২০০৭। দিল্লী।
একটা প্রেম দাঁড় করানোর কিঞ্চিৎ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রোজকার ক্লাস শেষ হতেই ছুট; সোজা গিয়ে ছ'শো একুশ নম্বর বাস ধরে কনট প্লেস। দেখাসাক্ষাতের ব্যাপারটা বেশিরভাগ দিন ও'খানেই সারা হত। তারপর ইনার সার্কেল আর আউটার সার্কেল জুড়ে মাইলের পর মাইল হাঁটা।
একটানা অকারণ হাঁটা, অর্ধেক দুপুর আর পুরোটা বিকেল জুড়ে। অকারণ; কারণ ওই বয়সের প্রেম-প্রেম হাহুতাশকে লজিকের ফ্রেমে ধরতে যাওয়াটা বাড়াবাড়ি।
কনট প্লেসের বেশিরভাগ দোকানপাট আর রেস্তোরাঁই কলেজপড়ুয়াদের পকেটের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর৷ সে বয়সে কেএফসির মত রেস্তোরাঁতে ঢুঁ মারার কনফিডেন্সও ছিলনা৷ ওয়েঙ্গার্সের স্যান্ডউইচ বা কেভেন্টার্সের শেকও বড্ড দামী মনে হত। আমাদের ভরসা ছিল মূলত ফুটপাতের খাবার বিক্রেতারা৷ শিঙাড়া, বাদামভাজা, আলুচাট, চিপস, 'স্লাশ', বরফগোলা; এই'সব। বুকে 'অষ্টমীতে প্রথম দেখা' মার্কা হুহু থাকলে আলুচাটের থেকেও চিকেনরোলের সুবাস পাওয়া যায়। দিব্যি উতরে যেত সেই দুপুর আর বিকেলগুলো।
শুধু কোনও কোনও দিন হাঁটাহাঁটির মধ্যে পেত প্রবল খিদে। প্রবল। সুতীব্র। সে বয়সে খিদেপেটে মনে হত; পারলে মরিচ ছড়িয়ে, মাখন মাখিয়ে চেয়ার টেবিল বা এনসাইক্লোপিডিয়াও চিবিয়ে খেতে পারি বোধ হয়। সেই হাইক্লাস খিদে যে আলুচাট বা বাদামভাজায় বধ হবে না, সে'টাই স্বাভাবিক।
আমরা গোটা এলাকা চষে ফেলে এমন একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করতে পেরেছিলাম যে'খানে দশ-পনেরো দিনে একবার লাঞ্চ করলে পথে বসতে হবেনা। আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট। সে'খানকার বোলচাল বেশি নয় আর রান্নাবান্না বেশ মশলাদার। আমাদের অবশ্য বেশি এক্সপেরিমেন্ট করবার ক্ষমতা ছিল না। একটা প্রবল ভাবে অ-চৈনিক চিলি চিকেন বানাতো তারা৷ তার সঙ্গে রুমালি রুটি দিব্যি জমে যেত। যে'দিন তেমন মেগা-খিদের খপ্পরে পড়তাম, সে'দিন আমরা গিয়ে বসতাম ন্যাশনাল রেস্টুরেন্টে। এক প্লেট চিলি চিকেনের দাম ওই একশোটাকা মত ছিল, দশ পিস পাওয়া যেত। ছ'পিস আমার প্লেটে, চার পিস তার। রুমালি রুটিও বেশ সস্তাই ছিল। ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট না থাকলে আমাদের মাঝেমধ্যে অমন আয়েস করে বসে গল্প করা হত না, হেঁটেই হদ্দ হতে হত।
এক প্লেট চিলি চিকেন আর খান ছয়েক রুটি অর্ডার দিয়ে রহিসি মেজাজে গল্প শুরু হত। দশ মিনিটের মাথায় খাবার সার্ভ হয়ে যেত টেবিলে; সঙ্গে বোনাস - পুদীনার চাটনি আর কুচোনো পেঁয়াজ। ছ'টা রুটির চারটে আমার থালায়।
খাবার আসা মাত্রই পেটের খিদে চারগুণ, চোখের সামনের জলজ্যান্ত প্রেমিকাটি আবছা হয়ে আসত। জীবনে পড়ে রইত শুধু ওই ছ'পিস চিলি চিকেন আর ছ'টা রুমালি রুটি। স্রেফ চিলি চিকেনের ঝোল ছুঁইয়ে চারটে রুমালি উড়ে যেত, তখনও চিকেনের টুকরোগুলো অক্ষত। আরও দু'টো রুমালি চেয়ে নেওয়া হত। সাত নম্বর রুমালি শেষ হলে চোখের সামনে প্রেমিকার অবয়ব ফের স্পষ্ট হয়ে উঠত। সে তখনও দু'নম্বর রুমালি রুটি নিয়ে টুকুরটুকুর চালিয়ে যাচ্ছে। আট নম্বর রুমালিতে গিয়ে সামান্য ঝুঁকে ভাসিয়ে দিতাম সেই 'একবার বলো উত্তমকুমার' লেভেলের আর্তি;
"তোমার থেকে হাফ-পিস চিলিচিকেন পাওয়া যাবে"?
ও'দিক থেকে হাফ-পিসের বদলে একটা গোটা পিসই উঠে আসত আমার পাতে। সে কী সহাস্য আস্কারা।
মুখে বলতাম " আহা, এতটা আবার কেন"? অথচ মনের মধ্যে তখন চিত্রহার, রঙ্গোলী আর সুপারহিট মুকাবলা একসঙ্গে ফায়্যার হচ্ছে।
**
বহুদিন পর গতকাল আবার গেছিলাম কনট প্লেসের ও'দিকে৷ এক জোড়া রুমালিতে ঘায়েল হওয়া সেই মানুষটাই ডেকে দেখাল; ন্যাশনাল রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডের রংটা এখনও পাল্টায়নি।
No comments:
Post a Comment