কলেজ স্ট্রিট সংলগ্ন মেসবাড়িতে চার বছর কেটেছে৷ তখন অল্প বয়স, মনে ক্লোরোফিলের পরিমাণ বিতিকিচ্ছিরি ভাবে বেশি৷ আমাদের মেসে একটা মহালয়া-ট্র্যাডিশন ছিল, যা আর পাঁচটা ট্র্যাডিশনের মতই অদরকারী অথচ হাইক্লাস হুজুগ আর খামোখা লাফালাফিতে পরিপূর্ণ৷ মেসবাড়িতে কাকভোরে ঘুম থেকে ওঠার ব্যাপারটা একটা ক্রাইমের পর্যায় পড়ত, তবে মহালয়ার দিনটা অন্যরকম৷ রেডিওয় মহিষাসুরমর্দিনী শুরু হওয়ার আগেই আমারা ছেলেপিলেরা রেডিও আর চানাচুরের বয়াম হাতে ছাতে উঠে যেতাম৷ বীরেনবাবুর কণ্ঠ, হ্যারিসন রোড ধরে ছুটে চলা ভোরের ট্রামের ঘর্ঘর, আর ইয়ারবন্ধুদের চানাচুর চেবানোর মুচুরমুচুর মিলেমিশে সিম্ফনি তৈরি হত। সকলের চোখেই ঘুম লেগে থাকত, কিন্তু হুজুগ বড় বাই৷
রেডিওর মহালয়া শেষ হওয়ার পরেই আমরা বেরিয়ে পড়তাম দল বেঁধে৷ বছরে ওই একটি বারই হয়ত আমাদের গায়ে ভোরের কলকাতার হাওয়া লাগত৷ কলেজ স্ট্রিট থেকে হাঁটা শুরু করে সোজা হাওড়া ব্রিজ৷ সে'সময়কার গাম্বাট খ্যাপাটেপনার কথা ভাবলে এখন গায়ে জ্বর আসে৷ কলেজ স্ট্রিট মোড়, সেন্ট্রাল এভিনিউ মোড়, বড়বাজার পেরিয়ে যাত্রা৷ প্রতিবার চিৎপুর ক্রসিংয়ের সামনে পৌঁছে এক বন্ধুর স্বগতোক্তি শুনতে পেতাম, "ভাই, এই এনার্জি আর ফোকাসের সিকিভাগও যদি পড়াশোনোয় ইনভেস্ট করতে পারতাম, তা'হলে বাপমায়ের দুশ্চিন্তা দূর করে দাঁড়িয়ে যেতাম"৷ বন্ধুটি কিন্তু পড়াশোনায় কামাল করে চাকরী হাঁকিয়ে এখন দিব্যি দাঁড়িয়েছে, যেমনটি দাঁড়ালে সমাজ বলবে, "সাব্বাস ভাইটি"। কিন্তু ভাইটিকে মহালয়ার ভোরে হেঁটে বিশ্বজয় করার ক্ষমতাটুকু হারাতে হয়েছে৷
হাওড়া ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ খাজাগল্প চলত৷ মেসের ছেলেরা অ-কলকাতার মানুষ৷ হাওড়া ব্রিজের আমাদের প্রায় সকলেরই 'বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে ছোটা'র শেষ ল্যাপ। কিন্তু ওই দিনটা অন্যরকম হত, হাওড়া ব্রিজ হয়ে স্টেশনমুখো যাওয়া নেই, তা'তে সেই পেল্লায় ব্রিজটা খানিকটা বেশি আপন মন হত বোধ হয়৷ ভোরের ফুরফুরে হাওয়ায়, ব্রিজের রেলিং ধরে গঙ্গার দিকে এক মনে তাকিয়ে থেকে বীরেনবাবুর কণ্ঠস্বরের রেসোনেন্স অনুভব করতে পারলে নাকি আয়ুবৃদ্ধি হয়৷ থিওরিটা আমার নয়, ঘোর নাস্তিক এক মেসবন্ধুর৷ ধর্মটর্ম না মানলেও, কলকাতার ক্যাঁচক্যাঁচর, হুগলির মিঠে হাওয়া আর মহালয়া ভোরের আলোর যে ককটেল; তার আস্তিকতা উড়িয়ে দিতে পারত না বোধ হয়৷
এরপর নেমে আসতাম ঘাটের কাছে৷ বড্ড ঘিঞ্জি, জন্মের ভিড়৷ আর অজস্র মানুষ ছাপিয়ে যে'টা প্রকাণ্ড হয়ে উঠত সে'টা হল সম্মিলিত মন্ত্রোচ্চারণ৷ সে এক্কেবারে নেশা ধরানোর মত এক গমগম। সে দৃশ্য আর শব্দ বর্ণনা করার ক্ষমতা থাকলে আমি লারেলাপ্পা ব্লগার না হয়ে নভেলিস্ট হতাম৷ যে'টা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় সে'টা হল প্রতি বছর ঠিক সেই জায়গায় পৌঁছেই মনে হত, " উফ্ বড্ড হাঁটাহাঁটি গেছে, দুর্দান্ত খিদে পেয়েছে"৷ ঘাটের কাছের দোকান থেকে কিনে স্টিলের প্লেটে কচুরি ছোলারডাল খাওয়া হত৷ অজস্র কচুরি আর বাটি বাটি ডাল নিমেষে গায়েব করে মেসবাড়ির টীম বেরোত বজরাভ্রমণে। অবশ্যই বজরা নয়, সস্তায় পুষ্টিকর টিকিট কেটে চড়া লঞ্চ; তবে বজরা বললে মগনলালেস্ক একটা ঘ্যাম অনুভব করা যায়৷ সাতসকালের গঙ্গার হাওয়া যে এমন মিঠে, তা মহালয়া না এলে জানতেই পারতাম না৷ এরপর থাকত বিস্তর কচুরি-হজম-ঘোরাঘুরি। বাগবাজার, কুমোরটুলি হয়ে প্রিন্সেপ পর্যন্ত৷ পুরোটাই অদরকারী, দরকারী হলে তা নিয়ে এত বছর পর 'আহা উঁহু' করার প্রয়োজন হত না৷
তা এদ্দিন পরেও মহালয়া নিয়ে গল্প ফাঁদতে গেলে সেই চারবছরেই আটকে যেতে হয়৷ আরও ছোটবেলায় মহালয়াতে ঠাকুমা ছিল, আর তার চেয়েও সুগভীরভাবে ছিল একটা রেডিও যে'টাকে মহালয়ার ঠিক আগেই ঝেড়েপুছে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে মানুষ করা হত। মশারির নীচে আমি আধশোয়া৷ হাফঘুমে ৷ ঠাকুমা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আরাম দিত, তা'তে ঘুম ভেঙেও ভাঙতে চাইত না৷ অথচ ঠাকুমার মাঝেমধ্যেই বলে চলত, "এমন সুর ভাই, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে না? উঠে পড়ো"৷
আমার মহালয়া শুধুই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর আর রেডিওয় নেই৷ ভোরের হাওড়া ব্রিজ, কচুরির সুবাস, গঙ্গার হাওয়া, আর মাথায় বোলানো ঠাকুমার হাত; এই সব মিলিয়েমিশিয়ে একদলা স্মৃতি মনের মধ্যে মহালয়া হয়ে রয়ে গেছে। ইউটিউবের জগতের খোকাখুকুদের মহালয়া যে আমাদের মত দরকচা মারা বুড়োধাড়িদের স্মৃতির সঙ্গে খাপ খাবে না, সে'টাই স্বাভাবিক৷ তাদের মহালয়াতে বীরেনবাবু কতটা থাকবেন, বুকে 'পুজো এসে গ্যালো' মার্কা ছ্যাঁত কতটা থাকবে, সে হিসেব করার দায় তাদের নেই৷ সে আনন্দ তাদের গছিয়ে দেওয়ার দায় স্রেফ আমাদের৷ বীরেনবাবুর 'ইয়া দেবী' বহু প্রজন্মকে পুজোর গন্ধ চিনিয়েছে, এখনও তা অমলিন৷ তবে যে বুড়োচে মানুষরা মাঝেমধ্যেই মাতব্বরি সুরে বলেন, 'আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো মহালয়ার কিস্যু বোঝে না, মহালয়ার আমেজ ছিল আমাদের সময়...', তাদের মাথায় কয়েকটা কাল্পনিক গাঁট্টা মেরে ফেলুন, চটপট!
No comments:
Post a Comment