শুক্রুবার অফিস থেকে ফিরে মেসের স্যাঁতস্যাঁতে বাথরুমটায় ঢুকে মার্গো সাবান কচলাতে কচলাতে টপ্পা ধরেছিলেন শিবুবাবু৷ টপ্পার সুর স্যাট করে কেটে দিয়ে বাথরুমের মধ্যে রুমমেট অনন্তর হাঁক ভেসে এসেছিল; "চিঠি এসেছে শিবুদা"! মনটা চলকে উঠেছিল শিবুবাবুর৷ এ হপ্তায় দু'টো চিঠির কোটা পেরিয়ে এ'টা তিন নম্বর। শিবু চৌধুরি জানেন যে গিন্নী তিন নম্বর চিঠি তখনই লেখেন যখন বাড়তি মাখোমাখো ভালোবাসা ভূতের মত ঘাড়ে চাপে৷ অনন্তকে " আসছি!" বলে টপ্পা থেকে গজলে চলে গেলেন ভদ্রলোক৷ বারোয়ারি মার্গোর বদলে নিজের পার্সোনাল স্টকের লাক্স সাবানটা প্যাকেট ছিঁড়ে বের করলেন৷ অবশ্য তিনি জানেন যে প্যাকেট ছেঁড়া মাত্রই এ সাবান বারোয়ারি খাতায় চলে গেল; মেসের সে'টাই অলিখিত নিয়ম৷ প্রেমের চিঠি বাঘের শিকার নয়, বরং সুরাসমেত শৌখিন কারুকাজ করা সোনার বাদশাহী পেয়ালার সঙ্গে তার তুলনা চলতে পারে৷ সে রহিসি জিনিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে নেই৷ কাজেই তাড়াহুড়ো না করে স্নানে মন দিলেন ভদ্রলোক৷
স্নান সেরে বেরিয়ে এসে বসন্তকে চট করে আদা দেওয়া চায়ের পাশাপাশি কড়া করে ডবল ডিমের মামলেট ভেজে আনতে বললেন৷ এও জানিয়ে দিলেন রাতের খাবার তিনি বাইরেই খাবেন৷ তিন নম্বর চিঠি পড়ার পর মেসের ট্যালট্যালে ঝোল প্রাণে সইবে না৷ পরেশের দোকানের রুটি মাংস ছাড়া আজকের মেজাজটা কেউ ছুঁতে পারবে না৷ এরপর গোটা গায়ে পন্ডসের সুগন্ধি পাউডার ছড়িয়ে, গায়ে প্রিয় আকাশী রঙের ফতুয়াটা চাপিয়ে, নিজের চৌকিতে এসে আয়েস করে বসলেন শিবু চৌধুরি। অনন্ত টিউশনি পড়াতে যাওয়ার আগে এনভেলপখানা তার চৌকির ওপরেই বালিশচাপা দিয়ে রেখে গেছে৷
আধঘণ্টার মাথায় চা আর মামলেট শেষ করে এনভেলপখানা হাতে নিলেন শিবুবাবু৷ গিন্নীর হাতের লেখায় মেসের ঠিকানাটা বার বার পড়েও যেন মন ভরেনা৷ খামের গায়ে কি মুসুরডাল আর কেয়োকার্পিন তেল মেশানো একটা মিঠে গন্ধ লেগে আছে? ব্যাপারটা স্রেফ বাড়াবাড়ি, কিন্তু অমন কাব্যিক কল্পনা সামান্য মাথায় না খেললে তো প্রেমটাই মাটি৷ যা হোক৷ হপ্তায় তিন নম্বর চিঠির গুরুত্ব শিবু চৌধুরি জানেন। বেশির ভাগ হপ্তাতেই এই তিন নম্বর চিঠির সোহাগ তার কপালে জোটেনা৷ আর শিবুবাবুর ক্ষুদিরামের হিসেব বলছে যে এত বছরে এই নিয়ে এ'টা হল তিন নম্বর চিঠি পাওয়া সাতান্ন নম্বর হপ্তা।
এ'চিঠি পড়ার আমেজটাই আলাদা৷ সাধারণ রুলটানা ফুলস্কেপ কাগজের ওপর সস্তা ডটপেনে লেখা চিঠিটা মেলে ধরতেই বুকের মধ্যে ভালোবাসার তোলপাড় টের পেলেন শিবুবাবু৷ আজকেত চিঠিতে রয়েছে রুই মাছের ঢাকাইয়া কোপ্তার রেসিপি৷ আর কিচ্ছু না, স্রেফ রেসিপিটুকু; এ'টাই তিন নম্বর চিঠির নিয়ম৷ গিন্নীর হাতের রান্নায় ম্যাজিক রয়েছে, কোনও কবিতার ছন্দ বা গানের সুরের সঙ্গে তুলনা করা সে গুণের বর্ণনা অসম্ভব৷ গিন্নীর নিজস্ব রেসিপি অজস্র অথচ তার এতই লজ্জা যে সে নিজে সে'সব কিছুতেই লিখবে না৷ অনেক চেষ্টার পর, অনেক ঝুলোঝুলি খুনসুটির পর গিন্নীকে নিমরাজি করানো গেছিল যে শিবুবাবুর জন্য মনখারাপ মাত্রা ছাড়ালে সে নিজের কোনও একটা নিজস্ব রেসিপি যত্ন করে লিখে তাকে পোস্ট করবে৷ রুই মাছের ঢাকাইয়া কোপ্তার রেসিপিটা ঝাড়া একুশবার পড়লেন শিবু চৌধুরি৷ প্রতিটা ধাপে ধাপে বাড়ির রান্নাঘর আর গিন্নীর গায়ের সুবাস নিজের নাকে আর বুকে টের পাচ্ছিলেন তিনি৷ এমনটাই প্রত্যেকবার হয়৷ দিনে হাজারবার মোবাইল ফোনে কথা হলেও, এ' উষ্ণতার সঙ্গে সেই হ্যাঁগো-ওগোর তুলনা চলে না৷
পড়া হয়ে গেলে বুকশেল্ফের পিছন দিকে রাখা সবুজ ফ্ল্যাটফাইলটা বের করে গিন্নীর সাতান্ন নম্বর রেসিপিটা যত্ন করে ফাইল করলেন তিনি৷ একশো এক হলেই এ ফাইল বগলদাবা করে মনু দত্তের অফিসে ছুটতে হবে৷ ভদ্রলোকের সঙ্গে কফিহাউসের আড্ডায় আলাপ, ভারী মাইডিয়ার মানুষ৷ পেশায় নতুনধারা প্রকাশনীর কর্ণধার। এর জন্যে কিছু টাকাও আলাদা করে ফিক্স করে রেখেছেন শিবুবাবু; মনু দত্ত নিজের টাকা খাটাতে না চাইলেও "সুতপার ১০১ ভালোবাসার রান্না" ছাপা হতেই হবে৷ হটকেকের মত বিক্রি যে হবে সে নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই, ভালোবাসার কদর মানুষকে যে করতেই হবে৷ বইটে ছাপা হলে গিন্নীকে বেশ জব্বর একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে, আর শাজাহানের তাজমহলকেও দিব্যি ছ'গোল দেওয়া যাবে৷
No comments:
Post a Comment