Tuesday, May 25, 2021

গ্যাংটক ও হালুয়ামোহন



গ্যাংটকে গণ্ডগোল সম্বন্ধে দু'টো মাইনর আর একটা মেজর বক্তব্য।

**
মাইনর-এক।

বাদশাহী আংটির তরুণ তুর্কী মেজাজ ছেড়ে ফেলু এখানে বেশ পোড় খাওয়া গোয়েন্দা। পকেটে রিভলভার নিয়ে ঘুরছে। অবশ্য এর মাঝে সে সে কৈলাস চৌধুরীর পাথরে কেস আর শেয়াল দেবতার রহস্য সলভ করেছে। তাছাড়া এ গল্পটার মধ্যে ট্যুইস্ট অ্যান্ড টার্নগুলো রীতিমত সিনেম্যাটিক।  গ্যাংটকের পটভূমিটাও দিব্যি এক্সপ্লোর করা হয়েছে; পাহাড়ের গা দিয়ে গড়িয়ে ফেলা পাথর, মনাস্ট্রি বিষয়ক মিস্ট্রি, পাহাড়ি লোডশেডিংয়ে গা-কাঁপানো প্ল্যানচেট আর একটা 'হাইভোল্টেজস্পার্ক' ক্লাইম্যাক্স। 

**

মাইনর-দুই।

শুনেছি বিজ্ঞাপনে subliminal messaging  ব্যাপারটা প্রায় অস্ত্রের মত ব্যবহৃত হয়। আমি তেমন বুঝিটুঝি না তবে আমাদের বহু বাজারু বদ-অভ্যাস যে এই সাবলিমিনাল মেসেজিংয়ে ঘায়েল হয়ে তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।  তেমনই, ঝাঁ-চকচকে সুরসিক বাঙালি কেমন হবে তা নিয়ে সত্যজিৎবাবু ফেলুকে ব্যবহার করে আমাদের অজান্তেই আমাদের সাবকনশাসে কিছু ঘুঁটি সাজিতে গেছেন৷ একটা লাইন কোট করি যা এমনিতে তেমন নজরকাড়া কিছু নয় কিন্তু সে'সব লাইনের সামগ্রিক ইনফ্লুয়েন্স বেশ কয়েকটা প্রজন্ম বয়ে বেড়াচ্ছে;

"ফেলুদা মাঝেমধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল; কেন সেটা বুঝতে পারলাম না। হয়তো মনের মধ্যে কোনও খটকা রয়েছে। এত ভালো মাংস খাওয়ার সময়ও তার চোখ থেকে ভ্রূকুটি যেতে চাইছে না"।

**
মেজর।

এ'বার আসি মোক্ষম ব্যাপারটায়। এ'টা অবশ্যই অন্ধকারে ঢিল। তবু বলি। এই গল্পেই বোধ হয় লালমোহন গাঙ্গুলির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নিশিকান্তবাবুই সম্ভবত সত্যজিতের প্রথম চেষ্টা ফেলু-তোপসের সঙ্গে একজন মজারু আর মাইডিয়ার থার্ড হুইল জুড়ে দেওয়ার। নিশিকান্তবাবু লালমোহনের মতই আন্তরিক, বিপদে নার্ভাস হলেও ঝুলে পড়ার লোভ সামলাতে পারেন না। 
কোট করি;
"নিশিকান্তবাবু ফেলুদার মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে একটু ঘাবড়েছেন বটে, তবে ভিতরে ভিতরে মনে হল অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধটা পেয়ে তিনি বেশ একটা রোমাঞ্চ বোধ করছেন। নামচির বাজার থেকে একটা কমলালেবু কিনে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, 'বিপদ যাই আসুক না কেন মশাই, একদিকে প্রদোষবাবু আর একদিকে জার্মান বীরেনবাবুকে নিয়ে ডরাবার কোনও কারণ দেখছি না'।" মাঝেমধ্যেই তিনি লালমোহনীয় সুরে "বেশ থ্রি- মানে থ্রিলিং লাগছে"ও বলে উঠছেন। উপন্যাসের শেষও তাঁর কথা দিয়েই; "থ্যা-মানে থ্যাঙ্কস"।

এর সঙ্গে যোগ করা যাক ওঁর অস্ত্রের প্রতি ঝোঁক, এ ক্ষেত্রে ছিল জোঁক ছাড়ানোর বিশেষ লাঠি। প্যাকেজ সম্পূর্ণ করতে ভদ্রলোককে একটা বাটারফ্লাই গোঁফও পরিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ।  সব মিলে জম্পেশ লালুবাবু মেটেরিয়াল।

 নিশিকান্ত সরকারকে নিয়ে এগোনো গেলনা কারণ তিনি দার্জিলিংয়ের মানুষ, ফেলুর বাড়ি নিয়মিত শিঙাড়া পৌঁছে দেওয়ার জন্য গড়পাড়ের মানুষই সুবিধেজনক।  তা'ছাড়া রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের লেখক হিসেবে লালুবাবু অনেক বেশি মশলা এনে দিয়েছেন। আর একটা বড় ব্যাপার; নিশিকান্তবাবুর টাকার লোভ রয়েছে এবং তার জন্য এথিকস ব্যাপারটাকে মাঝেমধ্যে চেপেচুপে রাখতে তাঁর তেমন আপত্তি নেই৷ কিন্তু ফেলুদার বন্ধু হতে গেলে সে ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ যে কিছুতেই চলবে না তা বলাই বাহুল্য।

No comments: