অনুরাগবাবু আমার অত্যন্ত প্রিয়৷ তার মূলে রয়েছে "বরফি"। লোকমুখে ও বিভিন্ন রিভিউয়ের মাধ্যমে জেনেছি যে বরফিতে ভুলভ্রান্তি ও গোলমাল যথেষ্ট রয়েছে৷ কিন্তু গাম্বাট সিনেমা দেখিয়ে হিসেবে আমি বেশ বুঝেছি যে নিজের ভালোলাগাগুলোকে বুক বাজিয়ে আঁকড়ে থাকাটাই কর্তব্য৷ বরফি কতবার দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই৷ সিনেমার টেকনিকালিটি বুঝি না - শ্রুতিদেবীর ছলছলে চোখের পাশাপাশি বরফি আর ঝিলমিলের প্রতি তাঁর অপত্য স্নেহ, ও'তেই এস্পারওস্পার হয়েছি, বারবার। মোদ্দা কথা হল, সিনেমাটি যে আগাগোড়া প্রবল যত্ন আর ভালোবাসায় তৈরি - সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ থাকেনা। সে'খানেই অনুরাগবাবুর ভক্ত হয়ে পড়া৷
(আদতে হয়ত অনুরাগবাবু প্রবল অযত্ন আর অ-ভালোবাসায় বানিয়েছিলেন ছবিটা। তাতে আমার কী? আমার মনে হয়েছে 'বরফি'র ফ্রেমে ফ্রেমে রয়েছে স্নেহ, ভালোবাসা আর জ্বরে-জলপটি-মার্কা যত্ন৷ সেই মনে হওয়ার দামই তো লাখ টাকা)।
যাকগে৷ এতটা পাঁয়তারা কষলাম এ'টা জানাতে যে "লুডো" দেখেছি৷ অনুরাগবাবুর সিনেমার ব্যাপারে আমার একটা বায়্যাস থাকবে, সে সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷ কাজেই গোড়াতেই বলে দি যে সিনেমাটা আমার বড় ভালো লেগেছে। সুপারডিলাক্স মার্কা একটা জিগস-পাজলামো আছে। গতি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সুতোয় সুতোয় সিনেমার প্রতিটি কণার জড়িয়ে থাকা৷ তবে আমার ভালো লাগা সেই গতি আর থ্রিলে নয়।
লুডোর কয়েকটা সাদামাটা মুহূর্ত বড় অনাবিল হয়ে মনে গেঁথে গেছে৷ প্লট গপ্প ট্যুইস্ট ক্লাইম্যাক্স- সিনেমা মাত্রই এ'সব থিওরি কপচানো হবে৷ তার ভালো খারাপ থাকবে৷ কিন্তু কিছু কিছু অনস্ক্রিন মুহূর্ত অমূল্য - সে'সব মুহূর্তের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়াটাই আমার সিনেমা দেখা৷ এই যেমন কালপুরুষ সিনেমায় একটা রেস্টুরেন্টে বসে বাবা আর ছেলে খাওয়াদাওয়ার দৃশ্য৷ আপাতদৃষ্টিতে নিরেট৷ ডায়লগেও মারকাটারি তেজ থাকার কথা নয়। রাহুল বসুর বাংলাও নিখুঁত নয়৷ অথচ সেই সিন থেকে আজও বেরোনো হয়নি, এখনও সে দৃশ্য দেখলে বুকের মধ্যে ওলটপালট হবে৷ হবেই৷ আর সে'খানেই লুডো আমার চোখে অনবদ্য, এমন বেশ কিছু সিকুয়েন্সের জন্য৷
একটা ব্যাপার না বললেই নয়, আপাত ক্লিশেগুলো নিয়ে বড় চমৎকার গল্প বলেন অনুরাগবাবু (স্রেফ বরফি দেখে কথাটা বলা৷ এই অপর্যাপ্ত স্যাম্পেলে স্যুইপিং প্রশংসা করতে পারাটাই বোধ হয় আদত ভক্তি)৷ লুডোতেও সেই ব্যাপারটাও ঘটেছে৷ বাপের হাহাকার আর স্নেহ, বদখত মানুষের মনের নরম, আলগোছে পড়ে থাকা একনিষ্ঠ প্রেম - এমন সব প্রবল বলিউডি ক্লিশেগুলোর সরবতে প্যরামাউন্ট সুবাস মিশিয়ে মনভালো করা বেশ কিছু মুহূর্ত তৈরি হয়েছে৷ উয়ো সব ফ্রেম মে ফির সে ওয়াপিস যায়েগা, আবার দেখব 'লুডো'৷
আর। সিনেমা জুড়ে যে'টা তুরুপের তাস - সে'টা হল সারল্য৷ প্রতিটি জটিল চরিত্রের সারল্যটুকুকে ছেঁকে তুলে তৈরি হয়েছে এই প্লট৷
তাছাড়া৷ ভালো সিনেমার একটা বড় সিগনেচার হল 'শো'-য়ের শেষে দর্শকদের মনে সিনেমার গানগুলোর প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা তৈরি করতে পারা, সুর, গায়কি, লিরক্সের বাইরে গিয়ে৷ আবাদ-বরবাদ আর হরদম-হমদম গানদুটো আমি আদৌ সিনেমা দেখার আগে শুনিনি৷ অথচ সিনেমাটা দেখার পর থেকে মনের মধ্যে এই দু'টো গানের সুর ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়ে চলেছে৷ আর সুরের সঙ্গে চলকে উঠছে সিনেমার এক একটা মুখ, প্রবল ভালোলাগা সহ৷ (আর ওই সাতপুরনো 'ও বেটাজি ও বাবুজি' গানটা এমনভাবে মাখনে-ছুরি লেভেলে ব্যবহৃত হয়েছে, উফ। বাপি লাহিড়ির ক্রেড জিঙ্গলটির ম্যাজিকও হার মানতে বাধ্য)
ক্রিটিসিজম? আলবাত আছে৷ বেশ কিছু জায়গার ডায়লগ শীর্ষেন্দু লিখলে যেন আরও ভালো হত৷ বেশ কিছু দৃশ্যের বর্ণনা সিনেমার বদলে সঞ্জীবে কলমে পড়তে পারলে আরও লাগসই হত যেন।