প্রতি বছর বইমেলার আগে মনে হয় এইবারে অন্তত নার্ভ ধরে রাখতে পারব। মনে হয় এবারে অন্তত বাৎসরিক হুজুগের পাল্লায় পড়ে তাকের না পড়া বইয়ের বোঝা আরও খানিকটা বাড়িয়ে ফেলব না। এবারেও তেমনই একটা কিছু ভেবে রেখেছিলাম, কিন্তু শেষে ওই যা হওয়ার তাই হল। পাঠকের চেয়ে কনজিউমারের মেজাজে ধার বেশি; কাজেই শেষে পর্যন্ত পিঠের ব্যাগ বোঝাই করে বাড়ি ফেরা। নিশ্চিত জানি যে এই নতুন বইগুলোর মধ্যে বেশ কিছু বই হয়ত আগামী একবছরেও পড়া হবে না এবং পরের বইমেলার সময় এই বইগুলোর দিকে তাকিয়ে বারবার শিউরে উঠতে হবে।
এবারের বইমেলার দিন কয়েক আগে শেষ করেছি মার্কাস জুসাকের “দ্য বুক থীফ”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মানী আর সেই সময়ের নিবিড় অন্ধকার হাতড়ে বেড়ানো কিছু মানুষের গল্প বলেছেন লেখক। কাহিনীর মূলে রয়েছে লিজেল মেমিঙ্গার নামের এক কিশোরী। হিটলারের জার্মানির আর সেই বিষিয়ে যাওয়া সময়ে আটকে থাকা মানুষের অপরিসীম যন্ত্রণা নিয়ে আলোচনা আগেও হয়েছে আর ভবিষ্যতেও হবে। সেই যন্ত্রণাকেই প্রায় সহজবোধ্য কবিতার ভাষায় এ বইতে তুলে ধরেছেন লেখক।
গল্পের মূলে রয়েছে বইচোর লিজেল; পাঠক লিজেল। বই পড়বার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা বয়ে বেড়িয়েছে মেয়েটা, নিজের জীবনের প্রতিটি ট্র্যাজেডির সঙ্গে বইপড়া কে জুড়ে দিতে শিখেছে সে। বইকে ক্রমাগত লিজেল যন্ত্রণার মলমের মত ব্যবহার করেছে; একদল মানুষ যখন অসহায় ভাবে বেসমেন্টে লুকিয়ে থেকেছে বোমারু বিমানের আক্রমণের ভয়ে, লিজেলের পাঠ করা বই তখন উপশম হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি আতঙ্কিত মানুষের বুকে। সমস্যা হল; লিজেলের তাক ভর্তি না-পড়া-বই ছিল না। তার কেনার সামর্থ্যও ছিল না। লিজেলের কোনও বইই ছিল না।
কাজেই বইচুরি ছাড়া লিজেলের আর কোনও উপায় ছিল না। বইয়ের জঁর, লেখনী, বিষয়, মতাদর্শ, অর্থ; এসব নিয়ে ভাববার বিলাস লিজেলের কপালে ছিল না, যে কোনও একটা বই হলেই হল।
বই; যার মলাটে হাত বুলনো যায়, প্রতিটা পাতায় ছাপা প্রতিটি শব্দের ওজন মাপা যায়, এক লাইন থেকে পরের লাইনে যাওয়ার ব্যস্ততায় বারুদের গন্ধ পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়…। লিজেলের চোখ দিয়ে বই পড়ার আরাম আর স্নেহটুকু ছুঁয়ে দেখা যায়; সে ছুঁয়ে দেখাটুকুর মূল্য বইমেলা সমস্ত বইয়ের চেয়ে বেশি। লিজেলের বইচুরি আর বই পড়ার আবডালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ট্র্যাজেডি আর অজস্র ভালোবাসার মুহূর্ত। এ বইকে শুধু নাৎসি জার্মানারি বীভৎসতার হিসেবকিতেবে বেঁধে ফেলা অসম্ভব।
লিজেল বেড়ে ওঠা হান্স আর রোজা হুবারম্যানের সংসারে। হান্স একজন ভীতু সৈনিক অথচ দুঃসাহসী নাগরিক; আমি বড় হয়ে হান্স হতে চাই। ব্যাপারটা সহজ নয়, তবে চাইতে তো ক্ষতি নেই। আর তার পাশাপাশি রোজা হুবারম্যান। কাটখোট্টা, পাথুরে রোজা হুবারম্যানের অ্যাকোর্ডিয়ন আঁকড়ে বসে থাকা ভালোবাসা; তা কন্টেক্সট-সহ লিখে বোঝানোর ক্ষমতা (এবং ভাষার জোর) আমার নেই।
দুটো কথা না বলেই নয়।
এক, এ কাহিনীর অন্যতম চরিত্র মৃত্যু। মৃত্যুর জবানিতেই আমরা লিজেলকে চিনেছি, গোটা উপন্যাস গড়ে উঠেছে মৃত্যুরই ন্যারেশনে। পিওভিটা যেমন ডার্ক ও ধারালো , তেমনই সুন্দর ও স্নেহের। সাধে কি বলেছি যে এই গদ্যে সহজ কবিতার সারল্য মিশে আছে?
দুই, লেখকের স্টাইলে যে কী অবধারিত ভাবে যে শৈলেন ঘোষ মিশে রয়েছেন। পরতে পরতে শৈলেনের স্পর্শ লেগে আছে জুসাকের গল্প বলায়। অবশ্যই এ উপন্যাসে অনেক বেশি মাত্রায় ট্র্যাজেডির স্পর্শ লেগে আছে, রয়েছে অনেকটা বাড়তি হতাশা। কিন্তু কোথাও কীভাবে যেন শৈলেনের রূপকথার উপাদান এই গল্পে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন জুসাক।
No comments:
Post a Comment