জটিল কিছু যদি কেউ সহজ ভাষায় ফুসমন্তরে বুঝিয়ে দেন, তা'হলে তার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না৷ সে'দিক থেকে, য়ুভাল নোয়াহ্ হারারি সাহেবের প্রতি আমি বেশ খানিকটা ঋণী। আজ হঠাৎ ভদ্রলোকের কথা ফের মনে পড়ল কারণ ওঁর স্যাপিয়েনস বইটার মধ্যে যে চ্যাপ্টারটা আমার সবচেয়ে প্রিয়, সে'টা আজ আর একবার পড়লাম৷ বলে রাখা ভালো, 'এগ্রিকালচারাল রিভোলিউশন' নিয়ে লেখা ওই কয়েক পাতায় আমি মাঝেমধ্যেই ফেরত যাই। ঠিক যেমন ভাবে মাঝেমধ্যেই ঘুরেফিরে আগন্তুক সিনেমার সেই দৃশ্যটা দেখি যে'খানে মনমোহন মিত্র আর পৃথ্বীশ সেনগুপ্তর তর্কের চোটে অনীলা আর সুধীন্দ্রর ড্রয়িংরুম সরগরম হয়ে ওঠে৷
আগন্তুক যখন প্রথম দেখি, তখন আমি নেহাতই ছেলেমানুষ। তবে সে সংলাপ এতটাই তীক্ষ্ণ যে সেই স্কুলবয়সেও মনমোহনের ভক্ত হয়ে উঠতে সময় লাগেনি। কিন্তু সে সংলাপ নিয়ে 'বলে কী রে ভাই' মার্কা বিস্ময় বোধ করেছি অনেক পরে। স্যাপিয়েনসের ওই চ্যাপ্টারটার মতই, ওই দৃশ্যটা বারবার দেখেও ক্লান্তি আসেনা। আমার মত বহু ছাপোষা মানুষ নিশ্চয়ই মনমোহনের বাগ্মিতায় বারবার মুগ্ধ হয়েছেন। ফেসবুক টাইমলাইন বা ইউটিউবে সে দৃশ্য মাঝেমধ্যেই চলেও আসে। সভ্যতা কী, টেকনোলজি কী, মানবাধিকার কী, স্বাধীনতা কী; এ'সব ভারিক্কি প্রশ্নকে প্রায় টেনিস বল লোফালুফির পর্যায় এনে আলোচনা করেছেন মনমোহন। সারকাজম এড়াতে পারেননি, পৃথ্বীশের উস্কানিতে বারবার রেগেও উঠেছেন। কিন্তু মনমোহন নিশ্চিত ভাবেই দর্শকের ভাবনাচিন্তা এলোমেলো করে দিতে পেরেছেন৷ কিন্তু, পৃথ্বীশের জেদকে ঠিক ভাঙতে পারেননি মনমোহন। অবশ্য অমন একবগগা মানুষকে বাগে আনা সহজ নয়৷ সেই গাম্বাটপনার জন্যই তর্কটা জমে ওঠার আগেই সুতো ছিঁড়ে গেল।
আজ এই পোস্ট লিখতে বসা একটাই কারণে। আগন্তুকের সেই দৃশ্য যদি আমার মত অন্য কারুরও অসম্পূর্ণ ঠেকে, তাদের জন্য হারারির লেখা ওই কয়েকপাতা বেশ জরুরী। মানুষের চাষবাস কী ভাবে শুরু হল, সে গল্প হারারি বলেছেন যে'খানে, সেই অধ্যায়ের নাম; "হিস্ট্রিজ বিগেস্ট ফ্রড"। বনেজঙ্গলে শিকার করে, ফলমূল খেয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষ আচমকা একসময় চাষবাস শুরু করলে। সে'খান থেকে গড়ে উঠল বসতি। মানব সভ্যতা তরতরিয়ে এগোতে লাগল। পৃথ্বীশ নিশ্চয়ই যে'টাকে বলতেন; 'অভাবনীয় প্রগ্রেস'। কিন্তু সেই প্রগ্রেস যে কতটা গোলমেলে, সে'টাই বুঝিয়েছেন হারারি সাহেব; বরফ-মার্কা সব যুক্তি সাজিয়ে। গোটা মানব সভ্যতার মূলেই যে 'আশায় মরে চাষা'র ট্র্যাজেডি, তাই ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছেন হারারি।
চাষবাসের ফলে মানুষের খাটনি বাড়ল।
খাবারের পরিমাণ বাড়লেও পুষ্টি কমল, কারণ এর আগে মানুষ রকমারি ফল, সবজি, মাংস খেয়ে বেড়াত। অথচ কৃষিকাজ শুরু করার পর পাতে পড়তে লাগল কাঁড়িকাঁড়ি ভাত বা আটা।
শিকার করা বা গাছ থেকে ফল পাড়ার চেয়ে চাষবাসে অনেক বেশি খাটুনি। কাজেই জ্বালাযন্ত্রণা বাড়তে শুরু করল।
একদিকে।খাবার উৎপাদন যেমন বাড়ল, খেতখামারে কাজের জন্য বাড়তি লোকজনেরও দরকার পড়ল।
শিশুরা এর আগে স্রেফ মায়ের দুধের ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন 'আধুনিক' খিচুড়িটিচুড়ি পাতে পড়তে শুরু করল। ফলে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি বাড়তে লাগল, কমল ইমিউনিটি। শিশুমৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেল। সামগ্রিক রোগভোগও বাড়ল।
দু'এক রকম ফলনের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা বহুগুণ বেড়ে গেল, ফলে অতিবৃষ্টি খরা এইসব নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তায় বাড়ল বহুগুণ।
এরপর এলো আর এক গেরো। বাড়তি উৎপাদন সামলে রাখার দায় বাড়লো যাতে ভবিষ্যতে ফলন কম হলেও পেটে দানাপানি পড়ে। এরপর এলো একের ভরাগোলা দেখে অন্যের চোখ টাটানোর পালা। শুরু হলো চুরি। এলো যুদ্ধ। বসলো ট্যাক্স। শেষে সেই চিরপরিচিত ট্রাজেডি; কৃষকদের হাড়ভাঙা খাটুনির ওপর ট্যাক্স বসিয়ে সিংহাসনে বসলেন রাজা, তৈরি হল শহর, গড়ে উঠল সেনাবাহিনী, এলো রাজনীতি, এলো যুদ্ধ।
মোদ্দা কথা হল চাষবাস শুরু করার পর থেকেই হোমো স্যাপিয়েনদের রসেবশে থাকার দিন খতম। পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই বোধ হয় সুখে থাকতে ভূতে কিলোনোর শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ।
আর এ'খানেই একটা সামান্য খটকা। আগন্তুক সিনেমার সেই মারকাটারি তর্কের দৃশ্যে মনমোহন বন্যসভ্যতার পক্ষে সওয়াল করে বলছেন জংলি মানুষের 'এগ্রিকালচার, পটারি, উইভি''ও সমীহের দাবী রাখে। কিন্তু ওই এগ্রিকালচার থেকেই যে মানুষের পতনের শুরু। অবশ্যই সে পতনের মধ্যে দিয়েই রবীন্দ্রনাথ উঠে এসেছেন। সে'টা নিশ্চয়ই হেলাফেলার ব্যাপার নয়।
মনমোহনের আর্তনাদ মনে আছে? যে'খানে উনি প্রায় চিৎকার করে ঘোড়েলশ্রেষ্ঠ পৃথ্বীশকে বলছেন, "আপনি কেন বুঝতে পারছেন না আমি নিজে জংলি নই! এ'টা আমার পরম আক্ষেপের বিষয় যে আমি জংলি নই।...কিন্তু উপায় কী বলুন। ঘর ছাড়ার অনেক আগেই আমার মজ্জার মধ্যে ঢুকে গেছে শেকসপিয়ার, বঙ্কিম, মাইকেল, মার্ক্স, ফ্রয়েড, রবীন্দ্রনাথ.."।
" মজ্জায় রবীন্দ্রনাথ ঢুকে গেছে" - আমার মত এলেবেলে মানুষকে যদি এই আক্ষেপের মূলে পৌঁছতে হয়, তবে হারারি সাহেবের এই চমৎকার বইটা বোধ হয় অত্যন্ত জরুরী।
No comments:
Post a Comment