নাহ্৷ ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চার আর যাই হোক ওভাররেটেড নয়। অন্তত বাদশাহী আংটিতে ফিরে গিয়ে দিব্যি থ্রিলড হলাম৷ সাধারণত আমি যে কোনও গল্প পড়তে গিয়েই নিজের কল্পনায় গল্পের চরিত্রগুলোর জন্য জুতসই চেহারা বেছে নিই৷ এ ক্ষেত্রে ফেলুদার চরিত্রে অবশ্যই মাথায় ছিলেন সৌমিত্র, তবে সোনার কেল্লার মাঝবয়েসী সৌমিত্র নয়; বাক্স বদলের সেই চনমনে গোঁফলেস সৌমিত্র। তোপসের বাবা অবশ্যই হারাধনবাবু। বিকাশ রায়ের মুখে একটা খুব শৌখিন গোঁফ আর দামী একটা ফ্রেঞ্চকাট বসিয়ে বনবিহারীবাবু তৈরি করে ফেললাম মনে মনে৷ ইয়ে, ছোটবড় সমস্ত চরিত্রই আমি নিজের মত করে কাস্ট করে ফেলি, কাজেই ব্যাপারটা ছড়িয়ে লাভ নেই৷ শুধু বলে রাখি, এ গল্পে তোপসের চেহারাটা যে অবিকল ক্লাস নাইনে পড়া তন্ময় মুখুজ্জ্যের মত, তা আমি হলফ করে বলতে পারি৷
একটা ছুটকো ব্যাপার নজরে পড়ল৷ গল্পের প্রথম চুরিটা ফেলুই করে, তবে সে'টা বাদশাহী আংটি চুরি নয়৷ আংটি চুরিটাকে ঠিক চুরি বলাও চলে না, কারণ সে'খানে ফেলুর উদ্দেশ্য বদ ছিল না৷ তবে তোপসের প্লেট থেকে সান্ডিলা লাড্ডু হাপিস করার কেসটা স্রেফ রাহাজানি৷ পরে অবশ্য তোপসের মুর্গির ঠ্যাংও সরিয়েছে সে।
ডুন এক্সপ্রেসের রাতটা বড় চমৎকার৷ এদ্দিন পর পড়েও কী ভালো যে লাগল৷ সে'যাত্রাই প্রথম ফেলু চোয়াল শক্ত করে বনবিহারীবাবুর হামবড়াই ভাবকে পর্যুদস্ত করে।
বনবিহারী ফেলুকে ঠুকছেন - "তা'হলে তুমি বিশ্বাস করো না যে শ্রীবাস্তবের কাছেই এখনও আংটিটা আছে"?.
ফেলুদার এস্পারওস্পার কামব্যাক - " না করি না, আমার কাছে তার প্রমাণ আছে"৷ এই পয়েন্ট থেকেই ফেলু পাতি লাড্ডু-চোর-দাদার খোলস ছেড়ে; ধারালো, অবিচল আর বরফ-মাথার ফেলুদা হয়ে আত্মপ্রকাশ করে৷ সেই ধারের আঁচ থেকে শুধু বনবিহারী কেন, ভবিষ্যতে মগনলালও পার পাবে না৷
তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নিরিখে ফেলুদার গল্পগুলো যে কোনও পাহাড়ি নদীকেও অনায়াসে টেক্কা দেবে৷ বাদশাহী আংটিও তেমনই সচল আর স্মার্ট৷ প্রতিটা চরিত্রের নুয়ান্সেসগুলো মনে দাগ কেটে যায় (বহুবার পড়ার পরেও, আলাদা করে৷ আমার বায়াস? হবে হয়ত)। ডাক্তার শ্রীবাস্তবের নড়বড়ে কনফিডেন্স, ধীরুকাকার উষ্ণতা, বনবিহারীর গা-জ্বালানো মাতব্বরি; সমস্তই প্রকাশ পায় সহজ সিধে কথাবার্তায়৷ চরিত্রদের স্পষ্ট করে তুলতে গাদা গাদা ন্যারেশনে ভরসা করার মানুষ সত্যজিৎ নয়। সংলাপেই তাঁর কার্যসিদ্ধি। প্রত্যেকের কথাবার্তা দিব্যি ঝরঝরে প্রাণবন্ত বাংলায়; যতবার পড়ি ততবার মনে হয় আমরা ঠিক এ'ভাবেই কথা বলিনা কেন? আর কে জানে, ছেলেবেলায় এ'সব গল্পের মাধ্যমে সত্যজিৎ আমাদের কথাবার্তার স্টাইলে হয়ত বিস্তর প্রভাব ফেলেওছেন। অন্তত সে সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায়না৷
ওভাররেটিং প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম৷ সে প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ করি৷ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে আসছে। মানুষের কাজই হল ওভাররেট আন্ডাররেট করা, আবার মানুষেরই ধর্ম হল অন্যের ওভাররেটিং আন্ডাররেটিংয়ের ঝড়ে ভেসে না গিয়ে নিজের ভালোবাসাগুলোকে আঁকড়ে স্বস্তিতে থাকা৷
"ফেলুবাবুর কিন্তু কোনও জবাব নেই মশাই"।
একটা অদরকারী ট্রিভিয়া ঝেড়ে শেষ করি। লখ্নৌয়ের রাস্তায় নতুন হিন্দি ফিল্মের প্যাম্পফ্লেট ছড়ানোর উল্লেখ রয়েছে গল্পে৷ সিনেমা নাম; ডাকু মনসুর৷ ও'টা জেটবাহাদুর গোছের কাল্পনিক নাম নয় কিন্তু৷ ডাকু মনসুর নামে একটা সিনেমা সত্যিই বেরিয়েছিল ১৯৬১তে।
No comments:
Post a Comment