- আরে শিবু নাকি?
- আজ্ঞে।
- আরে থাক থাক থাক, রাস্তাঘাটে আবার প্রণাম করা কেন।
- না করবেন নায়েবমশাই। না করবেন না। পায়ের ধুলোটুকু অন্তত নিতে দিন। আপনাকে যে আমি কী বলে...।
- আহা, আমায় কিছু বলতে যাবেই বা কেন। চলো, বেলা বাড়ছে। স্টীমারে উঠি চলো গিয়ে।
- নায়েবমশাই, আপনি আমাদের উদ্ধার না করলে আমরা ভেসে যেতাম। এই অসময়ে আপনি দেবদূতের মত আমাদের পাশে এসে না দাঁড়ালে...।
- দ্যাখো শিবু। আমি তো মাইনে করা চাকর মাত্র। তবে হ্যাঁ, পেন্নাম যদি ঠুকতেই হয়; তবে ঠোকো জমিদার মশাইয়ের নামে।
- জমিদারমশাইয়ের জন্য জান কবুল নায়েবমশাই। এদ্দিন আমরা ভাবতাম মানুষটা বড় কঠিন..কিন্তু তাঁর মধ্যে যে এত মায়া..।
- নারকেল দেখেছ তো শিবু? নারকেল? তার বাইরেটা কেমন।বিশ্রী ছিবড়ে? আমাদের জমিদারমশাইও ঠিক তেমনি। বাইরেটা যতই শুকনো হোক, তাকে একটু বাজিয়ে দেখলেই জলের নড়াচড়া টের পাবে।
- তা তো বটেই। নইলে গরীবমানুষের জন্য এতটা কেউ করে?
- যবে থেকে জমিদারবাবুর কানে উঠেছে যে নদীর ও'পারে হরিহরপুর গাঁয়ে মড়ক লেগেছে; অমনি তাঁর ঘুম হাওয়া। বারবার শুধু পায়চারি করছেন আর শুধোচ্ছেন "নায়েব, আমার ফুলপুর গাঁয়ের অনেক মানুষ ওই হরিহরপুরের ইটভাটায় কাজ করে না? সে গায়ে মড়ক লেগেছে, এই অসময়ে আমি উদ্ধার না করলে তাঁদের দেখবে কে বলো"।
- দেবতা, সাক্ষাৎ দেবতা।
- আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম; "জমিদারমশাই, আপনার দুশ্চিন্তা অমূলক নয়। কিন্তু এ গাঁয়ের অন্তত শ'খানেক লোক সে ইটভাটায় খাটে৷ এই ভরা বর্ষায়, ছোটখাটো ডিঙিনৌকার ভরসায় এতগুলো মানুষকে নদী পারাপার করাবেন কী করে"? তা শুনে জমিদার মশাই আমায় চোপা কী করে বললেন জান?
- কী বললেন তিনি আজ্ঞে?
- বললেন, "শোনো নায়েব, এ গাঁয়ের প্রতিটি মানুষ আমার সন্তান। আমার অতগুলো জোয়ান ছেলেপিলে ভীনগাঁয়ের মড়কে উজার হয়ে যাবে আর আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকব? রাধামাধব আমায় ক্ষমা করবেন তা'হলে? তুমি শোনো, তুমি এখুনি স্টীমারের ব্যবস্থা করো। আমি তাদের স্টীমারে করে গাঁয়ে ফেরত আনব"।
- মাটির মানুষ আমাদের জমিদারবাবু।
- কিন্তু আমি যে সেরেস্তার হিসেবকিতেব নিয়ে থাকা কেঠো মানুষ, ফের বুঝিয়ে বললাম; "আপনারএস্টেটের খান দুয়েক স্টিমার আছে বটে। কিন্তু তা দিয়ে রোজ জুটমিলে সাপ্লাই যায়। সে স্টিমার দিয়ে একটা গোটা দিন মানুষ বওয়ালে যে প্রচুর টাকা নষ্ট"৷ কিন্তু ওই, কে শোনে কার কথা। আমায় কী হুকুম করলেন জানো শিবু?
- কী বললেন তিনি কত্তা।
- বললেন " নায়েব, আমার সন্তানরা কষ্টে আছে। এ সময় আমি জুটমিলের সাপ্লাই নিয়ে ভাবব? রাধামাধব রাধামাধব! শোনো, তুমি কাল ভোরে নিজে স্টিমার নিয়ে গিয়ে হরিহরপুরের ঘাটে গিয়ে দাঁড়াবে। আর হরিহরপুরের ইটভাটায় এ গাঁয়ের যত লোক কাজ করে, তাদের সব্বাইকে স্টিমারে তুলে, তবে ফিরবে"।
- আর ক'দিন থাকলেই মড়ক আমাদেরও ছুঁয়ে ফেলত নায়েবমশাই। জমিদারমশাইয়ের অসীম কৃপা যে এ অসময়ে স্টিমার পাঠিয়ে আমাদের প্রাণ বাঁচালেন। নয়ত আমাদের পরিবারগুলো নয়ত সবই ভেসে যেত৷ আমরা তো গাঁয়ে ফেরার জন্য কম চেষ্টা করিনি, কিন্তু মড়কের গাঁয়ে আমাদের বাস বলে কোনও ফেরিনৌকাই আমাদের নিতে চায়না। আপনার মধুকে মনে পড়ে নায়েবমশাই?
- মধু...যার বাপ ঘরামী ছিল?
- আজ্ঞে। তা সে বেচারা দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে ভরা নদী সাঁতরে পেরোনোর তাল করলে। এই গেল হপ্তায়। যা হওয়ার হল,বেলা ফুরোনোর আগেই তাঁর দেহ ভেসে উঠল এই ঘাটের কাছেই।
- ইশ। দ্যাখো দেখি, গণ্ডমূর্খ আর কাকে বলে। জমিদারমশাই শুনলে ভারী ব্যথা পাবেন যে। যা হোক। যার যেমন কপাল।
- তা ঠিকই বলেছেন নায়েব মশাই। আচ্ছা, স্টিমার বিকেলের মধ্যে ফুলপুর ঘাট পৌঁছে যাবে। তাই না?
- তা যাবে। কেন বল দেখি?
- আজ হাটবার, না? সন্ধ্যের আগে পৌঁছলে ঘাটের হাট থেকে খোকার জন্য দু'টো জামা কিনতাম। আর বৌটার জন্য হাঁড়ি খুন্তিও যদি..।
- রস আর রসদ, তোমার দুইই আছে দেখছি শিবু
- হেহহে, ওই আর কী। আধপেটা খেয়ে টাকা জমাই, যাতে গাঁয়ে ফিরে চালডাল ছাড়াও সামান্য কিছু..। ছেলেবৌকে তো কিছুই তেমন দিতে পারিনা নায়েবমশাই। তবে হাতে ওই এ'বারে সতেরো টাকা মত জমেছে। হাট থেকে তাই..। আর তাছাড়া, একটা জরুরী ওষুধও এ'বারে নিয়ে নেব ভাবছি। ওই ঘাটের কাছের রস সাহেব ডিসপেনসারি থেকে এ'বার কিনে নেব'খন।
- ওষুধ?
- ওই, বেশ কিছুদিন হল আমার মাঝেমধ্যে শ্বাস আটকে আসে, চোখে অন্ধকার দেখি। আর বুকে সারাক্ষণ একটা বিচ্ছিরি জ্বালা জ্বালা ভাব। জ্বালাটা অম্বলের নয় তাও বুঝি, আরও গোলমেলে কিছু যেন। তা ছ'মাস আগে গঞ্জের এক ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন, যে ওষুধ মাস তিনেক খেলেই নাকি ও'সব অসুবিধে কেটে যাবে।
- তা এদ্দিন সে ওষুধ খাওনি কেন?
- আজ্ঞে, এ ইটভাটা সর্বস্ব পাড়াগাঁয়ে রস সাহেবের ডিসপেনসারি কোথায় পাই বলুন। আর সে'সব যে দামী ওষুধ। যখন দেখলাম টাকা কিছুটা জমেছে তখন থেকে আর ফুলপুরে ফেরাও হয়নি। তাই ভাবছি সুযোগ যখন পেয়েছি তখন হাটের থেকে কেনাকাটা করে চলে যাব রস সাহেবের ডিসপেনসারিতে। সে'খান থেকে ওষুধ নিয়ে তারপর বাড়ি।
- বাহ্, মড়কে বাস করেও বাবুর শখে জং পড়েনি।
- হেহহেহহে।
- আর দেরী নয়, স্টীমারে উঠে একটু আয়েশ করে বসো তো দেখি শিবু।
- যেয়াজ্ঞে।
- আর শিবু, শোনো। ভাড়াটা আমায় দিয়ে তারপর স্টীমারে উঠো, কেমন?
- আজ্ঞে?
- ফ্যালফ্যাল করে দেখছ কী৷ ভাড়া! ভাড়া! ভাড়াটা আমায় দিয়ে তারপর স্টীমারে উঠো।
- কিন্তু নায়েবমশাই..ভাড়া? ভাড়া লাগবে?
- দ্যাখো কাণ্ড,ভাড়া ফাঁকি দেওয়ার জন্য তুমিও ওই মধু পাগলার মত সাঁতরে ফেরার তাল করছ না তো? হা হা হা হা হা।
- কত?
- ভাড়া? ও সামান্যই। পাঁচ টাকা মাত্র।
- পাঁচ টাকা? কী বলছেন কী নায়েবমশাই৷ ফেরিনৌকা নেয় চার আনা।
- তা'হলে তুমি।ফেরিনৌকাই খুঁজে নিও শিবু৷ খামোখা স্টীমারে ওঠার শখ হয়েছে কেন?
- পাঁচ টাকা ভাড়া দেব আমরা? অত টাকা দেওয়ার মুরোদ কি আমাদের আছে নায়েবমশাই?
- হাটে ঘুরে কেনাকাটি করার শখ আছে৷ জমিদারের স্টীমারে গা এলিয়ে নদীর হাওয়া খাওয়ার ধক আছে। কিন্তু সামান্য পাঁচ টাকা ভাড়ার কথা শুনলেই বাবুদের গলা শুকিয়ে কাঠ। বলি, জমিদারমশাই কি স্টীমারখামা মাগনা খাটাবেন? একদিন জুটমিলের সাপ্লাই বন্ধ মানে কতটাকার লোকসান জানো? তিনশো টাকা। চোখে দেখেছ অত টাকা কোনওদিন? দেখোনি। কিন্তু জমিদারমশাই সে'সব লোকসান গায়ে না মেখে স্টীমার পাঠিয়েছেন তোমাদের দুঃসময়ে উপকার করতে৷ আর এই তার প্রতিদান? ভাড়া দেওয়ার বেলায় গায়ে ফোস্কা?
- কিন্তু অতগুলো টাকা...।
- খোকার জন্য জোড়া জামা, বৌয়ের জন্য নতুন হাঁড়ি-কড়াই; বাহা। বাহ্ বাহ্ বাহ্। এ'দিকে জমিদারের বাড়িতে সিঁদ কাটার ইচ্ছে। তোমার লজ্জা করে না শিবু? কই, তোমার আগে এতজন যে স্টীমারে এসে বসলে; তাঁরা তো অকারণ চেল্লামেল্লি করেনি। বাজে কথায় নষ্ট করার মত সময় আমার নেই৷ স্টীমার ছাড়ার সময় হল৷ ভাড়া দিতে না চাইলে ওই মড়কের গাঁয়ে ফেরত যাওগে, আমার মাথা খেওনা।
***
- হ্যাঁ গো..।
- ঘুমোওনি বৌ?
- তুমিও তো ঘুমোওনি।
- কিছু বলবে?
- খোকার জন্য দু'টো জামা আনলে। আমার জন্য নতুন হাঁড়ি, হাতা,খুন্তি৷ আর এতগুলো চুড়ি। কত খরচ হল বলো..।
- ধুস, ইটভাটায় পয়সা উড়ছে গো বৌ৷ পয়সা উড়ছে। হাতে বেশ ক'পয়সা জমেছিল। তাই ভাবলাম...তা, খোকার বেশ মনে ধরেছে জামা দু'টো, তাই না?
- খুব। সেই যে দু'টো জামা একসঙ্গে গায়ে চাপালো, ঘুমের মধ্যেও খুলতে দিচ্ছে না। পাগল।
- চুড়িগুলো তোমার পছন্দ হয়েছে বৌ?
- খুউব। হ্যাঁগো, এত খরচ করলে...তোমার সেই ওষুধ আনলে না?
- ওষুধ?
- ওই যে গো..তুমি বলতে না। হঠাৎ করে শ্বাস আটকে আসে, বুক জ্বালা, চোখে অন্ধকার...। গঞ্জের হাসপাতালের ডাক্তার তোমার বুকে যন্তর দিয়ে দেখেশুনে কী'সব দামী ওষুধ লিখে দিলে। তুমি বললে টাকা জমলেই সে'সব ওষুধ কিনে আনবে...।
- ওহ হো, বাবাজীর ব্যাপারটা তোমায় বলাই হয়নি, তাই না?
- বাবাজী? কী ব্যাপার?
- হপ্তাখানেক আগের ঘটনা বুঝলে। আমাদের হরিহরপুরের ইটভাটার আস্তানায় এক বাবাজী এসে হাজির হলেন; এক্কেবারে সোজা হিমালয় থেকে পায়ে হেঁটে হরিহরপুর।
- সোজা হিমালয় থেকে?
- তবে আর বলছি কী বৌ। চেহারায় যেমন তেজ, চোখে তেমনি মায়া। তা সে বাবাজী তো একরাত আমার ঝুপড়িতেই কাটালেন। আমার বানানো রুটি আর ডাল খেয়ে খুব খুশি হলেন। রাতে গল্পের ছলে তাঁকে আমার অসুখের কথাটা বললাম৷ বাবাজী শুনেই নিজের ঝুলি থেকে কী একটা শিকড় বের করে বললেন সে'টাকে তুলসীপাতা সঙ্গে বেটে খেয়ে নিতে।
- তারপর?
- আমি বাবাজীর কথা মত খেয়ে নিলাম। সত্যিই ধন্বন্তরি৷ ওই এক দাগেই আমার বুক জ্বালা, শ্বাসের কষ্ট এক্কেবারে গায়েব।
- এক্কেবারে? আমার গা ছুঁয়ে বলো।
- গা ছুঁয়েই তো আছি। তোমায় কি আমি কোনওদিন মিছে কথা বলেছি গো বৌ?
No comments:
Post a Comment