চারুশিলা আজ আনন্দে ডগমগ; তিনি সকাল থেকে কিছুতেই স্থির হয়ে বসতে পর্যন্ত পারছেন না। একবার ছুটে ঝুল-বারান্দায় গিয়ে নীচে রাস্তার দিকে উঁকি মারছেন তো পরক্ষণেই আবার হেঁসেলে ঢুকে কমলার মাকে রান্নার খুঁটিনাটি টেনে হাজারটা প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলছেন৷ ঘরের সমস্ত আসবাব নিজের হাতে বারবার পুছেও যেন ঠিক তৃপ্ত হতে পারছেন না।
মাঝেমধ্যেই দেওয়াল ঘড়ির দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকাচ্ছেন তিনি; অথচ কাঁটা যেন এগোতেই চায় না ছাই। এই সোয়া বারোটা, এই বারোটা সাতাশ, এই বারোটা বত্রিশ৷ কখন যে পৌনে পাঁচটা বাজবে, তখন খোকার ট্রেন ঢুকবে স্টেশনে৷ রেলস্টেশন থেকে বাড়ি পৌঁছতে খোকার আরও মিনিট চল্লিশেক সময় লাগবে।
কতদিন পর। কতদিন পর খোকা ফিরছে৷ প্রায় বছর খানেক পর বাড়ি ফিরছে খোকা কিন্তু মায়ের মনের ভিতর এমন তোলপাড়; যেন কত যুগ পর ফের খোকাকে দেখবেন তিনি। নতুন চাকরীর এমনই চাপ যে বছরখানেক বাড়িমুখো হতে পারেনি খোকা; এদ্দিন পর কয়েকদিনের ছুটি পেতেই সে ফিরছে।
খোকার ঘর, বিছানাপত্র সব নিজের হাতে সাজিয়েগুছিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ নিজের শোওয়ার ঘরে গেলেন চারুশিলা। আলমারি বোঝাই শাড়ি অথচ খোকা না থাকলে তার সে'সব ছুঁয়েও দেখতে ইচ্ছে করে না। খোকার বাবা প্রায়ই বকাঝকা করেন, বলেন "এ দুনিয়ায় তুমিই কি একমাত্র মা নাকি যার ছেলে চাকরীর জন্য ঘরছাড়া"? কিন্তু তাঁর মন সরে না তাতে। আলনার ঝুলে থাকা কয়েকটা আলুথালু শাড়ি উল্টে পাল্টে পরেই বছর খানেক কেটে গেছে। আজ বহুদিন পর চারুশিলার ইচ্ছে হল আলমারিটা খুলে ভালো একটা শাড়ি বের করে পরতে৷ আজ খোকা ফিরছে বলে কথা।
এদ্দিন পর আলমারিটা খোলার কথা ভেবে চারুশিলার যে কী ভালো লাগছিল। শাড়ি আর ন্যাপথালিন মেশানো গন্ধ, সোনাগয়না রাখা লকার; সব মিলে এই সাতাশ বছর পুরনো নিজের বিয়ের আলমারিটা চারুশিলার বড্ড প্রিয়। কত অলস দূপুর তার কেটেছে এ আলমারির পাল্লা হাট খোলা রেখে বিভিন্ন শাড়ি ঘাঁটতে বা সোনাগয়নার গায়ে হাত বুলোতে৷ একসময় দিনে অন্তত একবার এ আলমারি তিনি ঘাঁটতেন আর প্রাণ ঢেলে গোছাতেন। শুধু খোকা যাওয়ার পর এমন মনমরা হয়ে পড়লেন যে আলমারির কথা তার মনেও পড়ত না।
এদ্দিন পর আলমারি খোলার কথা মনে পড়তেই চারুশিলা বুকের মধ্যে একটা বাড়তি চনমন বোধ করলেন। বিছানার তোশকের নীচ থেকে চাবিটা বের করে এগিয়ে গেলেন আলমারিটার দিকে।
আলমারি পাল্লাটা খুলতেই একটা ঝোড়ো হাওয়ায় চারুশিলার চারপাশটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। মাথাটা গেল ঘুরে, একটা বিশ্রী গা গোলানো আনচান চেপে ধরল তাঁকে। কিছুক্ষণের জন্য যেন চোখে অন্ধকার দেখলেন তিনি। খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পর যখন দৃষ্টির ঝাপসা ভাবটা কেটে গেল; তখন চারুশিলা টের পেলেন তাঁর গলাটা শুকিয়ে কাঠ। কারণ আলমারির পাল্লা খুলে তিনি শাড়ি গয়নার সম্ভার নয়, দেখতে পেলেন নিজের শোওয়ার ঘরটাকেই৷ কিন্তু শোওয়ার ঘর, ওই খাট, ওই দেওয়াল ঘড়ি; এ'সব তো তাঁর পিছনে থাকার কথা। আলমারির মধ্যে শাড়ি গয়নার বদলে তাঁর শোওয়ার ঘরটা উঠে এলো কী করে৷ চারুশিলা মাথার ভিতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। মন্ত্রাবিষ্টের মত নিজের আলমারির ভিতরে পা বাড়ালেন তিনি। অথচ আলমারির ভিতরে নয়, চারুশিলা এসে দাঁড়ালেন নিজের শোওয়ার ঘরেই। এই পালঙ্ক, এই মেঝে, এই জানালা; সবই তাঁর সুপরিচিত।
আর ঠিক তখনই তাঁর চোখ পড়ল সামকে দাঁড়ানো দু'জনের দিকে। দু'জনের একজন খোকা; খোকার সামনে তিনি দাঁড়িয়ে অথচ খোকা যেন তাঁকে দেখতেই পারছে না। খোকার দৃষ্টি বিহ্বল, ছলছলে। "খোকা" বলে প্রাণপণে চিৎকার করতে চাইলেন চারুশিলা অথচ মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোল না কারণ ততক্ষণে তাঁর দৃষ্টি টেনে নিয়েছে খোকার পাশে দাঁড়ানো ওই বিশ্রী মানুষটা।
মানুষটা চারুশিলার পরিচিত নয় কিন্তু ভদ্রলোকের দিক থেকে কিছুতেই চোখ সরানো যায় না যেন। মানুষটার লাল চাদরে মোড়া দীর্ঘ দেহর দিকে তাকিয়ে চারুশিলার গোটা গায়ে কেরোসিনে পোড়া জ্বলুনি শুরু হল৷ তিনি চেঁচিয়ে বলতে চাইলেন "খোকা আমায় তুই এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দে" অথভ কিচ্ছুটি বলতে পারলেন না৷ চারুশিলার মনে হল যেন তাঁর দেহটা ছিঁড়েখুঁড়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
খোকার পাশে দাঁড়ানো মানুষটা ততক্ষণে বরফঠাণ্ডা সুরে বিড়বিড় করতে শুরু করেছে;
"সুবিমলবাবু, আপনি তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন না কিন্তু আমি পেরেছি। হ্যাঁ আপনার মাকে আমি দেখতে পেরেছি। এদ্দিনে তাঁর মুক্তির পালা। বছর পাঁচেক আগে ঘটেছিল তো দুর্ঘটনাটা? ওই যে, আপনার যে বিকেলে।বাড়িতে ফেরার কথা ছিল, সেই দুপুরেই তো? আপনাকে না দেখতে পাওয়ার দুঃখ পুষে এদ্দিন এ আলমারিতে বন্দী ছিলেন মা। আজ তাঁর মুক্তি। সামান্য ছটফট আছে বটে, কিন্তু মুক্তি এ'বার আবশ্যম্ভাবী। আলমারি কেন, সিন্দুকের আড়ালে থেকেও গুপি তান্ত্রিকের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়"।
No comments:
Post a Comment