Thursday, July 30, 2020

বিমলবাবুর দরজা


- ও বিমলবাবু। ও বিমলবাবু। ও বিমলবাবু।

- কী চাই?

- দরজাটা খুলুন। তারপর তো কথা হবে।

- এত রাত্রে এমন হাঁকডাক শুরু করেছেন কেন?

- আরে মশাই আগে দরজাটা তো খুলুন।

- এই রাতবিরেতে? দুম করে দরজা খুললেই হল?

- আহা, আমি তো আর অচেনা কেউ নই। 

- যে'টুকু চিনি..ততটুকু যথেষ্ট নয়।

- চেনার কি কোনও শেষ আছে বিমলবাবু? নেই।

- দেখুন। এত রাত্রে আমি দরজা খুলব না। কভি নহি।

- এ এক অদ্ভুত জেদ। অভিমন্যুর মত। রথের ভাঙা চাকা বাগিয়ে সাতজন মহারথীকে ঠেকানো যায় বলুন? দরজা আপনাকে খুলতেই হবে।

- থ্রেট করছেন?

- অন দ্য কন্ট্রারি। আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

- যত বাজে কথা। দরজা আমি খুলব না।

- দরজা কি কাগজ? আমি কি এনআরসি? আচ্ছা বেশ। আমি না হয় দরজার এ'পাশেই বসে জিরিয়ে নিই খানিকক্ষণ। 

-  আচ্ছা ঘ্যাঁতা ইয়ে তো আপনি।

- আপনার ইচ্ছে করছে দরজা খুলতে।

- মোটেও না৷ খবরদার ম্যানিপুলেট করবেব না৷ ও দরজা আমি খুলব না। না, না, না। 

- আজ যে গোটা রাত আমাদের গল্পগুজব করার কথা বিমলবাবু।

- রাত্রে না ঘুমিয়ে আপনার সঙ্গে গল্প করব? আমি কি পাগল না প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চি?

- আপনি ভালোবাসিয়ে বিমলবাবু৷ ভালোবাসিয়ে। এ দরজা না খুলে আপনার উপায় নেই। 

- মাঝরাত্তিরে এ সব কী ধরণের বিটকেল ন্যাকাপনা মাইরি।

- যে ভালোবাসার মুহূর্তে আপনি আজ ফিরতে চাইছেন, তার জন্য যে আমি ছাড়া গতি নেই।

- আপনার মত থার্ডক্লাস কারুর হেল্প আমার চাইনা।

- ক্লাস বলে আমার কিছু আছে ভেবেছেন? কেউ ভাবে আমি ফোরটুয়েন্টি, কেউ বুক বাজিয়ে বলে আমি বাউল। কেউ হয়ত দিনের বেলায় আমায় 'শ্যালো, পাতি, ট্যু মেনস্ট্রিম' বলে নাক কুঁচকে পাশ কাটিয়ে যায়।  আবার সেই হয়ত রাত্রিবেলায় আমাকে সাদা ওয়াড়ে ঢাকা নরম পাশবালিশের মত বুকে টেনে নেয়। ক্লাস, জাত; সে'সব আমার থাকতে নেই।

- ও'সব হাবিজাবি কথায় আমার ব্রেন গুলিয়ে দেবেন ভেবেছেন? লাভ নেই। দরজা খুলব না। 

- আমি ছাড়া যে আপনার এ ব্যথার অ্যান্টিসেপ্টিক নেই বিমলবাবু।

- ব্যথা? ব্যথা আবার কীসের? দিব্যি ফুর্তিতে আছি। রাত্রে ইলিশের পেটি ভাজা দিয়ে আড়াই থালা ভাত খেয়েছি৷ 

- তবুও মনভার। চোদ্দ বছর আগের সেই মনখারাপ করা বিকেলে একবারটির জন্য ফিরতে না পারলেই নয়।

- খবরদার! বাড়াবাড়ি হচ্ছে।

- স্কুলের গন্ধ। জোড়া বিনুনি আর নীল স্কার্টের হুহু।  বাপুজি কেকের স্বাদ। খবরের কাগজের আজহারউদ্দিনের চারপাশ দিয়ে কাঁচি চালানোর মখমলে অনুভূতি। সে'দিনটায় ফিরে যেতে হলে আমি ছাড়া যে গতি নেই।

- সেই বিকেল? চোদ্দ বছর আগের বিকেল? সেই বিকেলেও আপনি ছিলেন। আপনাকে তখনও পাত্তা দিইনি। আজও দেব না।

- সে বিকেলের স্টক প্রাইস এমন হুহু করে বেড়ে যেতে পারে, সে'টা কি তখন আঁচ করতে পেরেছিলেন? বিমলবাবু?

- না মানে...।

- স্কুল শেষ। জোড়া বিনুনি হাওয়া। বাপুজি নাথুরামে। আজহার দুম করে অন্ধকারে। শুধু আমিই রয়েছি। দরজাটা খুলুন। 

- কিন্তু...আপনার জন্য দরজা খুলতে হবে...সে'টা আমি ঠিক..।

- ভাবতে পারেননি। জানি। আর এ'টাও জানি যে একা আমিই পারি ওয়ার্ম হোল হয়ে আপনাকে সে বিকেলে ফেরত নিয়ে যেতে। 

- সেই বিকেলে..সেই বিকেলে...।

- সে বিকেলে ফিরে যেতে না পারলে আপনার মুক্তি নেই৷ দরজাটা খুলুন।

***

মাঝরাত্তিরে পুরনো অবহেলিত গানেরা মানুষ শিকারে বেরোয়৷ 
এই যেমন আজ। এফএম চ্যানেলটা পাল্টাতে গিয়েও থমকালেন বিমলবাবু।

এর আগে বহুবার শুনেও পাত্তা না দেওয়া সাতপুরোনো  সস্তা গদগদে বলিউডি গানটাকে; 
মনের দরজা খুলে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।

No comments: