Monday, December 27, 2021

জগা মল্লিকের শাস্তি



- ব্রাদার৷ ও ব্রাদার। শুনছেন? জ্ঞান ফিরেছে?
- উঁ..।
- গা হাত পায়ে খুব ব্যথা নাকি? ব্রাদার? এহ্, আমার স্যাঙ্গাৎগুলো আপনাকে একটু বেশিই মারধোর করেছে। গোমুখ্যু ছেলেপিলে তো, মডারেশন ব্যাপারটা বোঝে না৷ তবে ভাববেন না৷ আমি ওদের খুব এক চোট ধমক দিয়েছি৷
- আমায় এ'ভাবে এদ্দিন আটকে রাখার মানে কী।
- এদ্দিন আবার কী৷ মাস তিনেকের বেশি তো হয়নি৷ বাড়ি ফিরে গুগুল ঘেঁটে দেখবেন শ্যামলবাবু৷ আপনার আগে বহু মানুষ মাসের পর মাস বন্দী থেকেছেন৷
- কী চান আপনারা৷ সে'টা তো এদ্দিনেও..।
- বলিনি৷ কারণ র্যানসম ট্যানসম নিয়ে আমরা মাথা ঘামাইনা৷ আমরা পেটি ক্রিমিনাল নই শ্যামলদা৷ কিছু মাইন্ড করবেন না, বাবুটাবু আমার পোষায় না৷ শ্যামলদাই ভালো৷ তাই তো?
- আপনারা টেররিস্ট?
- আমরা ভোট চাইলে আমাদের টেররিস্ট বলতেন না৷ তাই না?
- আপনি..আপনি কে?
- ওহ, আমার নাম জানা নেই বলে আলাপচারিতায় অসুবিধে হচ্ছে৷ তাই না ব্রাদার? বেশ৷ ধরুন আমার নাম জগা মল্লিক।
- কী চাই?
- আপনাকে মুক্তি দিতে চাই শ্যামলদা৷ মুক্তি৷
- এ'সব বাজে কথার কী মানে?
- বটেই তো৷ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে কথা বলছি না৷ আপনার মত সিভিলাইজড মানুষের কানে সে'সব বাজেই ঠেকবে৷
- এদ্দিন তো আমার সঙ্গে কথা বলেননি৷ আজ হঠাৎ..।
- ওই যে বললাম৷ আজ আপনার মুক্তি৷ আপনাকে আমরা ছেড়ে দিতে চাই৷ এই ভজা, শ্যামলদার হাতের বাঁধনটা খুলে দে বাপ৷ তবে পা আর কোমরটা আপাতত বাঁধাই থাক।
- আপনার মতলবটা কী?
- আপনি আমলা মানুষ৷ ইন্টেলিজেন্স তালেবর। সো কলড টেররিজমের বিরুদ্ধে নিবেদিত প্রাণ৷ আপনাকে রগড়ে দেওয়াটাই উদ্দেশ্য ছিল৷ তবে আমরা ঠিক করেছি আপনাকে ছেড়ে দেব৷ আফটার অল আপনার বৌ-মেয়ে নির্দোষ৷ আপনার অপেক্ষায় তারা নাওয়াখাওয়া ভুলে বসে আছে৷ দে ডিজার্ভ পীস৷
- বলে যান৷
- একটা ছোট্ট কাজ আপনাকে করতে হবে৷ মানে কাজটা এতই এলেবেলে যে বলতেও লজ্জা লাগছে৷ কিন্তু কী করি বলুন৷ আমারও ওপরওলা আছে৷ এই নিন৷ এই রিমোটটা ধরুন।
- এ'টা...এ'টা কী..।
- আরে! সাধারণ রিমোট৷ আপনাকে শুধু ওই বোতামটা টিপতে হবে৷ কাজটা নেহাতই পাতি৷ আমরাও সেরে ফেলতেই পারি৷ কিন্তু আমরা চাইছি এই পুণ্যটা আপনার কপালেই থাক৷ নিন, বোতামটা টিপুন৷ তারপর ভজা আপনার বাকি বাঁধনগুলো খুলে, মাছের ঝোল ভাত-চাটনি-সন্দেশ খাইয়ে, আপনাকে ট্যাক্সি করে বাড়ি দিয়ে আসবে৷
- এই বোতামটা টিপলে কী হবে?
- এ'সব ছেলেমানুষি প্রশ্ন আপনাকে মানায়? দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী শ্যামল দত্তর মুখে এমন নেকু প্রশ্ন মানায়?
- কী হবে?
- হাজার খানেক লোক সমেত কোনও ট্রেনে উড়ে যাবে হয়ত৷ অথবা ধরুন জমজমাট একটা গোটা বাজার ফুশ্ করে গায়েব৷ বলা যায় না, হাওড়া ব্রিজটাই হয়ত উবে যাবে৷ পসিবিলিটিস আর এন্ডলেস৷ তবে সে'সব ভেবে আপনার কাজ নেই৷ আসুন৷ বোতামটা টিপুন৷ অ্যান্ড দেন, মুক্তি৷ প্রমিস৷
**
মেয়ের মুখ বারবার মনে পড়ে৷ বুক ফেটে যায় শ্যামল দত্তের৷ কাছেই একটা টুলের ওপর রাখা রিমোটটা মাঝেমধ্যেই নেড়েচেড়ে দেখেন৷ হাত বোলান সে রিমোটের প্লাস্টিকে৷ কাঁপা কাঁপা আঙুলে হালকা স্পর্শ করেন লাল বোতামটা৷ আর তারপর সাবধানে সেই টুলের ওপর রেখে দেন৷
এ'ভাবেই কতদিন কেটে গেল৷ প্রতি মুহূর্তে মুক্তির হাতছানি; সে হাতছানি যে কী যন্ত্রণার৷ খুকির মুখ তাকে টানে, আবার খুকির মুখটাই মনে করিয়ে দেয় আর পাঁচটা খুকির প্রাণ তাঁর হাতের মুঠোয়৷ মাসখানেক পর সমস্ত বাঁধনই খুলে দিয়েছিল জগা মল্লিকের স্যাঙাৎরা৷ বন্দী হলেও হাঁটাচলা আটকে থাকেনি৷ শুধু সেই রিমোটটার দিকে তাকিয়ে প্রতি মুহূর্তে অজস্রবার ছিন্নভিন্ন হতেন শ্যামল৷
**
- ব্রাদার।
- জ..জগা..জগা মল্লিক?
- নামটা সাজানো নয় স্যার৷ এত বছর পরেও আপনি মনে রেখেছেন, থ্যাঙ্কিউ।
- আমি যার আস্তানায় বন্দী, তার নাম ভোলাটা গোস্তাখি।
- কেমন বোধ করছেন?
- এ'বারে সত্যিই মুক্তি হে জগা।
- ডাক্তার আজ আপনাকে দেখে গেলেন। ঘুমিয়েছিলেন আপনি।
- ডাক্তারির আওতায় আর কি আছি হে? এ'বার মুক্তি৷ দিন কয়েক, বড়জোর৷ তোমার রিমোটের বোতাম আর টিপতে হল না৷ এই বাঁচোয়া।
- তেরোটা বছর এইভাবে থেকে গেলেন৷ অথচ রিমোটের বোতামটা টিপলেই আপনি বেরিয়ে যেতে পারতেন৷
- আমায় খুন করতেই পারতে৷ তবে আমায় দিয়ে অকারণ মানুষ খুন করাতে পারবে না৷ কিছুতেই না৷ তা, ক'জন মারা যেত আমি এ বোতাম টিপলে?
- একজন।
- হুম?
- আমাদের দল আমায় বিশ্বাসঘাতক ভেবেছিল। আমার শাস্তিবিধান কী ছিল জানেন? আমার বন্দী..অর্থাৎ আপনার হাতে নিজের মেয়ের খুন হতে দেখা৷ আমার মেয়ে গত তেরো বছর একটা লকেট পরে রয়েছে৷ যে'টা সঙ্গে সঙ্গে তারও উড়ে যাওয়ার কথা, আপনি এই রিমোটের বোতাম টিপলে।
- জগা..!
- নিজের খুকির থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে আমার খুকিকে আপনি বাঁচিয়ে রেখেছেন শ্যামলদা৷ এ পাপ থেকে আমার মুক্তি নেই জানি৷ শুধু পারলে বিশ্বাস করবেন..আপনার খুকিকে আমি ভেসে যেতে দিইনি৷ আড়াল থেকে হলেও তাকে আগলে রেখেছি৷ আগলে রাখবও৷ আর বিশ্বাস করুন, গত তেরো বছরের প্রতিটি মুহুর্ত, আমি আপনার চেয়েও বহুগুণ বেশি যন্ত্রণায় কাটিয়েছি৷
- আই ট্রাস্ট ইউ ব্রাদার৷

No comments: