ইন্টারনেট বলছে প্রমথনাথ ১৯৮৫ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন৷ ক্যালক্যাটা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন, আনন্দবাজারে কাজ করেছেন, বিধানসভার সদস্যও হয়েছিলেন৷ কিন্তু এ'সব তথ্য দিয়ে যে'টা মাপা যায়না সে'টা হল ওঁর ভাষার মিষ্টতা এবং ধার৷ ওর লেখা মাইকেল মধুসূদনের জীবনী বিবরণের দিক থেকে সংক্ষিপ্ত কিন্তু মাইকেলের চরিত্র বিশ্লেষণের দিক থেকে অন্যন্য৷ সাকুল্যে একশো কুড়ি পাতার বই অথচ রিসার্চ আর ভাষার গুণে এতটাই সমৃদ্ধ যে মাইকেল, বাঙালির চরিত্র আর সে সময়ের বাঙলা সাহিত্যের মূল রস তুলে ধরার ব্যাপরে এ বই একটা দুর্দান্ত রিসোর্স।
খেয়াল করে দেখেছি যে জীবনী রচনার ক্ষেত্রে কয়েকটা বড় সমস্যা দেখা দেয়৷ যেমন ধরুন লেখক দুর্দান্ত রিসার্চ করলেন কিন্তু জার্নাল এন্ট্রির মত সমস্ত তথ্য সাজিয়ে দেওয়ার ফলে যে'টা তৈরি হল সে'টা পড়া প্রায় কাঠ চেবানোর মত একটা অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়৷ আবার অনেক ক্ষেত্রে জীবনীর নামে পড়ে থাকে অলীক রূপকথা, সে হেগিওগ্রাফি হজম করার চেয়ে তিন মিনিটের মধ্যে আধ-বস্তা চিনি গেলা সহজ। মাইকেলকে নিয়ে লিখতে গিয়ে সেই বাড়াবাড়ির ফাঁদ এড়িয়ে ব্যালেন্সটাকে টানাটান ভাবে ধরে রেখেছেন প্রমথনাথ। সবচেয়ে বড় কথা; বইটার পরতে পরতে রয়েছে প্রমথনাথের প্রবল রসবোধ, মেধা এবং সারকাজম (ইন্টারনেটের কলারটানা গুঁতোগুঁতি-মার্কা সারকাজম নয়)। বইটা হেগিওগ্রাফিক না হলেও আমার রিভিউটা তাই। কাজেই প্রমথনাথের কথা ধার করেই কাজ সারব।
গোড়াতেই প্রমথনাথ আড়াই পাতার একটা পটভূমি এঁকেছেন; মাইকেলের জীবনী কপচাতে কেন গেলেন সে সম্বন্ধে। অনেকটা নারায়ণ সান্যালের লেখা কৈফিয়ৎ স্টাইলে। এই আড়াই পাতা নিশ্চিন্তে "ডামিজ গাইড টু বায়োগ্রাফি রাইটিং" হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। প্রমথনাথ বলছেন, "আমি মাইকেলকে দেবতা করিয়া তুলি নাই; তাঁহার দোষত্রুটি দেখাইয়া দিয়াছি- এমনকি তাঁহাকে লইয়া ঠাট্টা বিদ্রূপও করিয়াছি; ইহাতে তাঁহার অসম্মান হইয়াছে মনে করি না - বরঞ্চ ইহা দ্বারা তাঁহাকে মানুষ মনে করিয়া সম্মান দেখানোই যেন হইয়াছে। মানুষকেই ঠাট্টা করা যায়- ভালোবাসা যায়। দেবতাকে ঠাট্টা করাও যেমন যায়না, তেমনই ভালোবাসাও যায় না। এই গ্রন্থে মধুসূদন ব্যক্তিটি কেমন ছিলেন- তাহাই প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিয়াছি।... পাঠকের কেমন লাগিবে তাহা জানি না, তবে ব্যক্তি মধুসূদন..নিশ্চয়ই উচ্চহাস্যে উল্লাস প্রকাশ করিতেন, মাঝেমাঝে হাততালি দিয়া উঠিতেন; আর লেখক চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলে বলিতেন; "Don't go away, man; Boy, give him a peg"।
বাঙালির গালগল্পের ধাত চিরকালীন; তিলকে তাল না করলে আমাদেত আড্ডা-সংস্কৃতি পূর্ণতা পায়না৷ অটোর লাইনের ঠেলাঠেলি থেকে গ্রেগ চ্যাপেলের কানমলা; দু'চারটে শহীদ খুঁজে উঁহু-আহা না করতে পারলে আমাদের ভাত-ঝোল হজম হয়না। ট্র্যাজেডির প্রতি আমাদের সুগভীর লোভ; কিন্তু সেই লোভের বশবর্তী হয়ে অত্যাধিক দৌড়ঝাঁপ আবার আমাদের ধাতে সয় না। সে'দিক থেকে মধুকবি যাকে বলে প্রবলভাবে ব্যতিক্রমী। তিনি ট্র্যাজেডির ব্র্যাডম্যান। ছেলেবেলায় মেসের এক বন্ধু বলেছিল, "ভাই রে, কবিতা লিখলেই বুঝি কবি হওয়া যায়"? আমার ধারণা মধুসূদন যদি এক লাইন কবিতাও না লিখতেন, স্রেফ ট্র্যাজেডি কোশেন্টেই তিনি কবিশ্রেষ্ঠ হয়ে উঠতেন। তবে মধুকবি লিখেছেন; বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সত্যিই প্যারাডাইম শিফট (অফিসের পাওয়ার পয়েন্টে লেখা গাঁজাখুরি শিফট নয়) এনেছেন। কারণ প্রতিভার দিক থেকে তিনি অতুলনীয়, অদম্যও বটে।
মধুসূদনের মধ্যে একটা প্রবল খ্যাপাটে জিনিয়াস ছিল, সেই জিনিয়াসের নাগাল পাওয়া সাধারণ মানুষের কাজ নয়৷ নিজের ট্যাজেডি তিনে একে একে নিজেই বুনে চলেছেন; হাহাকার করেছেন, খতরনাক আত্মবিশ্বাসে নিজেই নিজেকে বারবার ক্ষতবিক্ষত করেছেন, মানুষকে বিশ্বাস করে পথে বসেছেন আবার মানুষের সান্নিধ্যে তাঁর উত্তরণ ঘটেছে। মাইকেল মধুসূদন নামক দুর্দান্ত রোম্যান্সটি কোনও লেখকের কল্পনায় তৈরী হওয়া সম্ভব বলে মনে হয়না। কাব্যের জন্য জীবন, জাত, ধর্ম বা যা কিছু মূল্যবান; সমস্তই ভাসিয়ে দিতে মধুকবি কসুর করেননি। আবার অর্থের টানে কবিত্ব জলাঞ্জলি দিতেও তাঁর দু'বার ভাবতে হয় না। অবশ্য বাঙালি যেন ভেবে না বসেন যে মধুসূদন আখেরের স্বার্থে উপার্জনে মন দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক হয়ে দু'হাতে টাকা না ওড়াতে পারার পাপস্খলন করতেই তার এই প্রচেষ্টা। অর্থ আর কাব্য, এই দুইই তাঁর জীবনে ফুটোনোটের মত। আমার লেখায় ব্যাপারটা প্রলাপের মত শোনাবে এ'টাই স্বাভাবিক। সে ধোঁয়াশা কাটাতে বইটা পড়ে ফেললেই হয়। মধুসূদন নামক রোম্যান্সের সুবাস অল্প কথায় পাঠকের মনে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন প্রমথনাথ। সে'খানেই এ বই সত্যিই অতুলনীয়।
প্রমথনাথ মাইকেলের জিনিয়াসকে যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনই সাবলীল ভাবে মস্করা করেছেন তাঁর বিনয়ের অভাব এবং সাংসারিক বুদ্ধিহীনতার। আবারও বলি, প্রমথনাথের মস্করার ভাষা ছেনিহাতুড়ি নয়, সে ভাষার তুলনা চলে শুধু শিউলি সুবাসের সঙ্গে। অবশ্য এও ঠিক যে সাবজেক্ট হিসেবে মাইকেলের মত সরেস কাউকে জোটানো মুশকিল।
উদাহরণ দিই। "মাইকেলের মনে পড়িল বিদ্যাসাগরের কথা৷ বিদ্যাসাগর বলিয়াছেন, "তুমি খুব করিয়াছ। কিন্তু ভারতচন্দ্রকে ছাড়াইতে পারিয়াছ বলিয়া মনে হয় না"। আঃ, কিছুতেই কৃষ্ণনগরের লোকটার সঙ্গে আঁটিয়া উঠা যায়না৷ এখনও সকলে তাকে মাইকেলের চেয়ে বড় মনে করে৷ লোকটা বাংলা সাহিত্যের কী ক্ষতিই না করিয়াছে"৷
আবার মেঘনাদ-বধ সম্বন্ধে মাইকেল নিজেই বলছেনঃ
"এই কাব্য খুব লোকপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছে। কেহ বলিতেছে ইহা মিলটনের অপেক্ষাও ভালো; তাহা সম্ভব নয়। কাহারও মতে ইহা কালিদাসকে পরাজিত করিয়াছে, ইহাতে আমার আপত্তি নাই। আমার মনে হয় ভার্জিল, কালিদাস বা টাসোর সমকক্ষ হওয়া অসম্ভব নয়- যদিও তাঁহারা মহাকবি, তবুও তাঁহারা মানুষ বই নয়। মিলটন দেবতা"।
কাজেই মাইকেল মধুসূদন নামক রোম্যান্সের স্বাদ পেতে হলে প্রমথনাথবাবুর ভাষার দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই।
আরও একটা কথা বলে রাখি।
এই বইতে বাঙালির চরিত্রের ওপর যে খতরনাক কমেন্ট্রি রয়েছে, তার গুরুত্ব আগামী দেড়শো বছরেও কমবে কিনা জানা নেই। এ বিষয়ে বেশি না ফেনিয়ে প্রমথনাথের আর একটা কোটেশন ব্যবহার করে লেখা শেষ করি৷ বিদ্যাসাগরের চরিত্র মাহাত্ম্য অল্প কথায় বোঝাতে গিয়ে প্রমথনাথ লিখছেনঃ
"বিদ্যাসাগর বন্ধুদের মনে রাখিতেন; তাঁহার সমবেদনা মৌলিক আর লজ্জা কেবল চাক্ষুষ ছিল না; কথা দিয়া কথা রক্ষা করিতেন; দানের প্রয়োজন বুঝিলে ঋণ করিয়া টাকা দিতেন; বন্ধুর বিপদ দেখিলে কাজের ছুতায় সরিয়া পড়িতেন না; গাছে তুলিয়া মই টানিয়া লইবার অভ্যাস তাঁহার ছিল না। এক কথায় তিনি বাঙালি ছিলেন না"।
আর, যেহেতু আমাদের লজ্জা মূলত চাক্ষুষ, এ বই পড়লে আত্মসম্মানবোধে ঘা লাগার বিশেষ কোনও সম্ভাবনা নেই।
No comments:
Post a Comment