Thursday, July 30, 2020

ফারুক


ভাজা মৌরির মত মুচমুচে প্রেমে ঢলে পড়তে পড়তে,
দুপুরের নিশ্চুপ পুকুরপাড়ে প্রেমিকার হাত টেনে ধরে,
উত্তম বলেছিলেন
"শোনো, তুমি আমাকে বলো; ফারুক শেখ"।

**

লাইনের শুরুতেই দাঁড়িয়েছিলেন অমিতাভ।
অথবা অমিতাভ দাঁড়িয়েছিলেন বলেই  যেন সে লাইনের জন্ম। কিন্তু খানিক পরেই ভুল ভাঙল অমিতবাবুর। আর ভুল ভাঙতেই শ্যামলবাবুর গানের সুর তাঁর প্রাণে এসে ঠেকলো; " ও মন কখন শুরু কখন যে শেষ, কে জানে"। 

কারণ ততক্ষণে তিনি টের পেয়েছেন যে ওই মাদুরে গা এলিয়ে বসা মায়াবী মানুষটিকে স্পর্শ করে এমন সাধ্যি কোনও লাইনেরই নেই।

"T9999 - ওয়াহ্, ফারুকসাহাব। ওয়াহ্" বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অমিতাভ।

**

ট্রেন ছুটছিল? ছুটছিল।
এক প্ল্যাটফর্ম মানুষ থমকে ছিল? বিলকুল।
চলন্ত ট্রেনের একটা দরজায় শাহরুখ অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন? ছিলেন, দাঁড়িয়ে ছিলেন এক খতরনাক ধুকপুকের বোঝ বুকে নিয়ে। 

সে আসবে৷ ছুটে আসবেই। তাকে ছুটে আসতেই হবে।

কিন্তু ছুটে আসা প্রেমিকাকে দেখার আগেই ঘটে গেল গোলমালটা। প্ল্যাটফর্মের এক পানের দোকানের সামনে দাঁড়ানো, সাদা কুর্তায় উজ্জ্বল, খোশমেজাজি মানুষটির দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ শাহরুখ নেমে পড়লেন; 
"আরে, ফারুকবাবু না"?

**

উড়ে আসা সানগ্লাস ঐশ্বরিক ঘ্যাম নিয়ে গ্রহণ করলেন রজনীকান্ত। আচমকা ভেসে আসা একটা বেপরোয়া বুলেটকে টুথপিক ছুঁড়ে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে করে বাহবা কুড়োলেন তিনি৷ 

আর ঠিক তখনই..
পড়া থামিয়ে,কবিতার বইটা বুকের ওপর রেখে,
একটা শিস্ দিলেন ফারুকবাবু। 

সে শিস্ শুনে দিকভ্রান্ত বুলেটটি ফারুকবাবু কাছে এসে পোষা মৌমাছির মত ভনভন শুরু করলে৷

শেখসাহেবের বড় মায়া, শুধোলেন;
"তুমি কি বারুদ ছেড়ে সঞ্জীবে ঝুঁকেছ বাবু"?

বিমলবাবুর দরজা


- ও বিমলবাবু। ও বিমলবাবু। ও বিমলবাবু।

- কী চাই?

- দরজাটা খুলুন। তারপর তো কথা হবে।

- এত রাত্রে এমন হাঁকডাক শুরু করেছেন কেন?

- আরে মশাই আগে দরজাটা তো খুলুন।

- এই রাতবিরেতে? দুম করে দরজা খুললেই হল?

- আহা, আমি তো আর অচেনা কেউ নই। 

- যে'টুকু চিনি..ততটুকু যথেষ্ট নয়।

- চেনার কি কোনও শেষ আছে বিমলবাবু? নেই।

- দেখুন। এত রাত্রে আমি দরজা খুলব না। কভি নহি।

- এ এক অদ্ভুত জেদ। অভিমন্যুর মত। রথের ভাঙা চাকা বাগিয়ে সাতজন মহারথীকে ঠেকানো যায় বলুন? দরজা আপনাকে খুলতেই হবে।

- থ্রেট করছেন?

- অন দ্য কন্ট্রারি। আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

- যত বাজে কথা। দরজা আমি খুলব না।

- দরজা কি কাগজ? আমি কি এনআরসি? আচ্ছা বেশ। আমি না হয় দরজার এ'পাশেই বসে জিরিয়ে নিই খানিকক্ষণ। 

-  আচ্ছা ঘ্যাঁতা ইয়ে তো আপনি।

- আপনার ইচ্ছে করছে দরজা খুলতে।

- মোটেও না৷ খবরদার ম্যানিপুলেট করবেব না৷ ও দরজা আমি খুলব না। না, না, না। 

- আজ যে গোটা রাত আমাদের গল্পগুজব করার কথা বিমলবাবু।

- রাত্রে না ঘুমিয়ে আপনার সঙ্গে গল্প করব? আমি কি পাগল না প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চি?

- আপনি ভালোবাসিয়ে বিমলবাবু৷ ভালোবাসিয়ে। এ দরজা না খুলে আপনার উপায় নেই। 

- মাঝরাত্তিরে এ সব কী ধরণের বিটকেল ন্যাকাপনা মাইরি।

- যে ভালোবাসার মুহূর্তে আপনি আজ ফিরতে চাইছেন, তার জন্য যে আমি ছাড়া গতি নেই।

- আপনার মত থার্ডক্লাস কারুর হেল্প আমার চাইনা।

- ক্লাস বলে আমার কিছু আছে ভেবেছেন? কেউ ভাবে আমি ফোরটুয়েন্টি, কেউ বুক বাজিয়ে বলে আমি বাউল। কেউ হয়ত দিনের বেলায় আমায় 'শ্যালো, পাতি, ট্যু মেনস্ট্রিম' বলে নাক কুঁচকে পাশ কাটিয়ে যায়।  আবার সেই হয়ত রাত্রিবেলায় আমাকে সাদা ওয়াড়ে ঢাকা নরম পাশবালিশের মত বুকে টেনে নেয়। ক্লাস, জাত; সে'সব আমার থাকতে নেই।

- ও'সব হাবিজাবি কথায় আমার ব্রেন গুলিয়ে দেবেন ভেবেছেন? লাভ নেই। দরজা খুলব না। 

- আমি ছাড়া যে আপনার এ ব্যথার অ্যান্টিসেপ্টিক নেই বিমলবাবু।

- ব্যথা? ব্যথা আবার কীসের? দিব্যি ফুর্তিতে আছি। রাত্রে ইলিশের পেটি ভাজা দিয়ে আড়াই থালা ভাত খেয়েছি৷ 

- তবুও মনভার। চোদ্দ বছর আগের সেই মনখারাপ করা বিকেলে একবারটির জন্য ফিরতে না পারলেই নয়।

- খবরদার! বাড়াবাড়ি হচ্ছে।

- স্কুলের গন্ধ। জোড়া বিনুনি আর নীল স্কার্টের হুহু।  বাপুজি কেকের স্বাদ। খবরের কাগজের আজহারউদ্দিনের চারপাশ দিয়ে কাঁচি চালানোর মখমলে অনুভূতি। সে'দিনটায় ফিরে যেতে হলে আমি ছাড়া যে গতি নেই।

- সেই বিকেল? চোদ্দ বছর আগের বিকেল? সেই বিকেলেও আপনি ছিলেন। আপনাকে তখনও পাত্তা দিইনি। আজও দেব না।

- সে বিকেলের স্টক প্রাইস এমন হুহু করে বেড়ে যেতে পারে, সে'টা কি তখন আঁচ করতে পেরেছিলেন? বিমলবাবু?

- না মানে...।

- স্কুল শেষ। জোড়া বিনুনি হাওয়া। বাপুজি নাথুরামে। আজহার দুম করে অন্ধকারে। শুধু আমিই রয়েছি। দরজাটা খুলুন। 

- কিন্তু...আপনার জন্য দরজা খুলতে হবে...সে'টা আমি ঠিক..।

- ভাবতে পারেননি। জানি। আর এ'টাও জানি যে একা আমিই পারি ওয়ার্ম হোল হয়ে আপনাকে সে বিকেলে ফেরত নিয়ে যেতে। 

- সেই বিকেলে..সেই বিকেলে...।

- সে বিকেলে ফিরে যেতে না পারলে আপনার মুক্তি নেই৷ দরজাটা খুলুন।

***

মাঝরাত্তিরে পুরনো অবহেলিত গানেরা মানুষ শিকারে বেরোয়৷ 
এই যেমন আজ। এফএম চ্যানেলটা পাল্টাতে গিয়েও থমকালেন বিমলবাবু।

এর আগে বহুবার শুনেও পাত্তা না দেওয়া সাতপুরোনো  সস্তা গদগদে বলিউডি গানটাকে; 
মনের দরজা খুলে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।

শখ ও স্নেহ


শখ অতি খতরনাক ব্যাপার।
মেসের চৌকিতে এ'পাশ ও'পাশ করতে করতে সেই খতরনাক ব্যাপারটির খপ্পরেই পড়লেন রাধামাধব। 

রেলের কর্মচারী রাধামাধবের বাড়ি আসানসোলে, কলকাতার এই মেসবাড়িতে পড়ে থাকা শুধু চাকরীর দায়ে। অন্যদিনের মত আজও মেসের ঠাকুরের দায়সারা রান্নায় তিতিবিরক্ত হয়ে গজরগজর করতে করতে শুতে এসেছিলেন তিনি৷ অন্যদিনের মত আজও সে গজরগজরের রেশ কেটে যাওয়ার আগেই তার ঘুমিয়ে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু বাধ সাধল শখ। 

রাধামাধবের হঠাৎ গরম রসগোল্লা খাওয়ার শখ হল। ফুটন্ত শখের  দু'চামচ উৎসাহ এসে পড়লে কলকাতা শহরে উপায়ের অভাব হয় না। মেসের অনতিদূরে তেওয়ারি মিষ্টির দোকনখানা রাত দু'টো পর্যন্ত খোলা থাকে,  হালুইকররা সে'খানে কুস্তিগিরদের মেজাজে সর্বক্ষণ কর্মব্যস্ত। শখটাকে প্রথমে দাবড়ে চুপ করানোর চেষ্টা করলেন রাধামাধব,  মগজকে বোঝালেন; রাতবিরেতে এমন হ্যাংলামো অত্যন্ত অদরকারী৷ পাশের তাক থেকে পানমশলার কৌটো নামিয়ে মুখে দিলেন মনকে নরম করতে। কিন্তু তা'তেও কাজের কাজ কিছু না হওয়ায় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে, গায়ে ফতুয়া গলিয়ে, মানিব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লেন।

 শখের প্রাণে বিলম্ব ব্যাপারটা বিছুটির মত ঠেকে। তাই দ্রুত পায়ে তেওয়ারির দোকানে পৌঁছলেন তিনি। ক্যাশবাক্সে মাথা রেখে ঘুমিয়ে একটা বছর বারোর ছোকরা। ডাকতে মায়া হল। কিন্তু গরম রসগোল্লার সুবাসটুকু চিনতে ভুল করলেন না রাধামাধব।  খানিকক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছে, বাতাসে এখনও মিঠেভাব। সেই মিঠে বাতাসের সঙ্গে গরম রসগোল্লার সুবাস মিলে একটা মখমলে ভালোলাগা তৈরি হচ্ছিল। 

"এই যে" সম্বোধনে ক্যাশবাক্স আগলে রাখা ছোকরাটির ঘুম ভাঙানো গেল। 

"চারটে রসগোল্লা নিয়ে এসো৷ গরম দেখে আনবে"।

তিরিশ সেকেন্ডের মাথায় ছোকরাটি একটা প্লেটে চারটে রসগোল্লা সাজিয়ে নিয়ে এলো। 

প্লেটে সাজানো রসগোল্লাগুলোর দিকে তাকিয়ে খোকার কথা মনে পড়ল রাধামাধবের। বাড়ি ফেরার সময় খেলনা আর মিষ্টি নিয়ে যাওয়াটা রাধামাধবের অভ্যাস। চার বছরের খোকা খেলনার আগে ঝাঁপিয়ে পড়বে মিষ্টির বাক্সের ওপর। আর রসগোল্লা তো তাঁর অতি প্রিয়। 

খোকার কথা ভাবলে বুকের মধ্যে কেমন তিরতিরে কান্না ভেসে বেড়ায়৷ মাস গেলে মাত্র একবার দেখা,তাও মাত্র দু'দিনের জন্য। এমন নরম রসগোল্লা, খোকা কী ভালোই না খেত৷ খোকার মা নিশ্চয়ই মাঝেমধ্যেই তাকে রসগোল্লা কিনে খাওয়ায়। কিন্তু তবু, ইচ্ছে মত নিজের হাতে খোকাকে রসগোল্লা খাওয়াতে না পারার মনখারাপ যে কী প্রবল৷ বর্ষার মিঠে হাওয়া, গরম রসগোল্লার সুবাস আর ঝাপসা চোখ অত্যন্ত গোলমেলে কম্বিনেশন। 

- তোমার নাম কী খোকা?

- ভুটকাই। এই নিন রসগোল্লা। আর চারটে মিলে চল্লিশটাকা। 

- এই যে, টাকাটা।

- প্লেটটা নিন।

-  ভুটকাই, রসগোল্লা খাবি?

- কী?

- খাবি? রসগোল্লা? জানি,যে দোকানে গোটাদিন কাজ করিস, এ তো সে'খানকারই রসগোল্লা৷ কিন্তু খাওয়ানোর রকমফেরে স্বাদ এসপারওসপার হয়ে যায়। খাবি? আয়। আয়।

স্নেহ। স্নেহ অতি খতরনাক ব্যাপার। 
হতভম্ব ভুটকাইয়ের মুখে রসগোল্লা পুরে দিতে দিতে সে'টাই ভাবছিলেন রাধামাধব।

কবীরিয়ানি


- পুরস্কারটা পেয়ে কেমন লাগছে অপূর্ববাবু?

- কী বলব। এত বড় একটা সম্মান৷ সে'টাও মুখ্যমন্ত্রী নিজে আমার হাতে তুলে দিলেন। ভাবলেই এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

- মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আপনার নোবেল পাওয়া উচিৎ। আফটার অল, একটা গোটা রাজ্যের ভাগ্যপরিবর্তন ঘটেছে আপনার এই আবিষ্কারের হাত ধরে।

- আজ্ঞে..ইচ্ছেটা আমার মনেও যে ছিল না তা নয়। সুইটেবল ক্যাটেগরির অভাবে অ্যাপ্লিকেশনটা ফাইল করা গেলনা। যাকগে, বাংলার মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি৷ সে'টাই অনেক।

- শুনেছি গত সাতমাস ধরে ট্রায়াল চালিয়েছেন?

- প্যান্ডেমিকের বাজারে পাবলিক হেলথ নিয়ে তো আর ছেলেখেলা চলেনা। এই আবিষ্কার নিয়ে সাতটি স্তরে হিউম্যান ট্রায়্যাল চালিয়েছি। হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাকসেস রেট। একশোয় একশো।

- কবীরয়ানি নামটার পিছনে কোনও ইন্সপিরেশন? 

- ‘‘মায়ায় অন্ধ বসুন্ধরায় কেউ চেনেনা আমাকে। বাতাসও নই মাটিও নই, আমি শুধুই জ্ঞান। সবার ঊর্ধ্বে আমি শুধুই সুবাসের এক ফেরিওয়ালা’’। শুনেছেন তো?

- কবীরের দোঁহে?

- রাইট। তবে সামান্য ট্যুইস্ট করে চালাই৷ কবীর বলেছিলেন 'আমি শুধুই শব্দের এক ফেরিওয়ালা'। আমি বলি 'আমি শুধুই সুবাসের এক ফেরিওয়ালা'। কখন কোন ম্যাজিকে কাজ হয় তা কে বলতে পারে। কবীরে শব্দে কেল্লা ফতে করেছিলেন। আমি ফোকাস করেছি সুবাসে।

- আর সেই সুবাসে সমস্ত বাঙালি নিজের অসাবধানতা ঝেড়ে ফেলে জেগে উঠল। বাজার করে নিকেশ হয়ে যাবে; এই বিশ্রী বদনাম উড়িয়ে দিয়ে এখন বাঙালি গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য সচেতন। পরিসংখ্যানও তাই বলছে, করোনার দাপট বেশ কমে এসেছে আপনার আবিষ্কৃত বিরিয়ানি ফ্লেভারের হ্যান্ডস্যানিটাইজার বাজারে আসার পর।

- কবীরিয়ানি তো শুধু সুগন্ধ নয়৷ এক্কেবারে আদত ফ্লেভার৷ কবীরিয়ানিতে হাত কচলে মুলোশাক মাখা ভাত খেলেও যে কারুর মগজ আচ্ছন্ন থাকবে খাঁটি কলকাতা বিরিয়ানি মার্কা ভালোবাসায়। আর সেখানেই মানুষ কনভিন্সড হয়েছেন, বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন কবীরিয়ানিকে। রোজ রোজ গলায় মাস্ক ঝুলিয়ে, ঠেলাঠেলি করে ভালোমন্দ বাজার করার হ্যাপা নেই। টোটাল নিশ্চিন্দি। আমার এই হ্যান্ডস্যানিটাইজার হাত ডলে ভাতেভাত খেতে বসেও সবাই 'বহুত খুব, নাজুক' বলে টেবিল চাপড়াচ্ছেন। বাজারের ভীড় কমে যাওয়ার গোটা রাজ্যে এখন প্রবল ডিসিপ্লিন, তাই না?

- একদম। তাছাড়া, থ্যাঙ্কস টু ইওর আবিষ্কার, কারণে অকারণে অফিসে, রাস্তায়, বাড়ির সোফায়;  সবাই এখন মাঝেমধ্যেই কবীরিয়ানি বের করে হাত কয়েক ফোঁটা ঢেলে নিচ্ছে। এ'টাই মনভালো করার সবচেয়ে সহজ ফর্মুলা। অনেকে বলছেন যে মনে ফুরফুর আনতে আপনার এই হ্যান্ড স্যানিটাইজার নাকি সিঙ্গল মল্টের চেয়েও বেশি এফেক্টিভ।

- হেহ্। হেহ্।

- ইফ আই মে আস্ক, শুনেছি প্রধানমন্ত্রী নিজেও নাকি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন৷ 

- নিজের মুখে আর কী বলব বলুন। আমি পাতি মানুষ, সবার ভালোবাসায় এক্কেবারে ভেসে যাওয়ার উপক্রম। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন৷ নিরামিষ খাইয়েদের জন্য একটা নতুন স্যানিটাইজারের কথা ভেবেছি; ধোকলাইজার। অবিশ্যি সে'টার হিউম্যান ট্রায়াল শুরু হতে এখনও দেরী আছে। তবে করোনায় কাবু এই অন্ধকার সময়ে; গোটা দেশে যদি ডিসিপ্লিন, স্বাস্থ্য সচেতনতা আর পরিতৃপ্তির একটা ঢেউ ছড়িয়ে দেওয়া যায়, ক্ষতি কী বলুন?

Saturday, July 25, 2020

বিপ্লবের ঘুম


- ডাক্তার।

- হুম...।

- ডাক্তার!

- হুঁ।

- ডাক্তার চৌধুরী! ব্যাপারটা কী?

- ওহ। সরি বিপ্লববাবু। সরি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।

- চুপ করে রয়েছেন অনেকক্ষণ।  তাই ভাবলাম...দেখুন...আপনি আমার কাউন্সেলর..আপনিও যদি চুপ থাকেন..।

- আসলে...কী বলব সে'টা ঠিক..। আপনার কথাগুলোই প্রসেস করার চেষ্টা করছিলাম..।

- ওহ। আই সী৷ 

- আপনার ধারণা...।

- ধারণা?  রিয়ালিটি৷ অবিশ্যি, অনেকগুলো রিয়ালিটির একটা। 

- লেট মী সামারাইজ। আপনার ধারণা প্রতিবার ঘুম থেকে ওঠার পর আমাদের একটা নতুন জীবন শুরু হয়।

- দ্যাট ইজ করেক্ট।

- অর্থাৎ আমি আজ রাত্রে ঘুমোতে গেলাম ডাক্তার রীতা সান্যাল হিসেবে। আমার ধারণা আমি আগামীকাল সকালবেলা আমার সাদার্ন এভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে; ঘুম থেকে উঠে, ব্রেকফাস্ট সেরে চেম্বারে এসে বসব, বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে টেনিস খেলতে যাব। কিন্তু আদতে কাল সকালে আমার ঘুম ভাঙবে সম্পূর্ণ অন্য একটা জগতে।  যে'খানে বয়স, শরীর, চেহারা সব এক থাকলেও আমার পরিচয়, মন ও চারপাশটা একদম আলাদা। আগামীকাল হয়ত আমাত ঘুম ভাঙবে বাঁকুড়ার সুতপা দত্ত হিসেবে,  হাইস্কুল টীচার। আর আমার আগের দিনের ডাক্তার রীতা সান্যালের স্মৃতি সমস্ত ধুয়েমুছে সাফ। বরং ঘুম ভাঙার পর আমার মাথার মধ্যে গোটা জীবন সুতপা দত্ত হয়ে থাকার স্মৃতি মজুত থাকবে। 

- একদম। তবে শুধু বাঁকুড়ার সুতপা দত্ত কেন, আফ্রিকার কোনও এক দেশেও আপনার ঘুম ভাঙতে পারে। এমন দেশও হতে পারে যে'টার অস্তিত্ব আপনার এই কলকাতার চেম্বারওলা জগতে নেই। সে'টাই প্রসেস।

- প্রতিটি মানুষ প্রতিদিন প্রতিবার ঘুম থেকে ওঠার পর এই মেটামরফোসিসের মধ্যে দিয়ে যায় কিন্তু কেউই সে'টা টের পায় না।

- ইনফাইনাইট নাম্বার অফ প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস। ঘুম ভেঙে কখন কোন দুনিয়ায় কী রোলে অবতীর্ণ হতে হবে, কেউ ঠাহর করতে পারেনা। করতে পারার কথাও নয়। সবারই ঘুম ভাঙে একটা কন্টিনিউয়িটির বোধ নিয়ে। কিন্তু সবই ফাঁপা, প্ল্যান্টেড।

- প্ল্যান্টেড? ঈশ্বর? 

- সফটওয়্যার হলেও হতে পারে৷ আমি তো বিশারদ নই ডাক্তার। শুধুই একটা বাগ ইন দ্য সিস্টেম। ভুক্তভুগী।

- বাগ, কারণ আপনার ক্ষেত্রর ঘুমের পরেও আগের স্মৃতিগুলো মুছে যাচ্ছে না। 

- গতকাল আমার নাম ছিল আবিদকেহ, ধেজসিসব বলে একটা শহরে উটের মাংসের ব্যবসা করতাম। প্রায় র‍্যাগস টু রিচেস স্টোরি। বশেকুয়াক ভাষায় কথা বলতাম। এই শহর আর ভাষা কোথায় আছে জানতে চেয়ে লজ্জা দেবেন না। তার আগের ঘুমের আগে আমার নাম ছিল হান্স। মগজে ছিল অন্য একটা জীবনের গল্প। মাস দেড়েক আগে একবার কলকাতার বাঙালি হয়ে একটা দিন কাটিয়েছিলাম বটে। নাম ছিল রজত মল্লিক।

- ঘুম ভাঙার পর আগের জীবনের স্মৃতি মুছে গিয়ে মাথায় নতুন একটা জীবনের স্মৃতি এমনভাবে প্ল্যান্ট হওয়ার কথা যাতে আড়মোড়া ভাঙা মানুষটির মনে হয় যে এই নতুন জীবনেই সে আজন্ম রয়েছে৷ রাইট? কিন্তু যেহেতু আপনি সিস্টেমের বাগ, সেহেতু আপনার মনের মধ্যে...।

- কয়েক হাজার জীবনের স্মৃতি স্পষ্ট হয়ে আছে। জাতিস্মরদের কথা ভাবুন ডাক্তার৷ গতজন্মের কথা মনে পড়াটা কিন্তু আদৌ কোনও সুপারপাওয়ার নয়, সে'টা বরং একটা অপরিসীম যন্ত্রণা। থিওরেটিকাল লেভেলে সোনার কেল্লার মুকুলের কথাই ভাবুন না। এ জন্মে নিজের বাবা মায়ের সঙ্গে কনেক্ট করতে ওর অসুবিধে হচ্ছিল কেন? কারণ পূর্বজন্মের বাপ, মা, ছেলেবেলার স্মৃতি এসে এই জন্মের রিয়ালিটিকে গুলিয়ে দিয়েছিল৷

- রাইট। আপনার ব্যাপারটাও অনেকটা ওই জাতিস্মরের মতই..।

- তফাৎ একটা আছে। প্রতিবার ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে একটা গোটা জীবনের স্মৃতি আমার মনের মধ্যে জুড়ে যায়৷ সে এক নিদারুণ যন্ত্রণা ডাক্তার। কয়েক হাজার বাপ মায়ের স্নেহ, কত প্রেম, কত বন্ধুত্ব, কত জীবনসঙ্গী৷ কত অন্যায়ের স্মৃতি। কত অপরাধবোধ।  

- বিপ্লববাবু, আমি হয়ত বুঝতে পারছি আপনার যন্ত্রণাটা কতটা গভীর।

- সে জন্যেই তো আপনার কাছে আসা ডাক্তার৷ ঘুম পেলেই ভয়ে বুক কাঁপে। কোনও জীবন ভালো লাগলে দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু একটা সময় তো চোখের পাতা লেগে আসবেই। তাই না?

- সে জন্যেই আমার কাছে আসা? ঘুমোতে যাওয়া নিয়ে ডিলেমা? 

- খুলেই বলি৷ এ জীবনের মেয়াদ কয়েক ঘণ্টার বেশি তো নয়, ভণিতার আর অবকাশ কই। আর ডাক্তারের বদলে না হয় রীতাই বলি। দেখো রীতা, বেশিরভাগ জীবনেই আমার পাশে তুমি থাকো। আর যে জীবনগুলোয় তুমি থাকোনা, তোমার খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। ঘুম ভাঙতেই দেখি পাশে তুমি আছ কিনা। মাঝেমধ্যে অন্য কাউকে দেখি,  তখন কুঁকড়ে যাই, সুযোগ খুঁজি ফের ঘুমিয়ে অন্য জীবনে পৌঁছে যাওয়ার। 

- এ'বার ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায় চলে যাচ্ছে বিপ্লববাবু। 

- প্রায়ই তুমি আমারই পাশে লেপ্টে থাকো। অথবা পাশের ঘর থেকে তোমার গুনগুন শুনতে পাই, বুঝি আমার হয়েই আছ। আর ঘুম ভেঙে তোমায় আশেপাশে না পেলে? তোমায় খুঁজতে বেরোই। কত জীবন প্রাণপণে খুঁজেও তোমার দেখা পাইনি।  কতবার এমনও হয়েছে তোমায় অন্য কারুর হয়ে থাকতে দেখেছি। চুরমার হই বটে কিন্তু জানি, বেশিদিন তোমার থেকে দূরে থাকতে হবে না। কয়েক ঘুম দূরেই তুমি আছ। আমি ছাড়া তোমারও কোনও গতি নেই। কোনও নতুন দেশে তোমায় জড়িয়ে ধরে ঘুম ভাঙবে, এ ভরসাটুকু তো থাকেই। 

- দেখুন বিপ্লববাবু। আপনি একটা আস্ত ফ্রড! আর রীতিমতো অসভ্য একজন মানুষ।

- এ জীবনে তুমি আমায় আগে দেখোনি। অথচ তোমার পিঠের ওই তিলের ত্রিভুজটার কথা আমি জানলাম কী করে?

- বেরিয়ে যান। এখুনি।

- প্লীজ রীতা। এ'বারে সাতসাতটা ঘুম পেরিয়ে তোমার দেখা পেয়েছি। তাও নিজের করে নয়। অমন ভাবে দূরে ঠেলে দিও না। 

- গেট আউট।

- আমাদের কত নাম রীতা। কত বাড়ি, কত জড়িয়ে ধরা মুহূর্ত।  কত রঙিন পৃথিবী আমরা ভাগ করে নিয়েছি।  এই পৃথিবীর একটা গান...আমাদের জন্য যে কী প্রবল ভাবে সত্যি। 'যতবার তুমি জননী হয়েছ ততবার আমি পিতা'।

- বিপ্লববাবু, আপনি এখনই আমার চেম্বার থেকে বিদেয় না হলে আমি সিকিউরিটি ডেকে আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিতে বাধ্য হব।


***

- কী গো! ওঠো!

- উম!

- আরে আর কত ঘুমোবে। 

- পাশে এসো একটু।

- ন্যাকাপনা।  শনিবার তোমার অফিস ছুটি, আমার নয়। ওঠো এ'বার। 

- মিতুল, পাশে এসো না। প্লীজ।

- ধুস। এমন ভাব দেখাও মাঝেমধ্যে যেন সাতজন্ম পর দেখছ। গা জ্বলে যায়।

- তা প্রায় সাত জন্মই হবে। ইনফ্যাক্ট, গত জন্মে তুমি বড় নির্মম ভাবে আমায় ঘাড় ধাক্কা দিয়েছ।

- কী যে আজেবাজে সব গপ্প ফাঁদো তুমি মাঝেমধ্যে। ধেত্তেরি। 

- তুমি টেনিস খেলবে মিতুল?

- জীবনে র‍্যাকেট ধরিনি। আমার ওই লুডোই ভালো। 

- পিঠে তিলের ত্রিভুজ থাকলে টেনিসে গ্র‍্যান্ডস্ল্যাম লাভ হয়। লেগে পড়ো।

- তুমি একটা আস্ত পাগল। ঠিক আছে, ঘুমোও আরও।

- নাহ্, ভাবছি দিন তিনেক না ঘুমিয়ে থাকব। তোমায় জাপটে।

প্যান্ডেমিকের পুজোর প্ল্যান


- কী ব্যাপার ছোটকা? ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে মেডিটেট করছ নাকি?

- জুলাই মাস শেষ হতে চলল রে নিতাই।

- তা'তে কী?

- বছর এই সময়টা..।

- এই সময়টায় কী?

- এই সময় আমার বসকে তেল দেওয়ার কথা। বস নাচতে বললে ধেইধেই করব, বাজে চুটকি বললে হেসে গড়াগড়ি খাব, বসের ক্যাটক্যাটে রঙের বিশ্রী শার্ট দেখে বলব 'লুকিং অসাম'।

- বসকে তেল? ও মা, তুমি নাকি কেরিয়ারের জুজুকে পাত্তাটাত্তা দাও না৷ তা'হলে আবার আপিসিও তৈলমর্দন কেন?

- কেরিয়ার? প্রমোশনটমোশনের তোয়াক্কা? তা আমি সত্যিই করিনা। একার সংসার। ইএমআইয়ের ফাঁদে পা দিই না।  বসের তোয়াক্কা আমি করবই বা কেন? তবে...।

- তবে?

-  তবে পুজোর ছুটি আদায় করার জন্য আমি  মা কালীর পায়ে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো ঠেকিয়ে নিতেও হেসিটেট করব না। বসকে তেল তো কুছ ভি নহি।

- ও। তা, তুমি বুঝি জুলাই মাস থেকে বসকে তেল দেওয়া শুরু কর? পুজোর ছুটি আদায়ের জন্য?

- শুরু করি জুন থেকে। মালিশ করে করে তাঁর ঘেউঘেউ মেজাজ নরম করে মিউমিউতে আনতে মাসখানেক লাগে। আর তারপর শুরু হয় রিয়েল স্ট্রাগল। 

- লেট মি গেস। আইআরসিটিসির ওয়েটিং লিস্ট?

- পেরেকের মাথায় ঘা দিয়েছিস। এই সময়টায় শিলিগুড়িমুখো সমস্ত ট্রেন ওয়েটলিস্টে থাকার কথা। মেজদা রেলের বড় অফিসার, ওর কাছে দু'দিন রাবড়ি নিয়ে যেতে হবে। যদি একটু বলেকয়ে কনফার্ম করাতে পারে। ওর আবার বড় বেফালতু আইডিয়ালিজমের বাতিক। মেজদার রাবড়ি ফেল করলে লাটুগুণ্ডার কাছে রামের বোতল নিয়ে যাওয়া। 

- লাটু? বোমা বাঁধতে গিয়ে যার..?

- লাটুর নিজের ডানহাতটা নেই বটে। তবে ও পাড়ার এমএলএ'র রাইট হ্যান্ড। লাটু চাইলে হিল্লে একটা হয়েই যায়। জুলাইয়ের মধ্যে টিকিটের ব্যাপারটা ফাইনাল হলেই মন ফুর্তিতে ডগমগ। তখন জমে অন্য খেল, দ্য গ্রেটেস্ট পুজো কনানড্রাম। 

- পাহাড় না জঙ্গল...তাই তো?

- ইউ আর আ ব্রাইট চ্যাপ নিতাই। এই জন্যেই যখনই আমি পাঁঠা কষাই; তোকে ডাকি৷ 

- পাহাড় আর জঙ্গলের হিসেবটা কী'ভাবে ম্যানেজ করো?

- নট ইজি। নিজের মনের মধ্যে ডুবসাঁতার দিতে হয়। নিজের মেজাজকে অ্যানালাইজ করতে হয়, বুকের ধুকপুককে ডিকোড করতে হয়। কখনও নিজেকে দাদার কীর্তির কেদারের সঙ্গে আইডেন্টিফাই করি; ওই যে, 'স্বপ্নের নেচারটা ফোকাস'। তখন বুঝি যে এ'বারে পাহাড়ের ভাবগম্ভীর স্নেহ ছাড়া গতি নেই। আবার কোনও বছর নিজের মনের গভীরে পৌঁছে টের পাই যে আমি ওই সাহেব সিনেমার গোলকিপারের মত অস্থির হয়ে আছি; এ'বার জঙ্গলের মায়ায় নিজেকে বেঁধে না ফেললেই নয়। এই গোটা প্রসেসটা যেমন পোয়েটিক, তেমনই মিউজিকাল। 

- আর এ'বারে সেই কবিতা আর সঙ্গীত দু'টোই গেল জলে।

- রাস্কেল করোনা। নিনকমপুপ। হাড় জ্বালিয়ে ছাড়লে। কবিতা ডকে আর সঙ্গীত গোল্লায়৷ জুলাই শেষ হতে চলল অথচ পুজোয় ছুটি বাগানোর কোনও গা নেই। বসের গাম্বাট ঠাট্টাগুলো শুনলেই গা চিড়বিড়িয়ে উঠছে। ব্রাউজারে আইআরসিটিসি টাইপ করলেই কান্না পাচ্ছে৷ মেজদা রাবড়ির আব্দার করে ফোন করেছিল, ওর শুগার তুলে খোঁটা দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছি৷ লাটুকে দেখলেই ইচ্ছে করছে কান মলে দিতে। 

- খুবই চিন্তার ব্যাপার ছোটকা।

- ক্যাটাক্লিজমিক কেস। জুলাই শেষ হতে চলল। কোথায় এখন স্টলে গিয়ে পুজোবার্ষিকী আনন্দমেলার খোঁজ করব! তা না! পুজোয় কী ব্র‍্যান্ডের অক্সিমিটার কিনব সেই ভেবে হদ্দ হচ্ছি। 

- মনখারাপ? খুব? ছোটকা?

- বুঝলি নিতাই, পড়াশোনায় চিরকাল মিডিওকার ছিলাম। প্রেম ব্যাপারটাও ঠিকঠাক এক্সেকিউট করতে পারলাম না। এখন কলম পেষাই করে মাসমাইনে আদায় করি৷ এক্সট্রা কারিকুলার বলতে লবডঙ্কা।  জীবনে একটাই পয়েন্ট অফ এক্সেলেন্স ছিল; পুজোর ছুটির প্ল্যানিং। এই করোনার খপ্পরে পড়েও সে'টা গেল কেঁচে। গুরুদক্ষিণা সিনেমায় সুগায়ক ভালোমানুষটি যখন গাইতে চেয়েও গাইতে পারছেন না; সে না পারার যন্ত্রণাটা যে কী অপরিসীম তা আজ আমি ঠাহর করতে পারছি৷

Thursday, July 23, 2020

প্যান্ডেমিক


- ধুর শালা প্যান্ডেমিক! উফ!

- যা বলেছ ভায়া। প্রাণ ওষ্ঠাগত এক্কেবারে।

- কী খতরনাক ভাইরাসের পাল্লায় যে পড়লাম..।

- এক্কেবারে হুলুস্থুল অবস্থা। তাই না?

- গোড়ার দিকে কিছুতেই ঠাহর করতে পারিনি যে জল এদ্দূর গড়াবে।

- গভর্নমেন্টই ঘোল খেয়ে গেল হে। আমরা তো টোটাল আতিপাতি আর আলটিমেট এলেবেলে। 

- গভর্নমেন্টকে দোষই বা দিই কী করে বলো। এমন ক্যালামিটি এই সেঞ্চুরিতে আগে কেউ কি দেখেছে? বিলেত আমেরিকা টলে গেল, আমরা কোথাকার কোন হরিদাস পাল। তা ভায়া, ভ্যাক্সিনের খবর কিছু শুনেছ? আশার আলো আছে কিছু?

- কানাঘুষো যা শুনছি..তা খুব একটা কনফিডেন্স ইন্সপায়্যারিং নয়৷ অন্তত বছর দুয়েকের আগে তো তেমন কোনও আশা দেখছি না...।

- দু'বছর? দু'বছর ফেসমাস্ক না পরে থাকতে হবে?

- যে দেবতা যাতে তুষ্ট। মাস্ক পরলেই এই ভাইরাস এসে ক্যাঁক করে ধরবে। এমন খতরনাক ব্যাপার যে হতে পারে তা কেউ কোনওদিন ভাবতে পেরেছিল?

- সত্যিই, একটানা মাস্ক না পরে থাকা, সে যে কী অস্বস্তিকর।  মনে হয় যেন উলঙ্গ হয়ে ঘোরাঘুরি করছি৷ রাত্রে তো ঘুমই আসতে চায়না। মাঝেমধ্যে পাশবালিশ দিয়ে মুখ নাক ঢাকি বটে কিন্তু দুধের স্বাদ কি ঘোল চেটে মেটানো যায় বলো।

- গিন্নীকে দু'টো কাঞ্জিভরমের মাস্ক দিয়েছিলাম, জলে গেল। তবে শুধু তো সে'টুকুই নয়৷ মাস্ক ইন্ডাস্ট্রি যে পথে বসেছে। ইকোনমি গেঁজে যেতে বসেছে৷ চারদিকে হাহাকার। এ যে কী দুর্যোগ! 

- সত্যিই৷ রোজ সকালে উঠে মনে হয় যেন কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছি। এই দেখ, চারপাশের সবকিছু রিয়েল কিনা ভেরিফাই করতে গিয়ে নিজের গায়ে এমন রাম-চিমিটি কেটেছি যে কালশিটে পড়ে গেছে।

- আহা রে। 

- আর সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা শুরু হয়েছে এই রোজ রোজ বাজার যাওয়া। ব্যাটাচ্ছেলে প্যান্ডেমিকের পাল্লায় পড়লাম  সমস্ত হোমডেলিভারি বন্ধ। বাপের জন্মে ভাবিনি যে এমন এক থার্ডক্লাস ভাইরাসের পাল্লায় পড়তে হবে যাকে আটকানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে মানুষের গিজগিজে ভীড়ে গিয়ে মেশা। উফ! ডিসগাস্টিং টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি।

- সত্যিই ভাবা যায়না। কী ডেঞ্জারাস ব্যাপার। রাস্তায় বেরোলেই বুক কাঁপছে।  প্রতিবেশী টু হাফ-চেনা পুলিশদাদাটি; যে কেউ গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে  কোলাকুলি করার জন্য। আহ্, ভাবলেই গা শিউরে উঠছে,গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। 

- সত্যিই। এ যন্ত্রণা আর নেওয়া যাচ্ছে না ভাই। তিন মাস ধরে মেগা সাইজের সব প্যান্ডেল দাঁড় করিয়ে পুজো হচ্ছে স্রেফ ভীড় জেনারেট করতে। বিজয়া আদৌ আসবে কিনা, আসলে কবে আসবে; কেউই জানে না।আর আজকাল তো লকডাউন ব্যাপারটাকেই অবাস্তব এক ইতিহাসের মত মনে হয়।

- এই একটানা পুজো হল আর একটা মেনেস! কী গা ঘিনঘিনে ব্যাপার। মোবাইলে পুজো অ্যাপের বোতাম ফিঙ্গারপ্রিন্টে অ্যাক্টিভেট না করে বারোয়ারী প্যান্ডেলে,  হাতে ফুল চটকে, ভীড়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কম্পালসরি অঞ্জলি দেওয়ার এই যে ন্যাকাপনা; তা কহাতক বরদাস্ত করা যায়? আর তার ওপর গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া হয়েছে এই ওয়ার্ক ফ্রম অফিস। 

- তা আর বলো কেন। ভাবতে পারো...ওয়ার্ক ফ্রম অফিসের জ্বালায় উইকডেতেও রাস্তাঘাটে রীতিমতো ট্র‍্যাফিক জ্যাম হচ্ছে? দিনে দিনে আর কত দেখব? 

- নাহ্। মনখারাপ ক্রমশ গভীর হচ্ছে ভায়া। শুধু আমার একার নয়, চারদিকেই এক অবস্থা। দেখো কপালে আর কত কী আছে। কবে শুনব ডিজিটাল বুকক্রিকেট-টুকুও ব্যান করে দেওয়া হবে। শুনেছ তো, নতুন স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে দেশের প্রতিটি শহরে। 

- স্টে...স্টেডিয়াম? এ কোন মান্ধাতা আমালে আমরা ফিরে যাচ্ছি? শেষে কি আমরা ডার্ক-এজের মত কাঠের ব্যাট আর চামড়ার বল দিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করব?

- করব। এবং জোর করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে মানুষকে স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হবে সে'খেলা দেখার জন্য। আর সে'খানেই শেষ নয়। তোমার পেয়ারের নেটফ্লিক্সও জলে গেল বলে। নেটফ্লিক্সের জন্য মানুষ বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না, তাই রাস্তায় ভীড় তৈরি হচ্ছে না আর তার ফলে বেড়ে চলেছে ভাইরাসের অত্যাচার।

- নাহ্। এ অসহ্য৷ আর কয়েকমাসের মধ্যে বাজারে ভ্যাক্সিন না এলে...।

- না এলে?

- রিভোল্ট করব! সরকারি নির্দেশ অমান্য করব। অন্তত একটা টোকেন প্রটেস্ট করবই।

- প্রতীকী প্রতিবাদ? কী'রকম?

- হপ্তায় তিনদিন বাধ্যতামূলক ফুচকা খাওয়া? ভীড়ে দাঁড়িয়ে? লাইন দিয়ে? মানছি না! মানব না! আর দু'মাস অন্তর পুরী বা দার্জিলিং গিয়ে লাফালাফি? নেভার।  কভি নহি!

হেবো গুণ্ডার হবু স্যাঙাৎ

- নাম?

- আজ্ঞে, অনিন্দ্য।

- ঝাঁজ নেই।

- আজ্ঞে?

- নামে ঝাঁজ নেই। অমন নেতানো নাম নিয়ে বড় জোর বেনামি জমির দালালি করা যেতে পারে,গুণ্ডামি নয়। হেবোগুণ্ডার স্যাঙাৎ হতে হলে নামে ধার চাই হে।

- অমন বলবেন না হেবোদাদা। অমন বলবেন না। বড় আশা করে এসেছি আপনার কাছে। গুগল দেখে বোমা বানানো শিখেছি, একলব্য হয়ে ঘরে বসে নিজের খাটের তোষকে ছুরি ঢোকানো প্র‍্যাক্টিস করেছি৷ সবই শুধু আপনার কথা ভেবে। বড় সাধ, একদিন আপনার চরণে নিজেকে সঁপে দেব। বড় সাধ। 

- সে কত লোকের কত রকমের সাধ হয়। কেউ চায় ওবামার সঙ্গে বসে লুডো খেলতে, কেউ চায় মুকেশ আম্বানির ক্যাশিয়ার হতে। চাইতে তো ক্ষতি নেই চাঁদ৷ কিন্তু রামকৃষ্ণ না অনুপম কে একটা বলে গেছে; সব পেলে নষ্ট জীবন।

- একবার যখন আপনার দেখা পেয়েছি হেবোদাদা , ওই শ্রীচরণের আশ্রয় ছেড়ে আমি আর নড়ছি না।

- আইআইটির ক্যাম্পাসে ঘুরতে গেলেই কি আইআইটির একজন হওয়া যায় রে পাগলা? সবুজ ঘাসে গড়াগড়ি খেলেই কি জন্টি রোডস হওয়া যায়? যায় না। আমার আশ্রয়ও ঠিক তেমনই৷ কত খতরনাক খুনী মাস্তান আমার পিছন পিছন ঘুরঘুর করছে। এই তো সে'দিন এক সিরিয়াল কিলার এসে হত্যে দিয়ে পড়ল। কিন্তু..।

- কিন্তু?

- ঘুরঘুর করলেই হল নাকি? আমার স্যাঙাৎ হতে চাইলে থাকতে হবে হাইভোল্টেজ কিলার ইন্সটিঙ্কট৷ মামুলি দশ বিশটা খুন করলেই হল না, ঘ্যাম থাকতে হবে৷ 

- ও নিয়ে ভাববেন না। এ তুলোতুলো নাম পাল্টে ফেলে জংধরা পেরেক মার্কা কিছু একটা রাখব'খন। ফাটাবাঁশ বা আসমানিবেল্লিক গোছের কিছু চলবে?

- বেশ। নামের ব্যাপারটা না হয় কিছু একটা ভেবে দেখা যাবে। কিন্তু শোন, স্যাঙাৎ গভীরভাবে নৃশংস না হলে আমার   চলবে না যে।

- আমি প্রচণ্ড নৃশংস তো। প্রচণ্ড।

- প্রচণ্ড?

- মাইরি হেবোদাদা। মাইরি।

- নৃশংসতায় আমার মন গলানো সহজ নয়৷ ওই যে বললাম, খুনোখুনি ভাংচুর করলেই হবে না৷ 

- আমি যে কী চিজ..।

- শুনি...।

- আমি বিরিয়ানিতে কড়াইশুঁটি আর শসাকুচি ফেলে খাই।

- ইইইইকী...।

- আমি গল্পের বইয়ের পাতায় মাসকাবারির ফর্দ লিখি। তাও স্কেচপেন দিয়ে। 

- না না..না..না। না!

- আমি কেসি দাসের রসগোল্লা চেবানো তৃপ্ত মানুষের কানে ফিসফিস করে কেসিনাগের খটরমটর অঙ্ক আবৃত্তি করে শোনাতে পারি। 

- কেমন একটু অস্বস্তি হচ্ছে এ'বার।

- আমি প্রিয় ব্যটসম্যানের উইকেটের তোয়াক্কা না করে পয়া বসবার জায়গা পাল্টে ফেলতে পারি।

- থাম, থাম, থাম।

-  বাইশটা লম্বা ওগো-হ্যাঁগো চিঠির উত্তরে একটা কাঠকাঠ পোস্টকার্ড পাঠিয়ে দায়িত্ব সেরে নিতে পারি।

-  এদ্দিন কোথায় ছিলি বাবু। বুকে আয় ভাই, বুকে আয়।

Wednesday, July 22, 2020

টেলিপ্লে


এই নিয়ে দুশো বাইশ নম্বর চিঠি পেলেন রাধামাধব। একেবারে নিয়ম বেঁধে। আর্লি রাইজার রাধামাধবের ঘুম ভাঙবে ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায়; মোবাইলের অ্যালার্মে। আড়মোড়া ভাঙার আগেই বালিশের তলায় চালান করে দেওয়া আঙুলের ডগাটি ঠেকবে গিয়ে খামের আরামদায়ক খসখসে। 

সেই খামটা বালিশের তলা থেকে টেনে বের করে আনতেই একটা মনকেমন করা মিষ্টি সুবাসে ঘর ভরে যাবে। ঠিক যেন ওই শিউলি আর পায়েস মেশানো একটা গন্ধ। সে সুবাস নাকে এসে ঠেকলেই মনে চনমন, প্রাণে ফুরফুর।  

একে মাঝবয়সী মানুষের একার সংসার, তার ওপর বিশ্রী একটা ভাইরাসের ঠেলায় প্রায় বছর দুয়েক  বাড়ির বাইরে এক পাও বেরোনো হয়নি। ইন্টারনেটের ঘ্যাঁচরঘোচর, ওয়ার্ক ফ্রম হোমের হিজিবিজি আর নিষ্প্রাণ হোম ডেলিভারির চোটে প্রাণ প্রায় শুকিয়ে যেতে বসেছিল।কিন্তু সেই শুকনো খটখটে প্রাণে দু'পশলা বৃষ্টির মত এলো এই চিঠি। 

ব্যাপারটা শুরু হয় মাস সাত-আটেক আগে। তা প্রায় ভোজবাজিই বলা চলে।   ভোরবেলা ঘুম ভাঙলেই একটা করে চিঠি। রোজ। সে চিঠির হাতের লেখাটি বড় সুন্দর; ছাপার অক্ষরের মত উজ্জ্বল কিন্তু কাঠকাঠ নয়, বেশ মিষ্টি। সাদা খামের ওপরে যত্নে লেখা নাম; রাধামাধব দত্ত। আর সেই মিঠে হাতের লেখায় নিজের নামটুকু বারবার পড়তে বড় ভালো লাগে রাধামাধবের।  সাদা খামের ভিতরে হলুদ রঙের মোটা কাগজ। তার ওপর নীল কালিতে লেখা একটা গানের প্রথম দুলাইন। 

এক একদিন, এক একটা গান। কোনওদিন হেমন্তবাবুর "জীবনপুরের পথিক" আবার কোনওদিন মান্নাবাবুর "চার দেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে”। ব্যাস, ও'টুকুই। কার হাত ছুঁয়ে সে চিঠি রাধামাধবের বালিশের তলায় এসেছে, সে’টুকু এত দিনেও জানা গেল না। অবশ্য তা জানার চেষ্টাও করেননি রাধামাধব। ঘুম থেকে উঠে অমন সুগন্ধি চিঠি হাতে পেলে মন যে দিব্যি তরতাজা হয়ে পড়ে, কী হবে চিঠি লিখিয়ের খোঁজ করে? বালিশের তলায় সে চিঠি পৌঁছয় কী করে তা নিয়েও মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করে না রাধামাধবের। বড় কথা হল সে চিঠি আসে। রোজ আসে, নিয়ম করে আসে। ম্যাজিকের মত, ছুঁতে না পারা কলেজ প্রেমের মত; ব্যাস। এর বেশি কিছু জানতে রাধামাধবের বয়েই গেছে। 

সে চিঠি খুলে গানের দুলাইন পড়লেই একটা সুরের মখমলে ঢেউ এসে রাধামাধবের বুকে দোলা দেয়। হাত বাড়িয়ে খাটের পাশের টেবিল থেকে বাঁশিটা টেনে নিয়ে সেই গানের সুর ধরেন রাধামাধব। মনের মধ্যে ভালোবাসা জমতে শুরু করে, শিউলি আর পায়েস মেশানো সুবাসে ভেসে যান তিনি। 

****

- এই দ্যাখ বিন্তি। 

- এটা কী রে দাদা। 

- টেলিপ্লে স্পীকার। 

- কী সব গালভরা নাম বলিস রে তুই দাদা। এ'দিকে এ যে দেখছি স্রেফ একটা থ্যাব্যড়া বাক্স। তাও যা মনে হচ্ছে, সস্তা কাঠের। 

- দেখতে থ্যাবড়া বেঢপ বটে। কিন্তু এ হচ্ছে লেটেস্ট টেকনোলজিকাল মিরাকেল। 

- কী'রকম? 

- ঐযে, মানুষদের যেমন গুগল হোম বা আমাজন ইকো বা ওই ধরণের যন্ত্রপাতি? যে গান শুনতে চাইবি অমনি স্পিকারে সে গান বেজে উঠবে? এও তাই, তবে মানুষদের জন্য নয়। তোর আর আমার মত ভূতেদের জন্য।

- যে গান শুনতে চাইব পাব? 

- আলবাৎ। শুধু এই ফোঁকরের মধ্যে দিয়ে একটা চিঠি ফেলে দিলেই হবে। 

- চিঠি?

- সাদা খামের মধ্যে হলুদ কাগজে সে গানের দু'লাইন লিখে দিলেই হবে। 

- সত্যি রে দাদা?

- তুই আমার একমাত্র আদরে বাঁদর বোন, তোকে মিথ্যে বলব রে? ঘোস্টকার্টে মদন তান্ত্রিকের লেটেস্ট রিলিজ। ফ্ল্যাশসেলে কলেক্ট করেছি বিন্তি। শুধু তোর জন্যে। আর প্রচণ্ড কাসস্টোমাইজেবল। ওকে গুগল বা আলেক্সা গোছের একঘেয়ে কম্যান্ডে শুধু সাড়া দেবে, এমন ত্যাঁদড় নয় এই টেলিপ্লে। তুই নিজের পছন্দমত নাম দিতে পারবি এই যন্ত্রের। 

- ফাটাফাটি। আমি কিন্তু সবসময় শুধু বাঁশি শুনব। বলে রাখলাম। 

- বেশ তো, শুনিস'খন । আর এর নামটা কী দিবি?

- রাধামাধব। কেমন?

Monday, July 20, 2020

বটুগোয়েন্দার ইলিশচুরি

- এই যে বউ...।

- অত চেল্লাচিল্লি কেন।

- চেল্লাচিল্লি করার মতই দাঁও মেরেছি।

- চোরের গলায় অত তেজ ভালো না..।

- বিশু দারোগা চোর বলে চোপা করলে গায়ে লাগেনা। কিন্তু তুমিও চোরছ্যাঁচড় বলেই হ্যাটা করবে গো বউ? শিল্পীর কদর করবে না?

- উঁ। ভীড় বাসট্রেন থেকে এর ব্যাগ ওর থলে সরানোও নাকি শিল্প। ধুর ধুর শিল্পী ছিলেন মধুজ্যেঠু। গেরস্ত বালিশে মাথা ঠেকানোর দশ মিনিটের মধ্য সিঁদ কেটে মালপত্তর সরিয়ে হাওয়া।

- আরে সে মান্ধাতা আমলে পড়ে থাকলে চলবে কেন। ইন্টারনেটে চারদিকে কিস্তিমাত হচ্ছে। এ যুগে সিঁদ কাটলে লোক হাসবে যে। তবে যাক। আজ এক্কেবারে কেল্লাফতে করেছি। এই দ্যাখো।

- রামোহ্। চামড়ার দামী ব্যাগ নয়, জমকালো বটুয়া নয়, এ যে দেখি বাজারের থলে...। তাও ময়লা...।

- কিন্তু বউ, এ থলের মধ্যেই যে সাতরাজার ধন। 

- আহ, কী আছে সে'টা বলবে তো।

- ডাউন মেমারি লোকালে ফিরছিলাম। তখনই নজরে পড়ল লোকটাকে। গোবেচারা চেহারা, ট্রেনের দরজার এক্কেরে মুখে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছেন বাবু। ...দেখেই বুঝেছি এর মাথায় কাঁঠাল ভাঙা বাংলায় বানানভুল করার চেয়েও সহজ। ব্যাস। অমনি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তা ভদ্দরলোকের হাতে ঝোলানো থলির ভিতর উঁকি মারতেই বুকের মধ্যে এক্কেবারে যেন সাতশো বত্রিশটা রংমশাল জ্বলে উঠল। ঠিক করে ফেললাম এ ব্যাগ না হাতালেই নয়..। ভদ্রলোক শক্ত করে থলেটা ধরেছিলেন..। প্রথমে ভাবলাম।যে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ট্রেন গতি নিলে; সে ব্যাগ শেষ মুহূর্তে ছিনিয়ে ট্রেন থেকে দৌড়ে নেমে পগারপার হওয়াটাই একমাত্র উপায়। কিন্তু মা ভবতারিণীর আজ অসীম দয়া; ছিনতাইয়ের হ্যাপা পর্যন্ত যেতেই হল না। হঠাৎ এক প্যাকেট সল্টেড বাদাম কিনে খেতে শুরু করলেন ভদ্রলোক,হাতের থলেটা পাশে নামিয়ে রেখে। সে বাদামের নেশায় এতটাই বুঁদ হয়ে ছিলেন যে আমি দিব্যি থলে উঠিয়ে পাণ্ডুয়া স্টেশনে স্যাট করে নেমে পড়লাম অথচ সে'টা সেই থলেওলা টেরই পেলেনা। 

- হাউই গপ্প তো অনেক হলো। তা এই থলেতে আছেটা কী?

- দেখাব। তার আগে খোকা আর খুকিকে ডাকো দেখি। ওদের সামনেই না হয়...।

***

- পৌনে দু'কিলো সাইজের ইলিশ?

- করেক্ট।

- দু'টো ইলিশ?

- করেক্ট।

- কোয়ালিটি?

- এ-ক্লাস।

- তুমি জানো সে জিনিসের মার্কেট ভ্যালু কত?

- হিসেব করতে গেলে ভির্মি খেতে হবে। থাক না।

- থাক না মানে? অমন ইলিশ সহ থলে গায়েব হয়ে গেল?

- গায়েব নয়। চুরি।

- বটু গোয়েন্দার ইলিশ মাছের থলি চুরি হল?

- এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে সুবিনয়।

- অবাক হব না বটু? থানার বড়বাবুরা তোমার কনসাল্টেশনের জন্য হন্যে হয়ে ঘোরে। দুঁদে ক্রিমিনালরা তোমার নাম শুনলে থরথর করে কাঁপে। তেমন গোয়েন্দার মাছের থলে চুরি হয়ে গেল ট্রেনের ভিড়ে, অথচ সে টেরটিও পেল না। বাজারে এ কথা রটলে তোমার মানইজ্জত থাকবে বটু?

- মানইজ্জতের পরোয়া করলে কি আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াতাম হে সুবিনয়। সে চিন্তা নেই।  ইলিশের থলে চুরি হয়েছে বটে, কিন্তু তা আমায় ফাঁকি দিয়ে হয়নি।

- তার মানে? তুমি টের পেয়েছ যে তোমার থলি চুরি হচ্ছে?

- হাপিসটি হয়েছে পাণ্ডুয়া স্টেশনে। আর চুরিটা হয়েছে আমার সুপারভিশনে।

- তার মানে?

- চুরিটা আমি অ্যালাউ করেছি।

- তুমি চুরিটা হতে দিয়েছ?

- করেক্ট।

- তুমি দেখেছ সে চোরকে?

- বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে সাতচল্লিশের মধ্যে। একমাথা এলোমেলো ময়লা চুল, নীল শার্টটিকে আর যাই হোক নতুন বলা চলে না। ট্রাউজারটা এককালে হয়ত মিশকালো ছিল, এখন ফ্যাকাসে। পায়ে সস্তা হাওয়াই চটি। হাতে একটা পুরনো ইলেকট্রনিকস ঘড়ি, নেহাৎ শস্তা নয় তবে সে'টি যে চুরির মাল সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। 

- তা এই লোকটিকে তুমি তোমার থলে সরাতে দিলে?

- দিলাম। ইনফ্যাক্ট, যতটা সম্ভব সাহায্য করলাম। 

- খোলসা করো হে বটু।

- চোরের হাবভাব আমি বিলক্ষণ চিনি। তাঁদের আঙুল আর কবজির মুভমেন্ট, চোখের ধারলো ফোকাস আর ঠোঁটের পরিশীলিত উত্তেজনা; এই কম্বিনেশনটা নিশ্চিত ভাবে ঠাহর করতে পারাটা যে কোনও গোয়েন্দার জন্যেই একটা জরুরী স্কিল। তবে এই ভদ্রলোক..।

- ভদ্রলোক?

- সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় নিজের আখের গোছানো মানুষজন যদি ভদ্র হতে পারেন, সামান্য পকেটমারকে ছোটোলোক বলি কী করে বলো। যাকগে, তা অন্যদের পকেট আর ব্যাগ জরীপ করতে করতে এই নীল শার্ট ভদ্রলোকটি হঠাৎ একটা বই হকারের কাছে ছোটদের বই চেয়ে দরদাম শুরু করলেন। ওই সস্তা চটিবই। ট্রেন কাঁপানো দরদাম করে দু'টো বই বাগালেন ভদ্রলোক; একটা গোপাল ভাঁড়ের হাস্যরস আর একটা বীরবলের গল্প। কেনার পর বইগুলো নিজে একবারও উল্টেপাল্টে না দেখে নিজের বুকপকেটে যত্ন করে মুড়ে রাখলেন। বই কেনার সময়টুকু ভদ্রলোকের চোখ থেকে সেই ফোকাস গায়েব, ঠোঁটের উত্তেজনা কেটে গিয়ে উজ্জ্বল হাসি আর আঙুলের চনমন গায়েব। কেন?

- কেন?

- শিল্পীর ফোকাস আর উত্তেজনা ভাসিয়ে দেওয়া স্নেহ। বাড়ির বাচ্চাদের জন্য কি ভদ্রলোক দু'টো বই হকারের ব্যাগ থেকে সরিয়ে দিতে পারতেন না? পারতেন৷ কিন্তু তা করলেন না কেন? কারণ ছোটদের পড়ার বইটুকু তিনি চুরি করে সংগ্রহ করতে চাননি। শিক্ষার প্রতি সম্মান। আমাদের অনেকের মধ্যে নেই, ওঁর আছে। আসলে মানুষের এথিকস বোধ অতি বিচিত্র হে সুবিনয়। যা হোক, বইদুটো কেনার পর ভদ্রলোকের চোখের ফোকাস আর ঠোঁটের উত্তেজনা ফেরত এলো। অর্থাৎ তিনি ফের শিকারী বাজপাখি। এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে। তাঁর দৃষ্টি এসে পড়লো আমার থলের ওপর৷ প্রমাণ সাইজের দু'টো ইলিশ দেখে তার চোখের দৃষ্টি আরও প্রখর হয়ে ওঠা উচিৎ ছিল, ঠোঁট লোভে কেঁপে ওঠা উচিৎ ছিল। অথচ...।

- অথচ?

- অথচ তার দৃষ্টি হয়ে উঠল ঘোলাটে। ঠোঁটে ফুটে উঠল বিষাদ। আর নিজের অজান্তেই তিনি বুক পকেটে মুড়ে রাখা বইদুটো খামচে ধরলেন। এথিকসের মতই, পিতৃস্নেহও রীতিমতো বেহিসেবী একটা প্রসেস৷ আমার ইলিশের থলিটি তাকে টানলো কিন্তু সে টানে লোভ নেই৷ সে টানে নিজের সন্তানদের মুখে ইচ্ছেমত মাছের টুকরোটা তুলে দিতে না পারার আক্ষেপ রয়েছে৷ যন্ত্রণা রয়েছে। ব্যাস, তারপর আর কী। মক্কেলের ঘাড় মটকে আদায় করা ইলিশ আবারও জুটেই যাবে।

- ইলিশভাজা দিয়ে জমিয়ে আড়াই থালা ভাত খাবো ভেবে এসেছিলাম হে বটু। কাজটা তুমি খারাপ করোনি বটে৷ তবু আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন খালি খালি বোধ হচ্ছে..।

- গোয়েন্দাগিরির নেশায় মশগুল না হলে আমি অতি চমৎকার রাঁধুনি হতাম সুবিনয়। যাকগে, হাঁসের ডিম কষা করেছি, তাতেও ওই আড়াই থালা ভাত সাবাড় হবেই। দেখে নিও।

Thursday, July 9, 2020

তিব্বতি মাদুলি


- মনখারাপ?

- আজ্ঞে। প্রচণ্ড। টেরিফিক লেভেলে মনখারাপ।

- সে তো বুঝলাম। কিন্তু কেন? জয়েন্টে ফেল? মিনিবাসের পকেটমারিতে সত্তর টাকা জলে? 

- কই। না তো।

- তোমার বয়সে তো এ'সবই হয় খোকা...।

- খোকা? অমল বলে ডাকলেই হয় তো। ফার্স্ট ইয়ারে রয়েছি স্যার।

- স্যার? সাতাশ বছর হল তিব্বত থেকে ফিরে তন্ত্রসাধনা করছি। তাবিজমাদুলি দিচ্ছি। স্যারট্যার আবার কী। এ কি ডালহৌসির প্রাইভেট ফার্ম নাকি। গদগদ সুরে বাবাজী বলে ডাকো।  

- বাবাজী। আমার যে বড্ড মনখারাপ। সুপার-গভীর মনখারাপ। জিভে ফুচকাও তিতকুটে হয়ে ঠেকছে; এমন মনখারাপ। 

- কেস সিরিয়াস, সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু মনখারাপের সোর্স না জানলে মাদুলিটা দেব কী করে?

- আমিও কী ছাই জানি? বড় আশা করে এসেছিলাম তিব্বতি মন্ত্রতন্ত্র ঝেড়ে আপনি যদি ট্র‍্যাক করতে পারেন। 

- নাহ্। অমন আনতাবড়ি মাদুলি আমি দিতে পারিনা৷ আমি ফচকে ব্যবসায়ী নই, সাধক। 

- ঝড়ে বক ছাড়ুন না কিছু একটা। এমন ওজনদার মনখারাপ দিনের পর দিন বয়ে বেড়ালে শোল্ডার ডিসলোকেট করে ফেলব তো। 

- ছাড়ব? ঝড়ে বক?

- নয়ত আর তন্ত্র কীসে?

- দাঁড়াও, কনসেন্ট্রেট করি।

- আমার মনখারাপের সোর্স...কন্সেন্ট্রেট করলে খুঁজে পাবেন? বাবাজী? 

- কনসেন্ট্রেট করে ডাকলে মাতারা জ্বরের রাতে কপালে জলপটি রেখে যান। ফোকাস ঠিক থাকলে স্বয়ং মহাদেব এসে বিড়িতে আগুন দিয়ে যান৷ তোমার মনখারাপের সোর্স তো অতি পাতি ব্যাপার হে।

- হোক বাবাজী হোক। কন্সেন্ট্রেট করে আমার মনখারাপের সোর্স খুঁজে বের করা হোক।

- তিব্বতের লামাদের মাংসের শিঙাড়া খাইয়ে এমন ইম্প্রেস করেছিলাম যে তাঁরা সাধনার প্রচুর শর্টকাট শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এই যেমন এখুনি; এখন এক লহমায় পৌঁছে গেলাম তোর মনখারাপের গোড়ায়। 

- তা, কী বুঝছেন?

- কাল সকালেই সে গায়েব। ফুসমন্তর এক্কেবারে।

- ফুসমন্তর? 

- ফুসমন্তর। মিছে কথা কইতে নেই খোকা। মনখারাপের কারণ তো বেশ স্পষ্ট জানা আছে দেখছি।

- মোটেও না। কে গায়েব হল, কে ফুসমন্তর তাতে আমার কী?

- কিচ্ছুটি নয়?

- নয়ই তো। আপনি বড় বাড়তি কথা বলেন বাবাজী।

- কাল সোয়া দশটার ট্রেন।

- ট্রেন হোক। প্লেন হোক। স্পেসশিপ হোক। আমার কিছুই এসে যায়না। মাদুলির ব্যবস্থা করুন, আমার তাড়া আছে?

- তাড়া আছে?

- এ...এ কী..আমার হাত খামচে ধরছেন কেন বাবাজী?

- পালস না মেপে মাদুলি দেব?

- আপনি তান্ত্রিক না হোমিওপ্যাথি জ্যেঠু?

- ফার্স্ট ইয়ারে চোখ ছলছল কাজের কথা নয় অমলবাবু।

- ও কিছু না। থাক মাদুলি।

- সোয়া দশটার ট্রেন। ফুসমন্তর।

- হাত ছাড়।

- আপনি আজ্ঞে থেকে তুই?

- বাবাজীটি টেরিফিক লেভেলের ভণ্ড।

- ডায়াগনোসিসটা টেরিফিক লেভেলের খাঁটি।

- মনখারাপটাও। যাসনা। 

- বাবার ট্রান্সফার। 

- তোর বাবাকে পুলিশে দেওয়া উচিৎ। 

- খুব মনখারাপ?

- ওই যে। টেরিফিক লেভেলে।

- মাদুলিটাদুলিতে কাজ হবে? তিব্বতি টোটকা?

- দিবি?

- ওই যে। লামাদের মাংসের শিঙাড়া খাইয়ে আদায় করা মন্ত্রের গুণে তৈরি মাদুলি। তোর কাছে রেখে যাব। যদ্দিন না ফিরি, মনখারাপের ইন্স্যুরেন্স। 

- বটে? টেরিফিক লেভেলের মাদুলি তো! সালোয়ারকামিজ পরা বিনুনি দোলানো বাবাজীর এলেম আছে। 

- এলেম? তা আছে। আর আছে কাল সোয়া দশটার ট্রেনের টিকিট। 


***

- অমলবাবু?

- ইয়েস?

- হ্যাপি বার্থডে।

- হেহ্। থ্যাঙ্কিউ ডক্টর।

- কত হল বাইশ না তেইশ?

- তিরানব্বুইটাকে সত্যিই তেইশ বলে বোধ হচ্ছে ডাক্তার।

- প্রেশারটাও বেশ কন্ট্রোলে আনা গেছে। আর এই রিপোর্টগুলোও; পার্ফেক্ট। আপনার সেঞ্চুরি আটকায় কার সাধ্যি। 

- হোপ সো ডক্টর।

- আপনার মনটকে শুধু এমনই চনমনে রাখুন। তা'হলে সেঞ্চুরির পরেও চালিয়ে খেলতে পারবেন।

- মনখারাপ যে আমায় ছুঁতে পারেনা ডাক্তার।  

- বটে?

- সবই একটা তিব্বতি মাদুলির গুণ। 

- তিব্বতি মাদুলি? আমি তো জানতাম আপনি এথেইস্ট।

- কচু। আমার চেয়ে বড় থেইস্ট এ দুনিয়ায় নেই হে ডাক্তার। বাবাজী ফিরে আসবে, সে আশায় তিব্বতি মাদুলি বুকে আঁকড়ে কী প্রবল আনন্দে বেঁচে আছি। সেঞ্চুরিটা যে আমায় পেরোতেই হবে। আমি কেটে পড়ার পর বাবাজীর ওয়াপসি হলে একটা যাতা কাণ্ড ববে।

- তিব্বতি মাদুলিটা কিন্তু আমায় খুবই ইন্ট্রিগ করছে।

- সে হল গিয়ে তন্ত্রের মিরাকেল ডাক্তার। 

- সেই তিব্বতি মাদুলি? মিরাকেল?

- ইয়েস। অবিশ্যি, সেই তিব্বতি মাদুলিকে অবশ্য তোমরা বেরসিকরা চুমু বলে জানো। 

Wednesday, July 1, 2020

বাইশের দুই বিনোদ দত্ত লেন

- কাকে চাই?

- ম্যাডাম, এ'টা কি অমলেশ সমাদ্দারের বাড়ি?

- ওই ঢাউস নেমপ্লেটটা চোখে পড়েনি? ও'টায় কি অমলেশ সমাদ্দার লেখা আছে?

- এইচ দত্ত। ওহ, সরি। সরি। আসলে..।

- বাড়ির নম্বর কিছু আছে?

- বাইশের দুই বিনোদ দত্ত লেন।

- গুলিয়েছেন।

- গুলিয়েছি?

- এক্কেবারে।

- আসলে গুগল ম্যাপ ধরে..।

- ম্যাপকানা হয়ে অলিগলিতে ঢুকলে ওই হয়। ঝাড়া আড়াইশো মিটার পিছিয়ে গিয়ে শনিমন্দির পড়বে। সে'টার বাঁদিকের গলিতে ঢুকে ডান হাতের চার নম্বর বাড়ি।

- থ্যাঙ্কিউ।

- ও মা! কড়াইয়ের মাছ পোড়া লাগল বোধ হয়...।

**

ঘাটে এসে গা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করল নির্মলের। শেষ বিকেলের রোদ্দুর নরম হয়ে এসেছে। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে পছন্দসই একটা জায়গা দেখে জলে গোড়ালি ডুবিয়ে বসল সে। প্যান্টে শ্যাওলার দাগ বসে যাবে, যাক গে। আজ গায়ে বুকে বড় নিবিড় ভালোলাগা লেগে আছে। 

পকেট থেকে বাদামের প্যাকেটটা বের করে ডান হাতের মুঠোয় কয়েকটা নুনমাখানো বাদাম ঢেলে নিয়ে সামান্য গুনগুন শুরু করল নির্মল। 

বুকের ভিতরটা কেমন তিরতির করছিল, ওই ভালোলাগায়। সুমির সংসার; সে এক জমকালো ব্যাপার।
সুমির রান্নাঘরের কড়াইতে মাছ।
সুমির কোমরে গোঁজা শাড়ির আঁচল।
সুমির থুতনিতে ঘামের দানা।

দেখে প্রাণ ভরবে না কেন?  আর কেউ না জানুক, নির্মল তো জানে; তাঁর বুকে হিংসের একটা ফোঁটাও নেই৷ মাকালীর দিব্যি কেটে সে বলতে পারে। 

কী বিচ্ছিরি পাগলামি যে আজ হঠাৎ মাথায় চেপে বসল! যাক, সে পাগলামীর বশে এদ্দিন পর দেখা তো হল। ক্ষণিকের কথাবার্তা, এ দাড়িগোঁফে ঢাকা বাউণ্ডুলে চেহারা সুমি চিনতে পারবেনা; এ'টুকু ভরসা ছিল। নাহ্, সুমিকে কোনওভাবেই বিরক্ত করা চলবে না।

সুমি যে কী ভালো। কী ভালো। এই যে গায়ে মুখে লাগা শেষ বিকেলের আলো আর পা ভেজানো নদীর জলের মিঠে শিরশির; আর দু'টো মিলেমিশে এই যে মনঅবশ করা ভালোলাগা - সুমি তার চেয়েও ভালো। 

চারদিকে কতশত মনকেমন করা ভালো; সঞ্জীবের বইতে রাখা ভোরের শিউলি ভালো, জলপটিতে মায়ের হাতের ওমটুকু ভালো, খিদেপেটে গরম ভাতের গন্ধ ভালো ।  আর সে'সমস্ত ভালো মিশলে যে কান্না; সুমি সে'খানে।

বাইশের দুই বিনোদ দত্ত লেন; নির্মলের অল্প হাসি পায়। 

**

বাইশের দুই বিনোদ দত্ত লেন; যত্তসব!

সাজানো ঠিকানার অছিলায় দেখা করতে আসায় দোষ নেই, আর কড়াইতে মাছের মিথ্যেটুকুতেই যত পাপ? মোটেই না। সুমি জানে, পাপ নেই তাতে। 

এদ্দিন পর যে লুকিয়ে দেখা করতে আসে, তার সামনে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলা যায় নাকি? সুমি জানে, যায় না।

নির্মলের সাহস না থাক, এক ফোঁটা হিংসুটেপনাও কি থাকতে নেই? 

**

(পুনশ্চঃ হটস্টারে "আরিয়া" ওয়েবসিরিজটি দেখলাম। এ লেখার সঙ্গে অবশ্য সে সিরিজের কোনও যোগাযোগ নেই। তবে 'বড়ে অচ্ছে লগতে হ্যায়' গানটা মনের মধ্যে নতুন করে দাগ কেটে গেল। এই আর কী)

খুনখারাপি আর মামলেট


 - ব্রাদার, একটু অপেক্ষা করা যায় না?

- চোপ শালা। বন্দুকের ছ'টা গুলিই গেঁথে দেব মুণ্ডুতে..।

- অপচয় করবে কেন? একটা গুলিতে যদি খেলখতম করা যায়, তা'হলে বাকি পাঁচটা নষ্ট করার কোনও মানে হয়?

- এই! মাইরি! বলছি...।

- ভাতের দানা হোক কি বুলেট। অপচয় দেখলেই বুকে বড় বাজে।

- কপালে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে রেখেছি, তারপরেও এত ফটরফটর? আচ্ছা ত্যাঁদড় মাল মাইরি।

-  আমার বাপ, আমার অঙ্কের মাস্টার, আমার মায়া। সবার মুখেই আজীবন ওই এক কথা শুনেছি। আমি নাকি রাম-ত্যাঁদড়। তা ও'টাকে আমি কম্পলিমেন্ট হিসেবেই ট্রীট করি বুঝলে হে। কোনও কিছু একটু না বাজিয়ে আমি এক্সেপ্ট করতে পারিনি কোনওদিনই। 

- মায়া কে?

- আমার স্ত্রী। ওই যে..।

- কে? কে? কে ওখানে?

- আরে ধুর ধুর। এই কলজে নিয়ে মার্ডার করতে নেমেছ? লাশ নামানো কি অতই সস্তা? ও'দিকে কেউ নেই হে। ওই দেওয়ালের ছবিটা দ্যাখো। ওই যে। মায়ার ছবি। সে ফাঁকি দিয়ে সুট্ করে সরে পড়েছে অনেক আগে। মায়ার মত মেয়ে হয় না গো ব্রাদার। এই যে তুমি অসময়ে এলে, শুকনো মুখে তোমার সে কিছুতেই বসে থাকতে দিত না। ঘরে আর কিছু না থাকলে দু'টো ডিম অন্তত চট করে ভেজে দিত। আর কফি। আহা, মায়ার হাতের কফি ভায়া..প্রতি চুমুকে ইউরেকা। 

- ধুত্তোরি। তখন থেকে ভ্যাজরভ্যাজর। 

- তুমিই তো চান্স দিচ্ছ ব্রাদার। বন্দুক বাগিয়ে ঢুকেছ৷ সোজা ঠাই ঠাই চালিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তা না করে যেই না ওই বাতেলা ঝাড়া শুরু করেছ তখনই বুঝেছি...স্কিলে খামতি আছে। তা এতক্ষণ যখন গালগল্প হলই, আর মিনিট দশেক দেবে নাকি? ব্রাদার?

- কোনও চালাকি নয় কিন্তু...খুব সাবধান।

- চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য ইয়ে হয়না। শোনোনি নাকি?

- দু'মিনিট দেব। তার বেশি নয়।

- পাঁচে রফা কর ভায়া। উইন উইন।

- আমি ঘড়ি দেখছি,  পাঁচ মিনিট পরেই কিন্তু..।

- ঢিশুম। জাস্ট ফাইভ মিনিটস।

- কী হবে পাঁচ মিনিটে?

- পেঁয়াজ কুচোতে গেলে দেরী হয়ে যাবে। মামলেটের বদলে বরং পোচ করে আনি। আর ফ্লাস্কের কফি। 

- খাওয়ার শখ?

- আরে আমার জন্য না। ওই যে বললাম। মায়া নেই বলে তুমি শুকনো মুখে কেটে পড়বে। সে'টি হচ্ছে না। মায়ার খারাপ লাগবে। সে মরে গেছে বটে, কিন্তু উবে তো যায়নি। 

- দত্তবাবু। আমায় আর নার্ভাস করবেন না প্লীজ। আপনাকে খুন করাটা অত্যন্ত জরুরী।

- হাজরা পাঠিয়েছে? 

- আজ্ঞে। সোয়া লাখ পাবো। টাকাটার বড্ড দরকার।

- এ জন্যেই হাজরার মত বিজনেস রাইভাল আমার দু'চোখের বিষ। আর খুন করাবি করা, আমাদের ব্যবসার লাইনে এ'সব একটু না করলে চলবে কী করে৷ কিন্তু তাই বলে আমায় খুন করার রেমুনারেশন সোয়া লাখ? তুমিই বলো ব্রাদার, আমি কি অতই মামুলি?

- আজ্ঞে?

- হাজরা কী ভেবেছে। শুধু বিজনেস টার্নওভারে মেপে নিমাই দত্তের তল পাবে? হাজরা জানে যে নারায়ণ দেবনাথের কমিস্কের ব্যাপারে আমার চেয়ে বড় এক্সপার্ট গোটা দেশে নেই? জানে ও? ও জানে যে যে সতেরোটা ডায়েরী বোঝাই হয়ে আছে আমার লেখা গান? সে গানে সুরও নিজে বসাই আমি? ও জানে? রোজ রাত্রে হারমোনিয়াম নিয়ে ছাতে উঠে আমি নিমাইসঙ্গীত গাই! ব্যবসার খাতিরে খুন করছিস কর, তাই বলে সোয়া লাখের বিনিময়ে আমায় নিকেশ করবে? আটকালচারড ব্রুট কোথাকার। 

- আজ্ঞে দত্তবাবু, আমি ছাপোষা খুনি। ও'সবের আমি কী বুঝি বলুন। 

- ও মা। নারায়ণ দেবনাথ না বুঝলে চলবে কেন?

- খুনটা আমায় করতেই হবে।

- তাই বলে দেড় লাখে? না না। সে অন্যায় বরদাস্ত করা যায় না ব্রাদার।

- পাঁচ মিনিট কিন্তু শেষ হতে চলল।

- যাহ্। একটু ম্যানেজ করো ভাই। ডিমটা ভেজে না দিলে মায়া কষ্ট পাবে। 

- আচ্ছা। ইয়ে, দত্তবাবু। আমি পেঁয়াজ কুচিয়ে দেব? মামলেটই হোক বরং। পোচের বদলে। নিজের জন্যেও না হয় একটা ভেজে নেবেন।

- এই অসময়ে? আমিও খাব একটা? কড়া ভাজা অমলেট? জিভটা যে সুড়সুড় করছে না তা নয়...কিন্তু অম্বলটম্বল হলে..।

- কিছু মনে করবেন না। খুনটা কিন্তু আমায় করতেই হবে দত্তবাবু।

- তাই তো। তা'হলে আর অম্বলের ভয় কীসের বলো ব্রাদার। আচ্ছা, হাঁসের ডিমের অমলেট চলবে? ফ্রিজে এখনও বেশ কয়েকটা আছে।

- তাই হোক। তা..রান্নাঘরটা কোন দিকে? 

- কিচেন এ'দিকে। কিন্তু তুমি গেস্ট হয়ে পেঁয়াজ কুচোবে?

- আমি সুপার ফাইন পেঁয়াজ কুচোতে পারি দত্তবাবু। আমার বৌ হাতে ধরে শিখিয়েছিল। মামলেটের জন্য একেবারে নিখুঁত।

- বটে? 

- আজ্ঞে। ইয়ে..তার নামও ছিল..মায়া।

- ছিল? ব্রাদার?

- সেও এখন ফটো। আমাদের শোওয়ার ঘরের পশ্চিম দিকের দেওয়ালে, তারামা হার্ডওয়্যার স্টোরের ক্যালেন্ডারটার পাশে ঝোলানল। রোজ ঘুমোনোর আগে খোকা সেই ফটোফ্রেমের দিকে তাকিয়ে আমার কাছে গল্প শুনবে। শুনবেই। ওর মায়ের গল্প। মায়ার গল্প। 

- অ।

- আসলে..টাকাটা আমার বড় দরকার দত্তবাবু। খোকার একটা অপারেশন না করালেই নয়। 

- অ। খোকার জন্য। এ সোয়া লাখ তো সোয়া লাখ নয় ভায়া। সোয়া'শো কোটির সমান। শোনো, এখন ডিম ভাজি। তারপর আর দেরী নয়। 

- আমায় ক্ষমা করতে পারবেন দত্তবাবু?

- মায়ার কাছেই যাওয়া তো। আমার বরং একটা হিল্লে হয়ে গেল। একা একা রোজ নিমাইসঙ্গীত গাইতে বসে বুক ফেটে যায় ভায়া, সবটুকুই তো মায়ারই জন্য। কিন্তু তোমার খোকার গল্পগুলো শোনাটা জরুরী৷ আমি তোমায় বাড়তি টাকা দিতেই পারতাম, আমি তো আর ওই হাজরার মত চশমখোর নই৷ কিন্তু এ কাজে ফাঁকি দিলে হাজরা তোমার ছড়বে না হে।

- দত্তবাবু..। হাজরার দলের বাকি লোকেরা বাইরে দাঁড়িয়ে। কাজ হলে লাশ আর প্রমাণ লোপাট করবে বলে। বিশ্বাস করুন আমি যদি খুন নাও করি ওরা আপনাকে..।

- কেঁদো না ভায়া। মাঝেমধ্যেই মায়াকে বলি, আসছি গো। তোমার কাছে আসছি। শুধু সাহসের অভাবে এদ্দিন..। যাক, এই ভালো। তোমার খোকার জন্য আমার হারমোনিয়ামটা দিয়ে গেলাম। বসার ঘরেই রাখা আছে। নিয়ে যেও। আর শোনো, খোকাকে ওর মায়ের গল্পে রেখো, কেমন? দেখো একদিন সে মস্ত বড় মানুষ হবে।

- দত্তবাবু...।

- আর দেরী নয়। পেঁয়াজ কুচোও ব্রাদার। ওমলেটের ব্যাপারটা কুইকলি সেরে ফেলা যাক। নয়ত তোমার স্যাঙাৎরা এসে রসভঙ্গ করবে।