"কতটা পেরোলে পরে পথিক বলা যায়"৷ গানের কথাগুলো লেখার সময় সুমন একটা লাইন ফস্ করে লিখে ফেলার পর নির্ঘাৎ কেটে দিয়েছিলেন, " কতটা ক্রিকেট বুঝলে তবে ক্রিকেট রসিক বলা যায়"? অন্যান্য সব জটিল ও বেয়াড়া প্রশ্নদের মত, এরও কোনও সদুত্তর জোটানো সম্ভব নয়৷ সদুত্তর দেওয়া কেন সম্ভব নয়? সে পোয়েট্রি দু'জন মানুষের নিজেদের জীবন ও মৃত্যু দিয়ে বুঝিয়ে গেছেন৷
একজন বিলিতি সাহেব হ্যারি থম্পসন৷ অন্য জন শ্রীলঙ্কার ডাব্লু জি করুণাসেনা৷ তাঁদের মধ্যে প্রচুর অমিল৷ একজন রক্তে মাংসে বেঁচেবর্তে ছিলেন, অন্যজন নেহাতই এক টুকরো কল্পনা৷ একজনের জন্য আনন্দধারা বহিছে ভুবনে, অন্যজন কপাল-দিয়ে-পেরেক-ঠোকা বিটকেল মেজাজের মানুষ৷ একজন শখ-শৌখিনতায় ভরপুর, অন্যজন ধ্যাত্তেরিকাঁচকলায় দিন গুজরান করা বান্দা৷ একজনের সেন্স অফ হিউমরে পালকের সুড়সুড়, অন্যজনের সেন্স অফ হিউমরে বিছুটি আর চিমটির খুনে কম্বিনেশন; কিন্তু দুইই অব্যর্থ৷
দু'জনের যোগাযোগ শুধু একটাই বিন্দুতে; ক্রিকেটের প্রতি অদম্য ভালোবাসায়৷
হ্যারি একটা ক্রিকেট দল তৈরি করেছিলেন৷ ক্যাপ্টেন স্কট একাদশ৷ সে দলের যাত্রা শুরু এমন একদল ক্রিকেটারদের নিয়ে যাদের বেশিরভাগের ক্রিকেট দৌড় বোধ হয় আমার সঙ্গে তুলনীয়৷ তারা প্রচুর খেলত আর স্বাভাবিক কারণেই এন্তার হারত৷ অথচ সেই অজস্র গোহারানেও হ্যারির ক্রিকেটপ্রেম দমে যায়নি৷ বরং ক্যাপ্টেন স্কট একাদশ প্রতিটা মহাদেশ সফর করেছে ক্রিকেট খেলতে৷ আর সেই সফর নিয়েই হ্যারি থম্পসনের লেখা 'পেঙ্গুইনস স্টপড প্লে'৷ বইটা ধীরেসুস্থে পড়তে হয়েছে, কারণ প্রতি প্যারাগ্রাফে খ্যাকখ্যাক করে হাসলে পড়ার স্পীড কমবেই৷ ব্রিটিশ হিউমর হোমিওপ্যাথির বড়ির মত সুমিষ্ট কিন্তু কাজের বেলায় অ্যান্টিবায়োটিকের ঠাকুর্দা; তার প্রমাণ এই বই৷ জীবণের শেষ দিন পর্যন্ত হ্যারি ক্রিকেট নিমজ্জিত ছিলেন; দুর্দান্ত খেলে নয়, খেলার প্রতি ডিসিপ্লিনে নয়, এমন কি ক্ষুরধার ক্রিকেট বিশ্লেষক হিসেবেও নয়৷ হ্যারির ক্রিকেটে থাকা স্রেফ ভালোবাসায়৷ নিপাট ভালোবাসায়৷ 'পেঙ্গুইনস স্টপড প্লে' নেহাতই সেই ভালোবাসার গল্প৷
করুণাসেনা আবার সুমিষ্ট হিউমরের ধার ধারেন না৷ তাঁর অস্ত্র এফোঁড়ওফোঁড় করা সারকাজম৷ ভদ্রলোক ক্রিকেটের ফিল্টার দিয়ে জীবনকে চিনেছেন, ক্রিকেট নিয়ে বেমক্কা বেহিসেবি আলগা কথাবার্তা তাঁর ঘোর না-পসন্দ৷ ক্রিকেট তাঁর কাছে একমাত্র পবিত্র সত্য৷ তিনে নিজে সেঞ্চুরি বা ফাইফার হাঁকানো খেলোয়াড় নন, বরং একজন ধারালো ক্রিকেট জার্নালিস্ট এবং ক্রিকেট সত্যের একনিষ্ঠ উপাসক৷ যুক্তি, লজিক বা হিসেবের অবমাননা দেখলেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেন৷ দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো সমস্ত ঘটনাপ্রবাহকে তিনি ক্রিকেটের স্কেলে মেপে তাদের গুরুত্ব নির্ধারণ করেন৷ তবে হ্যারির মতই, তাঁরও ক্রিকেটে থাকা স্রেফ ভালোবাসার জোরে৷ শেষ বয়সে এসে তিনি খোঁজ শুরু করেছিলেন শ্রীলঙ্কার হারিয়ে যাওয়া জিনিয়াস;
ক্রিকেটার প্রদীপ ম্যাথিউ সম্বন্ধে৷ সে এক রুদ্ধশ্বাস কাহিনী৷ অবিশ্যি করুণাসেনা বা প্রদীপ, দু'জনেই শেহান করুণাতিলকের কল্পনা মাত্র, তাদের ঠাঁই স্রেফ 'চায়নাম্যান - দ্য লেজেন্ড অফ প্রদীপ ম্যাথিউ' বইটিতে৷ কিন্তু এ বইকে গড়পড়তা ফিকশন হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। শ্রীলঙ্কা সম্বন্ধে এমন ধারালো সোশ্যাল কমেন্ট্রি যে খুব বেশি নেই তা বলাই বাহুল্য৷ এ বইয়ের মূলে রয়েছে শ্রীলঙ্কা আর সে'খানকার মানুষ৷ ক'দিন আগেই পড়েছিলাম 'দিস ডিভাইডেড আইল্যান্ড'; নন-ফিকশন। শ্রীলঙ্কাকে বুঝতে সেই নন-ফিকশনের পাশাপাশি এই অ-ফিকশনিও ফিকশনখানাও না পড়লেই নয়৷ আর হ্যাঁ, এ বই পড়তে গিয়েও খানিক পরপরই হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়তে হবে৷ আর বাড়তি পাওনাঃ পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা দুর্দান্ত সব স্পোর্টস ট্রিভিয়া। এই বই হল 'ক্রিকেট রীডিং'য়ের টেস্টম্যাচ, ধৈর্য ধরে, রসিয়ে, হেলেদুলে এ বই ধরে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই৷ হুড়মুড় করে গিলে খাওয়ার কেতাব এ'টা নয়৷
আর দু'জন ক্রিকেট রসিকের কথা বলে শেষ করি৷ ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা আর ভাষার হিউমরে যারা থম্পসন৷ আবার নিখাদ স্ট্যাটিস্টিক্যাল ও ঐতিহাসিক সততা এবং চুলচেরা বিশ্লেষণের ব্যাপারে যারা করুণাসেনার দিকে। অভিষেক মুখার্জী আর অরুণাভ সেনগুপ্ত৷ কিছুদিন আগে এদের দু'জনের লেখা "শচীন অ্যান্ড আজহার অ্যাট কেপটাউন" প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৯৭ সাল, ভারত দক্ষিণ আফ্রিকা কেপটাউন টেস্ট৷ সাউথ আফ্রিকা প্রথমে ব্যাট করে কয়েক হাজার রান করেছিল বোধ হয়৷ জবাবে ভারত নব্বুইয়ের দশককে সেলাম জানিয়ে আটান্ন রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে 'মানিব্যাগ খোয়ানো গোবেচারা মানুষটির ধর্মতলায় খাবি খাওয়ার' স্টাইলে ছটফট করছিল৷ সে'খান থেকে শচীন আর আজহারউদ্দিন একটা বেহিসেবী পার্টনারশিপ গড়ে বসেন৷ শেষরক্ষা হয়নি, কিন্তু রূপকথা তৈরি করা গেছিল৷ সেই পার্টনারশিপকে ভিত্তি করা লেখা এই বই অবশ্য স্রেফ রূপকথার গালগল্প নয়; বরং ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এবং, 'চায়নাম্যান' বইটার মতই, এ বই একটা জরুরী সোশ্যাল কমেন্ট্রিও বটে৷ তবে এ বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ হল লেখার স্টাইল৷ দু'জন ক্রিকেট ভালোবাসিয়ের নির্ভেজাল ইতিহাস-নির্ভর আড্ডা দুই মলাটের মধ্যে তরতরিয়ে এগিয়েছে৷ শচীন আজহারের মাখনে-ছুরি পার্টনারশিপের মতই অরুণাভ আর অভিষেকের লেখা এস্পারওস্পার করেছে৷
ক্রিকেট-রসিক হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম৷ সেই সূত্রেই এই তিনটে বইয়ের কথা লিখে রাখা৷ কিন্তু ক্রিকেট ভালোবাসিয়ে হিসেবে আমার স্থান কোথায়? হ্যারি থম্পসন বড় কোনও ক্রিকেটার নন তবু একটানা একটা হেরো দল নিয়ে খেলে গেছেন স্রেফ নির্লজ্জ ভালোবাসায়। করুণাসেনার মত কিছু মানুষ হাজার হোঁচট খেয়েও ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরে থেকেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, গলির ক্রিকেট ম্যাচে জোর করে আম্পায়্যারিং করে নিজের ক্রিকেট-প্যাশন ফলিয়েছেন; সে'সবও তো ওই নির্লজ্জ ভালোবাসায়৷
খেলায় এলেম নেই, পরিসংখ্যান গুলে খাওয়া হয়নি, গেম-সেন্স ভোঁতা৷ তবু৷ নির্লজ্জ ভালোবাসার গুণ অসীম৷ ক্রিকেট রসিক হয়ে উঠতে না পারি, ক্রিকেট ভালোবাসিয়েদের দুনিয়ায়; থম্পসন করুণাসেনাদের পায়ের কাছে সামান্য জায়গা আমাদের জুটবেই৷ আর এ কথাটা মাথা উঁচু করে বলার জন্য আজকের এই 'ওভালে-কামাল' দিনটা বড়ই ভালো৷
No comments:
Post a Comment