Monday, January 31, 2022

বাজে পান

এই এক রোগ। পান। এই করে করে ট্যুইটার অ্যাকাউন্টটাই উজাড় হয়ে গেল। ফেসবুকটাকেই বা ছাড় দেওয়া কেন। মাঝেমধ্যে টুইটার থেকে কয়েক পিস্‌ করে তুলে এনে এখানে রেখে যাওয়া দরকার।

**
সে'বার পিকনিকে গিয়ে কিশোরকুমার বড়ই বিপদে পড়েছিলেন৷ খেতে বসে দেখলেন মাংসের ঝোলে বিশ্রী গন্ধ, অতিরিক্ত মশলাপাতি দেওয়ায় গোলমাল হয়েছে আর কী। তখনই তিনি গেয়ে উঠেছিলেনঃ
শুঁকেও কেঁদে ওঠে মন,
শুঁকেও কেঁদে ওঠে মন,
এমনও খাসি আছে বেদনা মনে হয়;
জলে ভরে দু'নয়ন,
শুঁকেও কেঁদে ওঠে মন।

**
তাঁবুতে হুট করে ঢুকেই আলভারেজ হতবাক! শঙ্কর মদ্যপান করছে যে।
আলভারেজ শুধোলে, "কোন ব্র্যান্ড ভাই"?
স্মিত হেসে শঙ্কর জানালে, " দেবদারু"।

**
পাটনা শহরে কোনও জুটমিল নেই৷ স্বাভাবিক৷

**
সাপটা তেমন বিষাক্ত ছিল না৷ Patisapta.
**
ইনসমনিয়ার ওষুধঃ
টর্চ জ্বেলে ভেড়া গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়ুন৷
অর্থাৎ,
Aloe vera কাজে দেবে।

পিকনিকের প্রাণ



পাড়ার পিকনিক উজ্জ্বল হয় যাদের গুণে।

১।

।।"হারি আপ" জ্যেঠু।।
আলো ফোটার আগে থেকেই তাঁরা মন্ত্রপাঠ শুরু করবেনঃ
"পাংচুয়াল না হলে পিকনিক কেন, কোনও বড় কাজই কোনওদিনও করতে পারবি না"!
"ফিরতে রাত হলে বিস্তর ঝ্যামেলা হবে, তখন যেন আমায় বলতে এসো না"!
(ভোর ছ'টার সময়) "আরে দুপুর গড়ালে বেরোবি নাকি রে তোরা"!
মোট কথা অনবরত ঘ্যানঘ্যান করে সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলবেন৷ রাত থাকতে উঠে, স্নান সেরে ফিটফাট জামাকাপড় পড়ে বারান্দায় পায়চারি করবেন আর চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলবেন৷

২।

।।"প্ল্যানার" বড়দা৷।
টারজানের কলজে নিয়ে এরা পিকনিকের পরিকল্পনা সাজান। এদের মতে অন্তত তিন রাত্রি বাইরে ক্যাম্প করে না থাকলে নাকি পিকনিকই হয় না৷ শিকার করা জিরাফের ঠ্যাঙ ঝলসে না খেলে নাকি পিকনিকের মেজাজটাই মাটি৷ ঝর্নার জলে চুমুক দিয়ে তেষ্টা মেটানোর পক্ষে এরা৷ দশহাত দূরে লম্ফঝম্প করে চলা সিংহের গর্জন শুনতে শুনতে এরা শালপাতার গায়ে লেগে থাকা চাটনি চেটে খেতে চান।
এইসব মোহময় চাওয়া-পাওয়া নিয়েই তাঁরা প্ল্যান ছকেন; লেপের তলে শুয়ে, মশলা জোয়ান চিবুতে চিবুতে৷ অত্যাধিক দৌড়াদৌড়িতে তাদের বিশ্বাস নেই৷ তাদের কাজ শুধু পিকনিক স্পটে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা, "আরে ধুর, এ'সব ট্যুরিস্ট স্পট আমার পোষায় না৷ পিকনিক করেছিলাম বটে নাইনটি ট্যুর জ্যানুয়্যারিতে৷ সে'এক অ্যাডভেঞ্চার বুঝলি..কফি আর এক প্লেট পকোড়া আন দেখি..গুছিয়ে সে গল্পটা বলি"৷

৩।

।।শেফ-মামা।।
তারা রান্নাবান্নায় বৃহস্পতি৷ কিন্তু টীকা-টিপ্পনিতে গর্ডন র্যামসের পিসেমশাই।
পেঁয়াজ কুচোতে খাবি খান কিন্তু বারো মিনিটে ভিন্ডালুর রেসিপি বলে জনতাকে তাক লাগিয়ে দেবেন৷
কালো জিরে আর চা-পাতার তফাৎ ধরতে পারেন না কিন্তু উনুনের ওপর কোন অ্যাঙ্গেলে কড়াই রাখলে মুর্গি নিখুঁতভাবে কষবে, সে'সম্বন্ধে এরা নিশ্চিত৷
এই বিশারদরা পিকনিকের বাসন মাজার সময় ব্যাডমিন্টন খেলবেন কিন্তু খেতে বসে প্রতিটা পদের ইতিহাস নিয়ে লেকচার নামাবেন অবলীলায়।
~~
আর এদের ছাড়া পিকনিক?
ক্যান্টিনবিহীন কলেজ৷
কেষ্টাবিহীন অর্জুন।
টেনিলেস পটলডাঙা৷

পল্টু-সুমির বইমেলা



- হ্যাঁ রে পল্টু, এ'টা আনন্দেরই লাইন তো?

- ভেরিফাই করে নিয়েছি সুমি৷ এই দাদা কনফার্ম করেছেন৷

- লাইনের যা বহর, সন্ধ্যে নামার আগে স্টলের গেট দেখতে পাব বলে মনে হচ্ছে না৷ যা ভীড়৷ উফ্! এত মানুষ বই পড়ে?

- দেখ, আমি অত পড়িনা৷ তবে ঘাটাঘাটি করি৷ হেবি লাগে৷

- অবশ্য আনন্দর বইটইগুলোর যা দাম৷ ইএমআই ফেসিলিটি না থাকলে উল্টেপাল্টে দেখেশুনে বেরিয়ে আসা ছাড়া উপায় থাকেনা৷

- তোদের মত পাবলিকের জন্যই যত সমস্যা৷ বাপের বাড়ির দলিল বন্ধক রেখে সিনেমাহলের পপকর্ন কিনবি কিন্তু বইয়ের দাম দেখলেই গলা শুকোনো৷

- বাজে না বকে লাইনে ফোকাস কর পল্টু৷ সুট করে কেউ ঢুকে না পড়ে৷

**

লাইন মন্থর গতিতে এগোতে থাকে৷ সুমি আর পল্টুর খোশগল্প জমে ওঠে৷ পড়ন্ত বিকেলের আকাশ লালচে, মেলার মাঠ সরগরম। গল্পের আগুনের ঘি হয়ে ওঠে সুমির হাতে ধরা বাদামের ঠোঙা আর পল্টুর হাতের নুনের প্যাকেট৷

**

- সুমি! বেগুনি খাবি?

- লাইনের কী হবে?

- আগেও লম্বা লাইন৷ তুই দাঁড়া! আমি চট করে নিয়ে আসি!

- ক্যুইক কমরেড! ক্যুইক!

- লাইন সামলে।

- জান কবুল। তুই আয় বেগুনি নিয়ে৷

**

বেগুনির গুনেই বোধ হয়, লাইন সামান্য গতি পেয়েছে।

বেগুনি সাবাড় করে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ হাতড়ে এক ডিবে মিঠেমৌরি বের করে আনলো সুমি। পল্টু নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে বের করে আনলো নন্টেফন্টে। আনন্দর লাইনে একটানা দাঁড়িয়ে হদ্দ হওয়ার পর মোক্ষম অ্যান্টিডোট; দেবসাহিত্য কুটীরের স্টল থেকে সংগ্রহ করা কমিক্স সুর করে পড়া৷

পল্টুর পড়া শুনে গজল ভালোবাসার মেজাজে "ওয়াহ ওয়াহ" বা "নাজুক" বলে সেলাম ছুঁড়ে দেবে সুমি৷

**

- পল্টু..! এই পল্টু! থাম৷ পড়া থামা৷ ওই দ্যাখ..।

- কী দেখব?

- স্টলের গেট দেখা গেছে৷ দিল্লী দূর নহি!

- আরে! ওইত্তো আনন্দ! মার দিয়া কেল্লা।

- পল্টু৷ শোন..।

- কী..।

- চ', লাইন ছেড়ে দিই।

- খেপেছিস সুমি?

- আরে বই কেনাটাই কি শেষ কথা? শোন না রে পল্টু, চ' এ'বার দে'জ পাবলিকেশনের লাইনে গিয়ে হত্যে দিই। এ লাইন থেকে ও লাইন..।

- সুমি তুই একটা আস্ত...।

- এই লাইন ছাড়তে রাজি হলে, সামনের শনিবার; টিউশনির পর হাত ধরে রেল ব্রিজ পেরোনো অ্যালাউ করব৷

- শুধু আঙুলের ডগা নয়৷ পুরো হাত৷

- পুরো হাত৷

- চলুন সুমিদেবী৷ এ'বার তা'হলে দে'জ।

**

- পল্টু৷ এ'বার আমায় ফোন রাখতে হবে৷

- এখুনি?

- হ্যাঁ৷ একটা জরুরী কাজ।

- ধুস৷ লংডিস্ট্যান্স প্রেম আর সইছে না রে সুমি৷ কী ছাই দু'জনে দুই মুলুকে চাকরী নিলাম৷ মুখোমুখি প্রেম আর কলকাতা; দুইই জলে৷

- আমাদের বইমেলার টেলিফোনিক রোলপ্লেগুলো খুব ইন্টেন্স হচ্ছে কিন্তু।

- তা ঠিক৷ এক্কেবারে রগরগে৷ কোথায় লাগে সেক্সটিং৷

- তুই একটা যাতা৷ এ'বার আসি?

- ধুস৷ যা ভাগ!

**

কল্পনার বইমেলা, তার গা-কাঁপানো কাল্পনিক ভিড়। আনন্দের স্টলের সামনের মাইলখানেক লম্বা কাল্পনিক লাইনে বহুক্ষণ দাঁড়ানোর পর,
দুম করে সে লাইনের মায়া উড়িয়ে স্টলের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া;

এ'টাই সুমি আর পল্টুর আনন্দ৷
তাদের গোপন রোলপ্লে৷

Wednesday, January 26, 2022

এম্পলয়ার



- প্রবীর? আয়, বস।

- সময় কম বড়দা। টাকাটা?

- ওই যে৷ টেবিলের ওপর। এনভেলপ।

- চললাম।

- গুনে দেখবি না?

- থাক।

- চারটেকেই কি গঙ্গায় ফেললি?

- বড়দা। কাজ হাসিল। নগদ হিসেব মিটিয়ে দিয়েছ৷ খেল খতম। হিসেব জেনে কী করবে৷

- কাল পরশু আবার কোথায় ভেসে উঠবে৷ পুলিশ খামোখা দৌড়ঝাঁপ শুরু করবে। তাই আর কী..।

- এদ্দিনে তোমার হয়ে অন্তত শ'তিনেক লাশ ফেললাম৷ তোমার দিকে কেউ আঙুল বাড়িয়েছে কি?

- আসলে কী জানিস, চারজনকেই সরাতে বলতাম না৷ কিন্তু ওই, বিজনেসে এমন গোলমাল পাকাতে শুরু করেছিল৷

- আমি মাইনে করা মানুষ৷ ও গল্পে আমার কাজ নেই৷

- প্রবীর।

- কিছু বলবে বড়দা?

- সিংঘানিয়ার পোষ্যরা কেউ তোকে দেখেনি তো?

- জিতু দেখেছিল।

- ওদের সেই ম্যানেজার? অবশ্য সে ব্যাটা নিজেও গুণ্ডা৷ কিন্তু সে যদি দেখে থাকে..। ঝামেলা পাকাবে না তো? ভালো করে শাসিয়ে এসেছিস তো?

- লাশকে শাসিয়ে কী হবে৷

- ওহ৷ ওকেও তুই...।

- দেখে ফেলেছিল৷ না দেখলে বেঁচেবর্তে থাকত৷ 

- তোর মাথাটা বড্ড গরম।

- জিতুর জন্য তোমায় তো বাড়তি টাকা দিতে বলিনি। কোল্যাটেরাল ড্যামেজ৷ 

- বলছি, বুলেটেই নামিয়েছিস তো সবকটাকে?

- বুলেটের যা দাম আজকাল৷ অবশ্য প্রসেসটা তোমার জেনেও কাজ নেই।

- তোর মেজাজটা দিনদিন বড় খটখটে হয়ে যাচ্ছে প্রবীর। আমি তোর এম্পলয়ার৷ ভুলে যাস না। 

- তুমি এম্পলয়ার৷ তা ঠিক৷ তবে আমি তো ক্লার্ক নই।

- লাশ কোথায় ফেলেছিস৷ সে'টা আমার জানা দরকার।

- এদ্দিন তো সে দরকার পড়েনি। 

- আজ পড়ছে৷

- থাক৷ আজ আসি।

- ও কী রে৷ এনভেলপটা রেখে যাচ্ছিস কোথায়।

- লাশের হিসেব যে দেবে, কাজ তাকেই দিও৷ টাকাটা রইল।

- উফ। তোর সব কথাতেই রাগ। নে, টাকাটা রাখ। ইয়ে, চা খাবি?

- আসি।

- চ', তোকে এগিয়ে দিই একটু।

***

- প্র..প্র..প্রবীর।

- বড়দা৷ বলো।

- আমি..আমি কোথায় বল দেখি..।

- বেশি ভেবে কী হবে বড়দা। থাক না।

- আমায় কোথায় এনেছিস?

- বড্ড বেশি ভাবছ।

- তুই..তুই সন্ধ্যেবেলা বাড়ি এলি, যাওয়ার সময় আমি তোকে এগিয়ে দিতে এলাম..। তারপর কিছু মনে পড়ছে না কেন?

- জিরিয়ে নাও বড়দা৷ 

- তুই আমায় কিডন্যাপ করেছিস? গুম করবি তুই আমায় রাস্কেল?

- আমি কিডন্যাপার নই৷ জানোই তো। 

- আমি নিজের বাড়িতে নেই কেন? এই ঘুপচি ঘরটায় আমায় এনেছিস কেন প্রবীর? তুই আমায় আটকে রাখবি? র‍্যানসম চাইবি? তুই এত বড় নিমকহারাম? 

- না বড়দা৷ খানিকক্ষণ পরেই ছেড়ে দেব। তোমার অনেক কাজ।

- হেঁয়ালি ছাড়৷ ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না৷

- এম্পলয়ারের মেজাজ বিগড়োচ্ছে নাকি?

- আমি তোকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি। কোন সাহসে আমায় ধরে এনেছিস রে তুই? কী ভেবেছিস, তুই কি আমার একমাত্র পোষা গুণ্ডা?

- না। তোমার তো রীতিমত নারায়ণী সেনা পোষা রয়েছে। আর সে জন্যেই তোমার মনে হচ্ছিল আমায় একটু শায়েস্তা করা দরকার৷ তাই না? 

- মাইনে দিয়ে পুষি তোকে৷ তোর কাজের মেথড জানার রাইট আমার আছে। 

- আর সে'টা জানতে না পেরে তুমি আমার পিছনে স্পাই লাগিয়েছ। পুলিশে ফাঁদে ফেলার ধান্দাও করছিলে৷ জানি৷ খবর পেয়েছি৷ 

- ইয়ে, শোন প্রবীর৷ তুই ওভাররিয়্যাক্ট করছিস৷ আমায় ফিরিয়ে নিয়ে চ'। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় না হয়..।

- কোথায় ফিরবে?

-ও মা৷ বাড়িতে।

- সে সুযোগ আর কোথায় বলো।

- কী ব্যাপার বল তো৷ কী সব আজেবাজে কথা বলছিস।

- তোমায় এম্পলয়ার হিসেবে বয়ে বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম বড়দা। এ'বার আমিই তোমার এম্পলয়ার৷ 

- তোর মাথাটা গেছে৷ তুই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছিস।

- বড়দা৷ আমার কাজের মেথডটাও এ'বারে জানবে৷

- আমায় তুই ধরে রাখতে পারবি না!

- তোমায় তো আমি বেঁধে রাখিনি৷ দরজাটাও হাট খোলা৷ এই দ্যাখো, হাতে ছুরি পিস্তর কিস্যু নেই৷ তুমি ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছ না কেন?

- আমি..আমি..আমি..।

- কেন পারছ না?

- প্রবীর, আ..আমি বেরোতে পারছি না কেন?

- কারণ আমি এখন এম্পলয়ার৷ আমি না বলা পর্যন্ত পারবে না। তবে চিন্তা কোরোনা৷ তুমিও পাতি ক্লার্ক নও৷ 

- আমি..আমি কোথায়..।

- আমার অফিসে। একটু পরেই জিতু এসে তোমায় সব বুঝিয়ে দেবে। 

- জিতু?

- ওই যে, সিংঘানিয়াদের ম্যানেজার৷ 

- তুই ওকে খুন করিসনি?

- কথার খেলাপ আমি করিনা৷ আমি খুনি, তাই বাজে মিথ্যেও বলিনা৷ যে'টা তোমার মত বিজনেসম্যানের জন্য জলভাত।

- আমি কিছুই..।

- আমার খুনের কারখানাটা বড্ড বড় বড়দা৷ রোজ কত শত অর্ডার৷ অত লাশ নদীতে ফেললে দেশে মড়ক লাগবে যে৷ আর গুণী মানুষের হাতে প্রতিটা লাশই প্রডাক্টিভ রিসোর্স। নষ্ট করলে আমার ব্যবসাটা চলবে কেন? কাজেই তারা আমার হয়ে কাজ করে বেড়ায়।  আমিই তাদের এম্পলয়ার৷ বড়দা, এখন আমিই তোমার মালিক। সবচেয়ে বড় কথা মাইনে দেওয়ারও ঝামেলা নেই, বেগার খাটার আর্মি আর কী৷ 

- তুই কী সব...!

- খবরদার..আর তুই নয়৷ মালিককে তুই বলে ডাকাটা ভালো দেখায় না। যাক৷ তোমায় জিতুই সব বুঝিয়ে দেবে৷ সামনের হপ্তা থেকে ফিল্ডে নামবে'খন৷ এখন আসি৷ কেমন?

সরি



র‍্যান্ডি পশ 'সরি বলার সঠিক পদ্ধতি' জলের মত সহজ ভাষায় বুঝিয়ে গেছেন৷ সবার আগে কোনও রকম 'কিন্তু', 'যদিও', 'আসলে কী হয়েছিল' মার্কা কেরদানি বাদ দিয়ে নির্ভেজাল 'সরি'টা বলতে হবে৷ তারপর স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করতে হবে "দোষটা পুরোপুরি আমার"৷ আর সবশেষে থাকবে আসল ব্যাপারটা যে'খানে নিজেকে এগিয়ে এসে বলতে হবে, "ভুল তো করেইছি৷ এ'বার কী করলে সে ভুলের খেসারত দেওয়া হবে সে'টুকু জানা দরকার"। 

কিন্তু এই ধরণের হাইক্লাস মেন্টোস সলিউশন আমাদের ধুরন্ধর আম জিন্দেগীতে সবসময় চলবে না। অতএব উপায়? ওই, গোপন কোডে 'সরি' চালান করার বিভিন্ন পদ্ধতি আমরা খুঁজে বের করি৷ সে কোড অবশ্য এনিগমার মতই জটিল৷ কিন্তু সংসার, প্রেম এবং ইয়ারদোস্তি গোছের সমস্ত ব্যাপারগুলোই যে হাজারো এনিগমা-সঙ্কেতের ওপর দাঁড়িয়ে। সে হেঁয়ালির তল না পেলে সম্পর্কের পেল্লায় সব জাহাজ ভুলবোঝাবুঝির ইউবোটের আক্রমণে ডুবতে বাধ্য। 

তা কী ধরণের সাঙ্কেতিক ভাষায় আমরা 'সরি' বলার চেষ্টা করে থাকি?

"আরে ভাই, শোন না। আজ ভাবছি তোকে শ্যামলদার দোকানে মোগলাই খাওয়াব। না না, কিছুতেই না শুনছি না৷ তোকে আসতেই হবে৷ আরে না হয় ক্রিকেট মাঠে সামান্য ইয়েটিয়ে হয়েছে, তা হতেই পারে৷ তুই ভাবলি লেগস্টাম্পের বাইরে বল পিচ করেছে, তাই আমার লেগ বিফোর আপিল উড়িয়ে দিলি। আমি বল আর লেগস্টাম্প বগলদাবা করে টিউশনি পড়তে চলে গেলাম৷ ওই সামান্য ব্যাপারের জন্য তুই মোগলাই রিফিউজ করবি"?

অথবা, 

"সুমি, নীল শাড়িতে তোমায় যা মানায় না..কী বলব..চোখ ফেরানো যায়না মাইরি...। শোনো না, আজ চলো গড়িয়াহাট ঘুরে আসি। গড়িয়াহাট নাপসন্দ? পার্কস্ট্রিট চলো! কী বললে? আমি মনে মনে সমুদের তাসের আড্ডা প্রেফার করি? ধুস্! সে তো বোগাস একটা গুড-ফর-নাথিং জায়গা৷ শুধু বাজে গপ্প আর সিগারেট। ননসেন্স৷ তার চেয়ে চলো না, প্রিন্সেপ থেকে ঘুরে আসি"৷ 

অথবা,

আয়নার দিকে তাকিয়ে; "এই যে ব্রাদার,  একটা গোটা ক্যাজুয়াল লীভ শুধু তোমারই জন্য বাগিয়েছি৷ ওই যে, বাঁদিকে দেখো, পুরনো পুজোসংখ্যার বান্ডিল৷ আর ডানদিকে একগাদা কমিক্স। ফোন স্যুইচড অফ৷ বাড়ির সবাই ঘুরতে গেছে৷ আর ফ্রিজে বাসি বিরিয়ানি, ফর ব্রেকফাস্ট,  লাঞ্চ অ্যান্ড ডিনার৷ জানি ভাই, বড্ড হুড়মুড় যাচ্ছে। আর এর মধ্যে যে তোমার দিকে দু'দণ্ড তাকাবো, সে সুযোগটুকুই জুটছে না৷ যাক গে৷ আজ একটু গা এলিয়ে বসো দেখি"৷

Monday, January 24, 2022

কাজের মত কাজ



কর্মব্যস্ত এবং তৃপ্ত মানুষের দিকে একমনে তাকিয়ে থাকতে কী ভালোই না লাগে৷ হাজারখানা 'ইন্সপিরেশনাল' সেল্ফ-হেল্প বই পড়ার চেয়ে অমন একজন হাসিখুশি শশব্যস্ত মানুষের দিকে মিনিট দুয়েক তাকিয়ে থাকাটা বেশি কাজের বোধ হয়৷ 

অফিসে যখন দেখি কেউ কাঠশুকনো কোনও রিপোর্টও এক গাল হাসি আর ম্যাক্সিমাম ফোকাস নিয়ে লিখছে, মন ভরে যায়৷ সে রিপোর্ট তিনি ধীরেসুস্থে পড়বেন। রিপোর্টের প্রতিটি শব্দকে কড়াভাবে ঝালিয়ে নেবেন; যেমনভাবে কোনও কবি নিজের সদ্যলেখা কবিতাকে পালিশ করে থাকেন৷ এলেবেলে ভুল চোখে পড়লে এমনভাবে চমকে উঠবেন যেন পোলাও চিবুতে গিয়ে দাঁতে পাথরকুচি পড়েছে৷ শুধু তাই নয়, খসখসে রিপোর্টকে তিনি মখমলে করে তুলবেন নিজের একনিষ্ঠ রিসার্চে। এ'সব মানুষ সুযোগ পেলে এমন মনপ্রাণ ঢেলে মাটি কোপাবেন যে মরুভূমিতেও বাসমতি ফলিয়ে ছাড়বেন। 

রিপোর্ট যত এগোবে, তাদের মুখের হাসিও ততটাই চওড়া হবে৷ মাঝেমধ্যে হয়ত টাইপিং থামিয়ে টেবিল ঠুকে তাল দেবেন, সামান্য গুনগুন না করলে যে খেটে-কামাল-করা কাজের মজাটাই মাটি৷ রিপোর্টের জটিলতম অংশটা নিখুঁতভাবে নামিয়েই হয়ত তিনি হাঁক পাড়বেন এক কাপ চায়ের জন্য, আদা দেওয়া৷ নিজেকে মাঝেমধ্যে বখশিশ না দিলে চলবে কেন?

রিপোর্ট শেষ হয়েও শেষ হবে না৷ কাজের অমোঘ মায়াটুকু তিনি হেলাফেলায় এড়িয়ে যেতে পারবেন না৷ ফন্ট কী হবে, স্পেসিং কেমন হবে, মার্জিন কতটা থাকবে, জটিল টেবিলগুলো কী টেম্পলেটে বসবে; এমন হাজারো বিষয় নিয়ে তাঁর মনের মধ্যে তোলপাড় চলবে৷ বহুরকম এ'দিক-ও'দিক, ওপর-নীচ, ডায়ে-বাঁয়ে করে তবে তিনি থামবেন৷ তারপর কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বুদ্ধের হাসি হেসে মত মাথা দোলাবেন, "এইবারে মনের মতন, এতক্ষণে রিপোর্ট বাবাজীকে বাগে আনা গেছে। এইবারে৷ এতক্ষণে"।

যদি সে রিপোর্টের প্রিন্ট নেওয়া জরুরী হয়, তা'হলে সে কাগজের গায়ে খানিকক্ষণ হাত বুলোবেন তিনি৷  লোকে পাত্তা দিক না দিক, নিজের কাজকে যে নিজেই বুকে করে আগলে রাখতে হয়, সে সত্যটা তিনি বিলক্ষণ জানেন৷ নিজের সেই রিপোয় বা সাধারণ মেমোটি পড়তে পড়তে হয়ত তিনি কল্পনায় শুনবেন এক স্টেডিয়াম " বাহ্, বাহ্"। তিনি চেষ্টা করবেন যাতে স্টেপলারের খটাসটুকুও জ্যামিতি মেনেই সে কাগজের গায়ে নেমে আসে৷ ময়লা ফোল্ডার দেখলে তিনি শিউরে উঠবেন৷ নিজে গিয়ে স্টোররুম ঘেঁটে বের করে আনবেন উজ্জ্বল একটা ফোল্ডার, যার মধ্যে সেই রিপোর্টকে আদুরে হাতে শুইয়ে রেখে তবে তার নিশ্চিন্দি৷ হয়ত একটু গজল বা দু'লাইন শ্যামাসঙ্গীত গেয়ে নিয়ে তিনি সে রিপোর্ট পর্বে ইতি টানবেন৷ 

পেটের টানেই দুনিয়াদারী, কাজ বেছে নেওয়ার বিলাসিতা সবার তো জোটেনা৷ কিন্তু সবার কপালে যেন কর্মব্যস্ততাটুকু জুটে যায়৷ আর ইয়ে, সে কর্মব্যস্ততা যেন খিটখিটে-মেজাজের চৌবাচ্চায় চুবনি না খাওয়ায়৷ প্রতিটি কাজ-পাগল মানুষ যেন তৃপ্তির সমুদ্দুরে গা ভাসিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিরে পারে। 

এ'টুকুই, দু'দিন বইতো নয়।

Friday, January 21, 2022

আদত আদবকায়দা



আদত অসাবধানতা।

রোলের অর্ডার দিয়ে রোলের চাটুর ওপর শ্যেনদৃষ্টি না রাখা৷

আদত অসহিষ্ণুতা।

রোলের পরোটা ভালোভাবে ভাজা হওয়ার আগেই রোলদাদা বা রোলদিদিকে "হল কী" বলে বেফালতু তাড়া দেওয়া।

আদত অজ্ঞানতা।
প্লেটে বা বাটিতে রোল সাজিয়ে দেওয়া।

আদত অসতর্কতা।
রোল থেকে চিকেনের টুকরো পড়ে যাওয়া। 

আদত অভব্যতা।
রোলের কাগজ খোলাটা শিল্প। মিহিভাবে, সরু পরতে পরতে, নরম ভাবে সে কাগজ না খুলে, খাবলে ছিঁড়ে ফেলা।

আদত অসভ্যতা।
ধীরেসুস্থে রোলের রোলত্ব উপভোগ না করে, রোল কামড়াতে কামড়াতে অফিস-ব্যবসা কাজকর্ম-ব্যস্ততার গল্প ফাঁদা।

ভূত নামানোর ব্যবসা



- এ কী৷ আবার এসেছেন?

- চিন্তা নেই৷ এ'বারে আর ভূত দেখতে আসিনি৷ 

- তাই বলে ফিজ না দিয়ে যেতে পারবেন না কিন্তু৷ আমার সময়ের দাম আছে৷ 

- রাখুন আপনার সময়ের দাম৷ বাইরে তো কেউই বসে নেই৷ ভূত নামানোর বাজার ডাউন যাচ্ছে? 

- আসলে দু'দিন আগেই পূর্ণিমা গেল তো৷ এ'সময়টায় ঠিক তেনারা অদরকারে ঘুরঘুর করতে পছন্দ করেননা৷ তাই এ'কদিন বিজনেস একটু ওই...যাকে বলে..।

- অত কথায় কাজ নেই৷ আপনার ফিজ একশো বত্রিশ টাকা তো? দেব। ইয়ে, আমায় মনে আছে আশা করি।

- ভাস্কর তান্ত্রিক একবার কাউকে দেখলে সহজে ভোলে না৷ আর আপনি মাইরি ভুলবার মত লোকও নন৷ গত হপ্তায় কী কাণ্ডটাই না ঘটালেন..। আপনি তো ব্যারাকপুরের প্রবীর দত্তগুপ্ত৷ তাই তো? দিব্যি, দিব্যি মনে আছে।  

- দেখুন ভাস্করবাবু..।

- ও কী! আমি আপনার অফিস কল্যিগ নই৷ বাবা বলুন, গুরুজীও চলতে পারে৷ 

- যাকগে৷ অকারণ খেজুর করতে আমি আসিনি। গতবার আপনাকে একটু অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিলাম৷ গোটা পরিস্থিতিটাই কেমন গোলমাল হয়ে গেছিল৷ তাই ভাবলাম..।

- আপনি কিন্তু আমায় সত্যিই ভেবড়ে দিয়েছিলেন প্রবীরবাবু৷ নিজের বাবার আত্মার সঙ্গে কমিউনিকেট করতে চেয়ে আমার কাছে এলেন৷ ভালো কথা। অথচ আমি তেনাকে ডাক দেওয়ার আগেই এমন বিশ্রীভাবে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন..৷ আরে বাপের নামটাও বলতে পারলেন না কান্নার চোটে৷ তারপর তো প্রায় ছুটে পালালেন..। আমি তো হতবাক। 

- জানি৷ ব্যাপারটা নেহাতই ছেলেমানুষির পর্যায়ে চলে গেছিল আর কী৷ তাই পরে মনে হয়েছে ব্যাপারটা আপনার কাছে একটু খোলসা করে যাওয়া দরকার৷ যদিও আপনার এ ব্যবসাটাকে আমি ঠিক সৎ বলে মনে করিনা, তবু ভাবলাম...।

- ব্যবসা? ব্যবসা? শুনুন মশাই৷ এ'টা হলো সাধনা৷ বুঝেছেন? সাধনা৷ ফিজটা নিই শুধু এস্টাবলিশমেন্ট মেন্টেনেন্স কস্ট হিসেবে। 

- যাক গে। ভাস্করবাবু..থুড়ি..শ্রী শ্রী ভাস্করতান্ত্রিক..যে'টা বলতে ব্যারাকপুর থেকে হালিশহর ছুটে আসা৷ আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি চেয়েছিলাম আমার মৃত বাবার আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে৷ কারণ..কারণ আমি পাগল হয়ে গেছিলাম৷ জানেন ভাস্করবাবু, আমার বাবার নাম অবনী দত্তগুপ্ত। পেশায় স্কুল মাস্টার ছিলেন৷ অতি সৎ একজন মানুষ ছিলেন৷ বহু সহায়সম্বলহীন ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে গেছেন মারা যাওয়ার দিন পর্যন্ত৷ ছাত্রছাত্রীরাও বাবাকে বড় ভালোবাসতো৷ আর বাবা তাদেরকে একটা শিক্ষাই দিতেন, সমস্ত ঝুটো বিশ্বাস আর কুসংস্কার উড়িয়ে দিয়ে সৎপথে থাকার শিক্ষা৷ বাবার গর্ব ছিল, যে তাঁর ছাত্ররা প্রত্যেকেই বিজ্ঞান-মনস্ক। অথচ আমিও তো বাবারই ছাত্র৷ বিশ্বাস করুন, বাবার বাকি স্টুডেন্টদের মত আমার মধ্যেও কুসংস্কার নেই৷ শুধু বাবা মারা যাওয়ার পর ক্ষণিকের জন্য মনটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল৷ বুকের মধ্যে একটানা একটা বিশ্রী হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়। আর তাই ব্যারাকপুর স্টেশনের ল্যাম্পোস্টে সাঁটা আপনার ওই ভূত নামানোর বিজ্ঞাপন দেখে হঠাৎ যেন জ্ঞানগম্যি হারিয়ে ফেলেছিলাম৷ কিন্তু আপনার কাছে এসে বসার পর সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আর তারপর একটা বিশ্রি লজ্জা আমার প্রায় গলা টিপে ধরেছিল। অবনী মাস্টারের ছেলে হয়ে তাঁর শিক্ষাকে এমন হেলায় ভাসিয়ে দিয়েছি ভেবে আমার বড় কষ্ট হয়েছিল ভাস্করবাবু৷ তাই আপনার সামনে থেকে অমন দৃষ্টিকটু ভাবে ছুটে পালিয়েছিলাম। কিন্তু পরে মনে হল, ব্যাপারটা আপনাকে জানানো দরকার..।

- আপনি আজ আসুন প্রবীরবাবু।

- আমার কথাগুলো একটু কটু শোনাচ্ছে বোধ হয়৷ মাফ করবেন কিন্তু আপনাকে না জানালে...।

- আপনি আসুন। আসুন।  

**

- আরে এতবার কলিংবেল! কে? ওহ! আপ..আপনি?

- কী,  চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না তো প্রবীরবাবু? 

- গেরুয়া লুঙ্গি আর খালি গায়ের বদলে হাফশার্ট আর ট্রাউজারে আপনাকে দেখতে হবে সে'টা কোনওদিনও ভাবিনি ভাস্করবাবু৷ আর আপনার মতলবটা কী বলুন তো? আমায় ফলো করছেন নাকি? হালিশহর ছেড়ে হঠাৎ ব্যারাকপুরে?

- ভিতরে আসা যায়?

- আমি ঠিক নিশ্চিত নই৷ বললাম তো। আপনার মতলবটা জানা দরকার৷ 

- আগের দিন মনে হল, অন্ধবিশ্বাসের টানে একবার আমার ডেরায় এসে পড়ার পর থেকে আপনি খুবই মনকষ্টে আছেন৷ তাই ভাবলাম..।

- মতলবটা কী আপনার?

- মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে আসব, তার জন্য আবার মতলবের দরকার হবে কেন?

- মাস্টারমশাই? আপনি কি বাবাকে..।

- চিনতাম। সাতাশির উচ্চমাধ্যমিক ব্যাচ৷ তখন অবিশ্যি আপনি নিতান্তই শিশু৷ সে'জন্যই আমি প্রথমদিন ঠিক আপনাকে চিনতে পারিনি৷ পরের দিন গিয়ে যখন অবনী স্যারের নাম করলেন, বুকের ভিতরটায় কেমন ছ্যাঁকা লাগল যেন৷ তবে মাস্টারমশাইয়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে আমি এদ্দূর আসিনি প্রবীরবাবু৷ আমি শুধু বলতে এসেছি একটা সহজ কথা জানাতে৷ শুনুন, ভূত নামানোর টানে আমার ডেরায় গিয়ে আপনি মাস্টারমশাইয়ের স্মৃতির অপমান করেননি৷ আপনি কুসংস্কারের টানে আদৌ ছুটে যাননি৷ আপনি গেছিলেন ভালোবাসার টানে, প্রবল মনকেমন বুকে নিয়ে৷ বাপের চলে যাওয়া যে ছোটখাটো ব্যাপার নয় প্রবীরবাবু৷ একটু পাগলামো চলতেই পারে৷ 

- ভাস্করবাবু..আমি যে কী বলব..।

- আপনি হয়ত আমায় দেখে ভাবছেন, মাস্টারমশাইয়ের ছাত্র শেষে ভূত নামানোর ব্যবসায় ঢুকলে? তবে কি মাস্টারমশাইয়ের শিক্ষায় ফাঁক ছিল? অভয় দিয়ে বলি, আপনার মতই আমিও অবনীবাবুর একনিষ্ঠ ছাত্র৷ কুসংস্কার আমায় সহজে ঘায়েল করতে পারবে না৷ তবে আপনার মতই, বাপের মৃত্যুটা আমাকে বিশ্রীভাবে ঘায়েল করেছিল বটে৷ আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্য৷ ইয়াব্বড় সংসার ফেলে বাবা দুম করে সরে পড়লেন৷ টের পেলাম; পেটের দায় বড় দায়৷ ভালোবাসাও মিইয়ে যায়৷ পড়াশোনা ছাড়তে হল, মাস্টারমশাইয়ের শাসন এবং স্নেহও বাদ পড়ল কারণ বাড়ির খরচ চালাতে গেলে অঙ্ক টিউশনিতে পড়ে থাকা চলবে না৷ চাকরী না থাক, বিজনেস খুঁজে নিতে হবে।  হিপনোটিজম আয়ত্ত করে তাই চলে এলাম ভূত নামানোর ব্যবসায়, নেহাতই দায়ে পড়ে। শুনুন, মাস্টারমশাইয়ের শিক্ষা জলে যায়নি প্রবীরবাবু৷ যেতে পারে না৷ কেমন? মনে থাকবে? এ'টুকু বলার জন্যই ছুটে আসা৷ আজ আসি।

- ভাস্করদা৷ চা না খাইয়ে তো আপনাকে ছাড়া যাবে না৷ আর বাবার কাছে অঙ্ক পড়েছেন যখন, মায়ের হাতের ডিমের কচুরির স্বাদও নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়৷ সে'স্বাদও না হয় আর একবার ঝালিয়ে নেবেন৷ আপনাকে ভিতরে আসতেই হবে৷ 

Wednesday, January 19, 2022

চলো অঞ্জন!



অঞ্জন দত্তর গান নিয়ে কোনও গুরুগম্ভীর আলাপ-আলোচনাকে কোনওদিনই পাত্তা দিইনি৷ নিন্দে তো নয়ই, অন্যের প্রশংসার সঙ্গে তাল মেলানোরও প্রয়োজন বোধ করিনি৷ অঞ্জনবাবুর গান একটা অভ্যাসের মত জুড়ে গেছিল৷ তার ভালোমন্দ হয়না, ডিসেকশন হয়না৷ ভালো লাগা থাকে। আর গানের ক্ষেত্রে, সেই ভালোলাগাটুকুই বোধহয় একমাত্র ডিসিপ্লিন, অন্তত আমার মত অতিপাতি মানুষের জন্য৷ 

প্রথমবার অঞ্জনবাবুর গান ক্যাসেট ধার করে শোনা৷ স্কুলবয়সে৷ সে'সব গান প্রথমবার শুনেই লাফিয়ে ওঠার নয়৷ 'ওয়াহ তাজ' বলে সেলাম ঠোকার নয়৷ কিন্তু৷ অঞ্জনবাবুর গানগুলোয় রয়েছে বার বার ফিরে যাওয়ার সুর৷ আর স্কেল-বসানো সোজাসাপটা সরলসিধে কথা৷ প্রথম শোনায় যে ক্যাসেট 'ঠিকই আছে' মনে হয়েছে, বাহাত্তর নম্বর শুনানির সময় সেই ক্যাসেটই ইয়ারদোস্ত৷ 

ভদ্রলোকের বেশ কিছু গোবেচারা গান রয়েছে৷ একসময় তারা মাঝেমধ্যেই টেপরেকর্ডারে বাজছে৷ বিরক্ত করছে না, আবার মনে ইয়াব্বড় দাগও কাটছে না৷ কিন্তু আচমকা একদিন খেলা ওলটপালট৷ হয়ত কেমিস্ট্রির খাতার পিছনে মন দিয়ে বুক ক্রিকেটের স্কোর লিখছি৷ তখন দুম করে টের পেলাম - আরে! "শুনতে কি চাও তুমি"র সুরে কী দারুণ মায়া৷ কী অপূর্ব স্নেহ৷ আর কী, অমনি সে গানের সঙ্গে দোস্তি হয়ে গেল৷ 

ব্যাপারটা ঠিক কীরকম? ধরুন আপনি সন্ধ্যে ছ'টা বেয়াল্লিশের ব্যান্ডেল লোকালের ডেলিপ্যাসেঞ্জার। ইঞ্জিনের দিক থেকে তিন নম্বর কামরাটি আপনার নিয়মিত অফিস-ফেরতা ঠাঁই। সেই কামরায় এক মুখচোরা মিষ্টি স্বভাবের ভদ্রলোকের সঙ্গে রোজই দেখা হয়, চোখাচোখির আলাপ৷ 'সব ভালো তো' গোছের ইশারা রোজই আদানপ্রদান হয়,থাকে মাথা নাড়া প্রত্যুত্তর৷ আচমকা একদিন, হঠাৎ সেই মুখচোরা মানুষটি যেচে এসে আলাপ জমাবেন৷ তখন জানা যাবে আপনাদের দু'জনেরই ওলসেদ্ধ দিয়ে ভাত মেখে খেতে ভালো লাগে, আর ভালো লাগে দীঘা, আর শীর্ষেন্দু, আর আশাপূর্ণাদেবীর লেখা৷ ব্যাস, জমে গেল বন্ধুত্ব৷ তেমনই, অঞ্জনবাবুর সবচেয়ে প্রিয় গানগুলোও একদিন অতর্কিতে এসে আলাপ জমিয়েছে, এবং তল্পিতল্পা সমেত থেকে যায়৷ 

আর থেকে যাওয়া মানে থেকে যাওয়া? এক্কেবারে জাঁকিয়ে বসেছে৷ কাজেই চৌধুরীদের  একুশতলার নির্লজ্জ ঝগড়াঝাটি এখন আমার সুপরিচিত৷ বাবা-মায়ের সিনেমা ফেরত রোলটা ডাবল এগ ডাবল চিকেন, আমার অন্তত সে'টাই বিশ্বাস; আর খোকার ডিনারের ট্যালট্যালে ঝোলের হলদেটে বিস্বাদ রংটাও আমি দিব্যি চিনি; অঞ্জনবাবুর সুরের মধ্যে দিয়ে৷ আমি মাঝেমধ্যেই গুগলম্যাপে বেনিয়াপুকুর আর বেহালা যাওয়ার রুট দেখি৷ কমলা এজেন্সির ছোট্ট অফিসের কোণে অর্ণবের কাগজ বোঝাই টেবিলটা আমি ভীষণ চেনা, সেই টেবিলের পিছনের দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারটাও আমি চিনে রেখেছি; ডাল লেকের ওপর শিকারা। আর বৃষ্টিতে চটি ছিঁড়ে যাওয়ার মধ্য যে চিনচিনে সুরটা মিশে থাকে, সে'টা আমি দিব্যি চিনি। 

এমন কত হাজার চেনাজানা, পরিচিতি, স্নেহ-মায়া সুট করে গছিয়ে দিয়েছেন অঞ্জন৷ তার গানগুলো আমাদের এই এলেবেলে জীবনের লাগসই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, এ নিয়ে আমার কিন্তু কোনও সন্দেহই নেই৷ 

নারায়ণ দেবনাথ



আমি নিজের আগ্রহে প্রথম পড়া শুরু করি মূলত ছবি সর্বস্ব ছোটদের বইগুলো৷ দাদু উপহার দিত সে'সব বিভিন্ন বাহারে বই৷ আমার উপহার পাওয়া প্রথম বই যে'টা উল্টেপাল্টে গিলে খেয়েছিলাম, সে'টা হল একটা বাংলা ছড়া সংকলন। সে'খানে ছিল ছোটছোট প্রচলিত ছড়া, আর চমৎকার সব স্কেচ৷ আমার আগ্রহ ছিল ওই স্কেচগুলোর ওপর। বইটার নাম ছিল বোধ হয় 'ছোটদের ছড়া সঞ্চয়ন'। তার প্রথম পাতায় দাদু নীল কালিতে লিখে দিয়েছিল আমার পড়া প্রথম কবিতাঃ
"দাদু, আমার বড় ভালো,
ছড়াগুলো পড়ে ফেলো"৷ 
এর বাইরে ছিল দাদুরই দেওয়া রাদুগা প্রকাশনীর ইয়াব্বড় কিছু বই, পাতা জোড়া ঢাউস সব চমৎকার আঁকা আর অল্প কথা, সহজ শব্দে সাজানো সরল প্লটের মজাদার গল্প৷ এ'ছাড়া ওই ছবিতে রামায়ণ বা মহাভারত তো ছিলই৷ মোট কথা হল সে'সব ছবি গিলতে গিলতে কয়েক লাইন পড়ে ফেলতাম৷ ছবি উপভোগ করাটাই ছিল আমার আদত পড়া। পারতপক্ষে ছবিবিহীন গল্পওলা বইটইয়ের দিকে তেমন ঘেঁষতাম না৷ সত্যি কথা বলতে কি, সেই খুদে বয়সে কমিক্সের দিকেও তেমন ঝুঁকিনি৷ বাড়িতে রাখা বাংলা কাগজে তখন নিয়মিত স্পাইডারম্যান আর ফ্ল্যাশ গর্ডনের কমিক্স প্রকাশ হত৷ দাদুর দেওয়া ছবির বইগুলোর তুলনায় সেই কমিক্সগুলোকে আমার একটু জটিল বোধ হত৷ সে'সব কমিক্সে আমি মন দিয়ে শুধু ছবিগুলো দেখতাম, স্পীচ বাবলে কী লেখা আছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। আমি খুঁজতাম সরল ভিসুয়াল প্লট, জলের মত ভাষা আর চমৎকার সহজবোধ্য অ্যাকশন। 

মনে আছে, যে কোনও পত্রিকাও তেমন টেনে দেখার আগ্রহ ছিল না সেই কচি বয়সে৷ পত্রিকা মানেই মনে হত কাটখোট্টা একটা ব্যাপার; বড্ড বেশি লেখা, ছবি কম৷ আমার এক দূরসম্পর্কের মামা তখন স্কুলেই পড়ে, তবে উঁচু ক্লাসে৷ তার বাড়িতে মাঝেমধ্যে যেতাম, তখন আমি খুব ছোট হলেও মামা সঙ্গে দিব্যি গল্প জমত। সেই মামার পড়ার টেবিলেই আমি প্রথম শুকতারা দেখি। অন্য কোনও সুবিধেজনক বই না পেয়ে বা খেলার সুযোগ না থাকায় শুকতারাটাই উল্টেপাল্টে দেখি৷ পত্রিকা হলেও সে'টাকে ঠেলে সরিয়ে দিইনি কারণ সে'টার প্রচ্ছদ উল্টেই দেখেছিলাম বাঁটুলকে৷ বাঁটুলের গল্পে হোঁচট খাওয়ার প্রশ্নই নেই৷ প্রাঞ্জল ভাষা৷ একটা শব্দও কঠিন নয়। যেন পাড়াতুতো কোনও পিসেমশাই পাশে বসিয়ে মুড়িচানাচুর চিবুতে চিবুতে, চোখ গোলগোল করে গল্প শোনাচ্ছেন৷ আর গল্পের রসিকতাগুলো এতই সোজাসাপটা যে পড়তে পড়তে দিব্যি হেসে গড়িয়ে পড়া যায়৷ সে'গল্পের চরিত্রগুলো যেমনি সাদাসিধে, তাদের মুখের ভাষাও তেমনি৷ আর থপাস, গ্লাব গ্লাব, ইয়াইকস, গেলুম, সাঁইইই-হুইইইই, দমাস, গালগ, গদাম-ঘ্যাঁক, গেছি রে, দমাস-দমাক; এমন হাজারো শব্দ মিলে কানের মধ্যে চমৎকার সব সিনেম্যাটিক এফেক্ট তৈরি হচ্ছে৷ তারপর খুঁজে পেলাম বাহাদুর বেড়াল আর হাঁদাভোঁদা। সেই একই ধরণের সব আলাভোলা চরিত্র, আর তাদের নিয়ে জমজমাট কয়েকটা পাতা৷ ব্যাস, নারায়ণ দেবনাথই একা হাতে আমায় প্রথম কোনও পত্রিকার দিকে টেনে নিয়ে গেছিলেন। সেই মামার পুরনো বইয়ের আলমারি ঘেঁটে সমস্ত পুরনো শুকতারা বের করে চড়াও হয়েছিলাম। শেষে আমাদের বাড়ির কাগজকাকুকে বলে দেওয়া হল শুকতারা দেওয়ার কথা৷ 

শুকতারা আসলেই আমি চটাপট বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা আর বাহাদুর বেড়াল পড়ে ফেলতাম৷ এবং বারবার পড়তাম একই স্ট্রিপগুলো৷ নারায়ণ দেবনাথের ভাষার মাটিতে এলোপাথাড়ি গড়াগড়ি খেয়েই আমার ভালোবেসে বাংলা পড়া শুরু৷ এই প্রথম ছবির পাশাপাশি লেখার মায়া আমায় টেনে ধরল। পড়ার সাহস বাড়ল৷ কিছুদিনের স্রেফ নারায়ণ বাবুর কমিক্সে আটকে থাকার পর হুট করে এগিয়ে গেছিলাম অন্য কমিক্সে; 'বিলির বুট'। তদ্দিনে নারায়ণবাবু বাংলা পড়ার কনফিডেন্স সামান্য বাড়িয়ে দিয়েছেন, চিনিয়েছেন কমিক্সের অলিখিত সব নিয়মকানুন৷ এ'বার আর বিলির বুটের অসুবিধে হল না।

মজার ব্যাপার হল, বাঁটুল পড়তে পড়তে একদিন দুম করে 'দাদুমণির চিঠি' (শুকতারার সম্পাদকীয়) পড়তে শুরু করলাম৷ যদিও সে চিঠিতে ছবি নেই। কিন্তু বাঁটুল হাঁদাভোঁদা তদ্দিনে এন্তার পড়ে ফেলেছি৷ নারায়ণবাবুর গোয়েন্দা কৌশিক আবার একটু সিরিয়াস, বাঙালি বন্ড যে সে৷ সে'কমিক্সও দিব্যি পড়ে চলেছি৷ এরপর দেখলাম দাদুমণির চিঠিও তেমন জটিল নয়৷ আমি নিশ্চিত, নারায়ণবাবু সাহস দিয়েছিলেন বলেই সে চিঠি পড়ার চেষ্টা করেছিলাম৷ এরপর ধীরে ধীরে শুকতারার অন্যান্য গল্পে গিয়ে পড়লাম৷ ধারাবাহিক উপন্যাসের প্রতি আগ্রহ তৈরি হল৷ এলো শারদীয় শুকতারার চমক, দুয়ের বদলে চার পাতার বাঁটুল ও হাঁদাভোঁদা, একের বদলে দু'পাতার বাহাদুর বেড়াল৷ সে যেন এক কার্নিভাল৷ প্রথম শারদীয়া শুকতারা হাতে পেয়ে  সে'সব কমিক্স বোধ হয় শ'খানেকবার পড়ে ফেলেছিলাম৷ নারায়ণবাবু আমায় পড়িয়ে ছেড়েছেন৷ পড়ার নেশা ধরিয়ে ছেড়েছেন তদ্দিনে৷ তারপর যা হওয়ার তাই হল৷ সাহস করে পড়ে ফেলেছিলাম ফ্রান্সিসের অ্যাডভেঞ্চার। অন্যান্য গল্প উপন্যাস৷ খুঁজতে শুরু করেছিলাম অন্যান্য গল্পের বই৷ ধীরে ধীরে এলো শঙ্কর-আলভারেজ, ফেলুদা-তোপসে, কাকাবাবু, টেনিদা এবং আরও কত ভালোবাসার মানুষজন৷  

কাজেই নারায়ণ দেবনাথকে ছুঁয়েই আমার গল্পের বই পড়া শুরু,  বাংলা ভাষা তরতরিয়ে পড়তে পারার অনাবিল আনন্দটুকু চিনতে শেখা৷ আর আমি নিশ্চিত যে এ ব্যাপারে আমি একা নই৷

লিঙ্কডনইন মেড-ইজি সিরিজ - প্রথম পর্ব


।। শব্দঃ DISRUPTOR।। 

ডিসরাপ্টর কে?

মিটিং চলাকালীন যে দুম করে 'ইয়ে, আজ লাঞ্চে মটন আছে শুনেছি' বলে জরুরী আলোচনার সুরতাল ঘেঁটে দেয়।

জরুরী ইমেলে সঠিক রিপোর্ট অ্যাটাচ না করে যে প্রাইভেট স্প্রেডশিটে বানানো মুদীখানার ফর্দ পাঠিয়ে ফেলে৷

অন্যমনস্ক হয়ে 'ইয়েস স্যারে'র বদলে যে ধের্বাল বলে ফেলে জিভ কাটে। 

পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের থ্যাঙ্কিউ স্লাইডের পর যে একখানা চোরাগোপ্তা ক্যালভিন-হবস বা হাঁদা-ভোঁদার ছবি সাঁটা স্লাইড জুড়ে দেয়, তুকতাক হিসেবে।

বাঁধা প্রমোশন হাতছাড়া হওয়ার পর যে পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড ওয়ার্ড ডকুমেন্টে সিস্টেম বিরোধী বিরাশিখানা স্লোগান লিখে মন শান্ত করে এবং তারপর আড়াই মিনিট বাউল শুনে,প্রমোশনের চিন্তা হাওয়ায় ভাসিয়ে; হাইক্লাস শিঙাড়া খুঁজতে বের হয়।

যে অমুক ডিডাকশন তমুক ডিডাকশনে ফালাফালা স্যালারি স্লিপের প্রিন্ট নিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে; সে কাগজের পিছনে চন্দ্রবিন্দুর বুক-কাঁপানো সমস্ত গান থেকে ধার করা মনগলানো বিভিন্ন লাইন টুকে রাখে৷  

যে রিভিউতে ছিন্নভিন্ন  হওয়ার পর হাফ-ডে ক্যাসুয়াল লীভ নিয়ে অফিসের ছাতে বসে শিব্রাম পড়তে পড়তে ভেজিটেবল চপ খায়৷

Monday, January 17, 2022

স্পষ্টবাদ

স্পষ্টভাষী হয়ে উঠতে পারায় যে কী পরম তৃপ্তি। সত্যিই, কাঠখোট্টা কথাগুলো সপাটে অন্যদের দিকে ছুঁড়ে মারার মধ্যে যেন দু'চামচ পাটালির পায়েস মুখে পোরার তৃপ্তি রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা; ধারালো স্পষ্টভাষী হয়ে ওঠার মধ্যে একটা মায়াবী উত্তরণ রয়েছে৷ তবে ভেবে খারাপ লাগে যে সকলে এখনও হাইক্লাস স্পষ্টবাদিতার দিকে এগিয়ে যেতে পারেননি৷ কাজেই সে বিষয়ে কিছু টিপস শেয়ার না করলেই নয়।

প্রথম।
আপনার পছন্দ, ভালোবাসা এবং ভালোলাগাগুলো; সে'সব সস্তাসরল ব্যাপার নিয়ে পড়ে থাকলে কিছুতেই কপিবুক স্পষ্টবাদি হয়ে ওঠা সম্ভব নয়৷ 'ভালো ভালো' জপ করে চলা মানুষদের দিয়ে আর যাই হোক রক্তগরম করা সেন্টিমেন্ট ছড়ানো সম্ভব নয়। নিজের খারাপলাগাগুলোকে আঁকড়ে ধরুন, দিনরাত সে'গুলোকেই বারবার কপচে নিজের মেজাজকে তিরিক্ষি করে তুলতে হবে৷ সে'টাই প্রথম ধাপ। মেজাজ খিটখিটে না হলে স্পষ্টবাদি ব্যাক্তিত্ব খোলতাই হয় না৷ 

দ্বিতীয়।
সবার কলার ধরে নিন্দে করাটা আপনার দায়িত্ব৷ কিন্তু সাবধান, ন্যাকাপনা করে গঠনমূলক আলোচনার দিকে ঝুঁকলে কিন্তু সমস্তটা মাটি৷ মনে রাখবেন, আপনি অভিনয় করছেন ছবি বিশ্বাস-প্যারোডি ফ্লেভারের ভূমিকায়। আন্তরিক পাহাড়ি সান্যাল হয়ে কারুর পিঠ চাপড়ে তার মঙ্গলসাধন করতে চেয়ে গল্প জুড়বেন না যেন। আপনার কাজ ক্যাঁক করে ভাষার লাথি কষিয়ে সরে পড়া৷ সেই ধরণের স্পষ্টবাদই পাবলিক খাবে, থুড়ি, উপভোগ করবে৷ 

তৃতীয়৷
সারকাজম মসলিনের মত মিহি হতেই হবে, এমন ধারণা বঙ্কিমের যুগে চলত৷ এই পোস্ট-মডার্ন যুগে অন্যের গলায় গামছা পেঁচিয়ে টেনে ধরাটাই সারকাজম৷ যত খিস্তি, তত রোয়াব৷ আর স্পষ্টবাদীদের মূল অস্ত্রই হল রোয়াব।

চতুর্থ। 
স্পষ্ট কথা বলার আদত জায়গা হল ইন্টারনেট৷ খাটে শুয়ে যে সিনেমাকে বলবেন, 'তেমন পোষাল না', সে সিনেমা নিয়ে যদি ইন্টারনেটে আড়াই পাতার গাল নাই পাড়তে পারেন; তবে জানবেন আপনার কনফিডেন্সের দুধে বিস্তর জল মিশে গেছে৷ স্পষ্ট কথা আপনার দ্বারা ফায়্যার হবে না।

পঞ্চম। 
কেউ ফীডব্যাক চাইলে আপনার কর্তব্য কী? কথার মাধ্যমে তার তলপেটে লাথি মারা৷ এক্কেবারে এলোপাথাড়ি লাথি৷ তারপর তাকে বলা "কিছু মনে কোরো না, আমি ভাই স্পষ্ট কথার মানুষ৷ আই উইল কল আ স্পেড আ স্পেড"৷ সবচেয়ে বড় কথা, কোদালকে কোদাল বলার জন্য কোদাল চেনার কোনও দরকার নেই৷ ও যা কিছু একটা দুমফটাস জুতোজুতি মার্কা কিছু বলে দিলেই হল৷ 

কথাগুলো সোজাসুজিই বললাম, যেমনটা আমি বলে থাকি৷ আমি আবার সোজা কথার মানুষ কিনা, কোনও রাখঢাক আমার পোষায় না৷ পারলে সাজেশনগুলোর ওয়ার্ড ডকুমেন্টে ফেলে, একটা প্রিন্ট নিয়ে মানিব্যাগে রাখুন। তা'তে আপনাদেরই আখেরে মঙ্গল৷ 

পুনশ্চঃ

রবীন্দ্রনাথের একটা খেজুরে ছড়া খানিকক্ষণ আগে পড়ছিলাম৷ সোজাসুজি স্পষ্টভাবে টুকে দিলামঃ

"বসন্ত এসেছে বনে, ফুল ওঠে ফুটি,
দিনরাত্রি গাহে পিক, নাহি তার ছুটি।
কাক বলে, অন্য কাজ নাহি পেলে খুঁজি,
বসন্তের চাটুগান শুরু হল বুঝি!
গান বন্ধ করি পিক উঁকি মারি কয়,
তুমি কোথা হতে এলে কে গো মহাশয়?
আমি কাক স্পষ্টভাষী, কাক ডাকি বলে।
পিক কয়, তুমি ধন্য, নমি পদতলে;
স্পষ্টভাষা তব কণ্ঠে থাক বারো মাস,
মোর থাক্‌ মিষ্টভাষা আর সত্যভাষ"।

Saturday, January 15, 2022

মনুবাবু ও বনমালী



চৌরাস্তার মোড়ের এককোণে বঙ্কুর পানের দোকান। বঙ্কুর সেই পানের দোকান থেকে খান দশ পা এগোলেই একটা ইলেক্ট্রিক পোল। অবশ্য মনুবাবু গোপনে সে পোলটার একটা নাম দিয়ে ফেলেছেন; বনমালী। ব্যাপারটা মধ্যে একটু খ্যাপাটেপনার গন্ধ যে নেই তা নয়, কিন্তু তা সবিশেষ পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না মনুবাবু।

রোজ সন্ধ্যেয় অফিস থেকে ফিরে, বঙ্কুর দোকান থেকে একটা খয়ের ছাড়া সাদা পান মুখে পুরে; সোজা বনমালীর পাশে এসে দাঁড়ান মনুবাবু। আর তারপর প্রাণ খুলে যত অভাব-অভিযোগ-মনখারাপ, সমস্ত উজাড় করে দেন বনমালীর কাছে। 

"বুঝলে ভায়া বনমালী, এই চ্যাটার্জিটা নির্ঘাৎ ব্যাকস্ট্যাব করেছে৷ আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর। আমি নিশ্চিত ও বড়সাহেবের কান ভাঙিয়েছে৷ নয়ত এ'বারের প্রমোশনটা আটকায় কী করে বলো"!

"বনমালী! শুনেছ? রাণুর বাবা বলেছে আমি নাকি রাণুর যোগ্য পাত্র নই! আরে রাণুর সিটিসি আমার চেয়ে বেশি বলে আমি ওর যোগ্য নই? এরা কোন সেঞ্চুরিতে বাস করে বলো দেখি"!

"ভায়া বনমালী, গোটা দুনিয়াটাই উচ্ছন্নে গেছে। আরে বাসভাড়া দেওয়ার পর ছাই টিকিটটা হারিয়ে ফেলেছি।  তবু কন্ডাক্টর ব্যাটা বিশ্বাস করলে না? চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে সে কী ইনসাল্টটাই না করলে।  বাধ্য হয়ে ফের টিকিট কাটতে হল। এ যে দিনেদুপুরে ডাকাতি"!

"বনমালী, শুনেছ তো খবরটা? গুপ্তিপাড়ার পিসিমা আজ দুপুরে চলে গেলেন। গার্জেন বলতে আর কেউই রইল না। এ'বারেই বোধ হয় ভেসে যাওয়া, তাই না ভাই"?

এমন হাজার রকমের বুকের চিনচিন, হাড়ের জ্বালা, বা মনের হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় নিশ্চিন্তে বনমালীর কাছে সঁপে দেন মনুবাবু। তিনি জানেন, বঙ্কু আর তার দোকানের ফিচেল খদ্দেররা তাকে নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি করে। মাঝেমধ্যে বিশ্রী সব আওয়াজও ভেসে আসে। কিন্তু সে'সব গা করেন না মনুবাবু৷ কেন জানি তার মনে হয় বনমালীকে বলা কথাগুলো সমস্তই জলে যায় না৷ কেন জানি তার মনে হয় যে বনমালীকে সব বলতে পারলেই প্রাণ জুড়িয়ে আসে, বুকের মধ্যে আরামদায়ক হাওয়া বয়, মনের তিতিবিরক্ত ভাব কেটে গিয়ে শান্তি আসে, মুখের তিতকুটে ভাব কেটে গিয়ে ফার্স্টক্লাস খিদে পায়৷  বনমালীকে ছাড়ার কথা ভাবতেই পারেন না মনুবাবু।

**

- কী রোজ ওই ওয়্যারলেস রিসিভার কানে চাপিয়ে বসে থাকিস বল দেখি৷

- দিনের ঠিক এই সময়টা, দূরের কোনও গ্যালাক্সির কোনও গ্রহ থেকে একজন প্রাণীর শব্দ ভেসে আসে। সে গ্রহের এগজ্যাক্ট পোজিশন যদিও এখনও ট্র‍্যাক করতে পারিনি৷ 

- শব্দ? এলিয়েনের?

- নির্ঘাৎ। 

- ডিকোড করতে পেরেছিস?

- না৷ কী সব হিজিবিজি শব্দ৷ ও আমাদের বুঝে উঠতে মেলা সময় লাগবে৷ 

- কী'রকম সব শব্দ?

- গুপ্তিপাড়া পিসি গার্জেন..কী'সব হিজবিজবিজ। কিন্তু আমাদের ফিলিং ইন্টারপ্রেটেনশন ডিভাইস একটা জিনিস ক্র‍্যাক করতে পেরেছে৷ সে এলিয়েনের সবকথাই মনখারাপের।

- বলিস কী! এলিয়েনরা তোর কাছে মনখারাপের মেসেজ ট্রান্সমিট করছে?

- অদ্ভুতুড়েই বটে৷ আমি অবশ্য পালটা মেসেজ না পাঠালেও, আমাদের এই ইন্টার গ্যালাক্টিক ভাইব ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে 'ঘাবড়ে-যেওনা-হে-আমি-আছি-তো' ভাইব একটানা ট্রান্সমিট করে যাই৷ সে ভাইব যে ওই এলিয়েনবাবাজীর কাছে পৌঁছচ্ছে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত৷