- এই যে ভায়া৷ এই যে।
- রবিদা? আপনি?
- আমি ট্রেন ধরতে আসিনি।
- আমায় ধরতে এসেছেন?
- তুমি তো আর চোর-ডাকাত নও৷ তোমার মাথার ওপর তেমন কোনও ইনামও নেই যে পাকড়াও করে দু'টো বাড়তি টাকা পিপিএফে রাখতে পারব৷
- তবু। আপনার কাছে হাজার তিরিশেক টাকা ধার রয়ে গেছে। এখুনি চাইলে কিন্ত দিতেও পারব না। তবে, টাকাটা মেরে দেব না৷ কোনও না কোনও ভাবে ঠিক..। তা সে আমি যে'খানেই থাকি।
- ইয়ং জেনারেশনের এ এক মস্ত বড় অসুবিধে হে৷ গিভ অ্যান্ড টেক ছাড়া কিছুই দেখতে পাওনা। আমি ধান্দাবাজ হতে পারি, তবে চশমখোর নই।
- ছি ছি রবিদা৷ বাবা মারা যাওয়ার পর এমন অথৈ জলে পড়েছিলাম৷ চাকরীটাও ছাই এমন সময়..। রবিদা, আপনি সে'সময় পাশে এসে না দাঁড়ালে..৷
- তা, এমন ভরদুপুরে..পাততাড়ি গুটিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আমার এজেন্ট খবর দিলে তুমি আন্ডারগ্রাউন্ড হওয়ার তাল করছ৷
- মুঙ্গেরে একটা চাকরীর সম্ভাবনা আছে৷ বিশুর মামা সে'খানে কন্ট্রাক্টরি করছেন৷ উনিই ডাকলেন তাই..।
- তা, তোমার তো ছাত্র পড়ানোয় বেশ রেপুটেশন তৈরী হয়েছে আজকাল৷ আর বেঙ্গলে তো আজকাল টিউশনিই হল ইন্ডাস্ট্রি৷ আচমকা সে'সব ছেড়ে মুঙ্গেরে আবার কেন।
- রবিদা৷ আমি সত্যিই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ৷ কিন্তু সিদ্ধান্তটা একান্তই ব্যক্তিগত৷ এ পাড়ায় আমার আর মন টিকবে না।
- তা অবিশ্যি ঠিক৷ ছেলেছোকরাদের আজকাল প্রাইভেসি নিয়ে হাজার রকমের টালবাহানা শুনি৷ গুরুজনদের সদুপদেশও দিব্যি প্রাইভেসির অছিলায় পাশ কাটিয়ে দেওয়া যায়৷ যাক গে৷ সোয়া চারটের এক্সপ্রেসটা ধরছ কি?
- হ্যাঁ।
- রাত পৌনে আটটায় আর একটা মেল ট্রেন আছে৷ ওই ও'দিকেরই।
- কী ব্যাপার বলুন তো?
- একটি বারের জন্য যে তোমার পাড়ায় ফিরতে হবে ভায়া।
- কিন্তু কেন?
- তোমার বাড়ির দলিলটা আমার কাছে রয়ে গেছিল৷ সে'টা ফেরত দিতে চাই৷ কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মে তো সে'টা দেওয়া সম্ভব নয়৷ কিছু সইসাবুদেরও ব্যাপার রয়েছে৷ তোমায় একটি বারের জন্য আমার অফিসে আসতেই হবে।
- সে কী৷ পুরো টাকাটা এখনও শোধ দেওয়া হয়নি৷ বন্ধক রাখা দলিল ফেরত দেবেনই বা কেন?
- তিরিশ হাজার তো মাত্র বাকি৷ ও নিয়ে তুমি ভেবো না৷ শুধু দলিলটা নিয়ে আমায় মুক্তি দাও।
- রবিদা আমি কিছুই বুঝছি না৷ শুনুন, বাকি তিরিশ হাজারটাকা ফেরত দিয়েই আমি ও দলিল ফেরত নেব৷ কেমন?
- সে'টি হওয়ার নয় ভায়া৷ ও দলিল তোমায় আজই নিতে হবে৷ বিপদে তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি, তুমি নিজের মুখেই স্বীকার করলে৷ করলে তো?
- নিশ্চয়ই৷
- তা'হলে তুমি আমার জন্য এ'টুকু করবে না? ও দলিল আমার থেকে নিয়ে তুমি আমায় মুক্তি দাও ভায়া।
- আমায় দয়া করে ব্যাপারটা খুলে বলবেন?
- আমাদের বাড়ির নারায়ণ কিডন্যাপ হয়েছে ভাই৷
- মানে আপনাদের ওই নারায়ণ শিলা? ঠাকুরঘর থেকে নারায়ণ শিলা চুরি হয়েছে?
- র্যানসম ডিমান্ড করে চিঠিও এসেছে৷ পুলিশ কিছুতেই নারায়ণ শিলা চুরি যাওয়ার কেস নিতে চাইছে না। এ'দিকে নারায়ণ না ফিরে পেলে নির্মূল হয়ে যাব ভাই৷
- র্যানসম?
- ওই৷ তোমার দলিল তোমায় ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত নাকি নারায়ণ ফেরত আসবেন না৷
- সর্বনাশ। আপনি বিশ্বাস করুন রবিদা আমি কিন্তু এ ব্যাপারে কিছুই..।
- আমি বিশ্বাস করতেই চাই ভায়া৷ কিন্তু নারায়ণের অভাবে ঘর যে আমার অন্ধকার। ও দলিল ফেরত নিয়ে তুমি আমায় মুক্তি দাও..।
- কিন্তু এ'টা তো অন্যায়। এক্সটর্শন।
- তুমি নিজের মানুষ ভাই৷ লুকোছাপার আর কী আছে৷ সুদের ব্যাপারে একটু চোরাগোপ্তা গুঁতো মারাটা আমার বিজনেস৷ তোমার ধারের টাকাটা সত্যিই অনেকদিন হল শোধ হয়ে গিয়েছে৷ সুদটা আমি একটু চড়াই রেখেছিলাম, সে'দিক থেকে দেখতে গেলে তোমার বিপদ থেকে একটু মুনাফা কামিয়ে ফেলেছিলাম৷ সে'টাও তো এক্সটর্শন৷ কে জানে, নারায়ণ রেগে ফায়্যার হয়ে নিজেই গায়েব হয়ে ওই মুক্তিপণের চিঠি পাঠিয়েছেন কিনা৷ তিরিশ হাজার বাকি কী হে, পাওনাগণ্ডা ইতিমধ্যেই কড়ায়গণ্ডায় উশুল হয়ে গিয়েছে৷ এ'বার ওই দলিলটা ফেরত নিয়ে আমায় রক্ষে কর ভায়া৷ না বললে কিছুতেই শুনছি না৷ ওই দ্যাখো, দু'জন পালোয়ান নিয়ে এসেছি৷ তুমি নরম কথায় ফিরতে রাজী না হলে আমি তোমায় চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাব৷ কিন্তু ও দলিল আমি আর রাখব না৷
**
- এত রাত্রে ফোন করার কী মানে?
- হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর ইন্সপিরেশন, দাপুটে প্রফেসর আর সান্যাল বাড়ির বৌ আজকাল হাতসাফাই শুরু করেছে।
- এ'সব বাজে কথার কী মানে?
- শুধু হাতসাফাই নয়৷ রীতিমতো মুক্তিপণ চেয়ে হুমকি।
- ফোন রাখ দীপু৷
- ছিঃ। শেষ পর্যন্ত নিজের ভাশুরের ঠাকুরঘর থেকে চুরি করতে গেলি?
- ফোন রাখ৷ তোর মাথা গেছে৷ আমি সুস্থ আছি।
- আমি দলিলটা ফেরত পাওয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই রবি সান্যালের নারায়ণ শিলা ফেরত এসেছে৷ ভোজবাজি৷ তাই না?
- দীপু, পাড়া ছাড়িস না।
- তুই কী ভেবেছিস, আমি কৃতজ্ঞ থাকব? তুই আমার হয়ে গুণ্ডামি করেছিস বলে? আর কেউ না জানুক, আমিও জানব না ভেবেছিলিস?
- আমি ভেবেছিলাম কাকীমার স্মৃতিটুকুকে অত সহজে তুই ভাসিয়ে দিবি না৷
- মা আর নেই৷
- মা নেই তাই সব মিথ্যে? বাউণ্ডুলে হয়ে সমস্ত ভাসিয়ে দিবি?
- তোর কী?
- তোর কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব আমি৷ খুব লায়েক হয়েছিস না? সব ভুলে ফ্যা ফ্যা করে দুনিয়া চষে বেড়াবি? বাপ-মায়ের সমস্ত স্মৃতি ভাসিয়ে দিয়ে ড্যাংড্যাং করে নেচে বেড়াবি?
- মানুষগুলোই তো নেই, স্মৃতির নামে ওই পুরনো আধভাঙা বাড়ি আগলে রেখে করবই বা কী?
- আমিও নেই, না রে দীপু?
- নেই৷ তোর থাকতেও নেই।
- পাড়ায় ফের বাবু৷ তোর বাড়ি, তোর শহর৷ তোর সমস্তকিছু৷ ফের।
- ও বাড়িতে আর ফেরা হবে না রে। ও পাড়াতেও না।
- তুই সত্যিই আর ফিরবি না?
- তুই কান ধরে টানলেও না। যাক গে, আমার একটা কাজ করবি?
- আমি? আমি করব? তোর কাজ?
- মা নেই৷ গার্জেন বলতে স্রেফ তুই। তাই, তোকেই বলি৷ তিরিশ হাজার টাকা কোনওক্রমে জোগাড় করেছি৷ তবে রবিদা ও টাকা আর নেবে বলে মনে হয়না। তুই তো অনেক এনজিওর সঙ্গে কাজ করিস, টাকাটার একটা হিল্লে করে দে দেখি৷ লোকের উপকারে লাগুক৷ বাবার নামে নেওয়া ধার, শোধ না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না৷
- যাস না।
- হেহ্৷ এ ঘ্যানঘ্যানের দায় শুধু আমার৷
- যাস না বাবু৷ আমি মন্দ নই৷
- তুই মন্দ হলে যে সমস্ত মাটি৷ কভি নহি৷ তুই অ্যান্টি-মন্দ। তুই ভালো-য়েস্ট৷
- যাস না।
- আসি৷ টাকার ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি জানাস৷ টাকাটার হিল্লে হলে এই যন্ত্রণার মোবাইল ফোনটা ত্যাগ করব। মুঙ্গেরে শ্রমিক তদারকির কাজ, মোবাইল ছাড়াও দিব্যি চলে যায়৷
- আচ্ছা৷ আয়।
- জানিস, তোর সঙ্গে কথা হলেই বড় মায়ের কথা মনে পড়ে৷ মা তোকে বড় ভালোবাসত।
- আমি ভালো মা হব, কেমন বাবু?
- একশো বার হবি৷ দি বেস্ট।
- যাস না বাবু।
- ইয়ে, টাকার ব্যাপারটা ভাবছি এই মুঙ্গেরেই মিটিয়ে নেব৷ গরীব অসহার মানুষ তো এ'খানেও কম নেই৷ কারুর উপকারে ঠিক লেগে যাবে৷ তুই ও নিয়ে আর ভাবিস না।
- আয় বাবু।
- আসি৷
No comments:
Post a Comment