থেবড়ে বসে। তিনিও যে সদ্য ধপ্ করে ল্যান্ড করেছেন তা বলে দিতে হবেনা। একটি সঙ্গী পেয়ে বুকে সামান্য বল পেলাম। 

এগিয়ে গেলাম আলাপ করতে।

- এই যে। শুনছেন? হ্যাঁ৷ আপনাকেই বলছি।

- কে? কে কথা বলে?

- এই যে। আমি। আমিও এইমাত্র এই গর্তে এসে পড়লাম।

- অ। আপনিও। 

- হ্যাঁ। নমস্কার।

- পেন্নাম।

- দেখা যখন হয়েইছে তখন আলাপটাও সেরে নেওয়া যাক। আমার নাম কনফিডেন্স। আর আপনি?

- আমি? আমি জিডিপি। 

Monday, August 24, 2020

জন্মদিন আর চাকরীর গল্প


- বায়োডেটাখানা তো মন্দ নয়।

- থ্যাঙ্ক ইউ।

- ফীডব্যাক নাম্বার ওয়ান। আপনার পশ্চারটা ঠিক নয়৷ ইয়ং ম্যান, ইউ আর স্লাউচিং। এ'রকম সিরিয়াস ইন্টারভিউয়ের সে'টা মোটেও বরদাস্ত করা যায়না। 

- ওই। সামান্য গা ম্যাজম্যাজ, তাই আর কী। যাকগে। বলুন।

- এই চাকরীর জন্য আমরা একজন চটপটে ক্যান্ডিডেট খুঁজছি। সামান্য ম্যাজম্যাজে গা এলিয়ে দেওয়া শখের প্রাণ গড়ের মাঠ মার্কা মানুষ দিয়ে আমাদের চলবে না।

- আপনার চোখ তো থার্মোমিটার নয়। ম্যাজম্যাজটাকে সামান্য বলে কোয়ালিফাই করাটা কি ঠিক হচ্ছে?

- এঁড়ে তর্কের টেন্ডেন্সি। ফীডব্যাক নাম্বার ট্যু।

- ও'টাকে আমি স্ট্রেন্থ বলেই জানি। বরাবর।

- আপনি কোনওদিন বোর্ডরুমে প্রেজেন্টেশন দিয়েছেন?.

- আপনি কোনওদিন কফি হাউসে আড্ডা দিয়েছেন?

- এ'টা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়।

- কর্পোরেটে আপনারা আদত উত্তর এড়িয়ে চলার জন্য পাওয়ারপয়েন্টে প্রেজেন্টেশন ব্যাবহার করেন।  ওই একই প্রয়োজনে আমি কবিতা লিখি। দু'একটা লেখায় সুরও দিয়েছি। শুনবেন নাকি? 

- তার চেয়ে বরং আপনার প্যাশনের ব্যাপারে শুনি৷ কী করতে ভালো লাগে আপনার?

- আপনি কি সত্যিই আমার ভালোলাগাগুলো জানতে চাইছেন? না আমার অধ্যবসায় নিয়ে কিছু বললে খুশি হবেন?

- যে কোনও বিষয়ে ভালোবাসা থাকলে অধ্যবসায় তৈরি হবেই।

- আপনার এ ধারণা ভুল। আমাদের ফুটবল কালচারের দিকেই দেখুন না৷ ভালোবাসা? ডেফিনিটলি আছে। অধ্যবসায়?  ডিবেটেবল।

- ভালোবাসাগুলোকে অধ্যবসায় দিয়ে গড়েপিটে নিতে না পারলে সে ভালোবাসার আদৌ কী দাম বলতে পারেন।

- দিব্যি আড়াই বছর প্রেম করলাম। কিন্তু স্টার্টিংয়ে সামান্য এগারোশো দেওয়া চাকরিটাও ম্যানেজ করতে পারলাম না। ওই, ভালোবাসার জন্য পার্কে যাওয়ার হুজুগটুকু ছিল অথচ চাকরীর জন্য পড়াশোনার করাটা যে সংসার স্থাপনের জন্য জরুরী অধ্যবসায়, সে'টাই গুলিয়ে ফেললাম। সে প্রেমিকা এখন আমাকে সাইডে রেখে বিয়েথা সেরে কসবায় সেটলড। 

- ট্র‍্যাজিক।

- যে'কোনও ব্যাপার ট্র‍্যাজেডির ফিল্টারে প্রেজেন্ট করলে লোকে খায়। এই যেমন এ ক্ষেত্রে আপনিও খেলেন। তাই না?

- সো ইউ আর নট অ্যাভার্স টু সেলিং ইওরসেল্ফ।

- আদৌ নয়। আফটার অল, আমি সন্ন্যাসী নই। তবে কী জানেন স্যার, ডিমান্ড কার্ভ আর সাপ্লাই কার্ভের ইন্টারসেকশনেই যে সমস্ত সত্যি লুকিয়ে আছে, এ কথাকে অমোঘ সত্য বলে মেনে নিতে মন সরে না।

- ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের কদর করেন না বলছেন?

- কদর যে একদম করিনা তা নয়। নয়ত চাকরীর জন্য হন্যে না হয়ে একটা টিউশনি খুঁজতে বেরোতাম। তবে ওই, ও'টুকুই শেষ কথা হতে পারেনা।

- আপনি ছাত্র পড়ান? সাহিত্য নিশ্চয়ই?

- অঙ্ক। 

- আপনি তো কবিতার মানুষ। অঙ্কের হার্ড লজিক বরদাস্ত হয়?

- লজিক নিরেট নয়। হিমশীতল নয়। 

- কোরাপশন সম্বন্ধে আপনার কী মতামত? 

- কোরাপশনের জন্য শুধু লোভই যথেষ্ট নয়। তার জন্য ধক লাগে। 

- লোভ আর ধক,এ দু'টো আপনার মধ্যে কতটা পরিমাণে রয়েছে?

- লোভ সাড়ে ষোলো আনা। কিন্তু সাহসটা বেশ কম জানেন। আর ভীতুর লোভে কোরাপশন কতটা আছে জানিনা, শয়তানি রয়েছে ঢের। 

- আপনার বায়োডেটা বলছে আজ আপনার জন্মদিন।

- আপনি বায়োডেটা আর সার্টিফিকেটে বিশ্বাস করেন?

- করা উচিৎ নয় বলছেন?

- পলিটিশিয়ানদের বক্তৃতা।  আর ভদ্রলোকের বায়োডেটা৷ চোখ বুজে বিশ্বাস করলে ঠকবেন।

- তবু। নিরেট লজিক মেনে নিয়েই বলি; হ্যাপি বার্থডে মিস্টার কলকাতা। আর শুনুন। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে৷ এ চাকরীটা আপনি পাচ্ছেন।

- ইমিডিয়েট জয়নিং?

- অফকোর্স।

- আসলে, আজ রাস্তায় বিশ্রী গরম ছিল। ফেউফেউ করে ঘোরাঘুরি করতে করতে দেখলাম চামড়া জ্বলে যাওয়ার উপক্রম। তাই এয়ার কন্ডিশনিংয়ে ঘণ্টাখানেক কাটানোর জন্য এই ইন্টারভিউ দিতে ঢুকে পড়লাম। হাতে বায়োডেটা থাকায় কোনও অসুবিধেও হলনা। এ চাকরী আমি নিতে পারব না। মাস দুয়েকের জন্য ঘুরতে বেরোব ভাবছি। 

- স্টার্টিংয়ে কিন্তু আমরা এগারোশোর চেয়ে বহুগুণ বেশি দেব।

- গুপ্ত প্রেসের পঞ্জিকা আর কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, দু'টোই আমি নিয়মিত কনসাল্ট করি। আর দু'টোই বলছে যে ডিমান্ড কার্ভ আর সাপ্লাই কার্ভের ইন্টারসেকশনে পা দিলেই আমার কপালে বিশাল ফাঁড়া প্লাস বুর্জোয়া ক্যালামিটি। আজ আসি স্যার। 

- ওয়েল। ওকে। অ্যান্ড ওয়ান্স এগেন, মেনি হ্যাপি রিটার্ন্স অফ দ্য ডে।

Sunday, August 23, 2020

রবিবারের হিসেবকিতেব


সকাল।

লুচি বেগুনভাজা মুখে দিয়ে শ্যামল মিত্রের গান, 
আর পাশাপাশি কয়েক পাতা শীর্ষেন্দু, অদ্ভুতুড়ে সিরিজ। 
জলখাবার শেষে জিলিপি চিবুতে চিবুতে নারায়ণ দেবনাথ।
আকাশের সিচুয়েশন যাই থাক, আদত রোদ্দুর জেনারেট করতে হবে মনের মধ্যে। এবং সে রোদ্দুর হতে হবে 'ও মন কখন শুরু কখন যে শেষ' মার্কা সুপার-মিঠে। 

***

প্রি-দুপুর।

রান্না চলাকালীন স্টিলের বাটিতে দু'পিস মাংস এক পিস আলু নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা। তখন আবার কানের ইয়ারফোনে মান্নাবাবুর 'ও আমার মন যমুনার' সুর ফ্লো করবে। স্নানের আগে মনটাকে একটু মাটন-মান্না রোম্যান্সে ম্যারিনেট না করলেই নয়।

***

দুপুর।

খেতে বসে তাড়া নেই। খাওয়া শেষে হাত ধোয়ার হুড়োহুড়ি নেই। আড্ডা আছে, এঁটো হাত শুকিয়ে যাওয়া আছে। নিজের রান্নার অ্যানালিসিস আর অন্যের রান্নার প্রশংসা আছে। আর আছে লাঞ্চ সেরে খাটে ফ্ল্যাট হয়ে হেমন্তবাবুর হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া। প্রো-টিপঃ ব্যাকগ্রাউন্ডে লো ভল্যুমে জীবনপুরের পথিক আর চোখের সামনে ক্যালভিন অ্যান্ড হবসের কমিক্স বই দিব্যি খাপেখাপ মিলে যায়। 

ভাতঘুম শব্দটায় তুলসীবাবু রয়েছেন,সিয়েস্টায় রয়েছেন ছবি বিশ্বাস। গান আর কমিক্সের মিশেলে কোনও রবিবার হয়ত চোখ ভার করে নেমে আসবেন তুলসীবাবু। আবার অন্য কোনও রবিবার দুপুরে ঘুমের আয়েশে থাকবেন ছবি বিশ্বাস। 

***

সন্ধ্যে।

রোব্বার সন্ধ্যেয় ছাতে মাদুর পেতে বসতে পারায় শুনেছি গঙ্গাস্নানের পুণ্য। মুড়িমাখা আর লেবু-চায়ের কম্বিনেশনকে খোলা আকাশের নীচে না আনতে পারলে নাকি সমস্ত মাটি।

সোমবারের ব্যস্ততা শুরুর আগে, এমন ছাতসন্ধ্যে বেশ টনিকের কাজ করে। পাশে আধো-মনখারাপ আর স্নেহ মিলিয়েমিশিয়ে কিশোরবাবু গাইবেন পাখিদের না ফেরার গান।

***

রাত।

ইলিশের রোয়াব যে থাকতেই হবে তার কোনও মানে নেই। ট্যাংরার গরম গরম ঝোলে বা মৌরলার ঝালেও এস্পারওস্পার সম্ভব। বিয়ের আগের প্রেম জমে নন্দন চত্বরে বা মিলেনিয়াম পার্কে; এ কথা নেহাৎ ফেলনা নয়৷ তবে বিয়ের পরে প্রেম খোলতাই হয় পোস্ট-ডিনার একসঙ্গে বাসন মাজায়। এর হাতে কড়াই, ওর হাতে সসপ্যান; কিচেন সিঙ্কের সামনে গা-ঘেঁষাঘেঁষি গল্পগুজব। 

হাতে ভিম-ভারের ফেনা, মুখে হাসি, সস্তা ঠাট্টা-তামাশা আর ব্লুটুথ স্পীকারে সাতপুরনো যত হিন্দি গান; এর সামনে উত্তমবাবুর মোটরবাইক আর সুচিত্রাদেবীর 'তুমি বলো' ফেল পড়তে বাধ্য৷