- ও নিতাইদা, টুয়েন্টি নাইন হবে নাকি? ভজা আর রতন রেডি৷
- না রে মধু। এই সবে অফিস থেকে ফিরলাম। বড় ক্লান্ত৷ ভাবছি সাততাড়াতাড়ি ডিনারটা সেরে লম্বা হব।
- আজ মেসে নতুন রাঁধুনি এসেছে৷ তার হাতে ডাল আর ঝোলের নাকি একদর।
- অমিয়বাবুর কাছে এ'বার একটা প্রটেস্ট না জানালেই নয়। মাস গেলে এতগুলো টাকা দিই আমরা। অথচ আজ ছ'মাস হল একটা ভালো রাঁধুনি জোগাড় করতে পারছেন না উনি?
- মাথা গরম করে আর কী হবে গো নিতাইদা।
- সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর মেসে ফিরে যদি তৃপ্তি করে ভাত মাছেরঝোলটুকুও না খেতে পারি, মেজাজ ঠিক থাকবে কী করে। ধুরছাই।
- বড় ক্লান্ত তুমি। তাই না নিতাইদা?
- কাজের যা চাপ রে মধু। আর ভাল্লাগেনা।
- তোমার মেজাজটা ঠিক..উঁহু৷ শুধু কাজের চাপ তো নয়। মনখারাপ নিতাইদা? বাড়ির জন্য?
- কদ্দিন বাড়ি যাইনা বল দেখি। কদ্দিন।
- খোকা কত বড় হল?
- এই পৌষে ছয়ে পড়বে।
- ফোনে কথা হয় তো ওর সঙ্গে রোজ৷ তাই না?
- খোকার গায়ের মিষ্টি গন্ধ কী আর ফোনে পাওয়া যায় রে মধু। তাছাড়া কদ্দিন তোর বৌদির পাশে বসে তার সঙ্গে প্রাণ খুলে গপ্প হয়না৷ আমার ভাই সামনের মাসে পার্ট টু পরীক্ষা দেবে, সে ব্যাটা কেমন প্রিপেয়ার করছে, সে'খবরটুকু পর্যন্ত রাখতে পারিনা।
- নিতাইদা, একটা শ্যামাসঙ্গীত শুনবে?
- সে কী রে। ভজা রতনকে বসিয়ে রেখে এসেছিস তো টুয়েন্টি নাইনের জন্য৷ অনিন্দ্য ফিরেছে কিনা দেখ, ট্যুয়েন্টি নাইনের পার্টনার পেয়ে যাবি।
- গলার সুর না থাকে, বুকে দরদটুকু তো আছে৷ টুয়েন্টি নাইন হবে'খন৷ শ্যামাসঙ্গীতটা ধরি?
- ধরবি? বহুত অচ্ছা।
- জ্যেঠু বলতেন আমার গলার টেক্সচারে কোথাও যেন সামান্য পান্নালাল মিশে আছে।
- নাহ্৷ এই ভালো। তোর গানই ভালো। মেসের ওই বিস্বাদ ভাত খেয়ে তো আর দিনগত পাপক্ষয়ের ক্লান্তি মিটবে না। শ্যামাসঙ্গীতে যদি একটা হিল্লে হয়।
**
'আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠনা ফুটে মন" ধরলে মধু। মেসের জানালা দিয়ে ভেসে আসা উত্তর কলকাতার গলি কাঁপানো শোরগোল ভিজে নরম হয়ে পড়ল মধুর দরাজ কণ্ঠস্বরে।
আর বিছানায় ও'পাশ ফিরে শুলেন নিতাই কর্মকার৷ বাড়ির জন্য মনকেমনে একজন দামড়া কেরানী মানুষের চোখ ভিজে যাওয়াটা সামান্য লজ্জার বলে মনে হয় তাঁর। মনভারটা এতক্ষণ দিব্যি চেপেচুপে রেখেছিলেন, কিন্তু ব্যাটাচ্ছেলে মধুর শ্যামাসঙ্গীতে সমস্ত হিসেব গোলমাল হয়ে গেল। বড় একা লাগে নিতাইবাবুর, বড্ড একা লাগে।
ও'দিকে মধু জানে ভজা আর রতন দাবা খেলতে ব্যস্ত, তারা মোটেও ট্যুয়েন্টি নাইনে সন্ধ্যে নষ্ট করতে উৎসুক নয়। টুয়েন্টি নাইন নিমন্ত্রণের অছিলায় শুধু অবসন্ন নিতাইদার পাশে এসে কিছুক্ষণ থাকা৷ আহা, বাড়িঘরদোর পরিবার ছেড়ে মানুষটা এতদূরে পড়ে আছে৷ আজ সন্ধেবেলা নিতাইদাকে দেখেই মনে হয়েছে আজ যেন সে একটু বেশিই অবসন্ন, আজ যেন নিতাইদার একটু বাড়তি মনখারাপ। এই মনখারাপের গুমোটে নিতাইদা যে একা আটকে নেই, এ কথাটা তো আর গায়ে পড়ে বলা যায়না৷ কিন্তু গায়ে পড়ে শ্যামাসঙ্গীত দিব্যি গাওয়া যায়৷
No comments:
Post a Comment