Sunday, January 31, 2021

এক্সেলেন্স

- স্যার, বলছিলাম যে..।

- কিছু বলার দরকারটা কী দত্ত?

- না মানে...।

- তিনটে রিপোর্ট আজ সন্ধ্যের মধ্যেই চাই।

- আসলে তিনটেই এত দেরী করে হাতে পেলাম..।

- ওরে আমার  নেকুচন্দ্র ঘ্যানঘ্যানবাহাদুর রে৷ রিপোর্টের ফরমায়েশ নাকি দেরী করে হাতে পেয়েছেন। শোনো, বড়সাহেবকে তো তোমায় জবাবদিহি করতে হয় না, আমায় করতে হয়৷ রিপোর্ট তিনটে আজকেই চাই...। যেমন ভাবে খুশি কাগেরঠ্যাংবগেরঠ্যাং সাজিয়ে দাও, কিন্তু দিতে হবেই৷ 

- না মানে বলছিলাম যে..।

- আবার! আবার বলবে? কাজ ফেলে এত গপ্পগুজবের সময় পাও কোথা থেকে?

- ইয়ে, গল্পগুজব নয়৷ একটা জরুরী পার্সোনাল দরকারে..।

- অফিসে পার্সোনাল দরকার টেনে আনার দরকারটাই বা কী? দেখো দত্ত, তিনটে রিপোর্ট আমার মেলে আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চাই..।

- কিন্তু রিপোর্টগুলো ভালোভাবে তৈরি করতে তো সময় দরকার। ব্যাপারগুলো কম্পলিকেটেড..।

- এই শুরু অজুহাত।  

- কিন্তু এক্সেলেন্সের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে..।

- ও'সব শৌখিন ইংরেজি কফিহাউসের দেখনাই ফিল্ম ক্রিটিসিজমে ঝেড়ো দত্ত। অফিসে নয়। আর এক্সেলেন্সের ঝোল দিয়ে বরং কাল দুপুরে ভাত মেখে খেয়ো৷ এখন দয়া করে রিপোর্ট তিনটে ইমিডিয়েটলি জমা করো নয়ত বড়সাহেব আমায় আস্ত রাখবেন না।

 - কিন্তু স্যার, তার আগে ওই আমার ওই কথাটা..।

- কালকে শুনব। 

- কিন্তু স্যার..।

- আর একটাও বাজে কথা নয়।

***

- হ্যালো..।

- কী ব্যাপার? ফোন তুলছিলে না কেন?

- ইয়ে, আসলে জরুরী তিনটে রিপোর্ট..।

- বসকে বলেছ আগামীকাল ছুটি নেবে?

- ছুটি? 

- বলোনি, তাই না?

- আসলে আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কিছুতেই...ও কী...যাহ্। বোঝো কাণ্ড! কেটে দিল।

***

বাবুঘাটের এই বেঞ্চিটা দত্তবাবুর বড় পছন্দের। সন্ধ্যের দিকে ফাঁকাই থাকা। অফিসফেরতা বাস থেকে মাঝেমধ্যে নেমে পড়েন, থেরাপির জন্য৷ অফিসের ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসে গোপন ওষুধ; বাঁটুল সমগ্র বা নন্টে-ফন্টে সমগ্র বা হাঁদা-ভোঁদা সমগ্র৷ কাছের স্টল থেকে কেনা লেবু চা আর ডিমসেদ্ধর পাশাপাশি নারায়ণ দেবনাথের "ইয়াইকস, বাপস, গেলুম রে" মার্কা থেরাপিতে মনের জঞ্জাল সাফ হয়ে আসে। 

ওপরওলা তিনটে রিপোর্টে কোয়ালিটি আশা করেননি, শুধু আজ্ঞাবহ দাসের কলমপেষা নাকখত চেয়েছিলেন৷ কিন্তু গায়ে পড়ে সে রিপোর্টে 'এক্সেলেন্স' গুঁজে দিতে পেরেছেন দত্তবাবু৷ হ্যাঁ, তার জন্য তাঁকে ঘণ্টাদুই বেশি অফিসে বসে থাকতে হয়েছে, তা হোক। কিন্তু আজ্ঞাবহ হতে গিয়ে কাগেরঠ্যাংবগেরঠ্যাং গছিয়ে দেওয়ার বান্দা তিনি নন। অবিশ্যি এক্সেলেন্স আঁকড়ে বসে থাকাটা কর্পোরেট আখেরের জন্য যে তেমন সুবিধের নয় তা দত্তবাবু দিব্যি জানেন৷ তবে নারায়ণ দেবনাথের থেরাপি আর বাবুঘাটের গঙ্গার হাওয়ায় সমস্ত ক্লান্তি আর গ্লানি ভ্যানিশ হয়ে যায়, সে'টাই বড় কথা। 

কালকের ছুটির ব্যাপারটাও অবশ্য কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারেননি। ওপরওলারা এক্সেলেন্সের কদর করে না, তাদের চাই আজ্ঞাবহ কেরানী। না করুক গে। নিজের পিঠ মাঝেমধ্যে নিজে চাপড়ে নিতে কসুর করেননা দত্তবাবু৷ তাই কালকের জন্য আগাম ক্যাসুয়াল লীভ না জুটলেও কুছ পরোয়া নহি। মাইনে কাটা গেলে যাক৷ কাল তিনি নিজের ছুটি নিজেই মঞ্জুর করেছেন। 

"বিকজ ইউ ডিজার্ভ ইট মিস্টার দত্ত", কথাটা নিজেকে বলে তৃপ্তির হাসি হাসলেন দত্তবাবু৷

Wednesday, January 27, 2021

আশ্রয়

- এসেছো সমরদা? উফ, কদ্দিন পর দেখা বলো তো৷ অন্তত তিনমাস তো বটেই?

- আরে অনন্ত৷ কদ্দিন পর তোমায় বাড়ি এলাম ভায়া৷ কদ্দিন পর। 

- বিধুকে বলি আগে দু'কাপ চা দিতে৷ কেমন? আপনার পছন্দের আর্লগ্রে আনিয়ে রেখেছি৷

- বিধুকে বরং দু'কাপ চা দিতে বলো৷ আর্লগ্রে আছে?

- ওহে বিধু দু'কাপ চা দিয়ে যা৷ ওই কাবার্ডে একটা নতুন চায়ের প্যাকেট রাখা আছে৷ সে'খান থেকে পাতা নিয়ে নে৷ তারপর সমরদা! খবরটবর সব ভালো?

- আমি তো অনেকদিন থেকেই বলছি ভায়া৷ তোমার এ বসার ঘরে আলো বড় কম৷ টিউবদু'টো চেঞ্জ না করলেই নয়। 

- আপনি দিল্লী গেলেন ছেলের কাছে কিছুদিন কাটাতে৷ এ'দিকে আমি এক্কেবারে একাবোকা৷ গোটাদিন অফিসের খ্যাচম্যাচ, আর ফিরে এসে বিধুর গজরগজর৷ আমাদের উইকলি আড্ডার অক্সিজেন ছাড়া নাভিশ্বাস উঠছিল যে। 

- তা অবশ্য ঠিক৷ আজকাল নিউজচ্যানেলগুলো দেখলেই বদহজম হয়৷

- এদ্দিন পর আপনি আসায় যেন বুকে বল পেলাম। কী ভালো যে লাগছে৷ ফ্রিজে মৌরলা আছে, বিধুকে মুচমুচে করে ভাজতে বলি?

- সে'টা অবশ্য ভুল বলোনি অনন্ত৷ যত নষ্টের গোড়া এই পলিটিক্স৷ 

- অ্যাই বিধু, ফ্রিজ থেকে মৌরলাটা বের করে রাখ৷ ভাজা খাব। তা সমরদা, দিল্লী শহরটা বৌদির কেমন লাগল?

- চিকেন চিলিটা বাড়াবাড়ি হবে৷ তুমি বরং বিধুকে ভাতেভাত করে দিতে বলো৷ রাতের খাওয়াটা না হয় তোমার এখানেই সেরে নেব।

- বৌদির জন্যও না হয় একটা টিফিন বাক্সে খাবার দিয়ে দেব'খন।

- হ্যাঁ, তোমার বৌদিও তাই বলে৷ দুষ্ট গরুর চেয়ে ভ্যাকেন্ট গোয়াল ইজ বেটার৷

- সমরদা৷ আপনাকে পেয়ে যে কী ভালো লাগছে৷

- শীত শীত ভাব যে একটা আছে সে'টা ডিনাই করছি না৷ তবে বাতাসে এখনও শীতের কামড় নেই।

- জানেন সমরদা৷ মিতা আর ফিরবে না৷ ডিভোর্সের কাগজপত্র তৈরি করছে ওর উকিল।

- হুঁ। সে শীতও নেই, পিকনিকের সে আমেজও নেই৷

- অবশ্য আমি মিতার দোষ দেখিনা৷ আমিই ঠিক ওর বন্ধু হয়ে উঠতে পারিনি৷ কিন্তু আপনি তো জানেন সমরদা, আমার ভালোবাসায় কোনও খাদ ছিল না। এখনও নেই।

- বেশ তো৷ বিষ্ণুপুরেই যাওয়া যাক একদিন৷ তোমার বৌদিও বলছিল..। নাকি পুরুলিয়া যাবে?

- বছরখানেক আগে একবার আমি আর মিতা দিনদুয়েকের জন্য পুরুলিয়া গেছিলাম৷ শীতকালেই৷ বিউটিফুল৷ বড় মনখারাপ হয় আজকাল সে'সব ভেবে জানেন৷ আর নিজের কান মলতেও ইচ্ছে করে খুব৷ একটু ভালো পার্টনার যদি হতে পারতাম...৷ মিতা বড় ভালো মেয়ে, জানে? বড় ভালো৷ আমিই শালা একটা আস্ত রাস্কেল৷ 

- আরে ধুর ধুর। ভালো মিষ্টি খেতে চাইলে বরং চন্দননগর চলো৷ তোমাদের কলকাতার মিষ্টিতে কেত আছে, কিন্তু সেনসিটিভিটিতে চন্দননগরকে টেক্কা দিতে পারবে না৷ 

- মিতা আমায় সুযোগ কম দেয়নি৷ আমিই ওর যোগ্য নই৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন সমরদা, আমি মনেপ্রাণে চাই ও ভালো থাকুক৷

- সত্যিই তো৷ সত্যিই তো৷ টপ-কোয়ালিটি বোঁদে দিয়ে মুড়ি মাখা..আহা, সে যে অমৃত।

***

- মালটা গেছে?

- কতবার বলেছি বিধু৷ সমরদার সম্বন্ধে তুই ওই ভাষায় কথা বলবি না৷

- ঘাট হয়েছে৷ তবে ওই বদ্ধ কালার সঙ্গে যে কী'ভাবে আপনি অত খোশ গল্প জোড়েন তা মা তারাই জানেন!

- তা'তে তোর কী? শোন৷ আগামী শনিবার সমরদা ফের আসবেন৷ ভালো বোয়াল রেঁধে খাওয়াস দেখি সে'দিন৷ সমরদা বেশ পছন্দ করে বোয়াল৷ 

***

- কাজটা কিন্তু মোটেও ঠিক করোনি তুমি।

- তুমি ব্যাপারটা বুঝছ না গিন্নী..।

- অনন্ত কিন্তু তোমায় সত্যিই ভালোবাসে৷ তুমি ওর বাড়িতে গেলে কত খুশি হয়৷ আর ওর কাছে এত বড় খবরটা তুমি চেপে গেলে?

- ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দেব৷ ভেবেছিলাম কথার মাঝখানে দুম করে জানাব যে খোকা দিল্লীতে আমার কানে অপারেশন করিয়েছে৷ এখন আমি মোটামুটি শুনতে পারি৷ অনন্ত খুব খুশিও হত৷ কিন্তু..।

- কিন্তু বললে না কেন?

- অনন্ত তো বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট। অথচ আমাদের সাপ্তাহিক আড্ডা সে এত ভালোবাসে৷ কেন জান? কারণ এদ্দিন আমি শুনতে না পেলেও অনন্তর কাছে আমিই ছিলাম আদত শ্রোতা।  গল্পগুজবের মানুষ আকচার জুটে যায়, কিন্তু মনের কথা প্রাণখুলে নিশ্চিন্তে বলতে পারার আশ্র‍য় সহজে জোটেনা৷ আজ বুঝলাম আমি অনন্তর সেই আশ্রয়, আমি তাঁর কনফেশন বক্সও বটে৷ আমি এমন একজন শ্রোতা যে শুধু শুনে যায় অথচ তাঁকে পালটা জ্ঞান দিয়ে পর্যুদস্ত করে না, মর‍্যালিটির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে ফেলে না৷ এদ্দিন বদ্ধ কালা ছিলাম বলেই হয়ত I was the best listener that অনন্ত ever had। আর আজ যখন সে'টা টের পেলাম, কিছুতেই  অনন্তর সেই কনফেশন বক্সটুকু কেড়ে নিতে মন সরল না৷ 

- তুমি অনন্তকে কোনওদিনই জানাবে না যে তুমি শুনতে পাও?

- এই ভালো গিন্নী। এই ভালো।

Sunday, January 24, 2021

প্রিয় ফুল


- ইয়ে,তোমার কোন ফুল পছন্দ যেন?
- ফুল?
- বলো না৷
- তোমার শরীরটরীর ঠিক আছে? এতবছর পর আজ হঠাৎ প্রিয় ফুলের খোঁজ নিচ্ছ যে বড়?
- আহ, বলই না৷ তোমার সবেতেই একটা ইয়ে..।
- এই শোনো, ঝেড়ে কাশো দেখি৷
- মানে ওই৷ আসলে, এদ্দিনের ওই ঝুলে থাকা প্রমোশনটা শেষ পর্যন্ত হচ্ছে৷ বড়সাহেব আজ কনফার্ম করলেন৷ মেয়ের জন্য একটা জবরদস্ত কলম কিনলাম৷ ওই যে, যে'টা ও গত হপ্তায় দেখেছিল৷ ফাউন্টেন৷ তারপর ভাবলাম তোমায় সারপ্রাইজ দিয়ে যদি এক গোছা..কিন্তু ফুলের দোকানে এসে সব গুলিয়ে গেল। এত কিছু এ'খানে, অথচ আমি ওই জবা, রজনী, গাঁদার বাইরে কিছুই ঠিক ঠাহর করতে পারিনা৷
- ভালো মাফলারটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছ আজ,শীতের সন্ধ্যেয় টইটই করে না ঘুরে সোজা বাড়ি ফেরো দেখি৷ আজ একটা ট্যাক্সি নিও বরং৷ আর শোনো, ভালো ফুলকপি উঠেছে আজকাল৷ দু'জোড়া এনো, কেমন?

ডিসিপ্লিন

কিছুদিন আগেই টের পেলাম যে কথায় কথায় কারণে-অকারণে রোজ রোজ সন্দেশ রসগোল্লা খাওয়া হয়ে যাচ্ছে৷ ব্যাপারটা আদৌ স্বাস্থ্যকর নয়। আবার মিষ্টি একদম ঘ্যাচাং করে বাদ দিলেও মন আনচান করবে৷
কাজেই বাড়িতে এলো তালমিছরি। একটুকরো মুখে দিলেই আনচান কেটে যাবে। রোজ রোজ সন্দেশ-রসগোল্লা খাওয়ার যে বিশ্রী অপরাধ-বোধ; সে'টাও পাশ কাটানো যাবে। এক্কেবারে কম্পাস-বসানো হিসেব।
তাই বলে রোজ রোজ তালমিছরি খাব? সামান্য 'ভ্যারাইটি' না হলে কি চলে?
বেশ, ঘরে এলো পাটালি। রাতের খাবার পর, একটা ছোট্ট টুকরো - নিজেকে কথা দিলাম। তোফা।
এ'বার গত দিনচারেক ধরে গুড়ের রসগোল্লার পাশাপাশি পাটালি আর তালমিছরি একসঙ্গে নিজের ওপর ফায়্যার করে চলেছি।
মুক্তি নেই। নেই।

ব্যস্ত

- কী রে৷ এত রাত হল, খেয়ে নে৷
- উঁ।
- কই ওঠ৷ খেতে চ'।
- উঁ?
- আরে, সেই সন্ধ্যে থেকে শুয়ে আছিস। ওঠ।
- উঠতেই হবে রে মেজদা?
- খেতে হবে না?
- আমি ব্যস্ত।
- ব্যস্ত?
- আই অ্যাম ল্যাদগুইশিং।
- ল্যাদগুইশিং?
- ল্যাদ খেয়ে খেয়ে ল্যাংগুইশিং।
- তোর হবে।
- টু কোট চন্দ্রবিন্দু; কে জানে বাবা কবে।

নির্ভুল

গিজার অন করলাম। বাহ্৷
দু'টো শ্যামল মিত্রের গান শুনলাম, এ সময়ে জল যথেষ্ট গরম হওয়া দরকার। নির্ভুল জানুয়ারিস্ট স্ট্র্যাটেজি।
বোনাসে শুনলাম মান্নাবাবুর "এ নদী এমন নদী"৷ জল এক্কেবারে ঘ্যাচাং-গরম চাই৷ বহুত খুব।
এরপর সেই মখমলে সুরে ভেসে ভেসে বাথরুমে গেলাম৷ দু'টো সুপরিচিত নল৷ তবে আগে মিনিট দুই গিজারের জ্বলন্ত লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে থেকে গাইলাম
"এখনও ডুব না দিলে হায়গো স্নান করবে কবে"?
গানের সুর স্তিমিত হয়ে আসার আগেই নল চালু করলাম। বালতি ভরল৷ তারপর ঝপাৎ স্পীডে আধ-মাইক্রোসেকেন্ডে কয়েক মগ স্ট্রেট-টু-তালু৷
ঠাণ্ডা জলের নল খুলেছিলাম৷
পরাস্ত বিধ্বস্ত বরফকুচি মাখানো দেহটাকে কোনও মত টেনে হিঁচড়ে সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে গিজার বন্ধ করে বেরিয়ে এলাম৷

জননেতা



- ভায়া, নমস্কার।
- আমি আপনার ইয়ারদোস্ত নই৷ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। জননেতা৷ ভায়া আবার কী? স্যার বলুন৷ নিদেনপক্ষে দাদা।
- ওহো৷ সরি, সরি৷ হে হে৷ নমস্কার স্যার দাদা৷
- আহ৷ হয় স্যার নয় দাদা।
- বেশ বেশ৷ নমস্কার হয়স্যারনয়দাদা।
- ধের৷ যাকগে। তা আমার অফিসে কী মনে করে? কী চাই?
- আজ্ঞে, হয়স্যারনয়দাদামশাই। আমিও লাইনের লোক৷
- আপনিও লাইনের লোক? এর মানেটা কী?
- মানে ওই৷ কী বললেন যেন? রাজনীতিবিদ৷
- মস্করা হচ্ছে? বেশি ফচকেমো করলে ছেলেদের ডেকে দেব দু'ঘা!
- আরে মাইরি৷ আমিও রাজনীতিবিদ৷ আপনার অফিসের বাইরে দু'টো টেম্পো ভরে আমার ছেলেরাও অপেক্ষা করছে৷ আপনার ছেলেরা লাফালাফি করলেই তারাও নেত্য শুরু করবে৷
- এত পাঁয়তারা না কষে নিজের পরিচয়টা স্পষ্টভাবে দিন।
- হয়স্যারনয়দাদা, উত্তেজিত হবেন না প্লীজ৷ জননেতারা মেজাজ হারালে কী চলে? আরে সে কাজ তো তাদের পোষা মাস্তানদের। যাক গে, আমার নাম মনোহর ধর৷ অমুক পার্টিতে রয়েছি৷
- অমুক পার্টি? মানে আমাদের তমুক পার্টির আর্চ রাইভাল? কিন্তু আপনাকে তো কোথাও দেখেছি বলে..।
- আজ্ঞে আমি ব্যাকএন্ডের মানুষ৷ আপনার মত জননেতা আমায় দেখবেনই বা কেন৷
- ব্যাকএন্ড?
- ওই৷ হেডহান্টার৷ ডীল ক্লোজ করে থাকি৷
- তা আমার কাছে কী মনে করে ধরবাবু?
- আপনার জনসমর্থন আছে। লোকে আপনার কদর করে। আপনার পোষা গুণ্ডাদের ভয় পায়৷ এ'সব দেখে আমাদের হাইকম্যান্ড এক্কেবারে ইম্প্রেসড।
- আপনারা? গত ইলেকশনে গোহারান হেরেও ইম্প্রেসড?
- ইলেকশন-টিলেকশন বোঝার লোক আমি নই হয়স্যারনয়দাদা৷ আমি বুঝি ডীল৷
- তা এ'খানে কী ডীল চাই?
- ওই৷ আপনার জনসমর্থন আর গুণ্ডাবেস-সহ আপনাকে কিনতে চাই৷ আপনার প্রাইসটা কাইন্ডলি বলে দিন৷
- হাউ ডেয়ার ইউ? রাস্কেল কোথাকার!
- পাঁচ কোটি।
- আচ্ছা নচ্ছার লোক তো আপনি! যখন খুশি যাকে খুশি চাইলেই কেনা যায় ভেবেছেন?
- সাত কোটি।
- তবে রে শুয়ার! শুনে রাখ৷ আমায় লোকে ভালোবাসে। ভক্তি করে৷
- বেশ৷ দশ কোটি৷
- খবরদার বলছি৷ আইডিয়ালের জন্য প্রাণপাত করতে পারি আমি৷ আর একবার যদি শুনি..।
- পঁচিশ।
- ইয়ে..। পঁ..পঁ...!
- পঁচিশ বরং বাদ থাক৷ তিরিশ৷ কোটি।
- ইয়ে, স্যার৷ শুনুন।
- আমি পাতি মানুষ হয়স্যারনয়দাদা৷ আমায় মনোহর বলেই ডাকবেন৷ মনু বলেও ডাকতে পারেন৷ আর হ্যাঁ, চল্লিশ কোটি৷
- ওহ৷ মানে, মনুবাবু। ইয়ে, বুঝতেই পারছেন...এমন দুম করে পালটি খাওয়াটা ঠিক সমীচীন হবে না। আসলে মানুষ তো..।
- পঞ্চাশ কোটি৷
- আমি রাজী!
- ভেরি গুড৷ আপনার ছেলেদের নিয়ে তা'হলে কাল বেলা দশটা নাগাদ আমাদের অফিসে চলে আসবেন৷ দু'হপ্তার একটা কোর্স করে তারপর পার্টিতে জয়েন করে ফেলবেন৷
- কোর্স? কীসের?
- চামড়াটা একটু মোটা করিয়ে নেওয়ার৷ ও সিলেবাস রেডি আছে, আপনাকে ভাবতে হবে না৷ হয়ে যাবে।
- ইয়ে, চামড়া বুঝি এখনও যথেষ্ট মোটা হয়নি?
- হয়নি। এভ্রিওয়ান হ্যাস আ প্রাইস হয়স্যারনয়দাদা মশাই৷ সবারই ব্রেকিং পয়েন্ট আছে৷ আইডয়ালিজম, সততা, জনসমর্থন; সবকিছুই ভেঙে গড়িয়ে নেওয়া যায় সঠিক দাম জানলে। আপনাকে পারচেজ করার জন্য বাজেট ছিল আশি কোটির, অথচ আপনি পঞ্চাশেই কাত হলেন। গায়ের চামড়া সাফিশিয়েন্টলি মোটা হলে আরও কিছুক্ষণ আইডিয়ালিজমের দোহাই পেড়ে নিজের দর বাড়াতে পারতেন।
- এহ হে।
- এখন আসি হয়স্যারনয়দাদা মশাই৷ কাল তা'হলে আমাদের পার্টি অফিসেই দেখা হচ্ছে? আজ আবার শপিং ডে কিনা, আরও বেশ কয়েকটা জায়গায় ছুটতে হবে৷ আসি, কেমন?

ভ্যাকেশনে ভাগ্নে


- মামা, চললাম ভ্যাকেশনে৷
- ভ্যাকেশন?
- ইয়েস স্যার৷ ঝাড়া দু'হপ্তা৷
- অফিস ছুটি দিলে?
- আরে ছুটি নিতেই হবে বলে বসের কী ঝোলাঝুলি৷ ক'দিন কোথাও ঘুরে না আসলে নাকি আমার প্রডাক্টিভিটি অপটিমাইজ করা যাবে না৷
- তা চললি কোথায়?
- বহু দূর৷ ক'টা দিন আরামে কাটানো যাবে - এই অসহ্য নিস্তব্ধতা থেকে হাজারখানেক মাইল দূরে৷ এ'কদিন শুধু হইচই গোলমাল আর হট্টগোল৷
- আহ! পিসফুল৷ ডেস্টিনেশনটা কোথায় রে ভাগ্নে?
- কী হিংসে হচ্ছে নাকি মামা? তবে আরও শোনো। সে'খানে বাতাস এমন ম্যাড়মেড়ে নয়৷ এ'খানের বাতাসে শ্বাস নেওয়া যায় নাকি ছাই? শুধু অক্সিজেন আর অক্সিজেন৷ ধুর ধুর৷ ক'দিন একটু ধুলোবালি বুকে নিয়ে রিল্যাক্স করব৷ আর সবচেয়ে বড় কথা মামা, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেই টের পাবো পোড়া পেট্রোলের সুবাস৷
- এক্সটিক ব্যাপার তো রে।
- অফ কৌর্স৷ তাছাড়া এত নিরিবিলি মামা, প্রাণ এক্কেবারে হাঁপিয়ে উঠছিল৷ আর মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়েও মানুষজনের দেখা মেলেনা এখানে৷ ছ্যাঁহ্৷ ছুটিতে গিয়ে ভীড় ছাড়া একটি পা'ও এগোনো নয়৷
- আরিব্বাস ভাগ্নে৷ শহর চললি নাকি?
- যে'সে শহর নয় মামা। এক্কেবারে মেট্রোসিটি৷ সে'খানে কয়েকদিন স্রেফ রিল্যাক্স করা৷ শশব্যস্ত হয়ে দৌড়ঝাঁপ, ট্রেনেবাসে ঝুলোঝুলি; ব্যাস৷ ক'দিন পরেই তো আবার সেই আলসেমিতে ফিরে আসতেই হবে৷
- মাইরি রে ভাগ্নে৷ এই ম্যাদামারা বরফ ঢাকা পাহাড়ে থেকে থেকে প্রাণ আইঢাই করে ওঠে রে৷ ভাবছি ঝুলে পড়ব তোর সঙ্গে৷ শহরে গিয়ে কিছুদিন যোগনিদ্রায় না কাটালেই নয়৷

প্রেম-ফ্রেম


- প্রেমে দাগা খাওয়ার যন্ত্রণা...সে যে অসহ্য।
- তা ঠিক, তবে কী জানো ভায়া, দাঁতের ব্যথার কাছে সে যন্ত্রণা হল নেকু সুড়সুড়ি মাত্র।

***
- বাতাসে একটা বেশ, প্রেম প্রেম ইয়ে, তাই না?
- রিল্যাক্স। পাশের বাড়ির পিসিমা বোধ হয় ফুলকপির শিঙাড়া ভাজছেন ভাই। বাতাসের ইয়ের সোর্স ওটাই।

***
- শীতের কলকাতা। সন্ধ্যে নাম্বার ঠিক আগে ময়দানে বসা প্রেম আর আড্ডা। তার যে কী রোম্যান্স...উফ!
- প্রসেসটা বইয়ে পড়লে রোম্যান্টিক ভায়া। সমস্যা হচ্ছে ময়দানের খচ্চর মশারা সেসব বইকে তেমন পাত্তা দেয় না।

***
- ভালোবেসে দেবদাসের মত নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চাই।সমস্ত ধান্দাবাজি ভুলে, নিজের ভালোমন্দ ভুলে, উজাড় করে দিয়ে, স্রেফ নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চাই।
- ভেরি গুড। তবে নিজের ভালো ভুলে ভেসে যাইতে চাইলে তার চেয়েও একটা সরেস অপশন আছে ভায়া। গোলবাড়ির কোলেস্টেরলে ভেসে যাওয়ায় মুনাফা বেশি।

বুকমার্ক


ঝুলছি৷
মানে..কী অদ্ভুত! পা'দুটো নাইলনের দড়ি দিয়ে কষে বেঁধে কেউ সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছে৷ হাত দু'টোও পিছমোড়া করে বাঁধা। কী সাংঘাতিক৷ এমন ভাবে বেশিক্ষণ ঝুললে মাথায় রক্ত উঠে যাবে তো৷ দুম করে এ'খানে এলামই বা কী করে৷
চিৎকার করতে গেলাম। লাভ হলো না৷ গলা শুকিয়ে কাঠ, জোরালো আওয়াজ বেরোলনা৷ থুতনির ঘাম চোখে এসে পড়ছে৷ বিশ্রী অবস্থা৷
চারপাশে নিরেট অন্ধকার৷ কিছুই দৃষ্টিগোচর হয়না৷
যা বুঝছি, এ'টা সম্ভবত স্বপ্ন৷ কিন্তু আচ্ছা হ্যাপা তো, স্বপ্ন না ভাঙা পর্যন্ত এমন বাদুড়ঝোলা হয়ে থাকাটাও তো রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক৷
স্বপ্নের মধ্যেই চেষ্টা করলাম সতেরার ঘরের নামতা পড়ে মনকে শান্ত করতে৷ লাভ হলো না। একুশের ঘরে পৌঁছনর পর একটা হিমশীতল কমল মিত্তির গোছের ধারালো পুরুষ কণ্ঠ কানে এলো৷
- ঠিকই ধরেছেন, এ'টা আপনার স্বপ্নই। তবে শাস্তিটা কিন্তু রিয়েল৷
- শাস্তি?
- ইয়েস৷ আজকে খানিকক্ষণ ঝুলিয়ে রেখে ছেড়ে দেব৷ এর পরের দিন দেব গিলোটিনে৷
- আপনি কে বলুন দেখি? বড় চ্যাটাংচ্যাটাং কথা তো৷
- ইউনিয়নের নেতা, তেজ না থাকলে চলবে কেন?
- ইউনয়ন? কীসের ইউনিয়ন।
- আপনার বই-তাক-নিবাসী বইদের ইউনিয়ন।
- কী?
- আপনার বই-তাক-নিবাসী বইদের ইউনিয়ন।
- ইয়ার্কি হচ্ছে?
- ঝুলছেন আপনি৷ অসহায়, নিরুপায়,ঠুঁটোজগন্নাথ৷ আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করে লাভ নেই।
- আমার বই-তাক-নিবাসী বইদের ইউনিয়নের নেতা মানেটা কী?
- এক তাকে পাশাপাশি থাকা বইদের মধ্যে একটা ইউনিটি থাকে মশাই৷ আপনার মত কোদালে পাঠকরা সে'টা বুঝবে না।
- বইদের ইউনিয়নের নেতা৷ মানে,আপনি মানুষ নন? আপনি বই?
- অপরাজিত, দশম মুদ্রণ৷ আপনি কিনেছিলেন বছর দশেক আগে৷ মাঝেমধ্যেই উল্টেপাল্টে দেখেন আমায়, বহুবার পড়া সত্ত্বেও ফের যে'কোনো পাতা থেকে পড়তে শুরু করেন৷ কাজেই আপনার তাকে অন্য বইদের মধ্যিখানে আমার ইজ্জতও একটু বেশি। কাজেই আমিই নেতা।
- সে'তো ভালো কথা৷ তা আমায় এ'ভাবে স্বপ্নের মধ্যে টাঙিয়ে রাখার মানে?
- কারণ আপনি একটা ক্রিমিনাল।
- ক্রিমিনাল?
- আস্ত ক্রিমিনাল৷
- ও মা! সে কী৷ কেন?
- গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে মাঝেমধ্যেই শৌখিন বুকমার্ক কেনেন৷ ভালো কথা৷ উপহার হিসেবেও মাঝেমধ্যে জুটে যায় সুন্দর সব বুকমার্ক, অতি উত্তম৷ অথচ প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে সে'সব চমৎকার জিনিস না পেয়ে, বুকমার্ক হিসেবে ব্যবহার করেন ভিজিটিং কার্ড, আঙুল, দেশলাইকাঠি, খাম, স্কেল, পেনসিল এবং আরও বহুবিধ ননসেন্স৷ এই তুঘলকি কারবার সহ্য করা উচিৎ?
- ইয়ে মানে..।
- এ'টা অন্যায় নয়?
- সরি, আসলে হয় কী..।
- আমরা বইরা৷ আমরা সবাই মিলে আপনার মগজ আর আত্মার জন্য এত কিছু করি, আর আমাদের প্রতি আপনার এতটাই অযত্ন? এতটাই অবহেলা? কী ইরেসপন্সিবল আপনি মশাই৷
- ইয়ে মানে, নেতাবাবু। শুনুন..।
- আমাদের কি আদত বুকমার্ক জুটতে নেই মশাই? আপনি কি এতটাই পাষণ্ড? আজ বইয়ের ফাঁকে তাস রাখছেন, কাল তো পাতা মুড়বেন মশাই।
- না না না
- এই অভব্যতা চালিয়ে গেলে কিন্তু আপনাকে সত্যিই গিলোটিনে দেওয়া হবে। কেমন?
***
ধড়ফড়িয়ে খাটের ওপর উঠে বসলাম। এই শীতের রাতেও গায়ের জামা ঘামে ভিজে একাকার কাণ্ড৷ হাত বাড়িয়ে বেডস্যুইচ টিপে আলো জ্বালতেই, নজর গেল খাটের পাশের টেবিলের ওপর৷ সে'খানে রাখা আছে সন্ধ্যেবেলা বইয়ের তাক থেকে নামানো "অপরাজিত"। আর আমি জানি যে সে'টার একশো আটচল্লিশ আর একশো উনপঞ্চাশ নম্বর পাতার মধ্যে বুকমার্ক হিসেবে যে'টা রয়েছে সে'টা আদতে কোল্ডড্রিঙ্কসের বোতলের ছিপি৷

দ্য ক্যালক্যাটাজ


"কী দেখছেন"?

উত্তর ১ঃ কলকাতা।

উত্তর ২ঃ ক্যালক্যাটা।

উত্তর ৩ঃ ফোট্৷ ন্যাকাপনা৷ ক্লিশে৷

উত্তর ৪ঃ আর্কিটেকচারল ফিলোসোফিটা বুঝতে হবে ভায়া..এমারসন সাহেব যেমন তেমন লোক ছিলেন ভেবেছ? তবে শোনো..।

উত্তর ৫ঃ কলোনিয়াল হিস্ট্রি তো তলিয়ে দেখলি না..। তোকে শুরু করতে হবে ফিফটিন্থ সেঞ্চুরি থেকে, বুঝলি৷ য়ুরোপে তদ্দিনে..।

উত্তর ৬ঃ কদ্দিন কলকাতা যাইনি রে ভাই৷ কদ্দিন৷ কদ্দিন। মাস তিনেকের মধ্যে যাবই যাব।

উত্তর ৭ঃ ডিসেম্বরের কলকাতা৷ মফস্বলি ড্যাবডেবে একজোড়া সরল চোখ, তারা 'আরিব্বাস কলকাতা'র স্লোগান তুলে যা পাচ্ছে তাই শুষে নিচ্ছে৷ দাদুর কাঁধের ঝোলা থেকে বেরোবে স্টিলের টিফিন বাক্স৷ ঠাণ্ডা লুচি, ঠাণ্ডা আলুরদম, জলভরা সন্দেশ৷ কাগজের প্লেটের ওপর পড়লেই সে'ঠাণ্ডা লুচি-আলুরদমের স্বাদ তুরীয় লেভেলে চলে যায়৷ লুচি সাফ হলে দাদুর সঙ্গে মেমোরিয়ালের ভিতর মিউজিয়াম দেখা, ধীরেসুস্থে,খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে৷ "বাঁ-দিক থেকে দেখা শুরু করে ক্লকওয়াইজ যাব আমরা৷ কেমন ভাই"? তারপর বাগানে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি৷ বাড়ি ফেরার পথে বেলুড়ে পিট-স্টপ, গঙ্গার ধারে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি, খণ্ডন-ভববন্ধনের সুরমাখানো সন্ধ্যারতি। হাতে ততক্ষণে চলে এসেছে হাওড়া স্টেশনের হুইলার থেকে দাদুর কিনে দেওয়া গল্পের বই। পকেটে এসেছে লোকাল ট্রেনে কেনা কাঠিভাজা, সল্টেড বাদামের পাশাপাশি দিলখুশ মেঠাই৷ ভিক্টোরিয়ার শীতের দুপুরসহ ছোটবেলার একটা জরুরী টুকরো পকেটস্থ করে দাদু সরে পড়েছেন৷ ঠাণ্ডা লুচি আর আলুরদমকে অমৃতজ্ঞানে গ্রহণ করতে পারার বুকের পাটাও বেমালুম গায়েব৷ এ'ছবি হালফিলের, অথচ দিব্যি সে'সব ডিসেম্বরের হুহ-তে ভরপুর৷

মিঠে পান ও ওষুধ



- এই যে দাদা, একটা ফার্স্টক্লাস মিঠাপান দিন দেখি৷

- স্পেশ্যাল বানিয়ে দিই?

- দিন। তবে দেখবেন, স্পেশ্যালের নামে আবার গুলকন্দ ঠুসে ভরবেন না যেন৷

- তা অবিশ্যি ঠিক৷ কড়া মিঠে স্বাদে পান নষ্ট হয়৷
গোটা ব্যাপারটাই হচ্ছে সুগন্ধের খেলা।

- করেক্ট৷ অতিরিক্ত মিষ্টি খেতে হলে দু'পা এগিয়ে হরেনদার দোকান থেকে দু'টো গরম রসগোল্লা খেয়ে নেব৷ তাই না? পান মিঠে হবে আলতো আভাসে, কলার টানা মিষ্টি হলেই কেলেংকারি৷ টেস্টের পাঁচদিন একটানা যদি শুধু সিধুবাবুর কমেন্ট্রি হজম করতে হয়, গোলমাল হবে না?

- ঠিক৷ সুপুরি দেব তো?

- সুপুরি বাদে পান? মোটরসাইকেলের দুলুনি বাদ দিয়ে এই পথ যদি না শেষ হয়?

- হওয়া উচিৎ না, তাই না?

- কভি নহি৷

- গোটা গোটা টুকরো করে কাটা সুপুরি না মিহি কুচনো সুপুরি?

- চাঁদের পাহাড়ের অ্যাব্রিজড ভার্সন পড়তে নেই৷ মিহি কুচনো সুপুরির চলবে না৷ চেবানোর সাবস্ট্যান্স চাই। আর হ্যাঁ, এলাচের খোসাটা ফেলে শুধু দানাগুলো৷ কেমন? এ ব্যাপারে আমি একটু সেনসিটিভ।

- বহুত খুব। আমি তো বারবার বলি, পান ব্যাপারটাই ওই..আপনি যে'টা বললেন...সেনসিটিভ।

- এই যেমন আমার বাবা খান খয়ের ছাড়া সাদা পান৷ এক্সট্রা সুপুরি, অল্প এলাচ, সামানহ চমনবাহার৷ নো জর্দা৷ তিরিশ বছর বাবাকে দেখেছি, টেম্পলেট এ'দিক ও'দিক হতে দেখিনি৷ উনিও বলেন, পান ব্যাপারটাই সেনসিটিভ৷ তবে অত নীরস পান আবার আমার চলেনা৷ তাই এই মিঠে পানের ককটেল।

- আসুন৷ খেয়ে দেখুন দেখি৷

- দেখি দেখি৷

- কেমন?

- অত্যন্ত মোলায়েম৷ ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম। খুশবুতে ঘায়েল করেছেন। কত দেব?

- টুয়েন্টি রুপিজ অনলি।

- আসুন।

- একটা কথা বলি দাদা?

- দশটা বলুন পানবাবু। দশটা বলুন।

- এত রাত্রে একা বেরিয়েছেন শুধু পানের জন্য? পান আপনার নেশা তো নয়৷ নেশাড়ুরা স্পেশ্যাল মিঠেপানের খদ্দের হয়না। আর এত গল্পও জোড়েনা।

- উরিব্বাস৷ এ'টা পানের দোকান না দু'শো একুশের বি বেকার স্ট্রিট মশাই? তবে মোক্ষম ধরেছেন৷ রাত বাড়লে কাশির মত মনখারাপগুলোও বাড়ে। প্রথম ডোজে হেমন্তবাবু ইঞ্জেক্ট করি মনে৷ তারপর বিভূতিভূষণ৷ সে'টাও কাজ না করলে আই ওয়াক ইনটু আ পানশালা।

- সিগারেট চলে নাকি দাদা? না না, এ'টা বিক্রি নয়৷ আমি খাওয়াব।

- ও বদনেশাটা নেই৷ তবে দিন, ঠোঁটে ঝোলাতে আপত্তি নেই৷ আগুন জ্বালার ব্যাপারটা না হয় বাদই থাকল। অমন ভালোবেসে অফার করলেন, রিফিউজ করি কী করে।

- ও'তেই হবে৷ আসুন৷ গোল্ডফ্লেক।

- তা পানবাবু, সিগারেট অফার করলেন যে৷ আপনারও কি ওই কেস? মনখারাপ?

- মোক্ষম ধরেছেন৷ ওই, রাত বাড়লে যা হয় আর কী৷ আমার ওষুধ আবার কিশোরকুমার। ওই দেখুন, ওই সিডি প্লেয়ারে। তবে দু'একদিন গভীর রাতের দিকে স্রেফ কিশোরে বরফ গলেনা৷ সে'সব রাতে আমার বরাতে ঠিক স্পেশ্যাল মিঠে পানের খদ্দের জুটে যায়৷ ব্যাস, আমি অমনি একটা সিগারেট অফার করে ফেলি। মনখারাপের পানের ওপর দিলখোলা আড্ডার চুন-খয়ের লাগিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ।