- দাদা।
- কী ব্যাপার পিলু? এত রাত্রে?
- মনে হল তুই হয়ত এখনও ঘুমোসনি। তাই ভাবলাম যাই একবার...।
- আয়। বস।
- কী পড়ছিস?
- ইংরেজি নভেল পড়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। ভাবলাম একটু শরদিন্দু ঝালিয়ে নিই। তোর ডিনার হয়েছে রে পিলু?
- দাদা। রাত ক'টা বাজে সে খেয়াল আছে? পৌনে একটা৷ আর নীলাকে তো জানোই, রাত ন'টার মধ্যে খাওয়াদাওয়া না করলেই এক্কেবারে হুলুস্থুল শুরু করবে।
- নীলার শাসনে আছিস তাই কোলেস্টেরলে পিষে মারা যাসনি এখনও।
- ছেলেবেলায় মায়ের শাসন। আর এখন বৌয়ের। তোর তো আর সে বালাই নেই, বেশ আছিস।
- বৌ না থাক। বই তো আছে। আর বইও শাসন করে, সোহাগও করে। এই লাইব্রেরি কত সাধ করে বানানো বল দেখি।
- তা বটে। টিকলিকে তো আমি বারবার বলি, জ্যেঠুর লাইব্রেরিতে যা৷ দু'টো বই উল্টেপাল্টে দেখ৷ তোর মত ভোরেশাস রীডার না হোক, মাঝেমধ্যে দু'একটা বই তো পড়তেই পারে বলো। কিন্তু না। সে দিনরাত শুধু ওই মোবাইলে মুখ গুঁজে পড়ে আছে।
- দিনকাল পাল্টেছে। বইটাই তো আজকাল একমাত্র রিসোর্স নয়। তুই বরং ওকে জোর করিস না।
- জোর করলেও সে মেয়ে পাত্তা দেবে নাকি৷ ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগ। তার ওপরে সদ্য কলেজে যাওয়া শুরু করেছে, তা'তে বাড়তি আর এক জোড়া ডানা গজিয়েছে।
- পিলু। বুড়োদের মত খিটখিট করিসনা। নতুনদের সব খারাপ আর আমাদের সব ভালো, এ'সব ন্যাকাপনা আমার অসহ্য লাগে। বাড়িতে এত বড় লাইব্রেরি, তুইই বা ক'টা বই পড়েছিস গত দু'বছরে?
- ব্যবসাপত্তর সামলে আর পড়ার সময় কোথায় বল৷ আমার ওই ইকনমিক টাইমসই ভালো। তা দাদা, আর কতক্ষণ পড়বি? এত রাত হল...।
- পড়ার জন্য এই রাতটাই ভালো সময় বুঝলি। দিনের গোলমালে বরং ফোকাস নষ্ট হয়। তা হ্যাঁ রে পিলু, তোর চেহারাটা এত শুকনো লাগছে কেন?
- ও তেমন কিছু না।
- তুই আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট পিলু। কাস্টোমারদের ফাঁকি দিয়ে বাড়তি দু'পয়সা কামিয়ে নিচ্ছিস নে, আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারবি না।
- বাজারের যা অবস্থা। ডিপ্রেশন, মিসগভার্নেন্স, শেয়ারমার্কেট রক্তারক্তি। তার ওপর কোরাপশন; গত বছরখানেক ধরে ব্যবসাটা যে কী'ভাবে চালাচ্ছি তা আমিই জানি।
- পিলু, আমি দেখি তো তোর ব্যস্ততা। আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি তুই উদয়াস্ত কী পরিশ্রম করিস। শোন, আমি তোর দাদা। এক বাড়িতে আমরা থাকি। আমি একতলায় তুই দোতলায়, অথচ দিনের পর দিন আমাদের দেখা হয়না৷ এই যে তুই আজ মাঝরাত্রে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলি, কী ভালোই যে লাগল। রোজ আসিস না কেন? নীলা বারণ করে?
- সে'সব কথা থাক দাদা।
- যাকগে, ব্যবসার সমস্যা কথা কিছু বলছিলিস।
- দাদা, বাড়তি কিছু টাকা ঢালতে না পারলে ব্যবসাটা ভেসে যাবে। টিকলি আর নীলাকে নিয়ে যে কী বিপদে পড়তে হবে আমায়..। আর দুম করে টাকাটা আমি কী করে জোগাড় করব বল।
- পিলু। তুই কি ফের বাড়ি বিক্রির কথা বলতে এসেছিস?
- গোটা বাড়িটা আমরা বিক্রি কেন করব দাদা? তুই কী ভাবিস, এ বাড়ির প্রতি আমার টান নেই? তোকে তো আগেও বলেছি কতবার; শুধু একতলার এই উত্তরের দিকটা বেচে দেব। লীগাল দিকটা অলরেডি দেখে নিয়েছি৷ আর দ্যাখ, এত বড় বাড়ি মেন্টেন করা এমনিতেও আমার পক্ষে..। তাছাড়া লাহাদের অফারটা লুক্রেটিভ। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলতে চায়। পোজিশন ভালো, মার্কেট রেটের আড়াইগুণ অফার করেছে।
- পিলু..।
- প্লীজ দাদা..আমার কথাটা ভাব একবার...। শুধু তো এই একতলার উত্তর দিকটা..।
- কিন্তু এই সে'খানেই তো আমার এই লাইব্রেরি পিলু...এই লাইব্রেরি ভাঙলে আমি কোথায় যাব...। এই বইগুলো ছাড়া তো আমার আর কিছুই নেই।
- প্লীজ। আমার জন্য একটু ভেবে দেখবি?
- কথাটা তুই তো আগেও বলেছিস। বহুবার। আমার উত্তরও তো তুই জানিস। এ লাইব্রেরি আমি ছাড়তে পারব না। আর আমার জোর করিস না, ফল ভালো হবে না।
- তুই আমার কথাটা একবারও ভাববি না দাদা?
- আমি তোর চোখের দিকে তাকিয়ে তোর মনের কথা টের পাই পিলু। আজও আমি সে'টা পারি। এ লাইব্রেরি নষ্ট করতে তুইও চাস না, তা আমি বেশ বুঝি। আর শোন, নীলাকে বলে দিস। এ লাইব্রেরি আমি কিছুতেই ছাড়ব না।
- আমি আসি দাদা। অনেক রাত হল।
- পিলু।
- কিছু বলবি?
- তোকে সত্যিই বড় শুকনো দেখাচ্ছে রে। শরীরের অযত্ন এ'বার একটু কম কর। আর...আর মাঝেমধ্যে আসিস আমার ঘরে, কেমন? না হয় রাত্রের দিকেই আসিস, নীলারা ঘুমোলে। কোনও বাড়ি বেচার মতলব ছাড়া আসিস কখনও। দুই ভাই মিলে না হয় একটু খোশগল্প করা যাবে। আসবি পিলু?
- গুডনাইট দাদা।
***
- নাহ্। দাদার সেই একই গোঁ। লাইব্রেরি সে ছাড়বে না।
- যত বাজে কথা। এ সব তোমারই বদমায়েশ।
- কী যাতা বলছ নীলা?
- আমি ঠিকই বলেছি। তুমিই ওই লাইব্রেরির মায়া ত্যাগ করতে না পেরে লাহাদের অফার রিফিউজ করছ। আর সে'টা চালাচ্ছ দাদার নামে।
- কতবার বলব, আমি দাদার লাইব্রেরি সহ বাড়ির ওই অংশটা বেচে দিতে চাই। কিন্তু দাদা অ্যালাউ না করলে..।এইতো, আজও দাদা বললে, লাইব্রেরি হাতছাড়া হলে তার ফল ভালো হবে না।
- যত্তসব বাজে কথা।
- বাজে কথা?
- বাজে কথা নয়? দু'বছর আগে যে মানুষটা মারা গেছে তাকে নাকি তুমি শুধু দেখতে পাও। আর চাইলেই তাঁর সঙ্গে গল্পগুজব করে আসো। আর সে নাকি বাড়ি বিক্রি আটকাচ্ছে...। আমার মেজদা বললে হালিশহর থেকে ওঝা নিয়ে এসে হিল্লে করে দেবে। তা'তেও তোমার আপত্তি...তোমারই কোনও মতলব আছে..।
- শোনো নীলা। দাদা আজীবনের কমিউনিস্ট। ধান্দাবাজ পলিটিকাল ফায়দা লোটা লোক নয়, মনেপ্রাণে কমিউনিস্ট। মরার আগে উকিল ডেকে এমন লিখিত ব্যবস্থা করে গেছিল যাতে কেউ ধর্মমতে ওঁর শ্রাদ্ধ না করে। সেই কম্যুইনস্ট দাদার আত্মাকে আমি ওঝা লাগিয়ে বাড়িছাড়া করব গো নীলা? ধর্মে সইবে?
2 comments:
গল্পখনা বেশ খাসা তো!!
nice
Post a Comment