বছর তিনেক আগে৷
অফিস থেকে বেরোনোর মুখে ব্রজদার ফোন৷ ভদ্রলোক আমার বাপের বয়সী৷ তবে কফিহাউস আলাপের ক্ষেত্রে বয়স নিয়ে শুচিবাই চলেনা৷ ব্রজদা ব্যাচেলর দিলদরিয়া মানুষ৷ আড্ডায় সরেস, খাওয়াতে ভালোবাসেন৷ প্রচুর ঘুরে বেড়ান, তাই গল্পের স্টক অফুরন্ত৷ বদগুণ একটাই; বড্ড বেশি কবিতা লেখেন আর সে'সব মাঝেমধ্যে হাসি মুখে শুনতে হয়৷
কবিতা ব্যাপারটা ভালো লেখেন না খারাপ সে সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণাই নেই৷ কবিতা ব্যাপারটাই গোলমেলে এবং সম্ভবত লোকঠকানো৷ কাজেই এ বিদঘুটে ব্যাপার আমি চিরকালই এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু ব্রজদার কবিতাগুলো অবশ্য হাসিমুখেই হজম করে থাকি, কারণ চপ-কাটলেট না খাইয়ে উনি কবিতার ডায়েরি নামান না৷
- ব্রাদার, একটি বারে জন্য যে আমার বাড়িতে আসতে হবে। এখুনি।
- কী ব্যাপার ব্রজদা?
- না এলেই নয়৷ চট করে চলে এসো দেখি৷ তারপর ডিটেলে বলছি৷
- শনিবার কফিহাউস থেকে বেরিয়ে না হয় আপনার ফ্ল্যাটে ঢুঁ মারব..আজ একটু..।
- বড় দেরী হয়ে যাবে ভায়া৷ ইট ইজ অ্যান এমার্জেন্সি৷ স্পেশ্যাল মোগলাই পরোটা আর মাটন কষা অর্ডার করেছি৷ ক্যুইকলি চলে এসো৷
এরপর আর না বলা সম্ভব নয়৷
**
নেহাৎ বিভূতি রেস্টুরেন্টের হাইক্লাস মোগলাই আর জিভ কাঁপানো কষা মাংস আগেভাগেই পেটে পড়েছিল। নয়ত নার্ভাস হয়ে হাঁটু ক্র্যাশ করে যেত৷ ব্রজদাই বলেছিল "আগে ডিনারটা সেরে নেওয়া যাক"৷ কিন্তু তারপর ব্রজদা যে খেল দেখালে, আমি তো থ৷
ডিনারের পর, "এক মিনিটে আসছি" বলে ব্রজদা ভিতরের ঘরে মিনিট কুড়ির জন্য গায়েব হলেন৷ সে ফাঁকে ব্রজদার রেফ্রিজারেটর জরীপ করে এক বাক্স চমচম পাওয়া গেল। সে বাক্স অনেকটা হালকা করে এনেছিলাম৷ এমন সময় ব্রজদা ফিরল। আর ব্রজদাকে দেখে একটা বিশ্রী বিষম খেতে হল যার ফলে মুখ থেকে এক টুকরো চমচম উড়ে গিয়ে থিতু হয় বসল দেওয়ালে টাঙানো গ্রিনপ্লাইয়ের ক্যালেন্ডারে৷
স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি ছেড়ে ব্রজদা গেরুয়া জোব্বা পরে বেরিয়ে এসেছে৷ গলায় কয়েক'ছড়া রুদ্রাক্ষের মালা৷ কাঁধে একটা হলদে ঝোলা আর ডান হাতে একটা সুটকেস৷ আর মুখের হাসি অত্যাধিক চওড়া আর অস্বস্তিকর ভাবে দেখনাই৷
হাসিটাকে আরও একটু চওড়া করে, সুটকেসটা নামিয়ে রেখে আমার সামনে ক্যাটওয়াকের ভঙ্গীমায় তিরিশ সেকেন্ড মত হাঁটলেন৷ তারপর আচমকা হাঁটা থামিয়ে আমার দিকে উৎসুকভাবে তাকালেন।
- কেমন বুঝছ ভায়া?
- কী ব্যাপার ব্রজদা? হঠাৎ এই পোশাকে..থিয়েটার টিয়েটারে চান্স পেয়েছেন নাকি?
- ঘাবড়ে গেছ দেখছি।
- হ্যাঁ মানে আচমকা এ'ভাবে..।
- একটা সিগারেট দাও..বলাই বাহুল্য..মাই লাস্ট সিগারেট।
- সিগারেট ছেড়ে দেবেন?
- মোগলাই আর মাটন ছেড়ে দিলাম হে৷ এ তো স্রেফ ধোঁয়া৷
- ওহ আজ তাহলে..।
- লাস্ট সাপার ছিল৷ ঠিকই ধরেছ।
- কিন্তু আপনি হঠাৎ..।
- চললাম। হে বন্ধু, বিদায়। এই ক্যালক্যাটা, অফিস; সব নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম৷
- ডিটক্স?
- পার্মানেন্ট৷ সন্ন্যাস। গত হপ্তাতেই এক বাবাজী জোগাড় করতে পেরেছি৷ গোট দেশে তাঁর খানসাতেক আশ্রম৷ ব্রশার পাঠিয়েছিল। আমি হিমাচলের একটা স্পট সিলেক্ট করেছি৷ আজ রাতের ফ্লাইটে দিল্লী চললাম৷ সে'খানে বাবাজীর হেডঅফিস৷ একটা কন্ডিশনিং কোর্স করতে হবে সে'খানে। দিন সাতেক পর সোজা কোর্স কম্পলিশন সার্টিফিকেট হাতে সোজা আশ্রম৷ পাহাড়ের কোলে, সাররিয়াল, পীসফুল৷ ভাবতেই ভালো লাগছে।
- বাবাজীর আশ্রমের ব্রশার? কন্ডিশনিং কোর্স?
- ব্রশারের সফটকপিও আছে৷ তোমায় হোয়্যাটস্যাপ করে দেব'খন।
- ওহ্।
- তা, মহাপ্রস্থানের জন্য আজকের দিনটা প্রেফার করলাম কেন আশা করি বুঝতে পারছ৷ ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ ইয়োগা আজ। অফিসের কচকচি, লিটল ম্যাগাজিনের ইন্টেলেকচুয়াল ভাঁওতা, কফি হাউসের কলার টানাটানি আর এই চপ-কাটলেটের লোভের অন্ধকার থেকে নিজেকে লেভিটেট করিয়ে তুলে নিচ্ছি৷ এরপর আমার গোটা জীবনটাই হয়ে উঠবে যোগসাধনা৷ প্রতিটি মুহূর্তই প্রাণায়াম।
- আপনি কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছেন ব্রজদা?
- ফর এভার৷ ট্যু ক্রাউডেড৷ চারদিকে ধান্দাবাজি৷ বছরে সাড়ে এগারো মাস প্যাঁচপ্যাঁচে গরম৷ ভাজাভুজিতে ভেজাল তেল। অফিসে ল্যাং মারামারি৷ বাসে ঝুলোঝুলি, ফুটপাতে ধাক্কাধাক্কি৷ ফেড আপ৷ আশ্রমে একটা বড় খোলামেলা ঘর পেয়েছি, রিভার ফেসিং - বুঝলে! বাবাজির ট্রাস্টে একটা বড় আমাউন্ট দিতে হয়েছে অবিশ্যি সে'সবের জন্য৷ এখন সেই পীস হ্যাভেনে শুধু আমি আর আমার যোগসাধনা৷
**
- এই যে ভায়া!
- আরে ব্রজদা না?
- এটা নতুন নম্বর, সেভ করে নাও৷
- হোয়াট আ সারপ্রাইজ৷ আছেন কেমন?
- জাস্ট তোফা৷
- কদ্দিন পর কথা হচ্ছে বলুন তো?
- পাক্কা তিন বছর পর।
- রাইট৷ তাই তো৷ তা আছেন কেমন? মোক্ষলাভ হল কি? এখনও সেই রিভার ফেসিং রুমেই আছেন নাকি হিমালয়ের কোনও গুহায় কৌপীন পরে গাঁজা টানিছেন?
- আপাতত বিভূতি রেস্টুরেন্ট ফেসিং ব্যালকনিতে বসে তোমায় ফোন করছি।
- সে কী? কলকাতায় ফিরেছেন? কদিনের জন্য? ভক্ত সমাগম কেমন? দর্শন দেবেন কি?
- এক ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ ইয়োগাতে প্রস্থান৷ অন্য এক ইন্টারন্যাশনাল ইয়োগাতে রিটার্ন।
- বলেন কী! আশ্রম ছেড়ে দিয়েছেন?
- সমস্তটাই যোগসাধনার স্বার্থে৷ তোমায় তো বলেইছিলাম, ইয়োগা ইস মাই লাইফ৷
- কেন? আশ্রমে সাধনায় ব্যাঘাত ঘটছিল বুঝি ব্রজদা?
- মনের মত আসনটা ঠিক হয়ে উঠছিল না৷
- মনের মত আসন?
- তিনটি বছর লাগল সত্য অনুধাবন করতে৷ একমাত্র একটাই যোগে আমার মুক্তি৷ প্রাণখুলে নিজের লেখা কবিতা শোনানো; অনলি ফর্ম অফ ইয়োগা আই নীড ভায়া৷ এ তিন বছরে কম আশ্রম আখড়া ঘুরলাম না। কিন্তু আমার সমস্ত ধরেবেঁধে কবিতা শোনানোর বন্ধুদের যে কলকাতাতেই ফেলে গেছিলাম ভায়া৷ কবিতা না শোনাত পেরে মনের ভিতর ময়লা জমতে শুরু করেছিল, পেট ফেঁপে ওঠার উপক্রম৷ কাজেই, যোগদিবসে তাই ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন৷ শোনো, চলে এসো৷ এখুনি! তিন বছরে দিস্তে দিস্তে পোয়েট্রি লিখেছি। সে'সবের শ্রোতা না পেলে আমার যোগসাধনা বৃথা।
- ইয়ে, মানে...সামনের উইকেন্ডে আসব না হয়? গোটাদিন বেশ আড্ডা জমানো যাবে৷ আজ একটু কাজ জমেছিল..।
- আশ্রমে থেকে আমার আমিষে আগ্রহ সত্যিই গেছে৷ নিজের জন্য কয়েকটা লুচি ভাজব বলে ময়দা মেখে রেখেছি৷ আর বেগুনভাজা৷ তোমার জন্য অবশ্য রুমালি রুটি, মাটন চাপ, ব্রেনকারি, মেটে চচ্চড়ি আর মুর্গ পোলাও আনিয়ে রেখেছি৷ চলে এসো৷ আমি বাহাত্তরটা কবিতা শর্টলিস্ট করে রেখেছি পড়ব বলে। ক্যুইকলি চলে এসো ভাই।
এরপর আর না বলা সম্ভব নয়৷
1 comment:
আহা অপূর্ব লেখা।
Post a Comment