- বিধু৷ মন দিয়ে শোনো৷ আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি৷
- হুঁ।
- ওই যে সতেরো তলা..।
- সতেরো৷
- এ'বার ডান দিক থেকে সাত নম্বর জানালায় এসো৷ সাত নম্বর।
- এক..তিন..পাঁচ..সাত।
- কী দেখছ?
- বসবার ঘর৷
- ঠিক৷ আর?
- ইজিচেয়ার। লাল চামড়ায় মোড়া।
- গুড। ফোকাস ও'খানেই রাখো৷ আশা করি তোমার স্নাইপিং রেঞ্জের মধ্যেই আছে৷
- নিশ্চিন্তে৷
- এ'বার অপেক্ষা৷ অমিয় দত্ত যে'কোনও মুহূর্তে এসে বসবে৷
- পর্দা টেনে নিলে? জানালা বন্ধ করলে?
- ভদ্রলোক ক্লস্ট্রোফোবিক। জানালার পাল্লা বা পর্দা তার পরম শত্রু। তাছাড়া, এদ্দিন ধরে ফলো করছি৷ এ তো মাপা হিসেব।
- একটা কথা জিজ্ঞেস করব কালীদা?
- তুমি কাজের মানুষ বিধু৷ প্রশ্নে তোমার কাজ কী৷ তবু, ইচ্ছে যখন হয়েছে, করো৷
-আমরা গুণ্ডাবদমাস৷ ডনমাস্তানদের সরিয়ে নেওয়ার কন্ট্র্যাক্ট নিয়ে থাকি৷ অন্তত বড় স্মাগ্লার বা তেমন কেউকেটা কেউ৷ কিন্তু হঠাৎ এই সাদামাটা ব্যাঙ্কম্যানেজারকে সরাতে এলাম কেন?
- স্নাইপার। স্নাইপ করবে৷ কুটকুট প্রশ্ন বেশি করলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না৷
**
খানিকট দূরে দাঁড়িয়ে লাল চেয়ারটার দিকে বড় মায়া নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন অমিয় দত্ত। কালী নিশ্চয়ই কথা মত উল্টোদিকের পেল্লায় অফিসবাড়িটার ছাতে নিজের স্যাঙাৎসহ দাঁড়িয়ে৷ নিশানা বাগিয়েই নিশ্চয়ই বসে আছে তারা৷ চেয়ারে গা এলিয়ে বসলেই টুক করে একগুলিতে হাওয়া।
সব ঠিকঠাক ছকেই রাখা আছে৷ গলায় দড়ি দেওয়া বা সত্তরখানা ঘুমের বড়ি খাওয়ার থেকে এই পদ্ধতি অনেক বেশি গ্ল্যামারাস। এক্কেবারে হলিউড মার্কা৷ শুধু চেয়ারে গিয়ে বসার আগে নিজের বসার ঘরটা আরও একটু দেখে নিতে ইচ্ছে করছিল৷ তাকে নিজের প্রিয় বইগুলো, দেওয়ালে মিনুর ছবি৷ কী অপূর্ব মায়াজড়ানো হাসি মিনুর৷ ও যাওয়ার পর থেকেই ছটফটানিটা বড্ড বেড়ে গেল।
**
- রুমের মধ্যে নড়াচড়া হচ্ছে৷ ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ঘরের মধ্যে ঢুকেছে৷ বুঝলি বিধু..।
- বলো কালীদা।
- বসা মাত্রই চালিয়ে দিসনি৷
- কেন?
- দু'মিনিট জিরিয়ে নিতে দে৷ অমন হুড়মুড়িয়ে মরতে নেই৷ বাইনোকুলার দিয়ে দেখে যা বুঝলাম, লাল চামড়ার ইজিচেয়ারটা বড্ড আরামের৷
- কালীদা, ভদ্দরলোক বসেছেন৷ এ'বারে?
- আমি গুনছি৷ একশো কুড়িতে পৌঁছলেই ট্রিগার টেনে দিবি।
- বেশ।
- এক, দুই, তিন..।
**
বাহাত্তর পর্যন্ত গুণে থামতে হলো কালীদাকে। কেউ ঘাড়ে ফু দিয়েছে৷ পিছন ঘুরেই মৃদু একটা বিষম খেল কালী৷ সেই শব্দে বিধু ঘুরে তাকালে, তার হাত থেকে বন্দুক ধুপ করে খসে পড়ল।
মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে অমিয় দত্ত দাঁড়িয়ে।
- তুমি শালা একটা ইউজলেস মাইরি কালী। এই সিম্পল কাজটাও ঝুলিয়ে দিলে!
- আ..আ..।
- আরে চেয়ারে বসা মাত্রই ছাই হার্টটা বিট্রে করল।
- অ্যাটাক?
- মারাত্মক৷ কয়েক সেকেন্ডেই হুশ।
- যাচ্চলে৷ কিন্তু তাই বলে আপনি ভূ..ভূত হয়ে..।
- স্নাইপিংয়ে অক্কা পাওয়ার কথা আমার। অথচ ভেতো হার্ট অ্যাটাকে উঠে গেলাম৷
- এহ হে।
- এ'বার আমার টাকা ফেরত দে।
- ফেরত দেব?
- বাহ্৷ স্নাইপি করে সাফ করার জন্য মোটা টাকা নিলি৷ এ'দিকে আমি হার্ট অ্যাটাকে হাপিশ৷ টাকা কি গাছে ফলে নাকি রে?
- তা বলে..আপনিই বা ও'টাকা নিয়ে করবেনটা কী?
- গঙ্গায় ভাসিয়ে আসব৷ তা'তে তোর কী রে। ফেরত দে।
- একটা আইডিয়া ছিল অমিয়বাবু।
- পাতি বুলেট চালাতে প্যান্ট হলুদ তার আবার আইডিয়া৷ থাম থাম।
- শুনুন না৷ মাইরি। স্নাইপারের গুলিতে মরা হল না৷ কিন্তু আপনাকে যদি আমি অন্য একট দারুণ অফার দিই? ইকুয়ালি গ্ল্যামারাস?
- স্নাইপে মরার লেভেলে গ্ল্যামারাস? ধুস।
- মাইরি৷ আসলে আপনার টাকাটা দিয়ে একটা ট্যাক্সি কিনে ফেলেছি৷ সৎমানুষের টাকা দিয়ে সৎপথে আয়ের যদি একটা সোর্স দাঁড় করানো যায় তা ভেবে৷ কাজেই..।
- মহা নেকুচন্দর তো হে তুমি কালী৷ যাক গে৷ দারুণ অফারটা কী বলছিলে?
- আপনি স্নাইপিং করবেন?
- জ্যান্ত অবস্থায় কলম ছাড়া অন্য কিছু তোলার ধক ছিল না৷ শেষে ভূত হয়ে স্নাইপার ধরব?
- ও মা! না পারার কী আছে! আমি শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেই পারবেন।
- তুমি পারবে শেখাতে? আবার গুল দিচ্ছ?
- গোস্তাখি মাফ অমিয়বাবু৷ খুনোখুনির কাজটাই বুঝি আমার শেষ পরিচয়? হ্যাঁ? রীতিমত ভূত চড়িয়েই প্রাইমারি ইনকাম।
- ভূত হয়ে বন্দুক ধরতে পারব?
- বিধু পারলে আপনি পারবেন না কেন? তাছাড়া একা বিধুকে দিয়ে হচ্ছিল না৷ এত অর্ডার যে আরও ভূত দলে না টানলে বিজনেস গ্রো করবে না৷ আজ দিনক্ষণ লগ্ন ভালো ছিল৷ আমার কাছে খবরও ছিল আপনার হার্ট উইক৷ তাই বিধুকে বললাম গুলি করার আগে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে৷ ব্যাস, খাপেখাপ মিলে গেল।
- আমি ভূত-স্নাইপার হয়ে মার্ডার করে বেড়াব রে কালী? মাইরি?
অমিয়বাবু বিহ্বলতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ও'দিকে বিধু ততক্ষণে মহানন্দে কলকাতার ধোঁয়া-ময়লা মাখানো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সে'দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে কালী। মনে পড়ে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার অমিয়বাবুর মতই একদিন স্কুলমাস্টার বিধুশেখরের আত্মাকে হাতিয়ে এ ব্যবসায় নেমেছিল সে৷
কতশত ছাপোষা মধ্যবিত্ত মানুষ যে কী বিশ্রী রাগ চেপে রেখে 'মিউমিউ' সুরে অফিস-সংসার সামাল দিয়ে ফতুর হয়ে যায়৷ রাগ জমে জমে তাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা খুনে দিক তৈরি হয়। মরার পরও সে মধ্যবিত্ত আত্মারা গোটা জীবনের সে'সব জমানো রাগ ত্যাগ করতে পারে না৷ আর সেই মধ্যবিত্ত ভূতের পড়ে পাওয়া খুনে মেজাজ কালটিভেট করতে পারাটা যে একটা বড় ব্যবসা, সে'টা আর পাঁচটা বাঙালি তান্ত্রিক যে কেন বুঝতে চায়না তা কালী তান্ত্রিক অন্তত জানে না৷
No comments:
Post a Comment