Friday, May 1, 2020

অশোক ও অসীমা

১।

উপন্যাস থেকে তৈরি হওয়া সিনেমা।
এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত থাম্বরুল হল আগে উপন্যাসটা পড়ে তারপর সিনেমায় পৌঁছনো। উপন্যাসের 'ডিটেলিং' স্বাভাবিক ভাবেই সিনেমার স্ক্রিনে ঘণ্টা দুই-আড়াইয়ের মধ্যে ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়৷ তাছাড়া উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহকে কিছুটা কাটছাঁট না করে সিনেমার ফ্রেমে বসানো মুশকিল।  তার মানে এই নয় যে গুরুত্বের দিক দিয়ে সাহিত্য সবসময়ই সাহিত্য-নির্ভর সিনেমার ওপরে থাকবে। এডিটিং আর নির্দেশনার গুণে সিনেমা যে স্বতন্ত্র হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তেমন উদাহরণ যে অজস্র আছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।  সিনেফাইলরা সে বিষয়ে আরও বিশদে বলতে পারবেন৷ কিন্তু ওই, আমার বরাবরই মনে হয় যে ভালো লাগা বই থেকে তৈরি হওয়া সিনেমা যতটা সাগ্রহে দেখা যায়, সে সিনেমা আগে দেখে প্লটের নির্যাস বুঝে নিয়ে বইটা পড়তে শুরু করা অনেক বেশি কঠিন।

ঝুম্পা লাহিড়ীর 'নেমসেক' বইটা আমি সংগ্রহ করি নেমসেক সিনেমার বিভিন্ন ছবি দেখে। দু'টো ছবি আমায় বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে;
 
এক। যে'খানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে একগাল হাসি নিয়ে ইরফান দাঁড়িয়ে, পাশে টাবু। টাবুর মাথা ঝুঁকে পড়েছে ইরফানের কাঁধে।

দুই। টাবু আর ইরফান কোনও এক মার্কিন শহরের পটভূমিতে। টাবুর কোলে শিশু, ইরফানের হাতে ফুলের বোকে। আমেরিকা বাদ দিলে; এ ধরণের ছবি বোধ হয় একসময় প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত বাঙালির অ্যালবামে থাকত। 

বইটা পড়া বা সিনেমাটা দেখার আগেই বিভিন্ন রিভ্যিউয়ের মাধ্যমে জেনেছিলাম যে সিনেমায় টাবু রয়েছেন অসীমার চরিত্রে আর ইরফান হয়েছেন অশোক। কাজেই নেমসেক পড়তে শুরু করার আগেই আমার মনের মধ্যে স্পষ্ট ছিল যে এই বইয়ের মূল দু'টো চরিত্র ঠিক কেমন দেখতে বা তাঁদের কণ্ঠস্বর ঠিক কেমন। আমি সিনেমাটা দেখার আগেই, উপন্যাসের প্রতিটি পাতাকে অনুভব করেছি ইরফান খানের অশোক  আর টাবুর অসীমার মধ্যে দিয়ে। 
এবং আমি হলফ করে বলতে পারি; অশোক ইরফান গাঙ্গুলি আর অসীমা টাবু গাঙ্গুলির উষ্ণতায় ভর দিয়ে আমার উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতাটা আরও গভীর উঠেছে। 

বইটা পড়ার পর; সিনেমায় আমি যখন অশোক আর অসীমাকে স্ক্রিনে দেখেছি, চরিত্রেগুলোর পিছনে থাকা অভিনেতাদের নাম কিন্তু একবারও মাথায় আসেনি।

২।
'নেমসেক' উপন্যাসটি মন্থর কিন্তু ক্লান্তিকর নয়; বরং বেশ কিছু ক্ষেত্রে আলপনার মত সুন্দর।  প্রবাসী বাঙালি জীবনের খুঁটিনাটির আড়ালে অশোক আর অসীমা স্পষ্ট হয়ে উঠেছেন, ক্রমশ বেরিয়ে এসেছেন খোলসের মধ্যে থেকে। ষাট-সত্তরের দশক থেকে তুলে আনা মধ্যবিত্ত বাঙালির 'সিগনেচার ক্লিশে'গুলো ঝরঝরে ভাষার গুণে বড় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে; অশোক আর অসীমার নতুন সংসারের ছবি যেন আমাদের পুরোনো ছবির অ্যালবামের কোনও এক কোণে সহজেই সাঁটা থাকতে পারে। প্রবাসে থাকলে যে কোনও মানুষই নিজের দেশে থেকে বয়ে আনা ছোটোখাটো বর্ণগন্ধগুলোকেও যে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চাইবেন; সে'টাই স্বাভাবিক।  তাছাড়া ইন্টারনেটের যুগে আমরা অনেকেই দু'শো মাইল আর আড়াই হাজার মাইলের মধ্যে বিশেষ তফাৎ দেখতে পাইনি; ষাট-সত্তরের দশকে ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম।

অসীমা আর অশোকের কোনও 'রীতিমতো নভেল' গোছের আঙুলে আঙুল ছোঁয়ানো ভালোবাসা আবিষ্কারের মুহূর্ত নেই৷ দৈনন্দিন জীবনের জট ছাড়াতে ছাড়াতে তাঁরা নিজেদের অজান্তেই একে অপরে জাপটে ধরেছেন। তাঁদের কাছে আসার প্রসেসটা হয়ত ঠিক সেই অর্থে সিনেম্যাটিক নয়। আমাদের স্মৃতিতে কিছু মুহূর্ত উজ্জ্বল হয়ে থাকে বটে কিন্তু যে অসংখ্য আটপৌরে সাদামাটা মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে গিয়ে দু'জন মানুষ একে অপরকে চিনতে শুরু করে, ভালোবেসে আপন করে নয়; সেই সাদামাটা দিনপঞ্জির মাধ্যমেই অশোক আর অসীমার কথা লিখেছেন ঝুম্পা। আর কী অপূর্ব সারল্যের সঙ্গে তুলে ধরেছেন এই দু'জন মানুষ ও তাঁদের স্নেহের সম্পর্ককে। 

আগেই বলেছি, সিনেমার পোস্টারে ইরফান আর টাবু আমায় এতটাই মুগ্ধ করেছিলেন যে অশোক আর অসীমার চরিত্র দু'টো আমার মনের মধ্যে একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছিল। 

আমার কাছে এই উপন্যাসের দু'টো ভাগ। এক, শুরু থেকে অশোক গাঙ্গুলির মৃত্যু পর্যন্ত। দুই, তারপরের অংশটুকু৷ আমার টান বেশি ওই প্রথম অংশটার প্রতি৷  

উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই রয়েছে অশোক অসীমার ছেলে গোগোল। কালপুরুষ সিনেমার শেষে দৃশ্যে বাবা আর ছেলের পাশাপাশি হাঁটার স্বপ্নালু দৃশ্যটা ভোলার নয়। 'নেমসেক' উপন্যাসের শেষে এসে গোগল নাগাল পেয়েছিল নিজের বাবা অশোক গাঙ্গুলি এবং অশোকের প্রিয় লেখক (এবং গোগলের 'নেমসেক') নিকোলাই গোগোলের।  কালপুরুষ সিনেমার সেই দৃশ্যটা বারবার মনে পড়ছিল এ উপন্যাসের শেষে। 

৩।
নেমসেক সিনেমাটা দেখায় আগেই উপন্যাসের অশোক ও অসীমা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন ইরফান আর টাবু হয়ে। কাজেই সিনেমা দেখা শুরু করার পর ; উপন্যাসের চরিত্র আর সিনেমার অভিনেতাদের রিকনসাইল করতে আদৌ কোনও অসুবিধে হয়নি। সিনেমার একদম গোড়ার দিকে ইরফানের বাংলা উচ্চারণ কানে সামান্য খোঁচা দিয়েছিল বটে। কিন্তু সিনেমাটা শেষ করার পর ব্যক্তিগত ভাবে বলতে দ্বিধা নেই যে ইরফান ছাড়া অশোক গাঙ্গুলির কোনও অস্তিত্ব আমার মনে নেই৷ তাছাড়া সিনেমা চলাকালীন এক সময় মনে হয়েছিল উপন্যাসের যে অশোক, তাঁর তুলনায় সিনেমার অশোক যেন সামান্য বেশি প্রাণোচ্ছল, সে যেন একটু বেশি হাসতে পারে। সিনেমার শেষে দিব্যি টের পেয়েছিলাম যে অভিনেতা ইরফান আমার মত একজন মোটাদাগের পাঠককে বোঝতে পেরেছেন যে অশোক গাঙ্গুলির চাপা প্রাণোচ্ছলতাটুকুই তাঁর চরিত্রের মূলদিক৷ তারপর বইটার বিভিন্ন পাতায় ফেরত গিয়ে দেখেছি; প্রথমবার বইটা পড়ার সময় অশোককে যতটা চাপা মনে হয়েছিল, আদৌ সে ততটা নয়। সত্যিই, সিনেমাও পারে মূল উপন্যাসের পাঠককে সমৃদ্ধ করতে; ইরফানরা পারেন৷ 

অশোক গাঙ্গুলির অসময়ে চলে যাওয়াটুকু ওই ইরফানের মতই। প্রায় ইরফানেরই বয়সে। ভাগ্যিস ইরফান ছিলেন, নয়ত অশোক গাঙ্গুলিকে ভালো করে চেনাই হত না।

এবং শেষে যার কথা না বললেই নয়। টাবু। সিনেমায় পরিসর কম, উপন্যাসের মনকেমন করা অলস গতি সে'খানে চলে না। কোনও উপন্যাস ভালো লাগলে অনেক সময়ই মনে হয় যে সে উপন্যাস ভর দিয়ে বানানো সিনেমাটা যেন একটু হুটোপুটিতে কেটে গেল; কিছু জায়গায় 'নেমসেক'য়ের ক্ষেত্রেও সে'টাই মনে হয়েছে। সে'টাই স্বাভাবিক। 

কিন্তু টাবুর হাত ধরে অসীমা যে কী গভীর হয়ে উঠেছেন। অচেনা পাত্রের জুতোয় পা গলানো ছেলেমানুষি থেকে সদ্য পিতৃহারা ছেলেকে জাপটে বুকে টেনে নেওয়া সাহস; উপন্যাসের অসীমাকে ভালো করে চেনাও সেই টাবুর মাধ্যমে, ঠিক যেমনভাবে অশোককে পূর্ণতা দিয়েছেন ইরফান।

No comments: