- কী ব্যাপার বিমলদা। এমন জরুরী তলব?
- বস৷ কথা আছে। এগুলো খা' আগে৷
- বাহ্৷ পিঠেগুলো তুমি বানিয়েছ?
- একামানুষ৷ আর কে বানাবে বল। খেয়ে ফেল পেট পুরে৷ আজ ও'টাই ডিনার৷
- এমন রাতবিরেতে কী এমন দরকার পড়ল, আগে সে'টা তো বলবে।
- বিনু, তুই আমায় বিশ্বাস করিস?
- তোমার প্রফেশনটাকে করিনা। তবে তোমায় বিশ্বাস করি৷ আফটার অল, গত সাতবছর ধরে তুমিই আমার পাহাড়ে ঘোরার গাইড। আর সর্বোপরি আমার ক্যারম-পার্টনার৷
- অ্যাস্ট্রলজি ইস নট এভ্রিওয়ানস কাপ অফ টী। জ্যোতিষ বিদ্যার পজিটিভ সাইডটা বোঝার জন্য একটা প্রশস্ত মন দরকার৷ সে'টা তোর নেই৷ তবে তোর আগ্রহ আছে৷ সারল্য আছে৷ সে'জন্যই তোকে আমার এত ভালো লাগে৷
- ব্যাপারটা কী বলো তো বিমলদা? তোমার কথাবার্তা বেশ মিস্টিরিয়াস বোধ হচ্ছে৷
- মিস্টিক ব্যাপারস্যাপারে আমার বরাবরই প্রবল আগ্রহ৷ আমি নিজেও তো মিস্টিসিজম নিয়েই কাটিয়ে দিলাম এতগুলো বছর।
- তোমার বুজরুকিগুলো দিনদিন বাড়ছে বাড়ুক৷ তবে তোমার পাটিসাপটাগুলো কিন্তু এ-ক্লাস হয়েছে৷
- যে'কাজের জন্য তোকে ডেকেছি..।
- হ্যাঁ বলো।
- তোর কুষ্ঠীটা বানিয়ে দিয়েছিলাম৷ গেল মাসে। পড়েছিলিস তো ভালো করে? না তার আগেই ডাস্টবিনে৷
- সেই রাবিশ মাল? ও জিনিস ডাস্টবিনের যোগ্যও নয়৷ সোজা পুড়িয়ে ফেলেছি৷ তবে তার আগে অবিশ্যি বারচারেক পড়ে খুব একচোট হেসে নিয়েছিলাম।
- তোর রাবিশ মনে হতেই পারে। ওই যে বললাম, তোর মন এখনও ততটা প্রশস্ত নয়৷ যাকগে, কুষ্ঠীতে যে ক্রিটিকাল ব্যাপারটা লিখেছিলাম, সে'টা মনে আছে তো?
- ওই যে। আমার হাতে একটা খুন হবে? সেই ফালতু ভবিষ্যৎবাণীটা?
- করেক্ট৷
- সেই কথাটা বলতে তুমি এত রাত্রে আমায় ডেকে পাঠালে বিমলদা? নাহ্৷ তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে৷ নেহাৎ এই হাই-কোয়ালিটি পিঠে দিয়ে বশ করে রেখেছ৷ নয়ত এখুনি বেরিয়ে যেতাম।
- বিশ্বাস কর বিনু, আমার হিসেবে ভুল থাকলে আমি সত্যিই খুশি হতাম৷ তুই আমার অত্যন্ত স্নেহের৷ আনফরচুনেটলি, আমার অঙ্কে ভুল নেই। তোর হাতে খুন হবেই৷
- বিমলদা। কাউকে কোনওদিন চিমটি কেটেছি বলেও মনে পড়েনা৷ মাছ-মাংস নিজে আনতে যাই না রক্ত দেখতে পারিনা বলে৷ আর তোমার ধারণা আমি খুন করব?
- তোর গত বছর যে স্কুটার অ্যাক্সিডেন্টটা হল, সে'টার ব্যাপারে আমি তোকে আগেভাগে সাবধান করে দিইনি? বা সে'বার উত্তরাখণ্ডের ট্রেকটা করতে বারণ করেছিলাম না? বারণ না শুনে আমার লেজুড় হয়ে গেলি আর পা হড়কে হাড়গোড় ভেঙে দু'মাস পড়ে রইলি।
- ঝড়েবক আনতাবড়ি কতকিছুই তো বলো তুমি বিমলদা৷
- হিসেব৷ স্কেল কম্পাস বসানো হিসেব৷ বিনু, সবই নিরেট অঙ্ক৷
- আমার মেজাজটা খারাপ না করলেই নয়? তোমার কথা না শুনে পা হড়কে পড়েছি কোনকালে, তাই বলে আমি খুন করব?
- তুই আমার ভাইয়ের মত বিনু৷ আমি তোকে ভালোবাসি।
- তা'বলে আমি খুন করব? এ'টা তোমার মনে হল কী করে! আমি অতটা নীচে নামতে পারি বিমলদা?
- পরিস্থিতি তোকে কাজটা করিয়ে নেবে বিনু৷ পরিস্থিতি মানুষকে দিয়ে কী না করিয়ে নেয়।
- নাহ্৷ এ'সব শোনার ধৈর্য আমার নেই৷ কাজের কথাটা বলে ফেলো, যার জন্য ডেকেছিলে।
- আমার ডিপ্রেশনের ব্যাপারটা তো জানিস৷ সুইসাইডাল টেন্ডেন্সিগুলোও তোর অজানা নয়।
- তা'তে কী? কতবার বলেছি থেরাপিস্টের কাছে যাও। ও'সব ঠিকুজি মার্কা গাঁজাখুরি হিসেব নিয়ে দিনরাত পড়ে থাকলে হবে?
- শোন৷ অনেকদিন ধরেই ভাবছি আত্মহত্যার কথা। কিন্তু সুবিধেমত দিনক্ষণ পাওয়া যাচ্ছিল না।
- কী বলতে চাইছ?
- আরে সুইসাইড করব বললেই তো আর করা যায়না৷ গ্রহ নক্ষত্রের মুভমেন্ট যদি অ্যালাইন না করানো যায় তা'হলে হিতে বিপরীত হতে পারে৷ সে যাকগে৷ পজিটিভ নিউজ হল, আজকের রাতটা ও'কাজের জন্য আদর্শ।
- সুইসাইডের জন্য?
- শনি আর বেস্পতি এক্কেবারে সঠিক স্পটে বসে আছে রে৷ বহুবছর অপেক্ষা করে এমন দিন পেয়েছি৷ এ জিনিস হাতছাড়া হতে দেওয়া যায়না।
- তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে।
- আগে কথাটা শোন। আজ রাত একটা বত্রিশ নাগাদ গোপালপুর ব্রিজের ওপর থেকে ঝাঁপ দেব, স্ট্রেট নদীতে৷
- ধুস। পাগলের প্রলাপ যত।
- বিনু। ভাইটি৷ একবার অন্তত মন দিয়ে আমার কথাটা শোন৷ তোর সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে আমি যেচে আলাপ করেছিলাম, মনে আছে? কারণ আমি তোর মুখ দেখে ধরতে পেরেছিলাম আমাদের আত্মার যোগ আছে৷ দেখ বিনু। আমাকে আজ মরতেই হবে। আর তোর হাতেও খুন হবেই৷ আমাকেই বরং ব্রিজের ওপর থেকে ঠেলে ফেলে দে না ভাই! তা'তে তোর খুনের ব্যাপারটাও মিটে যাবে, আত্মহত্যার পাপটাও আমি পাশ কাটাতে পারব৷ নেহাৎ তুই কুওপারেট না করলে নিজেকেই ঝাঁপ দিতে হবে৷ কিন্তু এত বড় সুযোগ তুই হাতছাড়া করিস না..।
- এই রইল তোমার পাটিসাপটা...আচ্ছা উজবুক তো তুমি..।
- বিনু শোন৷ খুন তোকে একটা করতেই হবে৷ আজ আমায় খুন করে ফেলে সে ফাঁড়াটা কাটিয়ে নে৷ তোর দাদার মত আমি, তোকে বাজে কথা বলব না৷ তিন কপি সুইসাইড নোট লিখে রেখেছি৷ এই দেখ। একটা লোকাল থানার সামনে গোপনে ফেলে দিয়ে ব্রীজে যাব৷ একটা থাকবে আমার এই বাড়িতেই৷ আর একটা রিষড়ার মাসীর ঠিকানায় পোস্ট করে দেব৷ কারুর সন্দেহ হবে না, সহজেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে ব্যাপারটা সুইসাইড। আর গোপালপুরের ব্রিজটা রাতের বেলা এক্কেবারে সুনসান থাকে, কেউ আমাদের দেখবে না৷ চ'না ভাই৷ রথ দেখা কলা বেচা দুইই হবে৷ একটা আলতো ধাক্কা দিবি শুধু৷ আমার মরাও হবে, তোর খুন করার ব্যাপারটাও নিঃশব্দে মিটিয়ে ফেলতে পারবি৷ নয়ত ভাব, পরে কখন কী ভাবে খুন করে বসবি আর তারপর থানা-পুলিস-আদালত-ফাঁসি, সব নিয়ে কী হুলুস্থুল ব্যাপার ঘটবে।
- আমি আসছি বিমলদা। আমার গা গুলিয়ে উঠছে৷ তুমি বদ্ধ পাগল হয়ে গেছ।
- শোন বিনু, তুই আমার থেকে পালাতে পারবি কিন্তু ভবিতব্যকে এড়াতে পারবি না। পারবি না!
- আসি আমি৷
- খুন তোকে করতেই হবে৷ তোর ভাগ্য তোকে দিয়ে ঠিক খুন করিয়ে নেবে।
- ধুর।
- পারবি না তুই পরিস্থিতির চাপ সামলাতে৷ খুন তোকে করতেই হবে।
***
বাড়ি ফেরার ঘণ্টাখানেক পরও বুকের ধড়ফড়টা কমল না বিনুর৷ একবার মনে হলো থানায় ব্যাপারটা জানানো দরকার৷ সেই ভেবে ফের জামাকাপড় গায়ে চাপালো৷ কিন্তু মোটোরবাইকটা স্টার্ট করেই বিনুর মনে পড়ল উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ে পা হড়কে পড়ে যাওয়ার কথা৷ মনের মধ্যের বিশ্রী তোলপাড়টা যেন সহস্রগুণ বেড়ে গেল।
বাইকটাকে থানার দিকে না নিয়ে গোপালপুর ব্রিজের দিকে ছুটিয়ে দিল বিনু৷ রাত একটা বত্রিশের আগেই সে গোপালপুর ব্রীজের ওপর পৌঁছে যেতে পারবে। কানের মধ্যে তখন বিমলদার পাগলাটে গলাটা দামামার মত বাজছে - "পারবি না তুই পরিস্থিতির চাপ সামলাতে"।
***
গোপালপুর ব্রিজের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন বিমল৷ সম্ভবত তার শেষ সিগারেট৷ নদী ছুঁয়ে বয়ে আসা মিঠে হাওয়ার ঝাপটা মুখে লাগায় একটা আরামদায়ক ঝিমঝিম ভাব গোটা শরীরে৷ রিস্টওয়াচ বলছে রাত একটা বেজে সাত মিনিট, এখনও বেশ কিছুটা সময় আছে হাতে।
বিনু আসবেই, বিমল সে'টা জানেন।
মনটা বেশ ফুরফুরে বোধ হচ্ছিল৷ বহু বছর ধরে জ্যোতিষবিদ্যের প্রতি বিনুর অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য শুনেশুনে হদ্দ হয়ে পড়েছিলেন বিমল। উত্তরাখণ্ডের গাইডকে গোপনে ঘুষ খাইয়ে বিনুকে ঠেলে ফেলে দিয়ে হাড়গোড় ভাঙানোর পরেও ওর অবিশ্বাসকে টলানো যায়নি৷ কাজেই বড় কিছু একটা না করলে চলছিল না৷ এইবার সে ব্যাটাকে পথে আনা যাবে, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত৷
No comments:
Post a Comment