এই নিয়ে দুশো বাইশ নম্বর চিঠি পেলেন রাধামাধব। একেবারে নিয়ম বেঁধে। আর্লি রাইজার রাধামাধবের ঘুম ভাঙবে ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায়; মোবাইলের অ্যালার্মে। আড়মোড়া ভাঙার আগেই বালিশের তলায় চালান করে দেওয়া আঙুলের ডগাটি ঠেকবে গিয়ে খামের আরামদায়ক খসখসে।
সেই খামটা বালিশের তলা থেকে টেনে বের করে আনতেই একটা মনকেমন করা মিষ্টি সুবাসে ঘর ভরে যাবে। ঠিক যেন ওই শিউলি আর পায়েস মেশানো একটা গন্ধ। সে সুবাস নাকে এসে ঠেকলেই মনে চনমন, প্রাণে ফুরফুর।
একে মাঝবয়সী মানুষের একার সংসার, তার ওপর বিশ্রী একটা ভাইরাসের ঠেলায় প্রায় বছর দুয়েক বাড়ির বাইরে এক পাও বেরোনো হয়নি। ইন্টারনেটের ঘ্যাঁচরঘোচর, ওয়ার্ক ফ্রম হোমের হিজিবিজি আর নিষ্প্রাণ হোম ডেলিভারির চোটে প্রাণ প্রায় শুকিয়ে যেতে বসেছিল।কিন্তু সেই শুকনো খটখটে প্রাণে দু'পশলা বৃষ্টির মত এলো এই চিঠি।
ব্যাপারটা শুরু হয় মাস সাত-আটেক আগে। তা প্রায় ভোজবাজিই বলা চলে। ভোরবেলা ঘুম ভাঙলেই একটা করে চিঠি। রোজ। সে চিঠির হাতের লেখাটি বড় সুন্দর; ছাপার অক্ষরের মত উজ্জ্বল কিন্তু কাঠকাঠ নয়, বেশ মিষ্টি। সাদা খামের ওপরে যত্নে লেখা নাম; রাধামাধব দত্ত। আর সেই মিঠে হাতের লেখায় নিজের নামটুকু বারবার পড়তে বড় ভালো লাগে রাধামাধবের। সাদা খামের ভিতরে হলুদ রঙের মোটা কাগজ। তার ওপর নীল কালিতে লেখা একটা গানের প্রথম দুলাইন।
এক একদিন, এক একটা গান। কোনওদিন হেমন্তবাবুর "জীবনপুরের পথিক" আবার কোনওদিন মান্নাবাবুর "চার দেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে”। ব্যাস, ও'টুকুই। কার হাত ছুঁয়ে সে চিঠি রাধামাধবের বালিশের তলায় এসেছে, সে’টুকু এত দিনেও জানা গেল না। অবশ্য তা জানার চেষ্টাও করেননি রাধামাধব। ঘুম থেকে উঠে অমন সুগন্ধি চিঠি হাতে পেলে মন যে দিব্যি তরতাজা হয়ে পড়ে, কী হবে চিঠি লিখিয়ের খোঁজ করে? বালিশের তলায় সে চিঠি পৌঁছয় কী করে তা নিয়েও মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করে না রাধামাধবের। বড় কথা হল সে চিঠি আসে। রোজ আসে, নিয়ম করে আসে। ম্যাজিকের মত, ছুঁতে না পারা কলেজ প্রেমের মত; ব্যাস। এর বেশি কিছু জানতে রাধামাধবের বয়েই গেছে।
সে চিঠি খুলে গানের দুলাইন পড়লেই একটা সুরের মখমলে ঢেউ এসে রাধামাধবের বুকে দোলা দেয়। হাত বাড়িয়ে খাটের পাশের টেবিল থেকে বাঁশিটা টেনে নিয়ে সেই গানের সুর ধরেন রাধামাধব। মনের মধ্যে ভালোবাসা জমতে শুরু করে, শিউলি আর পায়েস মেশানো সুবাসে ভেসে যান তিনি।
****
- এই দ্যাখ বিন্তি।
- এটা কী রে দাদা।
- টেলিপ্লে স্পীকার।
- কী সব গালভরা নাম বলিস রে তুই দাদা। এ'দিকে এ যে দেখছি স্রেফ একটা থ্যাব্যড়া বাক্স। তাও যা মনে হচ্ছে, সস্তা কাঠের।
- দেখতে থ্যাবড়া বেঢপ বটে। কিন্তু এ হচ্ছে লেটেস্ট টেকনোলজিকাল মিরাকেল।
- কী'রকম?
- ঐযে, মানুষদের যেমন গুগল হোম বা আমাজন ইকো বা ওই ধরণের যন্ত্রপাতি? যে গান শুনতে চাইবি অমনি স্পিকারে সে গান বেজে উঠবে? এও তাই, তবে মানুষদের জন্য নয়। তোর আর আমার মত ভূতেদের জন্য।
- যে গান শুনতে চাইব পাব?
- আলবাৎ। শুধু এই ফোঁকরের মধ্যে দিয়ে একটা চিঠি ফেলে দিলেই হবে।
- চিঠি?
- সাদা খামের মধ্যে হলুদ কাগজে সে গানের দু'লাইন লিখে দিলেই হবে।
- সত্যি রে দাদা?
- তুই আমার একমাত্র আদরে বাঁদর বোন, তোকে মিথ্যে বলব রে? ঘোস্টকার্টে মদন তান্ত্রিকের লেটেস্ট রিলিজ। ফ্ল্যাশসেলে কলেক্ট করেছি বিন্তি। শুধু তোর জন্যে। আর প্রচণ্ড কাসস্টোমাইজেবল। ওকে গুগল বা আলেক্সা গোছের একঘেয়ে কম্যান্ডে শুধু সাড়া দেবে, এমন ত্যাঁদড় নয় এই টেলিপ্লে। তুই নিজের পছন্দমত নাম দিতে পারবি এই যন্ত্রের।
- ফাটাফাটি। আমি কিন্তু সবসময় শুধু বাঁশি শুনব। বলে রাখলাম।
- বেশ তো, শুনিস'খন । আর এর নামটা কী দিবি?
- রাধামাধব। কেমন?
No comments:
Post a Comment