গার্জেনরা লাগাম সামান্য আলগা করলেই ছেলেপিলেরা গোল্লায় যাবে৷ গার্জেনের শাসন সামান্য এ'দিক ও'দিক হলেই ছেলেপিলেদের ফিউচর ডকে উঠবে৷ শক্ত হাতে, পেটাই মেজাজে কচিকাঁচাদের মানুষ করতে হবে৷
এ'টাই নিয়ম!
তেমনটাই হয়ে এসেছে!
চিরকাল!
আর শিক্ষকরা তো গার্জেন পিরামিডের মাথায় বসে, তাদের দায়িত্ব সতেরোগুণ বেশি৷
চিরকাল এ বিশ্বাসই আঁকড়েই কাটিয়েছেন তালডাঙা বয়েজ হাইস্কুলের ভূগোল শিক্ষক মনমোহন দত্ত।
ডিসিপ্লিনে সামান্য গড়বড় দেখলেই দাঁত খিঁচিয়ে ওঠা,
বেয়াদবি দেখলেই হাতের বেত নাচিয়ে গর্জে ওঠা,
ফাঁকি নজরে পড়লেই চোখ থেকে আগুন ঝরিয়ে টেবিল চাপড়ানো;
এ'সব কপিবুক শাসন টেকনিকের ব্যাপারে মনমোহন মাস্টার অতুলনীয়৷ মনমোহনবাবুর "এ'দিকে আয়" শুনলেই ছাত্রদের বুকে এক বিশ্রী কাঁপুনি শুরু হয়৷ হাড়বজ্জাত কোনও ছেলেকে শায়েস্তা করতে চাইলে হেডমাস্টার হরিহর সেন মাঝেমধ্যেই মনমোহন মাস্টারের শরণাপন্ন হন৷ এমনই দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী তিনি৷
ক্লাস রুমে পায়চারি করতে করতে ছাত্রদের নার্ভাস করে দিয়ে মাঝেমধ্যেই হুঙ্কার ছাড়েন তিনি; "সাফার দ্য পেইন অফ ডিসিপ্লিন টুডে অর সাফার দ্য পেইন অফ রিগ্রেট টুমরো"৷ ক্লাসের সব চেয়ে খতরনাক বিচ্ছুটিও মনমোহন মাস্টারের ক্লাসে সবিশেষ ট্যাঁফোঁ করে না।
স্কুল ছুটির পর বিকেলের দিকে বাড়ি ফেরেন মনমোহন দত্ত৷ একলা মানুষের পরিপাটি সংসার৷ হাতপা ধুয়ে চা-মুড়ি খেয়ে দেরাজ থেকে বর্মা কাঠের বাক্সটা বের করে দেখা৷ রোজকার নিয়ম৷ ডিসিপ্লিন। বাবার লেখা বাইশখানা চিঠি সে বাক্সে রাখা৷ এর মধ্যে একটাকে ঠিক চিঠি বলা চলেনা৷ চিরকুট৷ বাবার রেখে যাওয়া শেষ নোট। সে'টাই রোজ পড়ে দেখা।
"মনু,
ভুলে যাস না, ডিসিপ্লিন ছাড়া কোনও কিছুই হওয়ার নয়৷
আর এও মনে রাখিস, যে ডিসিপ্লিনে ভালোবাসা মেশানো নেই, তার সঙ্গে চাবুকের কোনও তফাৎ নেই৷ আর চাবুকের ভাষা মানুষ কোনওদিনও বোঝেনি, বুঝবেও না৷ কেমন?
তোর মধ্যে ভালোবাসা আছে মনু৷ মনে রাখিস৷ ভালোবাসা আছে।
বাবা"।
এরপর একটা ফতুয়া গায়ে চাপিয়ে নিজের হারকিউলিস সাইকেলে চেপে গাঙ্গুলিবাজারের দিকে এগিয়ে যাওয়া৷ মনমোহন দত্তের রোজকার রুটিন৷
গাঙ্গুলিবাজারের উত্তরে রেলের মাঠ৷ সে মাঠের একপাশে ফুচকার ঠেলা নিয়ে বিশু দাঁড়িয়ে থাকে৷ আর রোজ বুকেলে সে'ঠেলা আলো করে অপক্ষা করে থাকে বেশ কিছু ছেলেছোকরা৷ সে'দিক স্কুলে যাদের সবচেয়ে বেশি ধমকেছেন মনমোহন মাস্টার, সে'কজন৷ তালডাঙা বয়েজ হাইস্কুলের প্রতিটা ছাত্র এ নিয়ম জানে৷ মনমোহন মাস্টার যে'দিন যাকে কড়া স্টাইলে 'ডিসিপ্লিন' করবেন, সে'দিন তাদের কপালে অঢেল ফুচকা৷ আর ফুচকার শেষে মাঠে বসে মনোহর মাস্টারের অঢেল মনমাতানো গল্প৷
গল্প ফাঁদতে না পারলে মাস্টারি মিথ্যে৷
মনমোহন মাস্টার সে'টা বিলক্ষণ জানেন৷
গল্পের সুরে বাঁধতে না পারলেই ছেলেপিলেরা গোল্লায় যাবে৷ গল্পের মধ্যে দিয়ে সহজ সত্যিগুলো ধরিয়ে দিতে না পারলেই ছেলেপিলেদের ফিউচর ডকে উঠবে৷ ইতিহাসের গল্প দিয়ে, মানুষের সংগ্রামের গল্প দিয়ে কচিকাঁচাদের মানুষ করতে হবে৷
এ'টাই নিয়ম!
তেমনটাই হয়ে এসেছে!
চিরকাল!
No comments:
Post a Comment