- ডাক্তার।
- হুম...।
- ডাক্তার!
- হুঁ।
- ডাক্তার চৌধুরী! ব্যাপারটা কী?
- ওহ। সরি বিপ্লববাবু। সরি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
- চুপ করে রয়েছেন অনেকক্ষণ। তাই ভাবলাম...দেখুন...আপনি আমার কাউন্সেলর..আপনিও যদি চুপ থাকেন..।
- আসলে...কী বলব সে'টা ঠিক..। আপনার কথাগুলোই প্রসেস করার চেষ্টা করছিলাম..।
- ওহ। আই সী৷
- আপনার ধারণা...।
- ধারণা? রিয়ালিটি৷ অবিশ্যি, অনেকগুলো রিয়ালিটির একটা।
- লেট মী সামারাইজ। আপনার ধারণা প্রতিবার ঘুম থেকে ওঠার পর আমাদের একটা নতুন জীবন শুরু হয়।
- দ্যাট ইজ করেক্ট।
- অর্থাৎ আমি আজ রাত্রে ঘুমোতে গেলাম ডাক্তার রীতা সান্যাল হিসেবে। আমার ধারণা আমি আগামীকাল সকালবেলা আমার সাদার্ন এভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে; ঘুম থেকে উঠে, ব্রেকফাস্ট সেরে চেম্বারে এসে বসব, বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে টেনিস খেলতে যাব। কিন্তু আদতে কাল সকালে আমার ঘুম ভাঙবে সম্পূর্ণ অন্য একটা জগতে। যে'খানে বয়স, শরীর, চেহারা সব এক থাকলেও আমার পরিচয়, মন ও চারপাশটা একদম আলাদা। আগামীকাল হয়ত আমাত ঘুম ভাঙবে বাঁকুড়ার সুতপা দত্ত হিসেবে, হাইস্কুল টীচার। আর আমার আগের দিনের ডাক্তার রীতা সান্যালের স্মৃতি সমস্ত ধুয়েমুছে সাফ। বরং ঘুম ভাঙার পর আমার মাথার মধ্যে গোটা জীবন সুতপা দত্ত হয়ে থাকার স্মৃতি মজুত থাকবে।
- একদম। তবে শুধু বাঁকুড়ার সুতপা দত্ত কেন, আফ্রিকার কোনও এক দেশেও আপনার ঘুম ভাঙতে পারে। এমন দেশও হতে পারে যে'টার অস্তিত্ব আপনার এই কলকাতার চেম্বারওলা জগতে নেই। সে'টাই প্রসেস।
- প্রতিটি মানুষ প্রতিদিন প্রতিবার ঘুম থেকে ওঠার পর এই মেটামরফোসিসের মধ্যে দিয়ে যায় কিন্তু কেউই সে'টা টের পায় না।
- ইনফাইনাইট নাম্বার অফ প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস। ঘুম ভেঙে কখন কোন দুনিয়ায় কী রোলে অবতীর্ণ হতে হবে, কেউ ঠাহর করতে পারেনা। করতে পারার কথাও নয়। সবারই ঘুম ভাঙে একটা কন্টিনিউয়িটির বোধ নিয়ে। কিন্তু সবই ফাঁপা, প্ল্যান্টেড।
- প্ল্যান্টেড? ঈশ্বর?
- সফটওয়্যার হলেও হতে পারে৷ আমি তো বিশারদ নই ডাক্তার। শুধুই একটা বাগ ইন দ্য সিস্টেম। ভুক্তভুগী।
- বাগ, কারণ আপনার ক্ষেত্রর ঘুমের পরেও আগের স্মৃতিগুলো মুছে যাচ্ছে না।
- গতকাল আমার নাম ছিল আবিদকেহ, ধেজসিসব বলে একটা শহরে উটের মাংসের ব্যবসা করতাম। প্রায় র্যাগস টু রিচেস স্টোরি। বশেকুয়াক ভাষায় কথা বলতাম। এই শহর আর ভাষা কোথায় আছে জানতে চেয়ে লজ্জা দেবেন না। তার আগের ঘুমের আগে আমার নাম ছিল হান্স। মগজে ছিল অন্য একটা জীবনের গল্প। মাস দেড়েক আগে একবার কলকাতার বাঙালি হয়ে একটা দিন কাটিয়েছিলাম বটে। নাম ছিল রজত মল্লিক।
- ঘুম ভাঙার পর আগের জীবনের স্মৃতি মুছে গিয়ে মাথায় নতুন একটা জীবনের স্মৃতি এমনভাবে প্ল্যান্ট হওয়ার কথা যাতে আড়মোড়া ভাঙা মানুষটির মনে হয় যে এই নতুন জীবনেই সে আজন্ম রয়েছে৷ রাইট? কিন্তু যেহেতু আপনি সিস্টেমের বাগ, সেহেতু আপনার মনের মধ্যে...।
- কয়েক হাজার জীবনের স্মৃতি স্পষ্ট হয়ে আছে। জাতিস্মরদের কথা ভাবুন ডাক্তার৷ গতজন্মের কথা মনে পড়াটা কিন্তু আদৌ কোনও সুপারপাওয়ার নয়, সে'টা বরং একটা অপরিসীম যন্ত্রণা। থিওরেটিকাল লেভেলে সোনার কেল্লার মুকুলের কথাই ভাবুন না। এ জন্মে নিজের বাবা মায়ের সঙ্গে কনেক্ট করতে ওর অসুবিধে হচ্ছিল কেন? কারণ পূর্বজন্মের বাপ, মা, ছেলেবেলার স্মৃতি এসে এই জন্মের রিয়ালিটিকে গুলিয়ে দিয়েছিল৷
- রাইট। আপনার ব্যাপারটাও অনেকটা ওই জাতিস্মরের মতই..।
- তফাৎ একটা আছে। প্রতিবার ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে একটা গোটা জীবনের স্মৃতি আমার মনের মধ্যে জুড়ে যায়৷ সে এক নিদারুণ যন্ত্রণা ডাক্তার। কয়েক হাজার বাপ মায়ের স্নেহ, কত প্রেম, কত বন্ধুত্ব, কত জীবনসঙ্গী৷ কত অন্যায়ের স্মৃতি। কত অপরাধবোধ।
- বিপ্লববাবু, আমি হয়ত বুঝতে পারছি আপনার যন্ত্রণাটা কতটা গভীর।
- সে জন্যেই তো আপনার কাছে আসা ডাক্তার৷ ঘুম পেলেই ভয়ে বুক কাঁপে। কোনও জীবন ভালো লাগলে দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু একটা সময় তো চোখের পাতা লেগে আসবেই। তাই না?
- সে জন্যেই আমার কাছে আসা? ঘুমোতে যাওয়া নিয়ে ডিলেমা?
- খুলেই বলি৷ এ জীবনের মেয়াদ কয়েক ঘণ্টার বেশি তো নয়, ভণিতার আর অবকাশ কই। আর ডাক্তারের বদলে না হয় রীতাই বলি। দেখো রীতা, বেশিরভাগ জীবনেই আমার পাশে তুমি থাকো। আর যে জীবনগুলোয় তুমি থাকোনা, তোমার খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। ঘুম ভাঙতেই দেখি পাশে তুমি আছ কিনা। মাঝেমধ্যে অন্য কাউকে দেখি, তখন কুঁকড়ে যাই, সুযোগ খুঁজি ফের ঘুমিয়ে অন্য জীবনে পৌঁছে যাওয়ার।
- এ'বার ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায় চলে যাচ্ছে বিপ্লববাবু।
- প্রায়ই তুমি আমারই পাশে লেপ্টে থাকো। অথবা পাশের ঘর থেকে তোমার গুনগুন শুনতে পাই, বুঝি আমার হয়েই আছ। আর ঘুম ভেঙে তোমায় আশেপাশে না পেলে? তোমায় খুঁজতে বেরোই। কত জীবন প্রাণপণে খুঁজেও তোমার দেখা পাইনি। কতবার এমনও হয়েছে তোমায় অন্য কারুর হয়ে থাকতে দেখেছি। চুরমার হই বটে কিন্তু জানি, বেশিদিন তোমার থেকে দূরে থাকতে হবে না। কয়েক ঘুম দূরেই তুমি আছ। আমি ছাড়া তোমারও কোনও গতি নেই। কোনও নতুন দেশে তোমায় জড়িয়ে ধরে ঘুম ভাঙবে, এ ভরসাটুকু তো থাকেই।
- দেখুন বিপ্লববাবু। আপনি একটা আস্ত ফ্রড! আর রীতিমতো অসভ্য একজন মানুষ।
- এ জীবনে তুমি আমায় আগে দেখোনি। অথচ তোমার পিঠের ওই তিলের ত্রিভুজটার কথা আমি জানলাম কী করে?
- বেরিয়ে যান। এখুনি।
- প্লীজ রীতা। এ'বারে সাতসাতটা ঘুম পেরিয়ে তোমার দেখা পেয়েছি। তাও নিজের করে নয়। অমন ভাবে দূরে ঠেলে দিও না।
- গেট আউট।
- আমাদের কত নাম রীতা। কত বাড়ি, কত জড়িয়ে ধরা মুহূর্ত। কত রঙিন পৃথিবী আমরা ভাগ করে নিয়েছি। এই পৃথিবীর একটা গান...আমাদের জন্য যে কী প্রবল ভাবে সত্যি। 'যতবার তুমি জননী হয়েছ ততবার আমি পিতা'।
- বিপ্লববাবু, আপনি এখনই আমার চেম্বার থেকে বিদেয় না হলে আমি সিকিউরিটি ডেকে আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিতে বাধ্য হব।
***
- কী গো! ওঠো!
- উম!
- আরে আর কত ঘুমোবে।
- পাশে এসো একটু।
- ন্যাকাপনা। শনিবার তোমার অফিস ছুটি, আমার নয়। ওঠো এ'বার।
- মিতুল, পাশে এসো না। প্লীজ।
- ধুস। এমন ভাব দেখাও মাঝেমধ্যে যেন সাতজন্ম পর দেখছ। গা জ্বলে যায়।
- তা প্রায় সাত জন্মই হবে। ইনফ্যাক্ট, গত জন্মে তুমি বড় নির্মম ভাবে আমায় ঘাড় ধাক্কা দিয়েছ।
- কী যে আজেবাজে সব গপ্প ফাঁদো তুমি মাঝেমধ্যে। ধেত্তেরি।
- তুমি টেনিস খেলবে মিতুল?
- জীবনে র্যাকেট ধরিনি। আমার ওই লুডোই ভালো।
- পিঠে তিলের ত্রিভুজ থাকলে টেনিসে গ্র্যান্ডস্ল্যাম লাভ হয়। লেগে পড়ো।
- তুমি একটা আস্ত পাগল। ঠিক আছে, ঘুমোও আরও।
- নাহ্, ভাবছি দিন তিনেক না ঘুমিয়ে থাকব। তোমায় জাপটে।
No comments:
Post a Comment