"ভালোবাসার ছোট্ট হরিণ" আমার পড়া প্রথম শৈলেন ঘোষের লেখা, আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে৷ সে গল্প খুব ভালো লেগেছিল শুনে পাশের বাড়ির এক সহৃদয় কাকু আমায় পড়িয়েছিলেন "মা এক নির্ভীক সৈনিক"। ধার করা পূজাবার্ষিকীতে পড়েছিলাম, তাই পড়ার পর বুকে পাথর রেখে সে বই ফেরত দিতে হয়েছিল। অত ছোটবেলায় যে'টা সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছিল সে'টা হল 'স্তেপস'য়ের হিংস্র যাযাবর উপজাতিদের দৈনন্দিন জীবন। 'সাইথিয়ান' শব্দটা উল্লেখ উপন্যাসের শুরুর দিকেই ছিল আর আমার মনে মধ্যে শব্দটা গেঁথে গিয়েছিল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক একটা কারণে। সাঁইথিয়া নামে একটা রেলস্টেশন এ বাংলায় আছে, এই অকারণ মিল খুঁজে পেয়ে থ্রিলড হয়েছিলাম। বহুবছর পর ইন্টারনেট ঘেঁটে পড়েছিলাম সাইথিয়ানদের সম্বন্ধে; আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ইউরেশীয় অঞ্চলের স্তেপস দাপিয়ে বেড়াত এই যাযাবর উপজাতিরা। শৈলেনবাবু লিখেছিলেন সাইথিয়ান (Scythian)-দের মধ্যে বিভিন্ন জাত; তার একটি হলো আসগুজাই। উইকিপিডিয়া বলছে সাইথিয়ানদের বিভিন্ন নামে ডাকা হত যেমন সাকা, ইসকুজাই, ইত্যাদি।
গল্পের মূলে রয়েছে আসগুজাই দলের সেনাপতি স্তানের পুত্র কোহেন এবং কোহেনের মা আনাতুরি। তবে যে নামটা মনের মধ্যে আজও সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়ে আছে সে'টা হল আসগুজাই দলের নির্মম রাজা বুমবুজাং৷ বুমবুজাং নামটা বিড়বিড় করে খানতিরিশবার বললেই মনে হয় " এখুনি যুদ্ধে যাব"। শৈলেনবাবু এত সুন্দর সব নাম বাছতেন তাঁর রূপকথার গল্পের চরিত্রদের জন্য; আহা, তাতেই কেল্লা ফতেহ হয়ে যেত। আলা-ইজা, শিজুমন; এক একটা লাখটাকার নাম।
আসগুজাইদের রক্তলোলুপতায় হাড়হিম করা বর্ণনা রয়েছে এই গল্পে। নির্মম হিমশীতল স্তেপসে ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়ানো মানুষ তাঁরা, গেরস্তবাড়ির নরম তাঁদের স্পর্শ করেনি কোনওদিন। এই দলের সঙ্গে ওই দলের খুনোখুনি সে'খানে নিত্যদিনের ব্যাপার। শত্রুর গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে গায়ের চাদর বানানো বা শত্রুর খুলি দিয়ে পানপাত্র তৈরি করাটাই তাঁদের একমাত্র ফ্যাশন। রক্তপাত ব্যাপারটা তাঁদের কাছে ছিনিমিনি৷ তা সেই খুনে শয়তান রাজা বুমবুজাংয়ের নেকনজর থেকে পড়ে যেতেই সেনাপতি স্তানকে নিকেশ হতে হয় খোদ রাজার হাতে৷ বুমবুজাং পারলে সে'দিনই খতম করে দিত শিশু কোহেন ও তাঁর মাকে। কিন্তু আনাতুরি কোনওক্রমে সেই কোলের শিশুকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচেন, আশ্রয় পান শত্রু শিবিরে।
আনাতুরি কোহেনকে বড় করেন একটাই স্বপ্ন নিয়ে, কোহেন আর পাঁচটা খুনে যাযাবরদের মত রক্তলোলুপ হবেনা৷ কোহেন ভালোবাসতে শিখবে৷ মা কোহনেকে সর্বক্ষণ আগলে রাখেন; কোহেনকে বুঝতেই হবে এ রক্তারক্তি কতটা অর্থহীন। কিন্তু আনাতুরির স্নেহ কাটিয়ে একসময় কোহেন বেরিয়ে পড়ে রক্তের নেশায়, খুনখারাপির টানে৷ মায়ের কান্না,আদর ও শাসন; সমস্ত হেলায় ভাসিয়ে দেয় সে, কোহেনকে পেয়ে বসে যুদ্ধের নেশায়।
তরুণ কোহেনের হিংস্র হুঙ্কার আনাতুরিকে ভেঙেচুরে ফেলে কিন্তু নিজের দায়িত্বটা দিব্যি টের পায় সে। লতায় পাতায় এগোতে এগোতে এই অপূর্ব রূপকথায় একসময় হিংস্র সন্তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান মা নিজে; মায়ের হাতে তখন অস্ত্র৷ মা তখন এক সৈনিক। মায়ের যুদ্ধ ভালোবাসার জন্য, খোকার যুদ্ধে খুনির দাপট। খোকা নির্মম, মা নির্ভীক।
ছেলেবেলায় ধার করা পূজাবার্ষিকীতে পড়া এই উপন্যাস। তারপর ঘটনাচক্রে সেই পূজাবার্ষিকীটা বহুদিন কিছুতেই জোটাতে পারিনি। কলেজের সম্ভবত সেকেন্ড ইয়ারে, ক্যালক্যাটা ইউনিভার্সিটির লাগোয়া ফুটপাথের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে খুঁজে পেয়েছিলাম সেই পুরনো পূজাবার্ষিকীটা। হাতে পেয়েই ফের পড়ে শেষ করেছিলাম "মা এক নির্ভীক সৈনিক"। ছেলেবেলায় ভালো লাগা অনেক উপন্যাস এখন পড়লে মনে হয়; আগে যেমন ভালো লেগেছিল বটে, এখন যেন তেমনটা মনে হল না। কিন্তু শৈলেনবাবুর বেশির ভাগ উপন্যাসের ক্ষেত্রেই এ দুশ্চিন্তা খাটেনা৷ আর "মা এক নির্ভীক সৈনিক" আমার পরে পড়ে যেন আরও বেশি ভালো লেগেছিল। এই ধেড়ে বয়সেও গল্পটা যখনই পড়ি, মনে হয় যেন আরও একটু বেশি ভালো লাগল। "জল নয়, আগুন"; এ কথা যেন এ উপন্যাসের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে খাটে।
শৈলেনবাবুকে আমরা যথেষ্ট সমাদর করতে পেরেছি কি? সে হিসেব করার যোগ্যটা আমার নেই। তবে যে রূপকথাগুলো উনি রেখে গেছেন, বয়স নির্বিশেষে বাঙালি পাঠকের জন্য সে'গুলো অত্যন্ত জরুরী।
আর হ্যাঁ, যদি এই গল্পটা আপনাদের বইয়ের তাকের কোনও কোণায় পড়ে থাকে; তবে আজকে পড়ে ফেলতে পারেন৷ আমি সোফায় মায়ের পাশে বসে একবার পড়ে ফেললাম; কোহেন ও তার মায়ের গল্প।
হ্যাপি মাদার্স ডে।
No comments:
Post a Comment