Tuesday, June 9, 2020

নন্দর তন্ত্রসাধনা

ব্যাপারটা যে আগাগোড়াই গোলমেলে তা নিয়ে আর নন্দর কোনও সন্দেহ রইলনা। বারুইপুর স্টেশনের কাছে চটিবইয়ের দোকান থেকে বাইশ টাকায় ১০১ তন্ত্র টোটকার মেডইজি গাইডবইটা কিনেছিল সে; নেহাত শখেরই বশে। এমন শিক্ষামূলক বইপত্র সে মাঝেমধ্যেই কিনে থাকে। ম্যাজিকের সহজপাঠ, জার্মান পদ্ধতিতে বাঙালি মাংস রান্না অথবা চটজলদি হোমিওপ্যাথি; এমন চিত্তাকর্ষক বই সে মাঝেমধ্যেই কিনে আনে। আর সে'সব বই পড়ে পড়েই তো পাড়ার ক্লাবের সান্ধ্য আড্ডায় নন্দর সবসময় একটা দাপুটে উপস্থিতি থাকে। 

পোস্টঅফিসের ক্লার্কের চাকরীটায় থিতু হওয়া সত্ত্বেও এখনও বিয়েটা সেরে ফেলা হল না। আজ নন্দর বাপ-মা বেঁচে থাকলে হয়ত একটা সম্বন্ধ দেখেশুনে একটা হিল্লে করে ফেলতেন; বত্রিশ বছর বয়সে তাঁকে এমন একা থাকতে হত না৷ 

যা হোক, একা থাকায় বিস্তর সুবিধেও আছে৷ এই যেমন তন্ত্রসাধনার বইয়ের খানচারেক পাতা পড়ার পরেই কেমন একটা নেশা ধরে গেল। গত তিনদিন সিকলীভ নিয়ে বাড়িতে বসে দিব্যি এ বই থেকে বিভিন্ন মন্ত্রতন্ত্র প্র‍্যাক্টিস করে যাচ্ছে সে। মনের মধ্যে বেশ কেমন একটা চনমনে ভাবও তৈরি হচ্ছে৷ একশো বারো পাতার বই, প্রথম দিন ঝড়ের গতিতে পড়ে শেষ করে ফেলেছিল সে। তারপর থেকে প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে পড়ছে, জটিল জায়গাগুলো বারবার আবৃত্তি করছে। বাড়িতে গেরুয়া বসন বলতে তেমন কিছু ছিলনা তাই একটা পুরনো গেরুয়া গামছা জড়িয়েই তন্ত্র অধ্যয়ন চালিয়ে যাচ্ছে নন্দ; টিশার্ট আর বার্মুডা পরে এমন গভীর কেতাব আত্মস্থ করা যায়না৷  

দিব্যি চলছিল সবকিছু।  রাতের কোন সময়ে সধবা মড়ার সিঁথি থেকে সিঁদুর নিয়ে তা'তে বাদুড়ের রক্ত আর জবাফুল পোড়ানো ছাই মিশিয়ে পুরিয়া বানিয়ে খেলে আড়াই বছর আয়ুবৃদ্ধি হবে, অমাবস্যার রাতে শ্মশানের মাটিতে গজানো কলমিশাক তুলে কুচনো বেগুন দিয়ে কীভাবে রান্না করে খেলে অন্তরাত্মার তেজ বাড়বে; এমন সব রসালো টোটকা তো ছিলই। পাশাপাশি ছিল বেশ কিছু ঘরোয়া টোটকার হদিশও। ঝাঁটা, কাটারি, কড়ি, হরতকি, সৈন্ধবলবণ, শাড়ির আঁচল থেকে কেটে নেওয়া টুকরো আর এমন শ'খানেক ঘরোয়া জিনিসপত্র দিয়ে যে কী অসাধ্যসাধন করা যায়; তন্ত্রের গভীরে না ঢুকলে তা বোঝা সম্ভব নয়।

বিভিন্ন গূঢ় মন্ত্রটন্ত্র আউড়ে বেশ চমৎকার দু'টো দিন কেটেছিল নন্দর। এত সহজে যে তন্ত্রশক্তি আয়ত্ত্ব করা যায় তা সে ভাবতেও পারেনি। তন্ত্রবলে দিব্যি ঘর ঝাড় দেওয়া, ঘর মোছা বা রান্নাবান্নার কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। এমন মহামূল্যবান সব বই কেন যে অমন সস্তা চটিবইয়ের দোকানে পড়ে থাকে। এই বইয়ের থেকেই এক দু'টো মন্ত্র আউড়ে নন্দ মনে এমন বল পেলো যে দিব্যিদৃষ্টিতে স্পষ্ট দেখতে পেল যে দক্ষিণপাড়ার সলিল দত্তর ছোটমেয়ে নির্মলার সঙ্গেই তাঁর বিয়ে হবে৷ তন্ত্রের সত্যকে তো আর মিথ্যে হতে দেওয়া যায়না, তাই নন্দ স্থির করলে যে সে নিজেই নিজের সম্বন্ধ নিয়ে সলিল দত্তর বাড়িতে হাজির হবে। তন্ত্রে পাওয়া আশ্বাস তো আর মিথ্যে হতে পারেনা৷ কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল সংসারে বাঁধা পড়ে আর কী হবে। তন্ত্রের স্বাদ একবার যে পেয়েছে, তাঁর মুক্তি তো শ্মশানে স্তব্ধতা আর অমাবস্যার অন্ধকারে। নির্মম গেরস্থালীতে আটকা পড়লে তাঁর চলবে কেন?

কিন্তু এই সাতপাঁচ ভাবনার মধ্যেই ঘটল সেই বিশ্রী গোলমেলে ব্যাপারটা। ঘরের কোণে পড়ে থাকা ঝাঁটাটা উড়ে এসে নন্দকে পেটাতে আরম্ভ করল। পেটাতে শুরু করল অথচ থামার নাম নেই।  এ'দিকে সে বইতে উড়ন্ত ঝাঁটার পিটুনি আটকানোর কোনও টোটকাও বাতলে দেওয়া নেই৷ 

আধঘণ্টা এক তরফা উড়ন্ত ঝাঁটার হাতে বেধড়ক পিটুনি খাওয়ার পর  রাগের চোটে নন্দ সেই তন্ত্র টোটকার বইটাকে ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দিল। ব্যাস, অমনি ঝাঁটা বাবাজীও ঠাণ্ডা। কী অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড। 

নাহ্, নন্দ ঠিক করলে যে তান্ত্রিক হওয়ার ব্যাপারটা আপাতত মুলতবি রাখতে হবে। যত্তসব বিটকেল ব্যাপার। তার চেয়ে বরং দক্ষিণপাড়ার দত্তবাড়ির ছোটমেয়েটির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে বিয়েথার ব্যাপারটা সেরে ফেললে একটা কাজের কাজ হবে৷ 

***

- গিন্নী, ছেলেটাকে এ'বার ছাড়ো। 

- সে আহাম্মককে একলা ছাড়ার উপায় আছে? নিজের কোনও ব্যাপার তাঁর বিন্দুমাত্র খেয়াল থাকে?

- আদরে যেমন বাঁদর করেছ, তেমনটাই তো ভুগতে হবে। 

- নন্দ তোমার ছেলে নয় যেন?

- আমি ওর বাপ। ওকে আলবাত ভালোবাসি। কিন্তু তা'বলে মরার পরেও চটিবইয়ের ভূত হয়ে ওর দেখভাল করাটা বাড়াবাড়ি।  অন্যান্য ভূতেরাও এ'সব বাড়াবাড়ি শুনলে ছি ছি করবে।

- বাড়াবাড়ি এ'টা?

- বাড়াবাড়ি নয়? নন্দর মনখারাপ হলে ম্যাজিকের চটি বই সেজে ওর পিছু নেওয়া। শরীর খারাপ হলে হোমিওপ্যাথির বই হয়ে ওকে টোটকা বাতলে দেওয়া। তন্ত্রের বইয়ের চেপে ওর বাড়ির কাজ করে দেওয়া, এগুলো বাড়াবাড়ি নয়?

- নন্দটা যে বড় একা গো। মা হয়ে আমি কী করে...।

- এ'বার অন্তর ওকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাও গিন্নী।

- সে ব্যবস্থাই তো করে এলাম এ'বারে। দত্তবাড়ির ছোটমেয়েটা বড় মিষ্টি। আর ও মনে মনে নন্দকে বেশ পছন্দও করে। নেহাত নন্দটা হাবলা তাই এদ্দিন টের পাইনি। ওই তন্ত্রের অছিলায় সে বুদ্ধি নন্দর মাথায় রেখে এসেছি।

- সে তো বুঝলাম, কিন্তু ওকে হঠাৎ ঝেঁটাপেটা করতে গেলে কেন?

- গবেট ছেলে ভাবছিল সংসার ছেড়ে তান্ত্রিক হবে৷ আমি দেখলাম এ তো উল্টোবুঝলিরাম। ব্যাস, ঝ্যাঁটা তুলে দিলাম আচ্ছা করে। ঘা-কতক পিঠে পড়তেই সব পাগলামি ঠাণ্ডা আর কী।